<p>আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (সংক্ষেপে এ আই) বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা একবিংশ শতাব্দীর বহুল আলোচিত ও অন্যতম চর্চিত বিষয়। ১৯৫৬ সালে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স শব্দটি প্রথমবারের মতো উচ্চারিত হলেও গত শতাব্দীর শেষ দিকের আগ পর্যন্ত তা খুব একটা পরিচিতি পায়নি। কিন্তু ২০১০ পরবর্তী সময়ে এই প্রযুক্তি শুধু জনপ্রিয়তাই নয়; বরং নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে দারুণ উৎকর্ষতা লাভ করেছে। এক কথায় বলা যায়, বর্তমান যুগটি হচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যুগ যা প্রতিনিয়তই নিত্য নতুন আবিষ্কারের মাধ্যমে চমক উপহার দিয়ে চলেছে। সকালে ঘুম ভাঙা থেকে শুরু করে রাতে ঘুমিয়ে যাওয়া পর্যন্ত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মানুষের নিত্য সঙ্গী। আলোচিত এই প্রযুক্তির এই অবিস্মরণীয় সাফল্যের পেছনে রয়েছে নানা কারণ।</p> <p>কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে মানুষের ওপর কাজের যে চাপ রয়েছে তা অনেকাংশে কমানো সম্ভব। ফলে, আগে যেখানে অনেক বেশি শ্রম ঘণ্টার প্রয়োজন হতো সেখানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে তৈরি মেশিন বেশিরভাগ কাজটুকু করে মানুষকে সৃজনশীল ও সিদ্ধান্ত নির্ধারণী কাজে মনোনিবেশ করার সুযোগ করে দিচ্ছে। ফলে পূর্বের তুলনায় উৎপাদনশীলতা ও কর্মদক্ষতা বাড়ছে। আগে বিপুল পরিমান ডেটা বা তথ্য বিশ্লেষন এর কাজে মানুষকে জড়িত থাকতে হতো। ‘মানুষের ভুল’ বা হিউমান এরর এর কারণে এই ডেটা বিশ্লেষন ক্ষেত্র বিশেষে শতভাগ ত্রুটিমুক্ত হতোনা। কিন্তু কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার নির্ভুল ভাবে ডেটা বিশ্লেষন করার সক্ষমতার কারণে আগের চাইতে কাজ অনেক সহজ ও ত্রুটি বিহীন হয়েছে। এছাড়া এই প্রযুক্তি (কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা) দিন রাত ২৪ ঘন্টাই ব্যবহার করা যায়। মানুষের মতো এর কোনো ক্লান্তি বা বিরতি নেয়ার প্রয়োজন পড়ছেনা।     </p> <p>কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার রয়েছে মানুষের তুলনায় অনেক দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা। এই সক্ষমতাটি 'জরুরি সেবা' প্রদানের ক্ষেত্রে বিশেষ ভাবে গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে সময় একটি বড় বিষয়। এছাড়াও গবেষকদের ক্ষেত্রে গবেষণালব্ধ ডেটাকে দ্রুত প্রয়োজনীয় তথ্যে রূপান্তরিত করতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে। এর পাশাপাশি চিকিৎসা ক্ষেত্রে এই প্রযুক্তি দারুণ ভূমিকা রেখে চলেছে। শুধু রোগ নির্ণয়ই নয়, শল্য চিকিৎসা বা সার্জারির মতো জটিল কাজে এই প্রযুক্তি আজ অসাধারণ ভূমিকা পালন করে আসছে। সর্বোপরি বলা যায় যে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মানুষের জীবন ধারার অনেক কিছুই পাল্টে দিয়েছে।  জীবনকে করে তুলেছে সহজ ও উপভোগ্য। উড়ন্ত বা মনুষ্য বিহীন ট্যাক্সি যা এই শতাব্দীর গোড়ার দিকেও মানুষের জন্য ছিল স্রেফ কল্পনা, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা তাকে আজ বাস্তবে রূপ দিয়েছে। কিন্তু এই প্রযুক্তি কি শুধুই কল্যাণকর? </p> <p>চমকপ্রদ আবিষ্কারের মাধ্যমে দৈনন্দিন জীবনকে সহজ করার পাশাপাশি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এমন কিছু জটিলতা তৈরী করছে যা অনেকটাই অনাকাঙ্খিত। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মূলতঃ ডেটা ইনপুট এর উপর নির্ভরশীল। কিন্তু এই ডেটা বা তথ্য অনেক ক্ষেত্রেই পক্ষপাতদুষ্ট হতে পারে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় কিছু সাবান বা সোপ ডিস্পেন্সার রয়েছে যা গায়ের রং দেখে সাবান বিতরণ বা ডিস্পেন্স করে। আধুনিক সমাজে গায়ের রং বা বর্ণের উপর নির্ভর করে এধরনের কাজ একেবারেই অগ্রহণযোগ্য। একইভাবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় তৈরী মেশিন কি ভাবে কাজ করে বা মেশিনটির অভ্যন্তরীণ গঠনই বা কেমন তা সম্পর্কে অনেকেরই সুস্পষ্ট ধারণা নেই। ফলে যন্ত্রের কার্যপ্রক্রিয়া সম্পর্কে না জেনেই মেশিনটি ব্যবহার করা হচ্ছে। এর পাশাপাশি এ প্রযুক্তি এমন কিছু ফলাফল দিতে পারে যা অনেকটাই অনভিপ্রেত বা অপ্রত্যাশিত। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, একবার খোদ যুক্তরাষ্ট্রে উবার এর একটি মনুষ্য বিহীন পরীক্ষামূলক গাড়ি একজন পথচারীকে চাপা দিয়েছিলো, কারণ সাধারণ মানুষ যে জেব্রা ক্রসিং ছাড়াও রাস্তা অতিক্রম করতে পারে এরকম তথ্য ঐ গাড়ির সিস্টেমে সংরক্ষিত ছিলনা। সবচাইতে বড় উদ্বেগের বিষয় হলো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কারণে যদি কোনো দুর্ঘটনা ঘটে তাহলে কে দায়ী হবে এসম্পর্কে কোনো সুস্পষ্ট ধারণায় এখনও বিশ্ববাসী একমত হতে পারেনি। এছাড়াও রযেছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় তৈরী রোবটের কারণে কর্মক্ষেত্রে মানুষের চাহিদা কমে যাওয়ার বিষয়টি। ফলে বেকারত্ব বাড়ার আশংকা দেখা দিয়েছে।</p> <p>এতো কিছুর পরেও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বিষয়ে মানুষের আগ্রহের শেষ নেই।  বিশেষ করে, সামরিক সরঞ্জমাদি তৈরিতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সংযোজনে সামরিকভাবে শক্তিশালী দেশগুলা যেন পরস্পর প্রতিযোগিতায় নেমেছে। এর পিছনে অবশ্য কিছু সুনির্দিষ্ট কারণ রয়েছে।</p> <p>প্রথমত : গতি। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যুদ্ধক্ষেত্রে লক্ষ্যবস্তু নির্ধারণ ও তাতে আঘাত হানার সময়কে উল্লেখযোগ্যহারে কমিয়ে নিয়ে এসেছে। ফলে যুদ্ধক্ষেত্রে আগে যে কাজটি করতে ২০ মিনিট সময় প্রয়োজন হতো এখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে সেই কাজ অনেক ক্ষেত্রে ২০ সেকেন্ডেই সম্পন্ন করা যাচ্ছে।</p> <p>দ্বিতীয়ত : কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে অনেক সামরিক কাজই স্বয়ংক্রিয় ভাবে যেমন বিমান বা ড্রোন উড্ডয়ন- অবতরণ করানো কিংবা যুদ্ধক্ষেত্রে রসদ ও গোলাবারুদ স্থানান্তরে নিজস্ব সৈন্য দলকে কোন ঝুঁকির মুখে না ফেলে যথাস্থানে সরবরাহ করা সম্ভব হচ্ছে।</p> <p>তৃতীয়ত : যুদ্ধক্ষেত্রে বিভিন্ন মাধ্যমে যে প্রচুর তথ্য আসে তা যথাযথভাবে নিরীক্ষার ক্ষেত্রে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দারুণ কার্যকর। ফলে দ্রুততম সময়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ সম্ভবপর হয়।</p> <p>চতুর্থত : যুদ্ধরত বা প্রতিযোগিতাপূর্ণ এলাকাতেও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে শত্রুকে ঘায়েল করা সম্ভব হচ্ছে। তাইতো শিল্ড এ আই এর সহ প্রতিষ্ঠাতা ব্রেন্ডন সেং বলেছিলেন, যদি একটি মানবহীন বিমান জিপিএস এবং যোগাযোগ ছাড়া কাজ করতে না পারে, তাহলে ভবিষ্যতের সংঘাতে এটি প্রায় অকার্যকর হয়ে যাবে। এছাড়াও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে সামরিক প্রশিক্ষণ, সিমুলেশন, ও যুদ্ধক্ষেত্রে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি সাধিত হয়েছে। ফলে, বিশ্ব ব্যাপী কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সামরিকায়নের ক্ষেত্রে এক ধরনের উন্মাদনার সৃষ্টি হয়েছে।</p> <p>সামরিক সরঞ্জামাদিতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রয়োগের সর্ব প্রথম নজির পাওয়া যায় ২০২০ সালের আর্মেনিয়া ও আজারবাইজান এর মধ্যে সংঘটিত নাগারনো- কারাবাখ যুদ্ধের সময়। সারাবিশ্ব বিস্ময়ের চোখে দেখেছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রয়োগে তৈরী ইসরায়েলের আত্মঘাতী হারোপ ও অরবিটার এবং তুরস্কের বাইরাকতার টিবি-২ ড্রোন কিভাবে আর্মেনিয়াকে বেসামাল করে দিয়েছিলো। ফলে, যুদ্ধে আজারবাইজান নিরংকুশ বিজয় লাভ করে। আর্মেনিয়া- আজারবাইজান যুদ্ধের মাধ্যমে যদি সামরিক সরঞ্জামাদিতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রয়োগের সূচনা মুহূর্ত হয় তাহলে চলমান রাশিয়া- ইউক্রেন্ সংঘাত হচ্ছে তার পরিপূর্ণ রূপ। আড়াই বছরের বেশি সময় ধরে চলতে থাকা এই যুদ্ধক্ষেত্রটি হচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন মারণাস্ত্রের সবচাইতে বড় পরীক্ষাগার।বর্তমানে স্বয়ংক্রিয় যান (অটোনোমাস ভেহিক্যাল), স্বয়ংক্রিয় ড্রোন  (অটোনোমাস ড্রোন), পর্যবেক্ষন (রেকোনাইসেন্স), সাইবার যুদ্ধ, পূর্ণ স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র (অটোনোমাস উইপন), রক্ষণাবেক্ষন ও রশদ ব্যবস্থাপনা, ঝাঁক প্রযুক্তি (স্বারমিং টেকনিক), সরবরাহ শৃঙ্খল ব্যবস্থাপনা (সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট) ইত্যাদি এর মতো জটিল ও সময়সাপেক্ষ কাজে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার লক্ষ্য করা যাচ্ছে।</p> <p>যুদ্ধের মাঠে ফলাফল নির্ধারণী ভূমিকা রাখলেও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সামরিকায়ন নানারকম বিতর্কের কারণ হয়ে দাড়িয়েছে।</p> <p>প্রথমত : নৈতিক দুর্বলতা। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের মানদণ্ড অনুযায়ী যেকোন আক্রমণ পরিকল্পনা, সিদ্ধান্ত ও পরিচালনাকারীগণকে কিছু সুনির্দিষ্ট আইনি বাধ্যবাধকতা মেনে চলতে হয়। কিন্তু কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে তৈরি পূর্ণ স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র ক্ষেত্র বিশেষে মানুষের সিদ্ধান্ত ছাড়াই আক্রমণ রচনা করতে পারে। তবে, এক্ষেত্রে যেহেতু কোন মানুষের সংশ্লিষ্টতা নেই তাই কোন মানবাধিকার লঙ্ঘিত হলে কে দায়ী হবে তা পরিষ্কার নয়।</p> <p>দ্বিতীয়ত : প্রত্যেক মানুষেরই তার ব্যক্তিগত জীবনের গোপনীয়তা রক্ষার অধিকার রয়েছে। কিন্তু কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে এমন ভাবে মানুষের পরিলেখ বা প্রোফাইলিং তৈরী করা হচ্ছে যা তার ব্যক্তিগত গোপনীয়তার সুস্পষ্ট লংঘন। শুধু তাই নয়, এরকম প্রোফাইলিং যান্ত্রিক ভাবে তৈরী হওয়ার কারণে তাতে অযাচিত ভুল হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। ফলে, যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে একজন মানুষের জায়গায় আরেকজন মানুষ আক্রান্ত হতে পারে।</p> <p>তৃতীয়ত : যুদ্ধ কারো কাম্য না হলেও এতে কিছু বীরত্বের বিষয়ও আছে। কিন্তু কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার যেন যুদ্ধক্ষেত্রকে বিবেক-বর্জিত এক বদ্ধভূমিতে পরিণত করেছে। ফলে, সাহসিকতা, বীরত্ব,  যোদ্ধার নৈতিকতা, চতুরতা, আকস্মিকতা ইত্যাদির মতো ঐতিহ্যবাহী সামরিক বৈশিষ্ট্য যেন আজ হারিয়ে যেতে বসেছে।  </p> <p>চতুর্থত : কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় তৈরী সমরাস্ত্র মূলতঃ তথ্য বা ডেটা ইনপুট এর উপর নির্ভরশীল।  কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্রে সঠিক ডেটা পাওয়া শুধু কঠিনই নয় বরং অনেক ক্ষেত্রেই দুরূহ। ফলে, অসম্পূর্ণ  বা ত্রুটিপূর্ণ ডেটার মাধ্যমে সমরাস্ত্র তৈরী হতে পারে। এখানে উল্লেখ্য যে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় তৈরী সমরাস্ত্র সমূহের্ কিছু সহজাত দুর্বলতা রয়েছে। যেমন, নিজস্ব সমরাস্ত্রে যে ডেটা প্রবেশ করানো হয় তা শত্রুর পক্ষে বিষাক্ত করে তোলা সম্ভব।</p> <p>উদাহরণস্বরূপ ধরা যাক, কোন একটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন সমরাস্ত্রের জন্য শত্রুর ট্যাংক সম্পর্কে ডেটা প্রবেশ করানো প্রয়োজন। শত্রু যদি এই ডেটা সংগ্রহের স্থান এবং সময় সম্পর্কে জানতে পারে তাহলে সে ডেটা সংগ্রহের স্থানের ট্যাংকের রং বা অবয়ব এমনভাবে পরিবর্তন করবে যাতে করে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন সমরাস্ত্র ভুল ডেটার উপরে প্রশিক্ষিত হয়। এটাকে বলা হয় ডেটা বিষাক্তকরণ বা ডেটা পয়জনিং। ফলে যুদ্ধক্ষেত্রে নিজস্ব সমরাস্ত্র সঠিকভাবে লক্ষ্যবস্তু চিহ্নিত বা  লক্ষ্যবস্তুর বিরুদ্ধে কার্যকরীভাবে মোতায়েন হতে পারবেনা। এছাড়াও নিজস্ব অস্ত্রে কি ডেটা প্রবেশ করানো হয়েছে শত্রু যদি তা জানতে পারে তাহলে শত্রুর পক্ষে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সমরাস্ত্রকে ফাঁকি দেয়া সম্ভব।</p> <p>উদাহরণস্বরূপ ধরা যাক কোনো একটি এধরনের সমরাস্ত্রকে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে যে শত্রুর ট্যাংকের রং হালকা সবুজাভ। এখন যদি শত্রু এই তথ্য জেনে যায় তাহলে শত্রু তার ট্যাংক এর রং এমন ভাবে পরিবর্তন করতে পারে যাতে ওই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সমরাস্ত্র তা চিহ্নিত করতে পারবেনা। এই পদ্ধতিকে বলা হয় ইভেশন বা পালিয়ে যাওয়া, যার মাধ্যমে এই সমরাস্ত্রের চোখ ফাঁকি দেয়া যায়। উল্টা প্রযুক্তি (রিভার্স ইঞ্জিনিয়ারিং) পদ্ধতিতেও শত্রু কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় তৈরী সমরাস্ত্রের অভ্যন্তরীণ গঠন জেনে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পারে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় তৈরী সমরাস্ত্রের এই দুর্বলতা পুরো ডেটা প্রশিক্ষণের বিষয়টিকেই ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে।</p> <p>পঞ্চমত : এই সমরাস্ত্র ব্যবহারের কারণে যুদ্ধের মাত্রা বহুগুন বেড়ে যেতে পারে, এমনকি তা  নিয়ন্ত্রণের বাইরেও চলে যেতে পারে। ফলে, যুদ্ধ মানুষ নিয়ন্ত্রিত না হয়ে মেশিন নিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়তে পারে। ষষ্ঠতঃ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে তৈরী সমরাস্ত্রের বহুমাত্রিক উন্নয়ন ও চাহিদার কারণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ এর উৎপাদন ও বিপণনের সাথে সংশ্লিষ্ট হয়ে পড়েছে। অস্ত্র ব্যবসার এই বিপদজনক মানসিকতার কারণে এই সমরাস্ত্রকে নিয়ন্ত্রণ করা ক্রমশঃ দুরূহ হয়ে পড়েছে। ফলে, রাষ্ট্রীয় বাহিনী ছাড়াও অরাষ্ট্রীয় প্রভাবশালী গোষ্ঠীর (নন স্টেট এক্টর) হাতে এই অস্ত্র পড়ার আশংকা আছে, যাদের বিরুদ্ধে (দায়িত্বহীন ব্যবহারের ক্ষেত্রে) আন্তর্জাতিক আইন বা নিয়ম অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা অনেকটাই কঠিন। যার দরুন রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা নষ্ট হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। </p> <p>সপ্তমত : কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে তৈরী সমরাস্ত্রের অভ্যন্তরীন গঠন অত্যন্ত জটিল। তাই অনেক ক্ষেত্রেই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে 'ব্ল্যাক বক্স' হিসেবে নামকরণ করা হয়।  কেননা, ব্যবহারকারি অনেক ক্ষেত্রে নিজেই জানেনা কখন মেশিনটি কার্যকর হয়ে উঠবে। ফলে, এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে যখন অপারেটরের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সমরাস্ত্র আক্রমণ পরিচালনা করছে।</p> <p>অষ্টমত : এই অস্ত্রের কারণে যুদ্ধের গতি অনেক বেড়ে গেছে। বিবাদমান পক্ষই এখন অতি দ্রুত আক্রমণ ও পাল্টা আক্রমণ রচনা করতে পারে যা আক্ষরিক অর্থে মানুষের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। মনে রাখতে হবে যে, বর্তমান যুগে বেশিরভাগ যুদ্ধই বসতি এলাকায় (শহর বা নগর) হয়ে থাকে। ফলে পূর্বে যেখানে খোলা ময়দানে যুদ্ধ হতো তার তুলনায় বর্তমান যুগের যুদ্ধে বেসামরিক লোকজনের হতাহতের সংখ্যা অনেক বেশী। </p> <p>উপরের আলোচনা থেকে এই বিষয়টি দিনের আলোর মতোই পরিষ্কার যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে তৈরী সমরাস্ত্র বিশ্ববাসীর জন্য একটি বড় মাথা ব্যাথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কোন কোন বিশেষজ্ঞগণ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার এই অনিয়ন্ত্রিত বেড়ে চলাকে "ওপেনহাইমার মুহূর্ত" এর সঙ্গে তুলনা করেছেন। "পারমাণবিক বোমার জনক" জে. রবার্ট ওপেনহাইমার, ম্যানহাটন প্রকল্পের সময় যেমন পারমাণবিক অস্ত্রের ধ্বংসাত্মক শক্তি সম্পর্কে গভীরভাবে সচেতন হয়েছিলেন, তেমনি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মতো শক্তিশালী প্রযুক্তির সম্ভাব্য বিপদ ও নৈতিক দ্বিধাগুলির বিষয়ে সারা বিশ্বই আজ গভীর ভাবে উদ্বিগ্ন। জাতিসংঘ সহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে এই উদ্বেগের বিষয়টি নানাভাবে ফুটে উঠেছে। কিন্তু কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার এই মানব সভ্যতা ধ্বংসকারী ভূমিকা থেকে পরিত্রানের কোনো উপায় কি আছে?</p> <p>আছে, তবে সেক্ষেত্রে এসব সমরাস্ত্রের দায়িত্বশীল ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। আরো কিছু পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন।</p> <p>প্রথমত : জবাবদিহিতা যেকোনো আইনি কাঠামোর মূল উপাদান এবং তা কোনো অবস্থাতেই মেশিনে স্থানান্তর করা যাবেনা। দ্বিতীয়তঃ যেকোন প্রকার বল প্রয়োগের ক্ষেত্রে মানুষের সংশ্লিষ্টতা থাকতে হবে।</p> <p>তৃতীয়ত : কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় পরিচালিত অস্ত্র ব্যবহারের ক্ষেত্রে ব্যবহারকারীকে নিশ্চিত হতে হবে যে, অস্ত্রটি কীভাবে কাজ করে এবং এটি যে পরিবেশে ব্যবহৃত হবে সেখানে এটি কীভাবে আচরণ করতে পারে?</p> <p>চতুর্থত : কোনো একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর বা গায়ের রঙের বা ধর্মের মানুষের বিরুদ্ধে কাজ করে এমন অস্ত্রের ব্যবহার নিষিদ্ধ করতে হবে। এছাড়াও ব্যক্তি মানুষকে লক্ষ্যবস্তু বানানো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা জরুরি নৈতিক উদ্বেগগুলির মধ্যে একটি।</p> <p>পঞ্চমত : পূর্ণাঙ্গ স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র, যা যুদ্ধ ক্ষেত্রে নিজে নিজেই আক্রমণ চালানোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে সক্ষম, তা নিষিদ্ধ করতে হবে।</p> <p>ষষ্ঠত : যে সকল অস্ত্র অপ্রত্যাশিত আচরণ করতে পারে, অর্থাৎ, যে অস্ত্রের সম্ভাব্য আচরণের বিষয়ে অস্ত্রের ব্যবহারকারী নিশ্চিত নন, তাও নিষিদ্ধ করতে হবে। অ্যান্টি-পার্সোনেল ল্যান্ড মাইন, লেজার অস্ত্র যা মানুষকে অন্ধ করে দিতো এবং ক্লাস্টার বোমার বিরুদ্ধে যেভাবে ইতিপূর্বে পদক্ষেপ নিয়ে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল তেমনি সাধারণ মানুষ ও এমনকি যোদ্ধাদের রক্ষা করতে এবং যুদ্ধে কিছুটা হলেও মানবতাবোধ বজায় রাখতে একটি নতুন আইনি কাঠামো প্রতিষ্ঠা একান্ত জরুরি হয়ে পড়েছে। মানব সভ্যতা রক্ষার্থে এখন তা সময়ের দাবি। </p>