এ জন্যই আমাদের সময়টাও বেশি লেগেছে। এ ছাড়া ৫০০ কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে ঢাকায় আসার পর বাকিপথে সঙ্গে তাঁবু ছিল। শেষটা ক্যাম্পিং করে কাটানোর ইচ্ছে থেকেই তাঁবু সঙ্গে রাখা। সেই সঙ্গে বিভিন্ন জায়গায় ক্যাম্পিংয়ের মাধ্যমেও রাত কাটিয়েছি।
সর্বমোট কত টাকা খরচ হয়েছে
এটার সঠিক কোনো হিসাবে নেই। রাজশাহী থেকে ২৫ ডিসেম্বর বের হওয়ার সময় বিকাশে ১৫০০ টাকার মতো ছিল। আর ক্যাশ সম্ভবত ৫০০-৬০০ টাকা। বাকিটা পথে বের হওয়ার পর ম্যানেজ হয়ে গেছে। বিশেষ করে আমার ভাই বন্ধুরা দূর থেকে হলেও বিকাশ, নগদ, ব্যাংকের মাধ্যমে গিফট পাঠিয়েছেন। বিশেষ করে আমার নিজ বিভাগের বড় ভাই, বন্ধু, ছোট ভাইয়েরা। আর গত ৫ বছর ধরে আমার ব্যক্তিগত একটা অনলাইন বিজনেস আছে। বাকিটা সেখান থেকে খরচ হয়েছে।
কোনো শারীরিক সমস্যা হয়েছিল কি না
আলহামদুলিল্লাহ, পুরো পথে আমাদের কোনো সমস্যা হয়নি। সুস্থ, সুন্দর, প্রাণবন্তভাবেই শেষ করি। হাঁটতে গিয়ে প্রথম প্রথম একটু পা ফুলে যায়, ব্যথা করে, তবে ৮-১০ দিন যাওয়ার পর সব ফ্রি হয়ে গেছে। যদিও আমার সঙ্গে ১০ কেজির ব্যাকপ্যাক ছিল। তবু কোনো অসুবিধা হয়নি।
সারা দিন হাঁটার পর পায়ের যত্ন কিভাবে নেওয়া হতো
প্রথম দিকে ব্যথা বেশি ছিল। তাই হাইকিং শেষ করে, ঠাণ্ডা পানিতে কিছুক্ষণ পা চুবিয়ে রেখে। তারপর মুভ স্প্রে করতাম, তারপর ১০-১২ দিন পর থেকে শুধু ট্রেক শেষ করে ঠাণ্ডা পানিতে কিছুক্ষণ পা চুবিয়ে রাখতাম। তবে কেউ চাইলে সরিষা তেল গরম করেও ব্যথা নিরাময়ের কাজ করতে পারেন।
ছোটবেলায় গ্রামে বেড়ে উঠা তো, মা নানা রকম ন্যাচারাল জিনিস খাওয়ায়ে বড় করছে। তাই মনে হয় এত বড় লং জার্নি তে প্রেশার বা ধকল যায়নি তেমন। মনের জোরটা ছিল একশ একশ। তাই কঠিন পথও সহজ হয়ে গেছে।
মেহেদীর ভাবনা
ক্রসকান্ট্রি হাইকিং শেষ করে বন্ধু শাহাদাত তার গন্তব্যে ফিরে গেছে। আমার গন্তব্য বাকি ৪৯ জেলা পায়ে হেঁটে শেষ করা এবং একটা মেসেজ পৌঁছে দেওয়া ‘Be the source of your own essentials!’
আমরা প্রতিটা পরিবার যদি যথাসাধ্য নিজেদের প্রয়োজনীয় সব কিছু নিজেরা উৎপাদন করি, যে যতটুকু পারি নিজেদের রিসোর্স অনুযায়ী, তাহলেই প্রিয় পরিবারকে ফ্রেশ ও অর্গানিক খাদ্য সরবরাহ করা সম্ভব অন্যথায় বাণিজ্যিক ভাবে ডিপেন্ডেবল হয়ে গেলে মুখ থুবড়ে পড়বে ভেজাল নামক মরীচিকা।
যদিও উচ্চ শিক্ষিত অনেকেই অনলাইন বিজনেসের মাধ্যমে নির্ভেজাল পণ্য সবার মাঝে পৌঁছে দিতে বদ্ধপরিকর হয়ে কাজ করে যাচ্ছে। গত ৪-৫ বছর ধরে এ সংখ্যাটা দৃশ্যমান, তাদের সাধুবাদ জানাই। সেটা অফলাইনেও ছড়িয়ে পড়ুক দৃশ্যমানভাবে। সেই সঙ্গে আমরা সবাই যদি খাদ্য গ্রহণের ক্ষেত্রে সতর্ক হয়ে যাই, তাহলেই পৃথিবীতে সদ্য ভূমিষ্ট হওয়া শিশুকে আপনি আমি তার মৌলিক ও প্রধান চাহিদা স্বাস্থ্যকর খাদ্য নিশ্চিত করতে পারি। অন্যথায় আমার মাঝেমধ্যে মনে হয় একটা নতুন প্রাণকে পৃথিবীতে আনার মানুষের কোনো অধিকার নেই।
আমরা বর্তমানে এমন একটা পৃথিবীতে বসবাস করছি যেখানে সব কিছুই বিষক্রিয়ায় ভরা। আমাদের মৌলিক চাহিদা অন্ন বলেন, শিক্ষা বলেন কিংবা চিকিৎসা—যেদিকেই তাকান, স্বস্তি পান? নিজেকে প্রশ্ন করলেই উত্তর পেয়ে যাই আমরা, তাই না? সদ্য ভূমিষ্ট হওয়া শিশুর জন্য আমি আপনি বিশুদ্ধ বাতাস গ্রহণের নিশ্চয়তা দিতে পারি না, বিশুদ্ধ খাবার মুখে তুলে দিতে পারি না। পুরো পৃথিবীটা আপনার আমার আবর্জনায় ভরপুর। এখানে সেখানে প্লাস্টিকের ছড়াছড়ি, একটু নিজ নিজ চারপাশে তাকালেই বুঝে যাই আমরা।
পায়ে হেঁটে বাংলাবান্ধা জিরো পয়েন্ট তেতুলিয়া টু টেকনাফ শাহ পরীর দ্বীপ পর্যন্ত যেতে প্রতি ইঞ্চি ইঞ্চি জমিতে মনে হয় প্লাস্টিক,পলিথিন দেখেছি। আপনি একটু পর পর রাস্তার দুপাশে, জমিতে, হাট-বাজার থেকে শুরু করে মোটামুটি দেশের উত্তর থেকে দক্ষিণ প্রান্ত সব যায়গায় কমন জিনিস পাবেন, সেগুলো হলো আমার আপনার ফেলে দেওয়া প্লাস্টিক, পলিথিন।
এবার পুরো বাংলাদেশ ইমাজিনেশন করলে সর্বনাশটা বুঝে যাবেন। যেগুলো সমতল থেকে সর্বোচ্চ পর্বত পৌঁছে, এমনকি সমুদ্রের তল দেশ পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছি মানব সভ্যতার কল্যাণে। অত্যন্ত আনন্দের বিষয় না, বলেন? সে আনন্দে একটা প্রশ্ন করি, সদ্য ভূমিষ্ট হওয়া একটা প্রাণ এমন পৃথিবী চেয়েছিল বুঝি মানবসভ্যতার কাছে?
যেখানে জন্ম নেওয়ার পর থেকেই একটা প্রাণের শাস্তি শুরু হয়ে যায়, এমন পৃথিবীতে নিষ্পাপ প্রাণেরা আসতে চেয়েছিল কি? আমার জানা নেই।
তাই সবার কাছে আমার একটাই মেসেজ, নিজের চারপাশে প্রতিটা ইঞ্চি ইঞ্চি মাটিতে প্লাস্টিক নয়, পারলে নিজেরা খেতে পারেন, এমন কোনো শাক-সবজি, সেটা হোক একটা মরিচ গাছ কিংবা একটা লাউ গাছ লাগান। নিজেদের জন্য নিজেরা উৎপাদন করে খান, বাড়ির চারপাশে দেশীয় ফলগাছ লাগান, কাঠ গাছ দিয়ে ভরপুর করে দিয়েন না এবং পাবলিক প্লেস গুলোতেও কাঠ গাছ না লাগিয়ে ফল গাছ লাগান।
আমাদের কমন একটা ন্যাচারের কথা মনে পড়ল, পাবলিক প্লেসে কিংবা নিজের বাড়ি থেকে দূরের কোনো জমিতে ফল গাছ লাগালে ব্যক্তির লাভ নেই—এই ভেবে দূরের জমিগুলোতে দেখবেন কাঠ গাছ লাগায়। অথচ মানব সভ্যতার কল্যাণে এই যায়গা গুলোতে ফলগাছ লাগানো উচিত ছিল। একটা গাছ বীজ থেকে ফুটে চারা গাছ হয়ে তারপর সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ফুল ফল ধরতেছে এর চেয়ে সুন্দর দৃশ্য কি হতে পারে। তারপর নিজে খেলেন, না পাখি খেল, না কোনো পথিক- তাতে কি আসে যায়।
তাই এখানে সেখানে যত্রতত্র প্লাস্টিক পলথিন না ফেলে আমার আপনার চারপাশের মাটিগুলো উৎপাদনমুখী করে তুলি। নয়তো বাণিজ্যিক খপ্পরে আটকে যাবে আপনার, আমার ও ভবিষ্যৎ শিশুর প্রাণ।
আমার জন্মস্থান কুমিল্লা। তেতুলিয়া টু টেকনাফ ক্রসকান্টি হাইকিংয়ে আমার ১৫টা জেলা কভার হয়ে গেছে। আমি আপাতত টেকনাফ আছি। আজকালের মধ্যেই বাকি ৪৯ জেলা পায়ে হেঁটে দেখতে বের হয়ে যাব। একদিন পুরো পৃথিবী। তা ছাড়া পোস্ট-গ্র্যাজুয়েশনের জন্য দেশের বাইরে পাড়ি জমানোর প্ল্যান আছে। তাই ইচ্ছে পুরো বিশ্বে পদচিহ্ন রাখার আগে নিজের দেশে পদচিহ্ন এঁকে নিজেকে দেখে যাই।
সবার নিকট দোয়া ও ভালোবাসা কামনা করছি, যেন বাকি জেলাগুলো শেষ করে সুস্থ ও সুন্দরভাবে ফিরতে পারি মায়ের কাছে।
লেখক : সাবেক শিক্ষার্থী, মার্কেটিং ডিপার্টমেন্ট, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।