প্যারিসে অনুষ্ঠিত বৈশ্বিক সম্মেলনে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) সংক্রান্ত একটি আন্তর্জাতিক চুক্তিতে স্বাক্ষর করেনি যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র। ফ্রান্স, চীন ও ভারতের মতো বহু দেশ এই বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেছে, যা প্রযুক্তিটির বিকাশে ‘উন্মুক্ত’, ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক’ ও ‘নৈতিক’ দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিশ্রুতি দেয়।
আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, সংক্ষিপ্ত এক বিবৃতিতে যুক্তরাজ্য সরকার জানিয়েছে, জাতীয় নিরাপত্তা ও ‘বৈশ্বিক শাসনব্যবস্থা’ নিয়ে উদ্বেগের কারণে তারা এতে স্বাক্ষর করেনি। এর আগে প্যারিসে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট জে ডি ভ্যান্স বলেন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ওপর অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রণ প্রযুক্তির বিকাশের প্রাথমিক পর্যায়ে এটিকে ‘ধ্বংস’ করে দিতে পারে।
ভ্যান্স বিশ্বনেতাদের উদ্দেশে বলেন, এআই যুক্তরাষ্ট্রের জন্য একটি ‘সুযোগ’, যা ট্রাম্প প্রশাসন নষ্ট করবে না। তিনি ‘অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিমুখী এআই নীতিকে’ নিরাপত্তার চেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়ার আহ্বান জানান।
মতবিরোধ
ভ্যান্সের বক্তব্য ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাখোঁর অবস্থানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক মনে হয়েছে। ম্যাখোঁ বলেন, এআইকে এগিয়ে নিতে হলে সুনির্দিষ্ট নিয়মের প্রয়োজন।
যুক্তরাজ্য এর আগে এআই নিরাপত্তার ধারণার পক্ষে ছিল। ২০২৩ সালের নভেম্বর মাসে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক বিশ্বের প্রথম এআই নিরাপত্তা সম্মেলনের আয়োজন করেছিলেন।
ফ্যাক্ট-চেকিং সংস্থা ফুল ফ্যাক্টের এআই বিভাগের প্রধান অ্যান্ড্রু ডুডফিল্ড বলেন, প্যারিসের ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর না করায় যুক্তরাজ্য তার এআই নিরাপত্তার ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দেওয়ার অবস্থানকে দুর্বল করে ফেলেছে। তবে যুক্তরাজ্যের এআইভিত্তিক ব্যবসায়ীদের প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠন ইউকেএআই এই সিদ্ধান্তকে সমর্থন জানিয়েছে।
ইউকেএআইয়ের প্রধান নির্বাহী টিম ফ্ল্যাগ বলেন, ‘যদিও ইউকেএআই পরিবেশগত দায়িত্বশীলতার পক্ষে, তবু আমরা প্রশ্ন করছি, কিভাবে এআই খাতের ক্রমবর্ধমান জ্বালানি চাহিদার সঙ্গে এই দায়িত্ব সামঞ্জস্য রাখা যায়।’
তিনি আরো বলেন, ‘সরকারের এই ঘোষণায় আমরা সতর্ক আশাবাদী, এটি বাস্তবসম্মত সমাধানের দিকেই এগোবে এবং আমাদের মার্কিন অংশীদারদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করার সুযোগ বজায় রাখবে।’
ঘোষণাপত্রে কী বলা হয়েছে?
৬০টি দেশ স্বাক্ষরিত বিবৃতিতে ডিজিটাল বিভাজন কমিয়ে এআই সবার জন্য সহজলভ্য করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, এআইয়ের বিকাশ ‘স্বচ্ছ’, ‘নিরাপদ’, ‘নির্ভরযোগ্য’ ও ‘বিশ্বাসযোগ্য’ হতে হবে।
এতে আরো বলা হয়েছে, ‘মানুষ ও পৃথিবীর জন্য টেকসইভাবে এআই তৈরি করাই’ অগ্রাধিকার।
প্রথমবারের মতো সম্মেলনে এআইয়ের জ্বালানি ব্যবহারের বিষয়টি আলোচনায় এসেছে। বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন, আগামী বছরগুলোতে এআইয়ের বিদ্যুৎ ব্যবহার ছোট দেশগুলোর সমান হতে পারে।
এই ঘোষণার মধ্যে কী এমন ছিল যা যুক্তরাজ্য সরকার গ্রহণ করতে পারেনি, তা স্পষ্ট নয়। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, তারা ‘নেতৃবৃন্দের ঘোষণার অধিকাংশ বিষয়’ মেনে নিলেও কিছু ক্ষেত্রে এটি পর্যাপ্ত নয় বলে মনে করেছে। একজন সরকারি মুখপাত্র বলেন, ‘আমরা মনে করি, ঘোষণায় বৈশ্বিক শাসন নিয়ে পর্যাপ্ত স্পষ্টতা নেই এবং জাতীয় নিরাপত্তার চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার কঠিন প্রশ্নগুলো যথাযথভাবে উপস্থাপিত হয়নি।’
তবে সরকার জানিয়েছে, তারা প্যারিস এআই অ্যাকশন সামিটে টেকসই উন্নয়ন ও সাইবার নিরাপত্তা সংক্রান্ত অন্যান্য চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে।
কূটনৈতিক ভারসাম্য
এই সিদ্ধান্ত এমন এক সময়ে এলো, যখন এআইয়ের সামাজিক, পরিবেশগত ও শাসনব্যবস্থায় প্রভাব নিয়ে আলোচনা চলছে। নীতিনির্ধারক, নির্বাহী ও কূটনীতিকরা প্রযুক্তির ঝুঁকি সামাল দিয়ে এর অর্থনৈতিক সুফল কিভাবে নিশ্চিত করা যায়, তা নিয়ে আলোচনা করছেন।
ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডার লিয়েন বলেছেন, ‘এই সম্মেলন কাজের ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে, যা এই মুহূর্তে সবচেয়ে জরুরি।’
তিনি বলেন, ইউরোপের এআইসংক্রান্ত দৃষ্টিভঙ্গি উদ্ভাবন ও সহযোগিতার ওপর গুরুত্ব দেবে এবং ‘ওপেন সোর্স প্রযুক্তির শক্তিকে গ্রহণ করবে’।