রাজু ভাস্কর্যের কাছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও রাজধানীর বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি স্কুল-কলেজ ও মাদরাসার শিক্ষার্থীরা খণ্ড খণ্ড মিছিল নিয়ে অংশ নেন। দুপুর ১২টার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠনের ব্যানারে বিক্ষোভ মিছিল হয়। দুপুরে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) থেকে বিক্ষোভ মিছিল বের করেন ইন্টার্ন চিকিৎসক ও মেডিক্যাল শিক্ষার্থীরা। অ্যাপ্রন পরে চিকিৎসকদের এই মিছিলে অংশ নিতে দেখা যায়।
রাজধানীর সায়েন্স ল্যাব মোড়ে বিক্ষোভ মিছিল করেন শিক্ষার্থী ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা। সকাল ১১টার দিকে ‘বিভিন্ন সংগঠন ও সাধারণ শিক্ষার্থী’ ব্যানারে এই কর্মসূচি পালিত হয়। এতে ঢাকা কলেজ, ঢাকা সিটি কলেজ, ধানমণ্ডি আইডিয়াল কলেজসহ আশপাশের বেশ কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী ও সাধারণ পথচারীসহ হাজারো মানুষ অংশ নেয়।
ঢাকার রাজপথে সবচেয়ে বেশি সরব ছিলেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার্থীরা। ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন করে গতকাল সকাল সাড়ে ৯টা থেকে তাঁরা রাজপথে নেমে আসেন ‘শো ইসরায়েল দ্য রেড কার্ড’ প্ল্যাকার্ড হাতে।
সকাল ১০টার দিকে রাজধানীর মেরুল বাড্ডায় ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে মানববন্ধন ও সমাবেশ করেন শিক্ষার্থীরা। পরে তাঁরা মধ্য বাড্ডা ও উত্তর বাড্ডা এলাকার সড়কে বিক্ষোভ মিছিল করেন।
প্রায় একই সময়ে আফতাবনগরে ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে বিক্ষোভ সমাবেশ করেন শিক্ষার্থীরা। পরে তাঁরা রামপুরা ব্রিজসহ আশপাশের এলাকায় বিক্ষোভ মিছিল করেন। একই এলাকায় কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীরাও বিক্ষোভ করেন। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ব্যানারে পৃথক বিক্ষোভ সমাবেশ ও মিছিল হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদ থেকে শুরু হয়ে এই মিছিল বাহাদুর শাহ পার্ক ঘুরে ক্যাম্পাসে সমাবেশে মিলিত হয়। শিক্ষার্থীদের এই সমাবেশে শিক্ষক, কর্মকর্তারাও অংশ নেন।
রাজধানীর শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি থেকে গতকাল সকাল ১১টা ৪৫ মিনিটে বিক্ষোভ মিছিল শুরু হয়। ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন করে শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ মিছিলে অংশ নেন।
সকাল ১১টার দিকে বিক্ষোভ মিছিল শুরু করেন নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি (এনএসইউ), ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ (আইইউবি), আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ (এআইইউবি) ও ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির (ইউআইইউ) শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সংহতি জানান শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষক ও কর্মকর্তারা।
বিকেল ৪টার দিকে রাজধানীর মানিক মিয়া এভিনিউতে প্রতিবাদ সমাবেশ করে বিক্ষুব্ধ জনতা। বিভিন্ন ব্যানার, ফেস্টুন নিয়ে এই সমাবেশে যোগ দেয় হাজারো মানুষ। ঘণ্টাব্যাপী সমাবেশ শেষে বিকেল ৫টার দিকে একটি প্রতিবাদ মিছিল মানিক মিয়া এভিনিউ দক্ষিণ করে।
মিরপুর, উত্তরা, বায়তুল মোকাররমসহ রাজধানীর বিভিন্ন এলকায়ও বিক্ষোভ হয়। বিক্ষোভকারীরা শান্তিপূর্ণভাবে বিভিন্ন স্লোগান ও প্ল্যাকার্ডের মাধ্যমে তাদের দাবি তুলে ধরে এবং গাজার জনগণের প্রতি সহমর্মিতা ও সংহতি প্রকাশ করে। বিক্ষোভকারীরা ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে গণহত্যার দায়ে আন্তর্জাতিক আদালতে বিচার এবং সর্বোচ্চ শাস্তির দাবি জানায়।
ঢাকায় মার্কিন দূতাবাসের নিরাপত্তা জোরদার : ঢাকায় মার্কিন দূতাবাস এলাকায় বিক্ষোভ হওয়ায় এই দূতাবাসের নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। এলাকাটিতে পুলিশের পাশাপাশি অবস্থান নেন সেনাবাহিনী, বিজিবি, এপিবিএন, এসবি, সিআইডি, পুলিশ ও গোয়েন্দা বাহিনীর সদস্যরা। নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে গুলশান এলাকায় থাকা অন্য দূতাবাসগুলোতেও। বিক্ষোভের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের সতর্ক থাকার পরামর্শ দেয় ঢাকার মার্কিন দূতাবাস।
ঢাকার বাইরে বিক্ষোভ : ঢাকার বাইরে চট্টগ্রাম, খুলনা, মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী, যশোর, বাগেরহাট, ময়মনসিংহ, রাজবাড়ী, কুড়িগ্রাম, খাগড়াছড়ি, কিশোরগঞ্জ, সিলেট, রাজশাহীসহ বিভিন্ন এলাকায় বিক্ষোভ সমাবেশ ও মিছিল করে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান। বিক্ষোভ সমাবেশে ইসরায়েলি পণ্য বর্জনের ডাক দেওয়া হয়। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ক্লাস-পরীক্ষাও বন্ধ ছিল। পুরো সিলেট যেন একটা মিছিলের নগরীতে পরিণত হয়।
রাজশাহীতে সকাল থেকে নগরজুড়ে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণে বিক্ষোভ সমাবেশ হয়। পৃথকভাবে এই আন্দোলনে অংশ নেয় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, বরেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ, রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী কলেজ, রাজশাহী মুহাম্মদীয়া যুব সুন্নীর শিক্ষক-কর্মচারী-ছাত্রছাত্রীসহ মুসল্লিরা। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা পুরো প্যারিস রোডকে একখণ্ড ফিলিস্তিন হিসেবে ফুটিয়ে তোলেন। রাজশাহীর প্রায় ১০টি স্থানে বিভিন্ন সংগঠন ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান একই কর্মসূচি পালন করে।
সারা দেশে আজ ছাত্রদলের বিক্ষোভ : ফিলিস্তিনের শহীদ ও যুদ্ধাহতদের প্রতি সহমর্মিতা প্রকাশ করে বিশ্বব্যাপী ‘দ্য ওয়ার্ল্ড স্টপস ফর গাজা’ কর্মসূচিতে সংহতি জানানোর জন্য এই কর্মসূচি ঘোষণা করেছে ছাত্রদল। গত রবিবার ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় কমিটি এই কর্মসূচি ঘোষণা করে। অন্যদিকে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরও সপ্তাহব্যাপী কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দিয়েছে।
কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ১০টায় দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সামনে মুখে কালো কাপড় বেঁধে অবস্থান এবং দুপুর ১২টায় প্রতিটি শহরের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে মিছিলসহকারে উপস্থিত হয়ে শহরের প্রাণকেন্দ্রে সম্মিলিত বিক্ষোভ সমাবেশ করা।
ছাত্রশিবিরের কর্মসূচি : বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির এ বিষয়ে সপ্তাহব্যাপী কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। গত সোমবার এক যৌথ বিবৃতিতে সংগঠনটির কেন্দ্রীয় সভাপতি জাহিদুল ইসলাম ও সেক্রেটারি জেনারেল নূরুল ইসলাম সাদ্দাম এসব কর্মসূচি ঘোষণা করেন।
তাঁদের ঘোষিত কর্মসূচিগুলোর মধ্যে রয়েছে ৮ এপ্রিল দেশের সব মহানগরে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ, ৯ এপ্রিল দেশের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ও ভবনের ছাদে ফিলিস্তিনের পতাকা উত্তোলনের মাধ্যমে ‘সলিডারিটি উইথ প্যালেস্টাইন’ কর্মসূচি পালন, ১০ এপ্রিল পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও বিভিন্ন দেশের দূতাবাসে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবিতে স্মারকলিপি দেওয়া, ১১ এপ্রিল জেলা পর্যায়ে ‘ম্যাস মুভমেন্ট’ কর্মসূচি পালন এবং ৭ থেকে ১৩ এপ্রিল সপ্তাহব্যাপী অনলাইন ক্যাম্পেইন ‘ইকোস অব গাজা’ কর্মসূচি পালন।
ঢাবি শিক্ষকদের সাদা দলের বিবৃতি : ফিলিস্তিনের গাজাসহ বিভিন্ন অঞ্চলে অবিলম্বে গণহত্যা ও জবরদখল বন্ধে দখলদার বর্বর ইসরায়েলের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) শিক্ষকদের সংগঠন সাদা দল। একই সঙ্গে ‘নো ওয়ার্ক নো স্কুল আনটিল জেনোসাইড স্টপ’ কর্মসূচির প্রতি সংহতি জানিয়েছে সংগঠনটি। গতকাল ঢাবি সাদা দলের আহ্বায়ক অধ্যাপক ড. মোর্শেদ হাসান খান এবং যুগ্ম আহ্বায়ক অধ্যাপক ড. আব্দুস সালাম ও অধ্যাপক ড. আবুল কালাম সরকার স্বাক্ষরিত এক বিবৃতিতে এ কথা জানানো হয়।
আগ্রাসনবিরোধী আন্দোলনের ছয় দফা দাবি : ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ছয় দফা দাবি জানিয়েছে আগ্রাসনবিরোধী আন্দোলন। গতকাল বিকেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিক সমিতিতে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এই ছয় দফা দাবি তুলে ধরেন সংগঠনটির নেতারা।
দাবিগুলোর মধ্যে রয়েছে পাসপোর্টে ইসরায়েলকে সন্ত্রাসী দেশ আখ্যায়িত করে পুনরায় ইসরায়েল প্রবেশ নিষিদ্ধ চাওয়া; ইসরায়েল ও তাদের মিত্রদের সব পণ্যের ওপর ১০০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা; ইসরায়েল ভ্রমণ আছে এমন ব্যক্তিদের বিমানবন্দরে বিশেষ জিজ্ঞাসাবাদের আওতায় আনা এবং ফিলিস্তিনের অনুদান পাঠানো সব পণ্য শুল্কমুক্ত ঘোষণা। এ ছাড়া এ বিষয়ে আজ মঙ্গলবার স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বরাবর স্মারকলিপি দেওয়া হবে বলেও সংগঠনটির পক্ষ থেকে জানানো হয়।
ইসরায়েলি পণ্য বয়কটের আহ্বান জবি উপাচার্যের : ইসরায়েলের সব পণ্য বয়কটের আহ্বান জানিয়েছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. রেজাউল করিম। সেই সঙ্গে দেশি পণ্য ব্যবহার করে গাজাবাসীর জন্য আর্থিক সহযোগিতার দাবি জানিয়েছেন তিনি।
গতকাল বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের সামনে জবি শিক্ষক সমিতি আয়োজিত সংহতি সমাবেশে তিনি এসব কথা বলেন। সমাবেশে শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. রইছউদ্দীনের সঞ্চালনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. সাবিনা শরমিন, শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. মোশাররফ হোসেন, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. বেলাল হোসেনসহ অন্যান্য শিক্ষক বক্তব্য দেন।
ডিআরইউর প্রতিবাদ ও নিন্দা : ফিলিস্তিনের গাজা ও রাফায় ইসরায়েলি আগ্রাসন ও গণহত্যার ঘটনায় তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি (ডিআরইউ)। পাশাপাশি জাতিসংঘ ও ওআইসিসহ সারা বিশ্বের সব মানুষকে ইসরায়েলের এই গণহত্যা বন্ধের জন্য সোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানিয়েছে ডিআরইউ। গতকাল সোমবার এক বিবৃতিতে ডিআরইউ কার্যনির্বাহী কমিটির পক্ষ থেকে সংগঠনের সভাপতি আবু সালেহ আকন ও সাধারণ সম্পাদক মাইনুল হাসান সোহেল এ আহ্বান জানান।
গাজায় হামলার প্রতিবাদে দেশজুড়ে নিন্দা বিক্ষোভের ঝড়

ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরায়েলের বর্বর হামলা ও গণহত্যার প্রতিবাদে গতকাল ঢাবির রাজু ভাস্কর্যের সামনে নেতানিয়াহুর কুশপুত্তলিকা দাহ করেন শিক্ষার্থীরা (বাঁয়ে) এবং মহাখালী থেকে বিক্ষোভ মিছিল করে জামায়াত।

শাহবাগ থেকে বিক্ষোভ মিছিল বের করে এনসিপি (বাঁয়ে), ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসের সামনে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ও বুয়েটে (ডানে) বিক্ষোভ।

মেডিক্যালের শিক্ষার্থীরা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে (বাঁয়ে) এবং নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির সামনে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ মিছিল।

চট্টগ্রাম (বাঁয়ে), কক্সবাজারে কেএফসি, পিৎজা হাটে ভাঙচুর ও রাজধানীর বসুন্ধরা সিটি শপিং মলের সামনে মোবাইল ফোন ব্যবসায়ীদের বিক্ষোভ (ডানে)। ছবি : কালের কণ্ঠ