বাংলাদেশে ব্যবসা পরিচালনাকারী মার্কিন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোর ক্ষতি করছে উচ্চ শুল্ক। আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকা ঘুষ, দুর্নীতি ও অস্বচ্ছতাকে বাংলাদেশে বিনিয়োগে বাধা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধি দপ্তর (ইউএসটিআর) তাদের সর্বশেষ প্রতিবেদনে এ তথ্য প্রকাশ করেছে।
‘২০২৫ ন্যাশনাল ট্রেড এস্টিমেট রিপোর্ট অন ফরেন ট্রেড ব্যারিয়ার’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এসব তথ্য তুলে ধরেছে ইউএসটিআর।
সংস্থাটি বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সম্পর্কিত অশুল্ক বাধাগুলোকে চিহ্নিত করে বলেছে, বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে যেসব বিষয় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে, সেগুলোসহ কঠোর ডিজিটাল আইনের ব্যাপারে সতর্ক করা হয়। রিপোর্টে বলা হয়, এ ধরনের দমনমূলক নীতি আন্ত সীমান্ত ডিজিটাল বাণিজ্যের পথ রুদ্ধ করতে পারে।
যদিও বাংলাদেশ ২০১৬ সালে ডব্লিউটিওর বাণিজ্য সুবিধা চুক্তি অনুমোদন করেছে, তবু তারা এখনো আমদানি, রপ্তানি ও ট্রানজিট বিধিমালার স্বচ্ছতা বিজ্ঞপ্তি জমা দেয়নি, যা ২০২৩ সালের ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে জমা দেওয়ার কথা ছিল। বাংলাদেশ তার শুল্ক মূল্যায়ন আইন সম্পর্কে ডব্লিউটিওকে অবহিত করেনি।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ বেশির ভাগ খাতে ১০০ শতাংশ বিদেশি মালিকানার অনুমতি দেয়। তবে পেট্রোলিয়াম, গ্যাস ও টেলিযোগাযোগের জন্য ইকুইটি ক্যাপ বহাল রয়েছে। তা ছাড়া ২২টি খাতে বিনিয়োগকারীদের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় থেকে অনাপত্তি সনদ গ্রহণ করতে হয়। যদিও মুনাফা প্রত্যাবাসন আইনত অনুমোদিত, আমেরিকান বিনিয়োগকারীরা প্রায়ই দীর্ঘ বিলম্ব এবং অস্বচ্ছ পদ্ধতির কথা জানান।
ইউএসটিআর উল্লেখ করেছে, অন্তর্বর্তী সরকার মার্কিন সংস্থাগুলোর সঙ্গে আনুষ্ঠানিকভাবে পরিশোধ ব্যবস্থায় সম্মত হয়েছে এবং প্রত্যাবাসনপ্রক্রিয়ার উন্নতির প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
এদিকে বাংলাদেশ জাতীয় ইলেকট্রনিক প্রকিউরমেন্ট পোর্টাল চালু করলেও যুক্তরাষ্ট্রের অংশীদাররা বিভিন্ন দরপত্রে প্রত্যাশিত পণ্যের পুরনো কারিগরি মান নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছে। এ ছাড়া কারিগরি মান পছন্দের দরদাতাদের কাজ দেওয়ার উদ্দেশ্যে নির্ধারণ করা হয় কি না, তা নিয়ে মার্কিন অংশীদারদের সন্দেহ আছে। একই সঙ্গে স্বচ্ছতার অভাব নিয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।
এতে আরো বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রের কয়েকটি কম্পানির দাবি, ক্রয়প্রক্রিয়ায় প্রভাব খাটাতে এবং যুক্তরাষ্ট্রের কম্পানির দরপত্র ঠেকাতে প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়া বিদেশি প্রতিদ্বন্দ্ব্বীরা স্থানীয় অংশীদারদের ব্যবহার করে।
এমনকি দরপত্র বাছাইয়ে কারচুপির অভিযোগও উঠে এসেছে। ডব্লিউটিওর সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত চুক্তির অংশীদার নয় বাংলাদেশ। ডব্লিউটিওর এসংক্রান্ত কমিটির পর্যবেক্ষক হয়নি দেশটি।
মেধাস্বত্ব সুরক্ষায় সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বেশ কিছু আইনগত উদ্যোগ নিলেও বাংলাদেশে এর কার্যকর প্রয়োগ অনিশ্চিত। মার্কিন প্রতিবেদনে উদাহরণ হিসেবে বলা হয়েছে, সারা বাংলাদেশেই নকল ও পাইরেটেড পণ্য সহজলভ্য। ভোগ্যপণ্য, পোশাক, ওষুধ ও সফটওয়্যার খাতের পণ্যগুলো বাংলাদেশে নকল হচ্ছে বলে মার্কিন অংশীদাররা অভিযোগ করেছে। প্রতিবেদনে বিশ্ববাজারে জাল পণ্য প্রবেশের উৎস দেশ হিসেবে বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান ভূমিকার কথাও উল্লেখ করা হয়েছে।
শ্রম ইস্যুতে উদ্বেগের কারণে যুক্তরাষ্ট্র ২০১৩ সালে বাংলাদেশকে অগ্রাধিকারমূলক বাজার সুবিধা (জিএসপি) পাওয়ার ক্ষেত্রে অযোগ্য ঘোষণা করে। এটি এখনো বহাল রয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে দুর্নীতি একটি বিস্তৃত ও দীর্ঘস্থায়ী সমস্যা এবং দুর্নীতি দমন আইন যথাযথভাবে প্রয়োগ করা হয় না। সুবিধা প্রদান এবং উপহারের অবৈধতা সত্ত্বেও বাণিজ্যিক লেনদেনে ঘুষ ও চাঁদাবাজি ব্যবসার সাধারণ বৈশিষ্ট্য। বাংলাদেশের সরকারি কর্মকর্তাদের ঘুষ চাওয়ার কারণে মার্কিন কম্পানিগুলো লাইসেন্স ও বিডের অনুমোদন পেতে দীর্ঘ বিলম্বের অভিযোগ করেছে।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি এবং মার্কিন পণ্যে শুল্কহার অনেক বেশি—এমন যুক্তি দেখিয়ে বাংলাদেশি পণ্যে ৩৭ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। সেটি মোকাবেলা করতে এই কৌশল প্রণয়ন করতে যাচ্ছে সরকার। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের রপ্তানি বাজারের মধ্যে একক দেশ হিসেবে বৃহত্তম, এই রপ্তানিকে পাল্টা শুল্কারোপের আঘাত থেকে সুরক্ষিত রাখতে এরই মধ্যে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে চিঠি দিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। গত শনিবার বিডার এক সভায় নন-ট্যারিফসংক্রান্ত ইস্যুও দ্রুত সমাধানের বিষয়ে আলোচনা হয়েছে।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বাণিজ্য ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে আমাদের চলমান সংস্কার কর্মসূচি, উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি, ব্যবসার খরচ কমানো, বৈদেশিক বিনিয়োগ আকর্ষণ করার জন্য যেসব উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তা জোরালোভাবে চালিয়ে যেতে হবে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে এর কোনো বিকল্প নেই।’
বিশ্বব্যাংক ঢাকা মিশনের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবসায়ীরা বাংলাদেশে ব্যবসা করতে গেলে বিভিন্ন সমস্যায় পড়তে হয় বলে তাঁরা জানিয়েছেন। এর মধ্যে পাবলিক প্রকিউরমেন্ট, ডিজিটাল সার্ভিস ট্রেড, এক্সপোর্ট সাবসিডি, ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি রাইটস, দুর্নীতি অন্যতম।’
লেদার গুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ সভাপতি সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর বলেন, “একটি বিষয়ে সবাই একমত হব, বাংলাদেশ যেন প্রতিযোগিতার সক্ষমতা না হারায়। এখানে ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ থাকলে বেসরকারি খাত থেকে সেটি অর্জন সম্ভব। আর ‘লেভেল প্লেয়িং ফ্লিড’ তৈরির দায়িত্ব সরকারের। এ জন্য একটি সমন্বিত প্রচেষ্টা লাগবে।”
বিজিএমইএর সাবেক পরিচালক মো. মহিউদ্দিন রুবেল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ইউএসটিআরের প্রতিবেদনে উঠে আসা বাণিজ্য বাধাগুলো দূর করতে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে। এগুলো করতে পারলে আমাদের সক্ষমতা আরো বাড়বে, যা শুধু যুক্তরাষ্ট্রে্ নয়, অন্য দেশেও রপ্তানি বাড়াতে সহায়ক হবে। সামনে আমাদের এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন আছে, সে জন্যও আমাদের ব্যবসা ও বিনিয়োগের বাধা দূর করা জরুরি।’