শিক্ষক হতে চেয়েছিলেন : রাঙামাটির কাউখালীর ঘাগড়া ইউনিয়নের রাজখালী গ্রামে জন্ম। দীর্ঘদিন ধরে থাকেন মঘাছড়িতে। পোয়াপাড়া উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ১৯৮১ সালে এসএসসি ও রাঙামাটি সরকারি কলেজ থেকে ১৯৮৩ সালে এইচএসসি পাস করেন। একই কলেজ থেকে পরে স্নাতকও সম্পন্ন করেছেন।
১৯৮৭ সাল। সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগ দিলেন ঘিলাছড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। মঘাছড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি হয়ে আসেন ১৯৯১ সালে। মাঝখানে আরো দুটি বিদ্যালয় হয়ে ১৯৯৯ সালে আবার আসেন মঘাছড়িতে। এবার প্রধান শিক্ষক। শুরু থেকেই পড়াশোনার পাশাপাশি শিশুদের খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক চর্চায় আগ্রহী করে তোলেন। সহযোগিতা করতেন ক্রীড়া শিক্ষক ধারশ মনি চাকমা।
কুঁড়ি থেকে ফুল : ২০১০ সালে বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপ প্রাথমিক বিদ্যালয় ফুটবল টুর্নামেন্টে ছেলেদের নিয়ে উপজেলায় রানার্স আপ হলেন। পরের বছর ‘বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব গোল্ডকাপ প্রাথমিক বিদ্যালয় ফুটবল টুর্নামেন্ট’। সেবার অনেক কষ্টে ১৭ জন খেলোয়াড়, কোচ, ম্যানেজারসহ ২০ জনের মঘাছড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় টিম দাঁড় করালেন। প্রতিযোগিতামূলক ফুটবলে সেবারই এই মেয়েদের প্রথম অংশগ্রহণ। কিন্তু মঘাছড়ি ফুটবল টিমকে করতে চেয়েছিলেন দেশসেরা। পাহাড়ের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা হাজারো কুঁড়ি ফুল হয়ে ফুটেছে বীর সেনের যত্ন ও পরিচর্যায়।
এখন মানুষ আনুচিং মগিনী, আনাই মগিনী, মনিকা চাকমা, চাথুইমা মারমা, মাউচাই মারমা, নদী চাকমা ও সিবলী তালুকদারকে চেনে। এরা তখন অন্য বিদ্যালয়ে পড়ত। তাদের মঘাছড়ি বিদ্যালয়ে ভর্তি করালেন। মঘাছড়ি স্কুলে মাঠ নেই। বীর সেন তাই প্রতিদিন বিকেলে প্রায় চার কিলোমিটার দূরে ঘাগড়া উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে নিয়ে যেতেন মেয়েদের। অনুশীলনের পর আবার নিয়ে আসতেন। যেসব ফুটবলার মঘাছড়ি স্কুলের হয়ে বিভিন্ন টুর্নামেন্টে খেলত, কম্পিউটারে তাদের প্রত্যেকের আলাদা প্রফাইল তৈরি করেন বীর সেন।
প্রভিডেন্ট ফান্ডও ভেঙেছেন : এর মধ্যে মেয়েরা পিএসসি পরীক্ষা দিল। এরপর বীর সেন আলাপ করলেন ঘাগড়া উচ্চ বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে। কারণ সবাই একই স্কুলে ভর্তি হলে টিমটা সুসংহত থাকে। কিন্তু হাই স্কুলে ওদের থাকার হোস্টেল ছিল না। বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সঙ্গে পরামর্শ করে বিদ্যালয়ের অব্যবহূত দুটি কক্ষে আনুচিংদের থাকার অনুমতি মিলল। সব খরচ চালাতেন বীর সেন। একা কুলিয়ে উঠতে না পেরে একসময় অনেকের কাছে হাত পেতেছেন। খেলোয়াড়দের থাকা-খাওয়া এবং সরঞ্জামের খরচ মেটাতে নিজের প্রভিডেন্ট ফান্ডও ভেঙেছেন। টাকার অঙ্কে সেটা ছয় লাখের কম হবে না।
মেয়েরা পারবে : ফুটবলারদের পথ মসৃণ করতে যা যা সম্ভব, সবই করেছেন বীর সেন। ঋতু পর্ণার কথাই ধরা যাক। অনটনের সংসারে জন্ম। ঋতুর মাকে বীর সেন বললেন, ‘আপনারা কুলাতে না পারলে আমিই ঋতুর দায়িত্ব নেব।’ তাঁরা বীর সেনের কথা ফেলেননি।
ঋতুকে নিয়ে মনে একটা জেদ চেপে গিয়েছিল বীর সেনের। বললেন, ‘জন্মের পর থেকে বৈষম্যের শিকার মেয়েটা। তাই ভাবলাম, ঋতু পর্ণাকে এমনভাবে তৈরি করব, যাতে তাকে দেখে অন্য অভিভাবকরা শেখে।’
বীর সেনের ছোট ভাইয়ের বাসা ঘাগড়ায়। তৃতীয় শ্রেণি থেকে ঋতু পর্ণাকে সেই বাসায় রাখলেন। সেখানকার একটা স্কুলে ক্লাস করার ব্যবস্থা করলেন।
মঘাছড়ি ফুটবল টিমের ১৮ জন মেয়ের মধ্যে প্রথমবার কেবল ঋতু পর্ণা সুযোগ পেলেন বিকেএসপিতে। কিন্তু ভর্তি ও যাতায়াতের টাকা নেই। পরে বীর সেন আর কোচ শান্তিমনি চাকমা মিলে তা জোগাড় করে দিলেন।
সাফের দুইবারের সেরা গোলরক্ষক রূপনা চাকমার খেলা দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন ২০১১ সালে। তখন তিনি তৃতীয় শ্রেণিতে। বছর দুয়েক পর ২০১৩ সালে তাঁকে নিজের স্কুলে নিয়ে এলেন। ঘাগড়া জুনুমাছড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তত্কালীন প্রধান শিক্ষক নলিনী চাকমা রূপনার ভরণ-পোষণের দায়িত্ব নেন।
উদযাপনপ্রিয় মানুষ : শিষ্যরা ভালো কিছু করলে রীতিমতো তা উদযাপন করে বেড়ান বীর সেন। একেবারেই নিজস্ব ঢঙে। ২০২২ সালে প্রথমবারের মতো সাফ চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন মেয়েরা। শিরোপাজয়ী সেই দলে ছিলেন পাহাড়ের পাঁচ কন্যা—রূপনা, ঋতু পর্ণা, মনিকা, আনাই, আনুচিং মারমা।
রাঙামাটির কাউখালী উপজেলার মঘাছড়ি এলাকা থেকে ঋতু পর্ণার বাড়ি প্রায় দুই কিলোমিটার দূরে। দীর্ঘ এই পথজুড়েই ছিল আলোর মশাল। মেঠো পথ ধরে ফুটবল কন্যারা গেছেন ঋতু পর্ণার বাড়িতে। ফুটবলাররা গুটি গুটি পায়ে এগিয়েছেন, আর সামনে থেকে একের পর এক মশাল জ্বলে উঠেছে! বীর সেন সবই করেছেন গাঁটের পয়সা খরচ করে।
রূপনা চাকমা বলেন, ‘ভাবতেই পারিনি এলাকায় এভাবে বরণ করে নেওয়া হবে! সত্যিই ভীষণ চমকে গেছি।’
বীর সেনের এই উদ্যোগ নিয়ে ২০২২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর কালের কণ্ঠের শেষ পৃষ্ঠায় ছাপা হয়েছিল সচিত্র প্রতিবেদন। শিরোনাম, ‘আলো ছড়ানো পথে পাহাড়ের পাঁচ মেয়ে’।
বীর সেন চাকমা বললেন, ‘মেয়েদের ফুটবল খেলাকে অনেকে বাঁকা চোখে দেখত। সবাইকে বোঝাতে চেয়েছি, মেয়েরা বোঝা নয়, বরং ঠিকঠাক পরিচর্যা করতে পারলে ওরা ফুল হয়ে ফুটবে।’
এখনো সাধ্যমতো মেয়েদের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেন। ২০২২ সালের নভেম্বরে অবসরে গেছেন। এরপর ‘ভরসা বহুমুখী প্রকল্প’ নামের জৈব কৃষিভিত্তিক একটা প্রকল্প চালু করেছেন, যার অধীনে জৈব সার উত্পাদন, নার্সারি স্থাপন, মৌমাছি পালন, বাঁশ দিয়ে আসবাব তৈরি ও বিক্রি করছেন। বীর সেন বলেন, ‘ভবিষ্যতে পরিবেশবান্ধব ফসল উত্পাদনের জন্য একটি কৃষিপল্লী নির্মাণের ইচ্ছা আছে।’

স্ত্রী-সন্তানসহ বীর সেন চাকমা। ছবি : পিন্টু রঞ্জন অর্ক

তৃণমূলে খেলোয়াড় তৈরির নেপথ্য কারিগর হিসেবে পেয়েছেন কুল-বিএসপিএ স্পোর্টস অ্যাওয়ার্ড ২০২৪। ছবি : মীর ফরিদ

বাঁ থেকে আনুচিং, রুপনা, আনাই, মনিকা ও ঋতুপর্ণা। রাঙামাটির এই পাঁচ ফুটবলারের উঠে আসার পেছনে অসামান্য ভূমিকা আছে বীর সেনের। ছবি: সংগৃহীত