<p>বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা অত্যন্ত বৈচিত্র্যময়, যেখানে বিভিন্ন মাধ্যম, ধরন ও প্রতিষ্ঠানের উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। প্রাক-প্রাথমিক, প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষার মতো বিভিন্ন স্তরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এর <img alt="প্রয়োজন মেগাপ্রজেক্ট" height="638" src="https://asset.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/1.Print/2025/1. january/12-01-2025/Rif2/13-01-2024-p6-5.jpg" style="float:left" width="300" />অন্তর্ভুক্ত। প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে দেখা যায়, এই স্তরের বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠান বেসরকারি খাতে পরিচালিত হয়, যার ফলে সরকারের তত্ত্বাবধান অত্যন্ত সীমিত। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার কারণে প্রাক-প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা বাড়ছে; তবে এই বিদ্যালয়গুলোর কাঠামো, পরিবেশ, শিক্ষার মান ও পরিচালন পদ্ধতি সম্পর্কে সরকারের কাছে সুনির্দিষ্ট ধারণা নেই।</p> <p>এই বিদ্যালয়গুলোর অনেকাংশ মানসম্মত শিক্ষার জন্য উপযুক্ত পরিবেশ প্রদান করতে ব্যর্থ। শিশুদের শিক্ষাজীবন শুরু হয় ছোট, জনাকীর্ণ শ্রেণিকক্ষে, যেখানে পর্যাপ্ত বায়ু চলাচল, খেলার জায়গা ও মৌলিক অবকাঠামোর অভাব রয়েছে। এই ধরনের অস্বাস্থ্যকর ও সীমাবদ্ধ পরিবেশ শিশুদের শেখার জন্য এক নেতিবাচক অভিজ্ঞতা তৈরি করে।</p> <p>বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থায়ও উল্লেখযোগ্য বৈচিত্র্য রয়েছে, যেখানে সরকারি বিদ্যালয়, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, মাদরাসা, এনজিও পরিচালিত বিদ্যালয় এবং কওমি মাদরাসা অন্তর্ভুক্ত। যদিও এই বৈচিত্র্য উপকারী হতে পারে, যেমন—এটি পছন্দের স্বাধীনতা প্রদান করে, তবু এর কিছু নেতিবাচক দিকও রয়েছে। শিক্ষক, সুযোগ-সুবিধা সবচেয়ে বেশি দেওয়া দরকার প্রাথমিকে। অন্য দেশের তুলনায় প্রাক-প্রাথমিক থেকে টারশিয়ারি লেভেল পর্যন্ত শিক্ষকদের বেতন বাংলাদেশে খুবই কম।</p> <p>বাংলাদেশের মাধ্যমিক শিক্ষাব্যবস্থায়ও উল্লেখযোগ্য বৈচিত্র্য রয়েছে, যেখানে সরকারি স্কুল, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, মাদরাসা ও ক্যাডেট কলেজ অন্তর্ভুক্ত। এর মধ্যে ক্যাডেট কলেজগুলোকে অভিজাত প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে এবং তারা অত্যধিক পরিমাণে সরকারি বরাদ্দ পাচ্ছে।</p> <p>এই পদ্ধতি শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে একটি কাঠামোগত বৈষম্য সৃষ্টি করেছে, কারণ সরকার ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃতভাবে একটি বিভাজনমূলক ব্যবস্থা তৈরি করেছে। একটি ন্যায়সংগত সমাজে সরকারের দায়িত্ব হলো সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে সমান সুযোগ ও বরাদ্দ নিশ্চিত করা। মাধ্যম বা ধরনের পার্থক্য নির্বিশেষে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে যথাযথ সুবিধা ও সহায়তা প্রদান করা উচিত, যাতে শিক্ষার্থীরা সমান মানের জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জন করতে পারে।</p> <p>এই বৈষম্য দূর করতে সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে যে প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সমান সুযোগ প্রদান করছে এবং সব পটভূমির শিক্ষার্থীরা একই স্তরের যোগ্যতা অর্জন করছে। যদি জ্ঞান ও দক্ষতার মধ্যে কোনো বৈষম্য থাকে, তাহলে প্রতিষ্ঠানগুলোকে দায়বদ্ধ করতে হবে এবং তাদের দুর্বলতার কারণগুলো চিহ্নিত করতে হবে। এই ঘাটতি দূর করতে যথাযথ পদক্ষেপ ও সহায়তা প্রদান করতে হবে, যাতে শিক্ষাব্যবস্থায় ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠা করা যায়।</p> <p>আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার সবচেয়ে বড় দুর্বলতা কোনো সরকার কখনোই শিক্ষাকে গুরুত্ব দেয়নি। গত সরকার অবকাঠামোগত বিভিন্ন মেগাপ্রজেক্ট নিলেও শিক্ষা নিয়ে কোনো মেগাপ্রজেক্ট নেয়নি, অন্তর্বর্তী সরকারও গুরুত্ব দিচ্ছে না। অনেক সংস্কার কমিশন তৈরি হলেও শিক্ষা নিয়ে কোনো কমিশন তৈরি হয়নি। এ থেকে বোঝা যায়, শিক্ষা নিয়ে কোনো সরকারের গুরুত্ব নেই। যার কারণে কোনো নীতিমালা নেই, ভালো বাজেট বরাদ্দ নেই।</p> <p>শিক্ষাব্যবস্থায় শিল্পপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংযোগ থাকা প্রয়োজন। শুধু মুখস্থ বিদ্যা না, শিল্পপ্রতিষ্ঠানভিত্তিক শিক্ষাসহ শিল্প অনুযায়ী জনসম্পদ তৈরির পরিকল্পনা থাকতে হবে। কতজন ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, সাংবাদিকসহ কোন সেক্টরে কত জনশক্তি লাগবে সে অনুযায়ী জনসম্পদ পরিকল্পনা করতে হবে। চাকরির বাজারের সঙ্গে শিক্ষার একটি সংযোগ থাকতে হবে। কতজন অবসরে যাবে, কতজন চাকরিতে প্রবেশ করবে—এ বিষয়গুলোর কোনো সমন্বয় বর্তমানে নেই। সমন্ব্বয় না থাকার কারণে এ বিষয়গুলোর কোনো বাজার চাহিদা নেই।</p> <p>শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে একটি মেগাপ্রজেক্ট থাকতে হবে। দেশের কোন জায়গায় কী ধরনের শিক্ষা লাগবে, কতজন লাগবে তার জন্য একটি মেগাপ্রজেক্ট নিতে হবে এবং প্রয়োজনীয় বরাদ্দ দিতে হবে। শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সুযোগ-সুবিধা বাড়াতে হবে। কোনো শিক্ষার্থীকে যেন হলে আসনের জন্য লেজুড়বৃত্তি করতে না হয়। প্রথম বর্ষ থেকেই একজন শিক্ষার্থী যেন হলে আসন পায়। শিক্ষার্থীদের টাকার জন্য যেন চিন্তা করতে না হয় সে জন্য সরকারকে লোন দিতে হবে। শিক্ষার্থীরা যখন চাকরি করবে তখন সেই লোন পরিশোধ করে দেবে। মূলকথা হচ্ছে, সরকারকে আগে শিক্ষাকে প্রায়োরিটি দিতে হবে। দ্বিতীয়ত, শিক্ষার বাজেট বাড়াতে হবে। তৃতীয়ত, শিক্ষার জন্য ভালো শিক্ষক নিয়োগ করতে হবে। চতুর্থত, যে সুযোগ-সুবিধা দরকার সেগুলো দিতে হবে। পঞ্চমত, জবাবদিহি বাড়াতে হবে। প্রতিটি শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর জবাবদিহি বাড়াতে হবে।</p> <p>শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রশাসনকে সরকারের কাছে বাজেট চাইতে হবে। তাকে ভিশন দিয়ে, যুক্তি দিয়ে সরকারের কাছে অর্থ চাইতে হবে। সরকা দেবে, দিতে বাধ্য তারা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে ফ্ল্যাগশিপ বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি করতে হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দেখে আরো চারটি বিশ্ববিদ্যালয় হবে। ধাপে ধাপে যেন প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়কে একই মানদণ্ডে আনতে পারে।</p> <p>আগামী দিনের শিক্ষাব্যবস্থা এমন করতে হবে, যার মাধ্যমে দেশের জনসম্পদকে শিক্ষিত ও দক্ষ করে তুলে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক চাহিদা পূরণ করা যাবে। এর জন্য সব অংশীজনের সঙ্গে আলোচনা করে কারিকুলাম ঠিক করতে হবে। শিক্ষক, শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মানুষ, বিষয় বিশেষজ্ঞ, আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ, অর্থনীতিবিদ, রাজনীতিবিদের সঙ্গে বসে বাংলাদেশের আগামী ২০ থেকে ২৫ বছরের জন্য শিক্ষা পরিকল্পনা করতে হবে। পরিকল্পনা অনুযায়ী রোডম্যাপ তৈরি করতে হবে। রোডম্যাপের মধ্যে কিভাবে ধাপে ধাপে আমরা এগোব, তারও একটা পরিকল্পনা থাকতে হবে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক দিক দেখে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে বসে আমাদের এমন পরিকল্পনা করতে হবে। পরিকল্পনা করার পর সে অনুযায়ী সরকারের বরাদ্দ দিতে হবে, বরাদ্দের সুষ্ঠু বণ্টন করতে হবে, জনশক্তি দিতে হবে, প্রশিক্ষণ দিতে হবে। একই সঙ্গে সবাইকে জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে।</p> <p>আমাদের চাওয়া আগামী দিনের বাংলাদেশে এমন শিক্ষাব্যবস্থা হতে হবে, যেখানে সবার জন্য শিক্ষা উন্মুক্ত থাকবে, সবাই দক্ষ জনশক্তি হিসেবে গড়ে উঠবে, মানসম্পন্ন চাকরির সুযোগ পাবে এবং একটি সম্মানজনক জীবন যাপন করতে পারবে।</p> <p> </p> <p> </p> <p> </p>