‘পীড়ার আকর ভূমি এই রঙপুর,/প্রণালী কাটিয়া তাহা করিবারে দূর,/ মাতা শ্যামাসুন্দরীর স্মরণের তরে,/জানকী বল্লভ সুত এই কীর্তি করে’। ১৮৯০ সালে যখন রংপুরের বুক চিরে ১৬ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের শ্যামাসুন্দরী খাল কাটা হয়, তখন উদ্বোধনের ফলকে লেখা হয় কথাগুলো। ওই ফলক আছে, চরণগুলো আছে, কিন্তু সেই খাল এখন দখল, ভরাট ও দূষণে মরণদশায়।
শুধু শ্যামসুন্দরী খাল নয়, রংপুর জেলার ২৯টি নদ-নদী-খালেরও একই দশা; যার সরাসরি বিরূপ প্রভাব পড়েছে রংপুরের সমাজ, কৃষি, অর্থনীতি ও জীববৈচিত্র্যে।
গোটা খালে সর্বত্রই দেখা গেছে ময়লা-আবর্জনা ও ডাস্টবিনের ভাগাড়।
কাচারিবাজারে ষাটোর্ধ্ব আবদুল মতিনের চায়ের দোকান। জন্মের পর থেকেই তিনি এ খাল দেখেছেন। মতিন বলেন, ২০ বছর আগেও খালের পানি ভাল ছিল। গোসল করা যেত। মাছ পাওয়া যেত। এখন নালা হয়ে গেছে। গোসল তো দূরের কথা, দুর্গন্ধে খালের পারে দাঁড়িয়ে থাকা যায় না।’
কৃত্রিম খাল শ্যামাসুন্দরী নয়, রংপুরের প্রাকৃতিক নদ-নদী-খালও এখন মৃত্যুশয্যায়। জেলার ভেতরে প্রবাহিত রয়েছে ২৯টি নদ-নদী-খাল। সব কটি এখন দখল ও ভরাটে জীর্ণ, দূষণে বিপর্যস্ত। ধীরে ধীর মৃত্যুমুখে পতিত হচ্ছে তিস্তা, ঘাঘট, যমুনেশ্বরী, চিকলি, শাখা চিকলি, বুল্লাই, টেপরীর বিল, নলেয়া, মানাস, ধুম, খটখটিয়া, বাইশা ডারা, আলাইকুড়ি, বুড়াইল, ইছামতী, শ্যামাসুন্দরী, খোকসা ঘাঘট, আঁখিরা, ভেলুয়া, কাঠগিরি, নেংটি ছেঁড়া, করতোয়া, সোনামতি, নলসিসা, মাশানকুড়া ইত্যাদি নদ-নদী-খাল।
ঘাঘট নদ ও শ্যামাসুন্দরীর মিলনস্থল শহরের কেল্লাবন্দ। ঘাঘট থেকে সরাসরি পানি প্রবাহিত হয় শ্যামাসুন্দরী খালে। এখন সেই চ্যানেল ভরাটে প্রায় বন্ধ। গতকাল সোমবার কেল্লাবন্ধ গিয়ে দেখা গেছে, অতীতের খরতোয়া ও স্রোতস্বিনী ঘাঘট এখন খালে পরিণত হয়েছে। দুই পারেই দেখা গেছে শতাধিক দখলদারের অস্তিত্ব। কোথাও কোথাও ভরাট করা হয়েছে নদের পার।
দুই হাজারেরও বেশি দখলদার : খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রংপুরের ২৯ নদ-নদী-খাল দুই হাজারেরও বেশি দখলদার কবজা করে রেখেছে। কোথাও কোথাও গড়ে তোলা হয়েছে বসতবাড়ি, দোকানপাট, ব্যবসাকেন্দ্র। কোথাও গড়ে তোলা হয়েছে ছোট মিল-ফ্যাক্টরি। দখলদারদের কবল থেকে রংপুরের নদ-নদী-খাল উদ্ধারের জন্য রংপুর বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসক, সিটি করপোরেশনের মেয়র, পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা একাধিক বৈঠক করলেও দখল উচ্ছেদ শুরু করা যায়নি।
জেলা প্রশাসক ও সিটি করপোরেশন সূত্রে জানা যায়, শ্যামাসুন্দরী খাল দখলের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে চার শতাধিক ব্যক্তি। ২৮ নদ-নদী-খাল দখল করে রেখেছে দেড় হাজার ব্যক্তি। এই দখলদারদের তালিকা তৈরি করা হলেও উচ্ছেদ করা হয়নি।
সরকারি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সমন্বয়হীনতা : নদ-নদীর সঙ্গে কৃষি মন্ত্রণালয়, ভূমি মন্ত্রণালয়, নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়, পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়, সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় ছাড়া সরকারের নানা দপ্তর ও বিভাগ জড়িত। কিন্তু নদী সুরক্ষায় এসব মন্ত্রণালয় ও বিভাগের তেমন সমন্বয় নেই বলে অভিযোগ করেছেন রংপুরের স্থানীয় নদী বিশেষজ্ঞ ও রাজনীতিবিদরা। হাইকোর্টের নির্দেশে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন গঠন করা হলেও কমিশন সুপারিশ ও পরামর্শ ছাড়া আর কোনো কাজ করতে পারে না। নদীর সুরক্ষায় কাজ করার কথা জেলা প্রশাসন, পানি উন্নয়ন বোর্ড, সিটি করপোরেশনেরও। কিন্তু বিভাগীয় কমিশনারের নেতৃত্বে কয়েকবার মিটিং হলেও তেমন কোনো উদ্যোগ কখনো দেখা যায়নি।
রংপুর জেলা প্রশাসক আসিব আহসান বলেন, ‘রংপুরে যদিও বলা হয় ২৮-২৯টি নদ-নদী রয়েছে। সেটা বাস্তব অর্থে সত্য নয়। যেসব নদী বাস্তবে রয়েছে, সেগুলো সুরক্ষার জন্য আমাদের নানা পরিকল্পনা রয়েছে।’
চাই জরুরি পদক্ষেপ : রংপুর জেলায় খুব বেশি মিল-ফ্যাক্টরি না থাকলেও শহরের ভেতর ও আশপাশের সব নদ-নদীই দূষণের শিকার। তার মূলেই রয়েছে পয়োনিষ্কাসন, শহরের ডাস্টবিনের সংযোগ। বিশেষ করে শ্যামাসুন্দরী খালের দূষণের প্রধান কারণ খালে সিটি করপোরেশনের ময়লার সংযোগ দেওয়া।
সিপিবি রংপুর জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক শাহীন রহমান বলেন, এখানে সমন্বিত কোনো কাজ হয়নি। সিটি করপোরেশনের মেয়র শ্যামাসুন্দরী খাল রক্ষার জন্য বারবার ওয়াদা করলেও তা বাস্তবায়ন করেননি।
রিভারাইন পিপলের পরিচালক ও বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. তুহিন ওয়াদুদ বলেন, ‘নদ-নদীগুলো কঙ্কালসার হওয়ার কারণে জলপথে যোগাযোগের ক্ষেত্রে ভীষণ নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। বন্ধ হয়ে গেছে কয়েক শ ঘাট। নদীকেন্দি ক ব্যবসা কেন্দ । নদীগুলো পানিশূন্য থাকায় যারা নদীতে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করত কিংবা নৌকা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করত, তাদের এখন অন্য পেশার সন্ধান করতে হচ্ছে। শুধু কৃষি ও অর্থনীতি নয়, নদীর দুরবস্থায় নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে প্রকৃতি ও জীবনবৈচিত্র্যেও।’