পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তির ২৭ বছর পার হলেও পাহাড়ের তিন জেলায় এখনো পূর্ণ শান্তি ফেরেনি। সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো এখনো অপহরণ, বেপরোয়া চাঁদাবাজি ও দখল নিয়ে তৎপর। গত সাড়ে তিন মাসে বান্দরবান, খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটি এ তিন জেলায় অন্তত ৫৫ জনকে অপহরণ করা হয়।
এ ছাড়া মোবাইল কম্পানির কাছ থেকে চাঁদা না পেয়ে চাঁদাবাজরা অন্তত ১৪টি মোবাইল নেটওয়ার্ক টাওয়ারে ভাঙচুরসহ বিদ্যুৎ ও কেবল সংযোগ ক্ষতিগ্রস্ত করে।
আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী, গোয়েন্দা সংস্থা ও স্থানীয় সূত্রে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
গোয়েন্দা সূত্রে জানা যায়, অপহরণকৃতদের মধ্যে অনেককেই মুক্তিপণ দেওয়ার পর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। আবার কেউ কেউ মুক্তিপণ ছাড়াই মুক্তি পেয়েছে।
সূত্র জানায়, পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি, সম্প্রীতি বজায় রাখার পাশাপাশি সশস্ত্র সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড দমনে সেনাবাহিনী ভূমিকা রাখছে।
সর্বশেষ গত ৭ মার্চ রাঙামাটির কাউখালীতে ইউপিডিএফের (মূল) শীর্ষ সন্ত্রাসীদের একটি গোপন আস্তানার সন্ধান পায় সেনাবাহিনী। সেখানে অভিযানে গেলে টের পেয়ে সন্ত্রাসীরা দ্রুত পালিয়ে যায়। পরে আস্তানা থেকে ১৭ রাউন্ড পিস্তলের গুলি, একটি বাইনোকুলার, একটি ওয়াকিটকি সেট, একটি হার্ডডিস্ক, সন্ত্রাসীদের ইউনিফর্ম, চাঁদা আদায়ের রসিদসহ বিভিন্ন সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়।
স্থানীয় সূত্র, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থা সূত্রে জানা যায়, জেএসএস (মূল), জেএসএস (সংস্কার), ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ-সংস্কার), ইউপিডিএফ (মূল), মগ লিবারেশন পার্টিসহ (এমএলপি) কয়েকটি সংগঠন এসব ঘটনায় জড়িত।
খাগড়াছড়ির পুলিশ সুপার (এসপি) আরেফিন জুয়েল বলেন, ‘যেগুলো আমাদের আওতার ভেতর সেগুলোতে নজরদারি রাখার চেষ্টা করছি। পাহাড়ে অপরাধীদের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য সেনাবাহিনী ও বিজিবির সঙ্গে কাজ করছি।’
উল্লেখযোগ্য কিছু ঘটনা : ২ ফেব্রুয়ারি আলীকদম জোনের লামা উপজেলার কমলা বাগানপাড়া এলাকা থেকে অজ্ঞাতপচিয় সন্ত্রাসীরা সাতজন বাঙালি কাঠ সংগ্রহকারী শ্রমিককে অপহরণ করে। পরে মোবাইল ফোনে সাত লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করলে তিন লাখ টাকা দিলে অপহৃত ব্যক্তিদের ছাড়িয়ে আনা হয়।
৫ ফেব্রুয়ারি রামগড় জোনের যৌথ খামার এলাকা থেকে ট্রাকচালক চাঁদ মিয়াকে অপহরণ করে এক লাখ ৬০ হাজার টাকা মুক্তিপণ নিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়।
১১ ফেব্রুয়ারি গুইমারা উপজেলার তৈকর্মা এলাকা থেকে সৃষ্টি কুমার ত্রিপুরাকে অপহরণ করে তাঁর বাবার কাছ থেকে পাঁচ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করা হয়। পরে নিরাপত্তা বাহিনীর তৎপরতায় মুক্তিপণ ছাড়াই অপহৃত ব্যক্তিকে উদ্ধার করা হয়।
এ ছাড়া ২ ফেব্রুয়ারি ইউপিডিএফের সদস্যরা খাগড়াছড়ির সিন্দুকছড়ির মায়ারখিল এবং সুদুরখিলে রবির দুটি মোবাইল টাওয়ারে আগুন দেয়। ৬ জানুয়ারি কংচাইউ মারমা মগ লিবারেশন পার্টির (এমএলপি) নেতা পরিচয়ে মানিকছড়ির রবি মোবাইল টাওয়ার ব্যবস্থাপকের কাছে চাঁদা দাবি করা হয়। ২১ জানুয়ারি সুদুরখিল এলাকায় অজ্ঞাতপরিচয় সন্ত্রাসীরা চাঁদা না পাওয়ায় রবি মোবাইল টাওয়ার ভাঙচুর করে। ২২ জানুয়ারি ইউপিডিএফ (মূল) দলের সন্ত্রাসীরা নানিয়ারচরের বেতছড়িপাড়ায় একটি টেলিটক ও একটি রবি টাওয়ার এবং গিলাছড়িতে একটি রবি টাওয়ারের মোবাইল নেটওয়ার্কের কেবল বিচ্ছিন্ন করে।
২৮ জানুয়ারি ইউপিডিএফ (মূল) দলের সন্ত্রাসীরা নানিয়ারচরের বেতছড়ি জেনারেল ওসমানী উচ্চ বিদ্যালয় এলাকায় একটি রবি ও একটি টেলিটক টাওয়ার এবং বুড়িঘাট ইউনিয়ন পরিষদের সাপমারা এলাকায় একটি রবি টাওয়ারের মোবাইল নেটওয়ার্কের কেবল ও বৈদ্যুতিক সংযোগ কেবল বিচ্ছিন্ন করে। ২৯ জানুয়ারি সিন্দুকছড়ি জোনের আসালংপাড়ায় ইউপিডিএফ (মূল) দলের সন্ত্রাসীরা রবি মোবাইল নেটওয়ার্কের কেবল ও বৈদ্যুতিক সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে।
৩ ফেব্রুয়ারি রাঙামাটির কুতুকছড়ি ইউনিয়নের মধ্যপাড়া থেকে ইউপিডিএফ (মূল) দলের সন্ত্রাসীরা বিটিসিএল কম্পানির লাইনম্যানের কাছ থেকে স্পাইসিক মেশিন ছিনিয়ে নেয়। ১৩ ফেব্রুয়ারি একই দলের সন্ত্রাসীরা রাঙামাটির সাপছড়ি ইউনিয়নসংলগ্ন মনজুরানি রেস্টুরেন্ট এলাকায় চাঁদার দাবিতে রবি ও এয়ারটেল টাওয়ারের ইন্টারনেট কেবল কেটে দেয়।
এর আগে ১১ ডিসেম্বর মাটিরাঙ্গার জারিচন্দ্রাপাড়ায় ইউপিডিএফ (মূল) দলের সন্ত্রাসীরা একজন বাঙালি এনজিওকর্মীকে অপহরণের চেষ্টা করে। পরে সেনা টহলদল ঘটনাস্থলে গেলে তাঁকে ছেড়ে দিয়ে পালিয়ে যায় সন্ত্রাসীরা। ২০ ডিসেম্বর জেএসএস (মূল) দলের সন্ত্রাসীরা লামা উপজেলার সরই ইউনিয়নের লামা রাবারবাগান ইন্ডাস্ট্রিজের সুপারভাইজার জসিম উদ্দিনকে অপহরণ করে বাগান ম্যানেজারের কাছে আট লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে। ঘটনা জেনে সেনা টহলদল অভিযান চালিয়ে অপহৃত ব্যক্তিকে সুস্থ অবস্থায় উদ্ধার করে।
৪ জানুয়ারি লামা উপজেলার চালপাড়ায় হিলটা অ্যাগ্রো লিমিটেড বাগানের ম্যানেজার হাসমত আলীকে অজ্ঞাতপরিচয় সন্ত্রাসীরা অপহরণ করে। বাগান মালিকের কাছে ছয় লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করার পর দুই লাখ ২৫ হাজার টাকায় তাঁকে ছাড়িয়ে আনা হয়। ৮ জানুয়ারি দীঘিনালার জামতলী থেকে তিনজন বাঙালি পর্যটককে অপহরণ করে অজ্ঞাতপরিচয় সন্ত্রাসীরা। পরদিন অবশ্য তাঁদের ছেড়ে দেওয়া হয়। ১৫ জানুয়ারি লামা উপজেলার সরই ইউনিয়নের তিনটি তামাকের খামার থেকে সাত বাঙালি ব্যক্তিকে অপহরণ করে সন্ত্রাসীরা। পরে খামারের মালিকদের কাছ থেকে মোট সাত লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে তারা। পাঁচ লাখ ৩০ হাজার টাকায় অপহৃত ব্যক্তিরা ছাড়া পান। এ ছাড়া ২৮ নভেম্বর দীঘিনালার বাবুছড়া নতুন বাজার এলাকা থেকে ইউপিডিএফ (মূল) দলের সন্ত্রাসীরা বেসরকারি সংস্থা আশার ম্যানেজার ফজলুর রহমানকে অপহরণ করে এবং চাঁদা আদায়ের পর ওই দিনই তাঁকে ছেড়ে দেয়।