এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) ঋণের টাকা হরিলুটের আয়োজন চলছে। কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের আধুনিক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে আরো দক্ষ করে তুলতে ১৫০ মিলিয়ন ডলার বা এক হাজার ৮০০ কোটি টাকার এই ঋণ প্রকল্প ঘিরেই অনিয়মের যত আয়োজন। তবে এই টাকার একটি বড় অংশই ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী সরকারের সময়েই নয়ছয় হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। যেখানে অন্যান্য প্রকল্পে আবাসিক-অনাবাসিক ভবন নির্মাণে প্রতি বর্গমিটারে ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকা খরচ করা হচ্ছে, সেখানে এই প্রকল্পে প্রতি বর্গমিটারে ৬৮ হাজার টাকা খরচ ধরা হয়েছে।
এ ছাড়া অন্যান্য খাতেও অপ্রয়োজনীয় ব্যয় ধরে লুটপাটের পরিকল্পনা করা হয়েছে।
গত ডিসেম্বরে পরিকল্পনা কমিশনে প্রকল্পটির মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভায় বেশ কিছু নির্দেশনাসহ ফেরত পাঠানো হয়। সম্প্রতি প্রকল্পটি সংশোধন করে পরিকল্পনা কমিশনে পাঠালেও দেখা যায়, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অপ্রয়োজনীয় ও অত্যধিক ব্যয়ের প্রস্তাব রয়েছে।
এ বিষয়ে পরিকল্পনা কমিশনের আর্থ-সামাজিক অবকাঠামো বিভাগের সদস্য (সচিব) কাইয়ুম আরা বেগম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা প্রস্তাবটি আবারও যাচাই-বাছাই করে দেখব।
প্রকল্পে অত্যধিক ব্যয় অনুমোদনের কোনো সুযোগ নেই।’
২০২২ সালে রাজশাহী মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন প্রকল্প নেওয়া হয়। সেখানে ১০ তলা অনাবাসিক ভবন নির্মাণে প্রতি বর্গমিটারে ৩৮ হাজার টাকা ব্যয় ধরা হয়। ২০২৩ সালে আগারগাঁওয়ে সংসদ সচিবালয়ের সরকারি কর্মকর্তাদের ১৫ তলা আবাসিক ভবন নির্মাণে প্রতি বর্গমিটারে ৪৮ হাজার টাকা ব্যয় ধরা হয়।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাইন আর্টস ফ্যাকাল্টি ভবন নির্মাণে ব্যয় হচ্ছে মাত্র ২৩ হাজার টাকা।
অথচ প্রস্তাবিত এই প্রকল্পে এক লাখ তিন হাজার ১০০ বর্গমিটার অনাবাসিক ভবন নির্মাণে ৭১১ কোটি ২৩ লাখ ৬১ হাজার টাকা ব্যয় ধরা হয়। অর্থাৎ প্রতি বর্গমিটারে ব্যয় পড়ছে ৬৮ হাজার ৯৮৫ টাকা। আর ৪০ হাজার ২১ বর্গমিটার আবাসিক ভবন নির্মাণে খরচ ধরা হয় ২৭০ কোটি ৪৪ লাখ ১০ হাজার টাকা। এখানে প্রতি বর্গমিটারে খরচ পড়ছে ৬৭ হাজার ৫৭৪ টাকা।
প্রকল্পটিতে ভবন নির্মাণে ব্যয় করেছে শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর। সংস্থাটির ডেস্ট-৪-এর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. রফিকুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এই প্রকল্পের ফিজিবিলিটি স্টাডি এডিবির কনসালট্যান্টরাই করেছেন। তাঁদের ব্যয় ধরেই আমরা এটা দিয়েছি। অনেক ভবন নির্মাণে ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকাও রয়েছে। কোনো ভবন নির্মাণেই ৬৬ হাজার টাকার বেশি নেই।’
তাহলে গড়ে ভবন নির্মাণের ব্যয় ৬৭-৬৮ হাজার টাকা হলো কিভাবে? সেটা জানতে চাইলে তিনি উত্তর দিতে পারেননি। তিনি বলেন, সামনে রেটশিডিউল বাড়লে আবার তো ব্যয় বাড়বেই, তাই ধরা হয়েছে। এদিকে পিইসির আগের প্রস্তাবিত ডিপিপিতে দেখা যায়, সেখানে অনাবাসিক ভবন নির্মাণে ৭৭ হাজার টাকা ধরা হয়েছিল।
পরিকল্পনা কমিশনের একাধিক কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে জানান, মূলত এডিবির ঋণের ১৮০০ কোটি টাকা ছাড় করার জন্যই বেশি ব্যয় ধরা হয়েছে। বেশি ব্যয় না ধরলে পুরো টাকা ছাড় করা যাবে না। এই প্রকল্পের জন্য এক হাজার ২০০ কোটি টাকা হলেই হয়। শুধু এডিবির ঋণের এক হাজার ৮০০ কোটি টাকা ছাড় করার জন্য এত কাজ ও বেশি ব্যয় ধরা হয়েছে। এই প্রকল্পে এত ভবনের প্রয়োজন ছিল না।
এদিকে এই সংকটের সময়েও প্রকল্পটিতে ৩৭৮ জনের বিদেশ প্রশিক্ষণে ৬৫ কোটি ৪১ লাখ টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে। একেকজনের বিদেশ প্রশিক্ষণে খরচ পড়ছে ১৭ লাখ ৩০ হাজার টাকা। যদিও প্রথমে এই প্রকল্পে বিদেশ প্রশিক্ষণে ১৩৫ কোটি টাকা চাওয়া হয়েছিল।
এ বিষয়ে কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক-৭ রেজওয়ানুল হক কালের কণ্ঠকে বলেন, শিক্ষকদের আধুনিক ও নতুন প্রযুক্তি সম্পর্কে দক্ষ করতে বিদেশে নিয়ে গিয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। সেখানে তারা দেড় মাসের মতো প্রশিক্ষণ পাবে।
প্রকল্পে পরামর্শক খাতে ১০০ কোটি টাকা ধরা হয়েছে। অথচ এই প্রকল্পের ভবন নির্মাণের কাজ শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের নিয়মিত কাজ। এই কাজে আদৌ কোনো পরামর্শকের প্রয়োজন নেই বলে মনে করছেন পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তারা।
প্রকল্পের প্রস্তাব সূত্রে জানা গেছে, এই প্রকল্পের মাধ্যমে চট্টগ্রাম ও খুলনা বিভাগে দুটি নতুন কারিগরি শিক্ষক প্রশিক্ষণ কলেজ (টিটিটিসি) প্রতিষ্ঠা করা হবে, ঢাকায় বিদ্যমান টিটিটিসি এবং বগুড়ায় বৃত্তিমূলক শিক্ষক প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট (ভিটিটিআই) সম্প্রসারণ ও আধুনিকীকরণ করা হবে। প্রকল্পটির মাধ্যমে প্রায় এক হাজার ২৩৫ জন কারিগরি শিক্ষক ও কর্মকর্তার জন্য উচ্চস্তরের প্রশিক্ষণ এবং বিদেশে উচ্চতর পড়াশোনার সুযোগ প্রদান করবে।
প্রকল্পটিতে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে দুই হাজার ৯ কোটি টাকা। যার মধ্যে সরকার দেবে ২০৯ কোটি টাকা আর এডিবি দেবে এক হাজার ৮০০ কোটি টাকা। যদিও প্রথম প্রস্তাবে ব্যয় ধরা হয়েছিল দুই হাজার ৪৫৮ কোটি টাকা। পিইসি সভায় ৪৪৯ কোটি টাকা ব্যয় কমানো হয়েছে তার পরও ব্যয় বেশি। প্রকল্পটি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় অনুমোদন পেলে বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ড (বিটিইবি) ২০২৯ সালের জুনের মধ্যে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে।