স্বামীর দিনমজুরির আয় পরিবারের একমাত্র ভরসা। সামান্য আয়ে অর্ধাহার-অনাহার নিত্যদিনের সঙ্গী। সংসারের এমন দুরবস্থায় স্বামীকে সহযোগিতার প্রবল ইচ্ছা স্ত্রীর। এ জন্য কাজের সন্ধান করেছিলেন বিভিন্ন স্থানে।
কাজ জুটিয়েছিলেন পাশের গ্রামের একটি কারখানায়, কিন্তু বাধা হয়ে দাঁড়ায় বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন দুই সন্তান। শারীরিক অক্ষমতায় (প্রতিবন্ধী) সন্তান দুটি চলাফেরা করতে পারে না। খেতেও পারে না নিজ হাতে। মুখে তুলে খাইয়ে দিতে হয়। এই কাজে একমাত্র ভরসা তাদের মা। এ জন্য ওই নারী ভাবতে শুরু করেন বাড়িতেই কী করে অর্থ উর্পাজনের ব্যবস্থা করা যায়। তাহলে সন্তান দেখভালের সঙ্গে সঙ্গে চলবে কাজও। সেই কাজের আয়ে পরিবারে ফেরাতে পারবেন সচ্ছলতা। কিছুটা হলেও সুখ আসবে সংসারে। দীর্ঘদিনের চেষ্টায়ও পূরণ হচ্ছিল না তাঁর সে স্বপ্ন। অসহায় নারীর সেই অধরা স্বপ্ন পূরণ করল বসুন্ধরা গ্রুপ। বসুন্ধরা শুভসংঘের উদ্যোগে বিনামূল্যে কাপড় কাটা ও সেলাই প্রশিক্ষণের পর বসুন্ধরা গ্রুপের পক্ষ থেকে তাঁকে দেওয়া হয়েছে একটি সেলাই মেশিন। গল্পটি নীলফামারী সদর উপজেলার খোকসাবাড়ী গ্রামের মনিরা আক্তারের (২৭)।
গত ১৬ মার্চ (রবিবার) সকাল ১১টার দিকে জেলা সদরের খোকসাবাড়ী ইউনিয়নের পূর্ব খোকসাবাড়ী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে আয়োজিত অনুষ্ঠানে তাঁকে এই সেলাই মেশিন প্রদান করা হয়। ওই অনুষ্ঠানে মনিরার মতো সেলাই মেশিন পান অসচ্ছল পরিবারের ২০ জন দরিদ্র নারী। সবারই প্রবল ইচ্ছা সেলাই মেশিন চালানোর আয়ে সুখ ফেরাবেন সংসারে।

মনিরা জানান, প্রায় এক যুগ আগে খোকসাবাড়ী গ্রামের মো. মনিরুজ্জামানের সঙ্গে বিয়ে হয় তাঁর। এরপর ঘরে আসে বেবী আক্তার (১০) ও বাবু মোজাহিদ নামের দুই সন্তান। জন্ম থেকেই প্রতিবন্ধিতা নিয়ে তারা আসে মনিরার কোলে। এর পর থেকে নানা হতাশায় কাটতে থাকে মনিরা-মনিরুজ্জামান দম্পতির জীবন। তাঁদের দুই সন্তানই কথা বলতে পারে না, একা একা চলাফেরা করতে পারে না, খেতে পারে না নিজের হাতে। এ জন্য সার্বক্ষণিক তাদের তদারকির কাজে বাড়িইে থাকতে হয় মা মনিরাকে। দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্নপূরণে সেলাই মেশিন পেয়ে খুবই আনন্দিত মনিরা। স্বপ্নপূরণের অনুভূতি প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘সংসারোত খুব কষ্ট। স্বামীর কিষান খাটার কামাই দিয়া ছয়টা মানসির খাবার জুটে না। কষ্টের কারণে মনটা চায় কোন কামকাজ করি কামাই করিবার, কিন্তু ছাওয়া দুইটাক থুইয়া বাড়ি থাকি কোনঠে যাবার পারো না। এলা বসুন্ধরার মেশিন দিয়া বাড়িত বসি সেলাইর কাজ করি কামাই করির পারিম। ওইলা কামাই দিয়া হামার (আমাদের) সংসারোত সুখ ফিরিবে।’ মনিরার মতো একই অনুষ্ঠানে সেলাই মেশিন পেয়েছেন আঁখি আক্তার (১৯)। খোকসাবাড়ী ইউনিয়নের খলিশাপচা গ্রামের অলিয়ার রহমানের মেয়ে আঁখি আক্তার পড়েন দ্বাদশ শ্রেণিতে। তাঁর দিনমজুর বাবার গতর খাটার আয়ে চলে সাত সদস্যের পরিবার। তিন বোন ও এক ভাইয়ের মধ্যে আঁখি সবার বড়। অভাব-অনটনের সংসারে এসএসসি পাসের আগেই আঁখির বিয়ের প্রস্তুতি নিয়েছিল পরিবার, কিন্তু আঁখি তাতে রাজি না হয়ে লেখাপড়া শিখে প্রতিষ্ঠিত করতে চান নিজেকে। এমন প্রবল ইচ্ছা নিয়ে এসএসসি পাসের পর ভর্তি হয়েছেন কলেজে, কিন্তু অর্থাভাবে লেখাপড়া প্রায় বন্ধের পথে। সেই সঙ্গে বন্ধের উপক্রম ছোট ভাই-বোনদের লেখাপড়া। গ্রামে টিউশনি করে লেখাপড়া চালানোর উদ্যোগ নিয়ে ব্যর্থ হয়েছেন। কেউই টাকা দিতে চায় না। এ জন্য খুঁজতে শুরু করেন এমন একটি কাজ, যা করে নিজেরসহ ভাই-বোনদের লেখাপড়া চালাতে পারেন। আঁখি আক্তারকে সেলাই মেশিন দিয়ে তাঁর সেই স্বপ্ন পূরণ করেছে বসুন্ধরা গ্রুপ। স্বপ্নপূরণের আনন্দে আঁখি আক্তার বলেন, ‘বাড়িতে সেলাইয়ের কাজ করে লেখাপড়া চালানোর আমার দীর্ঘদিনের স্বপ্ন ছিল, কিন্তু দিনমজুর বাবার আয়ে সেলাই মেশিন কেনার সাধ্য হয়ে ওঠেনি। বসুন্ধরা গ্রুপ আমার সেই স্বপ্ন পূরণ করেছে। এখন বাড়িতে সেলাই কাজের আয়ে আমার ও ভাই-বোনদের লেখাপড়ার খরচ মেটাতে পারব। পাশাপাশি বাবাকে সহযোগিতা করতে পারব।’ সেলাই মেশিন পেয়ে মনিরা ও আঁখির মতো অনুভূতি প্রকাশ করেন সবাই। তাঁদের প্রবল ইচ্ছা সেলাই কাজের আয় দিয়ে পরিবারে সচ্ছলতা ফেরাবেন। দেখা মিলবে একটুখানি সুখের। সেলাই মেশিন বিতরণ অনুষ্ঠানে অতিথি ছিলেন জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট উচ্ছ্বাস রায় ও জেলা জামায়াতে ইসলামীর কর্মপরিষদ সদস্য মো. মনিরুজ্জামান মন্টু। পূর্ব খোকসাবাড়ী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সাজেদা চৌধুরীর সভাপতিত্বে বক্তব্য দেন বসুন্ধরা শুভসংঘের পরিচালক জাকারিয়া জামান। আরো উপস্থিত ছিলেন বসুন্ধরা ফাউন্ডেশনের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা মো. মামুন, কালের কণ্ঠের প্রতিনিধি ভুবন রায় নিখিল, শুভসংঘের কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম সম্পাদক ইয়াছির আরাফাত রাফি, সদস্য ফরিদ মিয়া, আমিনুর রহমান, মো. গোলাম হোসেন, নিউজটোয়েন্টিফোরের জেলা প্রতিনিধি আব্দুর রশীদ শাহ, বসুন্ধরা শুভসংঘের জেলা শাখার সহসাধারণ সম্পাদক গিরেন রায়, সাংগঠনিক সম্পাদক দীপু রায়, সদস্য বেবী, মনি প্রমুখ।