ঢাকা, বৃহস্পতিবার ১০ এপ্রিল ২০২৫
২৭ চৈত্র ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৬

ষষ্ঠ বিমসটেক শীর্ষ সম্মেলন ও ইউনূস-মোদি বৈঠক

  • ড. সুজিত কুমার দত্ত
শেয়ার
ষষ্ঠ বিমসটেক শীর্ষ সম্মেলন ও ইউনূস-মোদি বৈঠক

গত ৩ ও ৪ এপ্রিল ব্যাঙ্ককে অনুষ্ঠিত ষষ্ঠ বিমসটেক (বেঙ্গল ইনিশিয়েটিভ ফর মাল্টিসেক্টরাল টেকনিক্যাল অ্যান্ড ইকোনমিক কো-অপারেশন) শীর্ষ সম্মেলন দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সহযোগিতার নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। এই সম্মেলনে বাংলাদেশ, ভারত, মায়ানমার, থাইল্যান্ড, নেপাল, ভুটান ও শ্রীলঙ্কার নেতারা অংশগ্রহণ করেন। বিশেষ করে সম্মেলনের পার্শ্বক্রমে বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির মধ্যকার বৈঠক আঞ্চলিক কূটনীতিতে নতুন সমীকরণ সৃষ্টি করেছে। সম্মেলনে সদস্য দেশগুলো বাণিজ্য ও পরিবহন সহযোগিতা বৃদ্ধির পাশাপাশি দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় সমন্বিত প্রচেষ্টার ওপর জোর দেয়।

মায়ানমারে সংঘটিত ৭.৭ মাত্রার ভূমিকম্পে তিন হাজারেরও বেশি মানুষের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করে এবং সম্মিলিতভাবে দুর্যোগ মোকাবেলায় প্রস্তুতি গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়।

ব্যাঙ্ককে অনুষ্ঠিত শীর্ষ সম্মেলনের ফাঁকে বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির মধ্যে অনুষ্ঠিত আধাঘণ্টার দ্বিপক্ষীয় বৈঠকটি আঞ্চলিক কূটনীতির প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। এই বৈঠকটি এমন এক সময়ে অনুষ্ঠিত হলো, যখন ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যকার দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক বেশ টানাপড়েনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে শেখ হাসিনার ক্ষমতাচ্যুতির পর থেকে দুই দেশের মধ্যে আনুষ্ঠানিক কূটনৈতিক যোগাযোগ অনেকটাই সীমিত হয়ে পড়েছিল।

শুধু অভিনন্দনবার্তা, স্বাধীনতা দিবসের শুভেচ্ছা এবং প্রধানমন্ত্রী মোদির পক্ষ থেকে ইউনূসকে ঈদের শুভেচ্ছা জানানো ছাড়া আর তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য কূটনৈতিক তৎপরতা দেখা যায়নি। এই পরিস্থিতিতে ইউনূস-মোদি বৈঠকটি দুই দেশের মধ্যে পুনরায় কূটনৈতিক যোগাযোগের পথ খুলে দিতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। বিমসটেক শীর্ষ সম্মেলনের নৈশভোজেও ইউনূস ও মোদি পাশাপাশি বসেছিলেন এবং তাঁদের মধ্যে বেশ কিছুক্ষণ আলাপচারিতা হয়। এই ঘটনাও দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্কের বরফ গলানোর ইঙ্গিত দেয়।

এই পরিস্থিতিতে ইউনূস-মোদি বৈঠকটি নতুন করে আলোচনার জন্ম দিয়েছে এবং আঞ্চলিক ভূ-রাজনীতিতে নতুন সমীকরণের ইঙ্গিত দিচ্ছে। বৈঠকের পর বাংলাদেশের প্রেস সচিবের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, দুই সরকারপ্রধানের মধ্যে পারস্পারিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম ছিল শেখ হাসিনার প্রত্যর্পণ। এ ছাড়া সীমান্ত হত্যা, তিস্তা নদীর পানিবণ্টনসহ অন্যান্য দ্বিপক্ষীয় ইস্যু নিয়েও আলোচনা হয়েছে। প্রেস সচিবের মতে, বৈঠকটি অত্যন্ত গঠনমূলক ও ফলপ্রসূ ছিল এবং দুই দেশের মধ্যে পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট সব বিষয়ে আলোচনা হয়েছে।

https://asset.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/1.Print/2025/04.April/06-04-2025/Sohan/kalerkantho-ed-2a.jpgইউনূস-মোদি বৈঠকের ফলাফল এবং এর প্রভাব আঞ্চলিক ভূ-রাজনীতিতে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলতে পারে। বিশেষ করে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি এবং আঞ্চলিক নিরাপত্তা পরিস্থিতির ওপর এই বৈঠকের প্রভাব পড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বৈঠকে হাসিনার প্রত্যর্পণের বিষয়টি উত্থাপন করা হয়েছে বলে জানা গেছে। এই বিষয়টি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে অত্যন্ত সংবেদনশীল। সীমান্ত হত্যা ও নিরাপত্তা পরিস্থিতি দুই দেশের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। বৈঠকে এই বিষয়ে আলোচনা হওয়ায় সীমান্ত হত্যা বন্ধে এবং নিরাপত্তা পরিস্থিতি উন্নয়নে দুই দেশের মধ্যে সহযোগিতা বৃদ্ধির সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। তবে এই বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা না হলে সীমান্তে উত্তেজনা বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কা থেকেই যায়। তিস্তা নদীর পানিবণ্টন দুই দেশের মধ্যে একটি দীর্ঘস্থায়ী সমস্যা। বৈঠকে এই বিষয়ে আলোচনা হওয়ায় সমস্যা সমাধানে নতুন করে আলোচনার পথ খুলেছে। তবে এই বিষয়ে কোনো চূড়ান্ত সমাধান না হলে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি ঘটতে পারে।

বিমসটেক আঞ্চলিক সহযোগিতা বৃদ্ধির একটি গুরুত্বপূর্ণ ফোরাম। এই শীর্ষ সম্মেলনের ফাঁকে ইউনূস-মোদি বৈঠক অনুষ্ঠিত হওয়ায় এই ফোরামের গুরুত্ব আরো বৃদ্ধি পেয়েছে। আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিমসটেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। ইউনূস-মোদি বৈঠকের ফলাফল এবং এর প্রভাব আঞ্চলিক ভূ-রাজনীতিতে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলতে পারে। এই বৈঠকের মাধ্যমে দুই দেশের মধ্যে পুনরায় কূটনৈতিক যোগাযোগের পথ খুলেছে এবং আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে নতুন করে আলোচনার সুযোগ তৈরি হয়েছে। তবে এই আলোচনার ফলাফল নির্ভর করবে দুই দেশের সরকারপ্রধানদের সদিচ্ছার ওপর। আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা ও উন্নয়নের স্বার্থে দুই দেশের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখা অত্যন্ত জরুরি।

বিমসটেক সদস্য দেশগুলো বাণিজ্য, পরিবহন ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় সহযোগিতা বৃদ্ধির প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছে। বাংলাদেশের চেয়ারম্যানশিপে এই উদ্যোগগুলো বাস্তবায়নে নতুন গতি আসবে বলে আশা করা যায়। তবে মায়ানমারের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও অন্যান্য দ্বিপক্ষীয় চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করাও জরুরি। ড. ইউনূস ও নরেন্দ্র মোদির বৈঠক দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে ইতিবাচক পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়। মায়ানমারের ভূমিকম্প ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্য চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করছে। সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলা করে বিমসটেক সদস্য দেশগুলো উন্নয়ন ও স্থিতিশীলতার পথে এগিয়ে যেতে পারে।

 

লেখক : অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

datta.ir@cu.ac.bd

মন্তব্য

সম্পর্কিত খবর

যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কারোপ এবং বাংলাদেশের আমদানি বৃদ্ধি

    মো. নাঈমুল ইসলাম ফারহান
শেয়ার
যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কারোপ এবং বাংলাদেশের আমদানি বৃদ্ধি

সম্প্রতি বাংলাদেশ থেকে পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র ৩৭ শতাংশ পারস্পরিক শুল্ক আরোপ করেছে। এতে বাংলাদেশের রপ্তানি খাত, বিশেষ করে তৈরি পোশাক শিল্পে উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়েছে। আমদানির চেয়ে রপ্তানি খাতে এগিয়ে থাকায় বাংলাদেশ মার্কিন অর্থনীতির ওপর মারাত্মকভাবে নির্ভরশীল। এর ওপর সেই রপ্তানির ৮০ শতাংশেরও বেশি তৈরি পোশাক শিল্পের ওপর নির্ভর করে।

এমতাবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রের এমন একটি পদক্ষেপ বাংলাদেশের জন্য বেশ কঠিন পরিস্থিতি তৈরি করেছে।

বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরে আমেরিকান বাজারে শুল্কমুক্ত বা কম শুল্কের সুবিধা উপভোগ করে এলেও আমেরিকা বাংলাদেশের বাজারে একই রকম সুবিধা পায়নি। বরং বাংলাদেশের বাজারে বেশি শুল্ক দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পণ্য আমদানি করা হতো। কিন্তু বর্তমান ৩৭ শতাংশ শুল্কের সিদ্ধান্ত সেই পরিস্থিতিতে বড় একটি পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়।

পারস্পরিক সম-আচরণের মাধ্যমে ওয়াশিংটন এখন ন্যায্য বাণিজ্য সম্পর্কের চেষ্টা করছে। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ সরকার যুক্তরাষ্ট্র থেকে আগের তুলনায় আরো বেশি পণ্য আমদানির এবং বাণিজ্যিক বাধাগুলো দূর করার সিদ্ধান্ত নেয়। প্রশ্ন হলো, যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি বাড়ানো কি বর্ধিত শুল্কের চাপ কমাতে পারবে কিংবা যুক্তরাষ্ট্রের সিদ্ধান্ত কিছুটা হলেও পরিবর্তন করাতে পারবে?

বাংলাদেশ-মার্কিন বাণিজ্য সম্পর্ক দীর্ঘদিন ধরে ভারসাম্যহীনভাবে চলছিল, যা ছিল বাংলাদেশের জন্য বেশি সুবিধাজনক। শুধু ২০২৩ সালেই বাংলাদেশ ১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের সমপরিমাণ পণ্য যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি করেছে।

অন্যদিকে আমদানির পরিমাণ ছিল তুলনামূলকভাবে অনেক কম। ঐতিহাসিকভাবে বাংলাদেশ জেনারালাইজড সিস্টেম অব প্রেফারেন্সেসের (জিএসপি) মতো বাণিজ্য সুবিধা থেকে উপকৃত হয়েছিল, যা বিভিন্ন পণ্যের ওপর শুল্কমুক্ত সুযোগ প্রদান করে। কিন্তু ২০১৩ সালে রানা প্লাজা ধসের পর শ্রম অধিকার এবং নিরাপত্তাজনিত উদ্বেগের কারণ দেখিয়ে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের জিএসপি সুবিধা স্থগিত করে।

বাংলাদেশ-আমেরিকার বাণিজ্য সম্পর্কে বাংলাদেশের বাণিজ্য উদ্বৃত্ত এবং দেশের বাজারে আমেরিকার সীমিত প্রবেশাধিকার থাকার ফলে আমেরিকান নীতিনির্ধারকদের চোখে বিষয়টি একতরফা হিসেবে বিবেচিত হওয়ার আশঙ্কা বেশি। এমতাবস্থায় আরোপিত ৩৭ শতাংশ শুল্ককে বাংলাদেশ-আমেরিকা বাণিজ্য সম্পর্কে উভয় পক্ষের জন্য সমান ক্ষেত্র তৈরির প্রচেষ্টা বলা যেতে পারে কিংবা এই প্রচেষ্টাকে মার্কিন পণ্যের ক্ষেত্রে বাণিজ্যিক বাধা কমানোর জন্য একপ্রকার চাপ হিসেবেও নিতে পারে বাংলাদেশ।

৩৭ শতাংশ শুল্কের এই সময়ে অন্তর্বর্তী সরকার সিদ্ধান্ত নেয় যে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানির পরিমাণ বাড়ানো হবে, যেখানে জরুরি প্রশ্ন হলো আদৌ সেটিতে বাংলাদেশের কোনো লাভ হবে কি না বা হলেও সেটি কতটুকু। আপাতদৃষ্টিতে এই পলিসি বাণিজ্যিক ভারসাম্যহীনতাকে, যেটি যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কারোপের কারণ, কমাতে পারে। মার্কিন পণ্যের আমদানি বৃদ্ধি যুক্তরাষ্ট্রকে এমন একটি বার্তা দিতে পারে, যেখানে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ন্যায্য বাণিজ্য ধরে রাখতে ইচ্ছুক। অর্থাৎ কোনো বাণিজ্যিক ভারসাম্যহীনতা থাকবে না, যেটি ভবিষ্যতে সমঝোতা কিংবা শুল্কমুক্তির সম্ভাবনার দরজা খুলে দিতে পারে।

এই পদ্ধতির বেশ কয়েকটি সম্ভাব্য সুবিধা আছে। প্রথমত, এটি বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক সম্পর্কে বিদ্যমান উত্তেজনা কমাতে পারে এবং যুক্তরাষ্ট্রকে এটি বোঝানো যেতে পারে যে বাংলাদেশ একটি ন্যায্য ও সৌহার্দ্যপূর্ণ বাণিজ্য সম্পর্ক তৈরিতে ইচ্ছুক। দ্বিতীয়ত, আমদানি বৃদ্ধির ফলে কৃষি যন্ত্রপাতি, ওষুধ, প্রযুক্তি এবং শিক্ষা পরিষেবার মতো বিভিন্ন উচ্চমানের আমেরিকান পণ্য আমদানির সুযোগ পাবে বাংলাদেশ। ফলস্বরূপ, বাংলাদেশে স্থানীয় বিভিন্ন শিল্প, সেবা ও অবকাঠামোগত উন্নয়নের সুযোগ বাড়বে এবং দীর্ঘ মেয়াদে উৎপাদনশীলতা ও প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে বাজারব্যবস্থা উন্নত হতে পারে।

তবে সুবিধার পাশাপাশি কিছু ঝুঁকিও রয়েছে। আমদানি বৃদ্ধির সঙ্গে যদি রপ্তানিও একইভাবে না বাড়ানো হয়, তাহলে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি বাড়তে পারে।  পাশাপাশি এমন একটি সময়ে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভেও চাপ পড়তে পারে, যখন মিসর, পাকিস্তান, নাইজেরিয়া কিংবা শ্রীলঙ্কার মতো অনেক উন্নয়নশীল দেশ এরই মধ্যে মুদ্রাস্ফীতি এবং ডলার ঘাটতির সম্মুখীন। তা ছাড়া কৃষি এবং ক্ষুদ্র উৎপাদনকারীসহ বিভিন্ন স্থানীয় শিল্প মার্কিন ভর্তুকিপ্রাপ্ত প্রতিযোগীদের মুখোমুখি হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি তো আছেই। এগুলো যদি ঠিকঠাকভাবে না নিয়ন্ত্রণ করা হয়, তাহলে স্থানীয় শিল্পগুলোর ক্ষতি হতে পারে।

তাই আমদানি বৃদ্ধি তাত্ক্ষণিক সমাধান মনে হলেও এর জন্য দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নের ওপর জোর দেয় এমন কিছু কৌশলগত এবং বাছাইকৃত খাতের ওপর নজর দেওয়া প্রয়োজন। এমন কিছু নয়, যেটি কেবল বাণিজ্য ঘাটতি পূরণ করবে।

মার্কিন পণ্যের আমদানি বৃদ্ধি শুধু অর্থনৈতিক কোনো হিসাব নয়, এটি একটি কূটনৈতিক বার্তাও বটে। যদি কৌশলগতভাবে সামলানো যায়, তাহলে এই পলিসিকে মার্কিন বাণিজ্য প্রতিনিধিদের সঙ্গে সংলাপ শুরু করার এবং ৩৭ শতাংশ শুল্ক প্রত্যাহারে আলোচনার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। কিন্তু এর জন্য প্রথমে বাংলাদেশের একটি স্পষ্ট এবং সুসংগত বাণিজ্যনীতি প্রয়োজন, যেখানে অর্থনৈতিক লক্ষ্যমাত্রা এবং ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতার মাঝে সামঞ্জস্যতা বজায় থাকবে।

এ ক্ষেত্রে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যচুক্তির ভূমিকা নিরূপণ করা যেতে পারে। বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মাঝে বর্তমানে কোনো মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি নেই। তবে আমদানি বৃদ্ধির ফলে ভবিষ্যৎ আলোচনার একটি ভিত্তি তৈরি হতে পারে।

বাংলাদেশের উচিত রপ্তানি ও আমদানি উভয় পণ্যের বৈচিত্র্যের ওপর মনোযোগ দেওয়া। তৈরি পোশাক শিল্প ও অল্প কয়েকটি পণ্যের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতা দেশের অর্থনীতিকে ঝুঁকিতে ফেলে দেয়, বিশেষ করে যখন বৈশ্বিকভাবে এ রকম পলিসির পরিবর্তন ঘটে। একই সঙ্গে মূলধনী পণ্য বা অভোগ্যপণ্য এবং মার্কিন প্রযুক্তির ক্ষেত্রে আমদানি বৈচিত্র্যকরণের মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক সুবিধা পাওয়ার পাশাপাশি বর্তমান বাণিজ্য ঘাটতিও মোকাবেলা করা যেতে পারে।

এখানে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থারও একটি দৃষ্টিভঙ্গি উল্লেখ করা যেতে পারে। পারস্পরিক মাত্রার শুল্কারোপকে ন্যায্য বাণিজ্যের পরিমাপক হিসেবে উপস্থাপন করা হলেও বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে এখানে সূক্ষ্ম পার্থক্য রয়েছে, যেখানে তারা স্বেচ্ছাচারী ও বৈষম্যমূলক বাণিজ্যচর্চা নিরুৎসাহ করে। বাংলাদেশ যদি মনে করে, এমন শুল্ক তাদের প্রতি শাস্তি বা বোঝামূলক কিংবা অসামঞ্জস্যপূর্ণ, তাহলে বিভিন্ন বহুপক্ষীয় প্ল্যাটফর্মে তার উদ্বেগ উপস্থাপন করতে পারে।

৩৭ শতাংশ শুল্ক প্রত্যাহারে মার্কিন পণ্য আমদানি বৃদ্ধি কতটা কার্যকর হতে পারে, তা পরিষ্কার না হলেও কেবল আমেরিকান পণ্যের আমদানি বাড়ানো কোনো লাভজনক সমাধান না-ও হতে পারে। এ ক্ষেত্রে কোনো প্রতিক্রিয়াশীল পদক্ষেপ গ্রহণের পরিবর্তে স্মার্ট ট্রেড ডিপ্লোমেসির প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেওয়া যেতে পারে। বাণিজ্যিক গতিশীলতা বা পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশের উচিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো শক্তিশালী বাণিজ্য অংশীদারদের সঙ্গে যোগাযোগ করার সময় তার আলোচনার ক্ষমতা জোরদার করা এবং স্পষ্ট উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা উপস্থাপন করা। একই সঙ্গে বাংলাদেশ সরকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে উচ্চস্তরের সংলাপ শুরু করার এবং ২০১৩ সালে স্থগিত হওয়া বাণিজ্য সুবিধা পুনরুদ্ধারের উপায় বের করতে পারে।

পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বাংলাদেশে মার্কিন পণ্যের আমদানি তুলনামূলকভাবে কম। মার্কিন আদমশুমারি ব্যুরোর মতে, ২০২৩ সালে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রায় দুই বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করেছে, যেখানে রপ্তানি ১০ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি। এই ভারসাম্যহীনতা শুল্কারোপের একটি কারণ। তবে এটি এও দেখায় যে বাংলাদেশে আমেরিকান পণ্যের বাজার সীমিত।

আমাদের দিক থেকে আমদানি বৃদ্ধির যেকোনো পদক্ষেপ অত্যন্ত কৌশলগত হওয়া উচিত। কেবল একটি সংখ্যা ঠিক করার জন্য অধিক পরিমাণে মার্কিন পণ্য আমদানি করা উচিত নয়। বরং এমন কিছু আমদানি করা উচিত, যা আমাদের প্রবৃদ্ধিতে সহায়তা করে; যেমনউন্নত প্রযুক্তি, মূলধনী পণ্য, উদ্ভাবন।

মার্কিন পণ্য আমদানি বৃদ্ধি বাণিজ্য উত্তেজনা কমাতে সাহায্য করলেও করতে পারে, তবে একটি পরিমাপিত, দীর্ঘমেয়াদি পদ্ধতির প্রয়োজন। বাণিজ্য কেবল ব্যালান্স শিটের কোনো বিষয় নয়, বরং এমন অংশীদারি গড়ে তোলারও বিষয়, যা জাতীয় উন্নয়নের লক্ষ্য অর্জনকে ত্বরান্বিত করে।

লেখক : স্বাধীন গবেষক, ডেভেলপমেন্ট ইকোনমিকস ঢাকা স্কুল অব ইকোনমিকস, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় 

farhanmdnaimulislam@gmail.com

 

মন্তব্য

বাংলাদেশের নেতৃত্বে নতুন মাত্রা পাবে আঞ্চলিক সহযোগিতা

    এ কে এম আতিকুর রহমান
শেয়ার
বাংলাদেশের নেতৃত্বে নতুন মাত্রা পাবে আঞ্চলিক সহযোগিতা

গত ৪ এপ্রিল থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাঙ্ককে অনুষ্ঠিত হলো ষষ্ঠ বিমসটেক শীর্ষ সম্মেলন। শীর্ষ সম্মেলনের আগে ২ এপ্রিল বিমসটেকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের এবং ৩ এপ্রিল বিমসটেকের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন সদস্য সাত দেশের সরকারপ্রধানরা। বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ওই সম্মেলনে অংশগ্রহণ করার জন্য ৩ এপ্রিল সকালেই ব্যাঙ্ককে পৌঁছেন এবং সম্মেলন শেষে ৪ এপ্রিল রাতে দেশে ফিরে আসেন।

শীর্ষ সম্মেলনের সাইডলাইনে সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী নেতাদের সঙ্গেও বেশ কয়েকটি বৈঠকে তিনি মিলিত হন। সম্মেলনে আগামী দুই বছরের জন্য বাংলাদেশকে বিমসটেকের পরবর্তী চেয়ারম্যানের দায়িত্ব দেওয়া হয় এবং প্রধান উপদেষ্টা তা গ্রহণ করেন। তিনি বিমসটেক সহযোগিতাকে এগিয়ে নিতে অন্যান্য সদস্য রাষ্ট্রের সঙ্গে সহযোগিতামূলকভাবে কাজ করার জন্য বাংলাদেশের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেন। আশা করা হচ্ছে, বাংলাদেশের নেতৃত্বে আঞ্চলিক সহযোগিতা নতুন মাত্রা পাবে।

দুই.

সমৃদ্ধ, সহিষ্ণু এবং উন্মুক্ত বিমসটেক ছিল এবারের শীর্ষ সম্মেলনের প্রতিপাদ্য বিষয়। সম্মেলনের লক্ষ্য ছিল নিরাপত্তা ও উন্নয়ন চ্যালেঞ্জ একত্রে মোকাবেলা করার জন্য সদস্য রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে সহযোগিতা জোরদার করা। উপস্থিত নেতারা তাঁদের বিবৃতিতে বিমসটেকের প্রতি তাঁদের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করার সঙ্গে সঙ্গে আঞ্চলিক সহযোগিতার অগ্রাধিকারের ক্ষেত্রগুলো চিহ্নিত এবং সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব ও উদ্যোগ উপস্থাপন করেন। তাঁরা আন্ত আঞ্চলিক বাণিজ্য ও বিনিয়োগ, সংযোগ, পর্যটন, সংস্কৃতি বিনিময়, জলবায়ু কর্মকাণ্ড, সবুজ ও নবায়নযোগ্য শক্তি, টেকসই কৃষি, খাদ্য নিরাপত্তা, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা এবং নিরাপত্তা বাড়াতে অগ্রগতি অর্জনের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন।

সম্মেলনে গৃহীত ব্যাঙ্কক ঘোষণাপত্রে ভবিষ্যৎ সহযোগিতার জন্য তাঁদের সিদ্ধান্ত ও নির্দেশনার রূপরেখার উল্লেখ রয়েছে। একই সঙ্গে বিমসটেকের দৃষ্টিভঙ্গি অর্জনে সদস্য রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে ভবিষ্যতে সহযোগিতার জন্য একটি বিস্তৃত ও বাস্তবসম্মত রোডম্যাপ ব্যাঙ্কক ভিশন ২০৩০ গৃহীত হয়।

শীর্ষ সম্মেলনে এই অঞ্চলে বাণিজ্য সম্প্রসারণ, যোগাযোগ নেটওয়ার্ক এবং মানব নিরাপত্তাকে প্রাধান্য দিয়ে ব্যাঙ্কক ভিশনসহ যে ছয়টি দলিলের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে সেগুলো হলো : (১) ব্যাঙ্কক ভিশনটি ২০৩০ সালের মধ্যে বিমসটেককে আরো সমৃদ্ধ, শক্তিশালী এবং উন্মুক্ত করে তোলার জন্য প্রথম একটি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা। বিমসটেক সদস্য রাষ্ট্রগুলোর জনগণের মধ্যে সংযোগ বৃদ্ধি এবং নতুন সম্ভাবনা অনুসন্ধানকে লালন করার কথা বলা হয়েছে। (২) ষষ্ঠ বিমসটেক শীর্ষ সম্মেলন ঘোষণাপত্রে বিমসটেক এবং ব্যাঙ্কক ভিশন ২০৩০-এর প্রতি নেতাদের দৃঢ় সমর্থন ব্যক্ত করা হয়েছে।

(৩) বিমসটেকের কার্যপ্রণালীর নিয়মাবলিতে বিমসটেককে আরো সুষ্ঠু ও দক্ষতার সঙ্গে বাংলাদেশের নেতৃত্বে নতুন মাত্রা পাবে আঞ্চলিক সহযোগিতাকাজ করতে সহায়তা করার জন্য নিয়মাবলি নির্ধারণ করা হয়েছে। (৪) বিমসটেক বিশিষ্ট ব্যক্তিদের গ্রুপের প্রতিবেদনে বিমসটেককে সংস্কার ও পুনরুজ্জীবিত করার জন্য বেশ কয়েকটি সুপারিশ রয়েছে। ভিশন ২০৩০-এর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বিমসটেকের কিভাবে এগিয়ে যাওয়া উচিত সে সম্পর্কে এই প্রতিবেদনটি সহায়ক পরামর্শ দেবে। (৫) সামুদ্রিক পরিবহন সহযোগিতা চুক্তিদক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যে সমুদ্র পরিবহন উন্নত করার জন্য একটি নতুন চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। এটি জাহাজীকরণ খরচ কমাতে, বাণিজ্য দ্রুততর করতে এবং পণ্য ও মানুষের জন্য অঞ্চলজুড়ে চলাচল সহজতর করতে সহায়তা করবে। এ ছাড়া বিমসটেক ও ইন্ডিয়ান ওশান রিম অ্যাসোসিয়েশনের (আইওআরএ) মধ্যে এবং বিমসটেক ও জাতিসংঘের মাদক অপরাধ নিয়ন্ত্রক অফিসের (ইউএনওডিসি) মধ্যে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। (৬) মায়ানমার ও থাইল্যান্ডের ভূমিকম্পের বিষয়ে যৌথ বিবৃতিএই বিবৃতিতে নেতারা সাম্প্রতিক ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্তদের প্রতি সহানুভূতি ও সমর্থন প্রকাশ করেন। তাঁরা দুর্যোগ প্রতিক্রিয়া এবং প্রস্তুতির ক্ষেত্রে আরো ঘনিষ্ঠভাবে একসঙ্গে কাজ করার প্রতিশ্রুতিও পুনর্ব্যক্ত করেন।

তিন.

বাংলাদেশের জন্য বিমসটেক শীর্ষ সম্মেলন আরেকটি কারণেও গুরুত্ব বহন করে। সেটি হলো নানা জল্পনাকল্পনার অবসানে অনুষ্ঠিত প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর বৈঠকটি। বৈঠকে তাঁরা পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে কথা বলেন। প্রধান উপদেষ্টা তাঁর বক্তব্যে শেখ হাসিনাকে ফেরত দেওয়ার বিষয়টি উত্থাপন করা ছাড়াও সীমান্তে হত্যা বন্ধ, গঙ্গা চুক্তির ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশনা, তিস্তা নদীর পানিবণ্টন ইত্যাদি বিষয়ের উল্লেখ করেন। তিনি শেখ হাসিনার বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে দেওয়া উসকানিমূলক মন্তব্যের উল্লেখ করে ভারতে থাকাকালে তাঁকে এ ধরনের উসকানিমূলক বক্তব্য দেওয়া থেকে বিরত রাখতে প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ জানান। প্রধান উপদেষ্টা জুলাই গণ-অভ্যুত্থান নিয়েও কথা বলেন। 

অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী মোদি শেখ হাসিনার মন্তব্য ঘিরে উত্তেজনার জন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে দায়ী করে বলেন, ভারতের সম্পর্ক দেশের সঙ্গে, কোনো ব্যক্তি বা রাজনৈতিক দলের সঙ্গে নয়। তিনি বাংলাদেশে দ্রুত অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠায় ভারতের প্রত্যাশার কথা বলেন। তিনি অবৈধভাবে সীমান্ত অতিক্রম প্রতিরোধ ব্যবস্থার ওপর গুরুত্ব দেন এবং হিন্দু ও অন্যান্য সংখ্যালঘুর নিরাপত্তা ও সুরক্ষার ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। প্রধানমন্ত্রী মোদি বাংলাদেশে শান্তি, স্থিতিশীলতা, অন্তর্ভুক্তি ও গণতন্ত্রের প্রতি ভারতের সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করেন। তিনি ভারত ও বাংলাদেশের সম্পর্ক পর্যালোচনা এবং এগিয়ে নেওয়ার জন্য দুই দেশের প্রতিনিধিদের বৈঠকের বিষয়ও উল্লেখ করেন।

চার.

শীর্ষ সম্মেলনের সাইডলাইনে প্রধান উপদেষ্টা থাইল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী পেতংতার্ন সিনাওয়াত্রার সঙ্গে বৈঠক করেন। তাঁরা বিভিন্ন দ্বিপক্ষীয় বিষয় নিয়ে কথা বলেন। প্রধান উপদেষ্টা থাইল্যান্ড ভ্রমণকারী বাংলাদেশি নাগরিকদের, বিশেষ করে চিকিৎসা নিতে আসা বাংলাদেশিদের জন্য ভিসা প্রক্রিয়া সহজ করতে থাই প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করেন। থাই প্রধানমন্ত্রী বিষয়টি খতিয়ে দেখার আশ্বাস দেন। প্রধান উপদেষ্টা রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে থাইল্যান্ডের সমর্থন কামনা করেন। তিনি দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য, জাহাজ চলাচল, সমুদ্র সম্পর্ক এবং বিমান যোগাযোগ সম্প্রসারণেরও আহ্বান জানান। থাই প্রধানমন্ত্রী বিমসটেকের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব গ্রহণের জন্য ড. ইউনূসকে অভিনন্দন জানিয়ে বলেন, বাংলাদেশের নেতা আঞ্চলিক গোষ্ঠীতে নতুন গতিশীলতা সঞ্চার করবেন।

প্রধান উপদেষ্টা থাইল্যান্ডের প্রয়াত রাজা ভূমিবলের প্রতি শ্রদ্ধা জানান, যিনি ১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশকে থাইল্যান্ডের প্রাথমিক স্বীকৃতি প্রদানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। বাংলাদেশে থাই বিনিয়োগ প্রসঙ্গে ড. ইউনূস এ মাসে ঢাকায় অনুষ্ঠেয় বিনিয়োগ শীর্ষ সম্মেলনে যোগদানের জন্য থাই কম্পানিগুলোকে আমন্ত্রণ জানান। তিনি থাইল্যান্ড, ভারত ও মায়ানমারের সঙ্গে ত্রিপক্ষীয় মহাসড়ক প্রকল্পে অংশগ্রহণে বাংলাদেশের আগ্রহের কথাও তুলে ধরেন। প্রধান উপদেষ্টা দুই দেশের মধ্যে আনুষ্ঠানিক আলোচনা শুরু করার লক্ষ্যে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দ্বিপক্ষীয় মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির জন্য একটি যৌথ সম্ভাব্যতা সমীক্ষা শুরু করার প্রস্তাব রাখেন।

দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে যৌথভাবে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এবং থাইল্যান্ডের জাতীয় দুর্নীতি দমন কমিশনের (এনএসিসি) মধ্যে একটি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষরিত হয়। স্মারক অনুযায়ী উভয় দেশ দুর্নীতি প্রতিরোধে প্রাসঙ্গিকতার প্রাথমিক তথ্য দেবে, তথ্য সংগ্রহের সর্বোত্তম কর্মপদ্ধতি বিনিময়, তথ্য বিনিময়, যৌথ প্রকল্প গ্রহণ, অংশীদারি সমীক্ষা এবং প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে দুর্নীতি প্রতিরোধ ও দমনের ক্ষেত্রে অন্যান্য সহযোগিতামূলক কার্যক্রম সম্পাদন করবে। বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা ও থাইল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী ওই স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।

পাঁচ.

সম্মেলনের সাইডলাইনে প্রধান উপদেষ্টা শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী হরিণী আমারাসুরিয়ার সঙ্গে বৈঠক করেন। বৈঠকে তাঁরা পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করেন এবং দুই বন্ধু দেশের মধ্যে বাণিজ্য ও সহযোগিতা সম্প্রসারণের প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেন। শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী চুরি যাওয়া অর্থ উদ্ধারে তাঁর দেশের প্রচেষ্টা বর্ণনা করে বলেন, পুনরুদ্ধারপ্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করার জন্য শ্রীলঙ্কার সংসদ একটি নতুন আইন অনুমোদন করেছে। প্রধান উপদেষ্টা বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া কোটি কোটি ডলার ফিরিয়ে আনার জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের প্রচেষ্টায় শ্রীলঙ্কার সমর্থন কামনা করেন। তাঁরা দুই দেশের মধ্যে জনগণের সঙ্গে যোগাযোগের গুরুত্বের ওপর জোর দেন। ড. ইউনূস তাঁর সরকারের সংস্কার এজেন্ডা উল্লেখ করে আগামী বছরের ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে বাংলাদেশে নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা জানান।

প্রধান উপদেষ্টার আরেকটি দ্বিপক্ষীয় বৈঠক হয় ভুটানের প্রধানমন্ত্রী দাশো শেরিং টোবগের সঙ্গে। দুই নেতা উভয় দেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়াদি নিয়ে কথা বলেন। প্রধানমন্ত্রী টোবগে বাংলাদেশের কাছ থেকে একটি সম্পূর্ণ নিবেদিত ফাইবার অপটিক ইন্টারনেট সংযোগ প্রদানের অনুরোধ জানালে প্রধান উপদেষ্টা এই বিষয়ে তাঁর সর্বাত্মক সহযোগিতার আশ্বাস দেন। তাঁরা দুই প্রতিবেশীর মধ্যে বাণিজ্য ও সংযোগ বৃদ্ধির ওপর জোর দেন। প্রধান উপদেষ্টা ঢাকায় অনুষ্ঠেয় বিনিয়োগ শীর্ষ সম্মেলনে ভুটানের বিনিয়োগকারীদের একটি প্রতিনিধিদল পাঠানোর জন্য প্রধানমন্ত্রী শেরিংকে অনুরোধ করেন। তাঁরা বাংলাদেশের কুড়িগ্রামে ভুটানের জন্য নির্ধারিত অর্থনৈতিক অঞ্চলের উন্নয়ন নিয়েও আলোচনা করেন। প্রধান উপদেষ্টা বাংলাদেশে ভুটানের শিক্ষার্থীদের, বিশেষ করে চিকিৎসাশাস্ত্র অধ্যয়নের সুযোগ আরো বাড়ানোর কথা জানান। ভুটানের প্রধানমন্ত্রী বিমসটেকের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব গ্রহণের জন্য বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টাকে অভিনন্দন জানিয়ে আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, বঙ্গোপসাগরকেন্দ্রিক আঞ্চলিক গোষ্ঠী বাংলাদেশের নেতৃত্বে একটি নতুন গতিশীলতা দেখতে পাবে।

এ ছাড়া সম্মেলনকালে বিমসটেকের নতুন চেয়ারম্যান বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন বিমসটেকের মহাসচিব ইন্দ্র মণি পাণ্ডে। তাঁরা বিমসটেকের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড ও অগ্রাধিকারের রূপরেখা নিয়ে কথা বলেন।

সম্মেলনকালে মায়ানমারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী উ থান সোয়ে বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টার প্রতিনিধি ড. খলিলুর রহমানকে জানান, মায়ানমার কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া আট লাখের (মায়ানমার কর্তৃপক্ষের মতে) তালিকার মধ্যে এক লাখ ৮০ হাজার রোহিঙ্গাকে মায়ানমারে ফিরে যাওয়ার জন্য যোগ্য হিসেবে চিহ্নিত করেছে। তারা শিগগিরই আরো ৭০ হাজার রোহিঙ্গার যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়া পরিচালনা করবে।  

ছয়.

ব্যাঙ্ককে বিমসটেক শীর্ষ সম্মেলনে স্বাভাবিক নিয়মেই বাংলাদেশকে আগামী দুই বছরের জন্য চেয়ারম্যানের দায়িত্বভার প্রদান করা হয়েছে। বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস সেই দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। এ উপলক্ষে দেওয়া বিবৃতিতে তিনি বিমসটেক সহযোগিতাকে এগিয়ে নিতে অন্যান্য সদস্য রাষ্ট্রের সঙ্গে সহযোগিতামূলকভাবে কাজ করার জন্য বাংলাদেশের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেন। বলার অপেক্ষা রাখে না যে সদস্য রাষ্ট্রগুলোর আন্তরিক সহযোগিতার ওপরই নির্ভর করে বিমসটেকের কর্মকাণ্ডের সফলতা। 

এই দায়িত্ব পালনকালে বাংলাদেশকে অনেক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে। আর সেসব উত্তরণে সঠিক ভূমিকা পালন করতে পারলে বিমসটেককে একটি প্রশংসনীয় অবস্থানে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে। অন্যদিকে এ সময় বিমসটেককেন্দ্রিক সব কর্মকাণ্ডে সদস্য সাত দেশের নেতা ও কর্মকর্তাদের মধ্যে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে যে যোগসূত্র স্থাপিত হবে, তা ওই সব দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে দৃঢ়তর করার সুযোগও সৃষ্টি করবে। এ ছাড়া নেতৃত্ব পর্যায়ের ব্যক্তিগত সংযোগ এবং বোঝাপড়া বাংলাদেশের অবস্থানকে আঞ্চলিক পর্যায়ে আরো শক্তিশালী ও আস্থাভাজন করার সুযোগ এনে দেবে।

এই শীর্ষ সম্মেলনেই অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে ড. ইউনূস প্রথমবারের মতো ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেন। তাঁদের মধ্যে অনুষ্ঠিত গঠনমূলক ও ফলপ্রসূ আলোচনা দুই দেশের সম্পর্কে যে টানাপড়েনের সৃষ্টি হয়েছে, তা প্রশমনে কার্যকর ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা যায়।  

রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন নিয়ে মায়ানমারের অবস্থান নিয়ে সন্দেহ এড়ানো কঠিন। কারণ মায়ানমার এর আগে কয়েকবার এ ধরনের ছলনার আশ্রয় নিয়েছে। তার পরও মায়ানমারের বর্তমান অবস্থা, বিশেষ করে বিরাজমান সশস্ত্র সংঘাত, রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ভিটামাটিতে শান্তিপূর্ণ, সম্মানজনক এবং নিরাপদ প্রত্যাবাসনে কতটুকু সহায়ক হবে, সে প্রশ্নটি থেকেই যায়। এ ছাড়া এ ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সংস্থার অসম্মতিও উত্থাপিত হওয়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। সর্বোপরি কবে থেকে এবং কিভাবে কতজন করে কাঙ্ক্ষিত প্রত্যাবাসন শুরু হবে, সেসবের একটি পরিপূর্ণ পরিকল্পনার প্রয়োজনও রয়েছে। আর এসব নিয়ে আলোচনার জন্য দুই পক্ষের (প্রয়োজনে জাতিসংঘের সংশ্লিষ্ট সংস্থাকে সঙ্গে নিয়ে) আলোচনায় বসা আবশ্যক।

লেখক : সাবেক রাষ্ট্রদূত ও সচিব

 

মন্তব্য

এবার ট্রাম্পের লক্ষ্যবস্তু কি ইরান

    ড. ফরিদুল আলম
শেয়ার
এবার ট্রাম্পের লক্ষ্যবস্তু কি ইরান

এবারের মেয়াদে দায়িত্ব গ্রহণের আগে থেকেই ডোনাল্ড ট্রাম্প বেশ আগ্রাসী মেজাজে ছিলেন, যা তাঁর দায়িত্ব গ্রহণের পরও অব্যাহত রয়েছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে যখন দুই পক্ষের মধ্যে আলোচনা চলমান রয়েছে এমন অবস্থায় তিনি রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের উদ্দেশেও হুঁশিয়ারি বাক্য উচ্চারণ করতে দ্বিধা করেননি। স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছেন, পুতিন যদি যুদ্ধবিরতি চুক্তি স্বাক্ষর না করেন তাহলে রাশিয়ার ওপর নতুন করে নিষেধাজ্ঞা আরোপের বাইরেও যেসব দেশ রাশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক রক্ষা করে চলবে তাদের ওপর তিনি অতিরিক্ত করের বোঝা আরোপ করবেন। এই ধারাবাহিকতায় নতুন করে যুক্ত হয়েছে ইরান।

তিনি তাঁর দায়িত্ব গ্রহণের আগে থেকেই পরোক্ষভাবে ইরানের ওপর নানাভাবে কঠোর বার্তা দিয়েছিলেন। বিশেষ করে হামাস-ইসরায়েলের মধ্যে যুদ্ধবিরতি চুক্তি স্বাক্ষর না হলে এর জন্য দায়ীদের নরকের স্বাদ ভোগ করতে হবেএ ধরনের বক্তব্যের মধ্য দিয়ে কার্যত তিনি হামাসের সঙ্গে ইরানকেও সতর্ক করেন।

এখানে একটি বিষয় বোঝার অবকাশ রয়েছে, আর তা হলো হামাস যতই চুক্তির প্রতি মান্যতা প্রদর্শন করুক না কেন, এই অঞ্চলে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের মূল এবং অভিন্ন শত্রু একটাই, আর সেটা ইরান। হামাস-ইসরায়েলের মধ্যকার যুদ্ধবিরতি যদি টেকসই হিসেবে বিরাজ করে, তার পরও ইরানের নিশানা থেকে ইসরায়েলের সুরক্ষিত থাকার কোনো নিশ্চয়তা নেই।

সম্প্রতি ইরানের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কর্মসূচি এমন পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে যে তারা পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির একদম দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে, যা হামাসকে ইসরায়েলের প্রতি হামলায় নিবৃত করতে পারলেও ভবিষ্যতে ইরানের সরাসরি লক্ষ্যবস্তু থেকে ইসরায়েলকে রক্ষা করা বেশ দুরূহ হয়ে দাঁড়াতে পারে। আর তাই কোনো ধরনের রাখঢাক না করে এবার তিনি ইরানের প্রতি কড়া বার্তা দিয়েছেন, আর তা হচ্ছে তাদের পারমাণবিক কর্মসূচি বন্ধ করা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আগামী দুই মাসের মধ্যে একটি চুক্তি করতে হবে, নইলে ইরানের ওপর বোমা হামলা পরিচালনা করা হবে। সেই সঙ্গে রাশিয়ার মতো একই কায়দায় এটাও জানিয়ে রেখেছেন যে ইরানের সঙ্গে যেসব দেশ বাণিজ্য করবে, তাদের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হবে। এর আগে যুক্তরাষ্ট্রের তরফ থেকে এ নিয়ে আলোচনা করার প্রস্তাবকে ইরানের দিক থেকে সরাসরি নাকচ করে দেওয়া হয়েছে।
ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ খোমেনি যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে সম্ভাব্য হামলার পাল্টা এবং কড়া জবাব দেওয়ার হুমকি দিয়েছেন। ফলে স্বভাবতই দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের ক্ষেত্রে এক তুমূল উত্তেজনা বিরাজ করছে এই মুহূর্তে।

এবার ট্রাম্পের লক্ষ্যবস্তু কি ইরানইরানের সর্বোচ্চ নেতার পক্ষ থেকে ট্রাম্পের হুমকির জবাবের পর দেশটির প্রেসিডেন্টের তরফ থেকেও একই বার্তা দিয়ে জানানো হয়েছে যে তারা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সরাসরি আলোচনা না করলেও বরাবরই পরোক্ষ আলোচনার পক্ষে রয়েছে, অর্থাৎ তৃতীয় কোনো দেশের মধ্যস্থতায় তারা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যেতে অনাগ্রহী নয়। এর কিছুদিন আগে ট্রাম্প তাঁর কথিত নিষেধাজ্ঞা বিষয়টি ভেনিজুয়েলার ওপর আরোপ করেছেন। দেশটির তেল ক্রেতাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে একটি নির্বাহী আদেশে সই করেছেন তিনি।

ট্রাম্পের মনোভাব থেকে বোঝা যাচ্ছে, তাঁর দিক থেকে আলোচনার জন্য ইরানকে চিঠি দেওয়ার পর ইরানের তরফ থেকে প্রত্যাখ্যাত হওয়াকে তিনি সহজভাবে মেনে নিতে পারছেন না। সে ক্ষেত্রে তিনি কী করতে পারেন সেটা নিয়ে বিভিন্ন পর্যালোচনা থেকে যা বের হয়ে আসছে তা হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র কিংবা ইসরায়েল ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলো লক্ষ্য করে সরাসরি হামলা চালাতে পারে। আর যদি এমন ঘটনা ঘটে, তাহলে চলমান মধ্যপ্রাচ্য সংকট আরো ঘনীভূত হবে। ইরানের সামরিক প্রস্তুতি নিঃসন্দেহে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের সমন্বিত শক্তির তুলনায় দুর্বল। তার পরও তাদের দিক থেকে পাল্টা হুঁশিয়ারি এটাই ইঙ্গিত করে যে ইরান একা নয় এবং তারা নিশ্চিতভাবেই এক বা একাধিক বড় শক্তি দ্বারা সমর্থনপুষ্ট। কে বা কারা সেই বড় শক্তি, এর সহজ জবাব হচ্ছে রাশিয়া ও চীন। এ ক্ষেত্রে রাশিয়া কিভাবে এবং কতটুকু ইরানের সহায়তায় এগিয়ে আসবে সেটা স্পষ্ট না হলেও সাম্প্রতিক সময়ে দুই দেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত কৌশলগত চুক্তি ইরানকে সম্ভাব্য মার্কিন হামলা থেকে রক্ষা করতে ভূমিকা পালন করতে পারে। এ বছর ১৭ জানুয়ারি স্বাক্ষরিত এই চুক্তির একটি বিশেষ দিক হচ্ছে, দুই পক্ষের যেকোনো পক্ষের ওপর আক্রমণকারীদের সরাসরি হামলার ক্ষেত্রে একে অপরকে সহায়তা দানের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।

ডোনাল্ড ট্রাম্প মধ্যপ্রাচ্যের সংঘাত নিরসনে পুতিনের সঙ্গে গত মাসে আলোচনা করেছেন এবং এ ক্ষেত্রে দুই পক্ষ একত্রে কাজ করার বিষয়ে একমত পোষণ করেছে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চুক্তিতে উপনীত না হলে তাদের ওপর বোমাবর্ষণের বিষয়ে যে হুমকি দেওয়া হয়েছে সে বিষয়ে রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে তীব্র প্রতিবাদ জানানো হয়েছে। দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মূখপাত্র জানিয়েছেন, ইরানের বিরুদ্ধে হুমকি এবং আলটিমেটাম এর কোনোটাকেই আমরা উপযুক্ত মনে করি না এবং আমরা এর নিন্দা জানাই।

গত জানুয়ারি মাসে ক্রেমলিনের পক্ষ থেকে রাশিয়ার মধ্যস্থতায় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইরানের মধ্যে একটি কৌশলগত চুক্তি স্বাক্ষরের আগ্রহ প্রকাশ করা হলেও ইরানের পক্ষ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কোনো ধরনের চুক্তি স্বাক্ষরের বিষয়ে অনীহা প্রকাশ করা হয়। বর্তমান ট্রাম্প প্রশাসনের সময়ে এসে বিষয়টি আরো জটিল হয়ে পড়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে ইরানের অবস্থানের যথেষ্ট যুক্তিও রয়েছে। এর আগে ২০১৫ সালে ইরানের সঙ্গে ছয় জাতির চুক্তি স্বাক্ষরের বিনিময়ে তাদের পরমাণু কর্মসূচি বাতিল করার শর্তে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা শিথিল করা হলেও ২০১৭ সালে ট্রাম্প দায়িত্ব নেওয়ার পর সুস্পষ্ট কোনো কারণ ব্যতিরেকেই যুক্তরাষ্ট্র এই চুক্তি থেকে বের হয়ে যায়। এর পরের ঘটনাগুলো নতুন করে আরো তিক্ততার জন্ম দেয়, যার মধ্যে অন্যতম ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্দেশে ইরানের রিপাবলিকান গার্ডের কমান্ডার কাশেম সোলাইমানিকে হত্যা এবং ইরানের ভেতরে ইসরায়েলের গুপ্তচরবৃত্তিকে উৎসাহ দানের মাধ্যমে তাদের অনেক বিজ্ঞানীকে হত্যা করা। বর্তমান সময়ে এসে ইরান যদি তার পরমাণু কর্মসূচিকে সমৃদ্ধকরণে মনোযোগী হয়ে উঠে, তাহলে এর সম্পূর্ণ দায় যুক্তরাষ্ট্রের।

ডোনাল্ড ট্রাম্পের অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে তিনি সব বাস্তবতাকে অবজ্ঞা করে নিজের এবং মার্কিন কর্তৃত্বকে সর্বাগ্রে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইছেন। একদিকে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে কূটনৈতিক তৎপরতা চলমান, এমন অবস্থায় এসে যুদ্ধ বন্ধ চুক্তি না হলে শুধু রাশিয়া নয়, রাশিয়ার তেলের পর নির্ভরশীল দেশগুলোকে হুমকি দেওয়ার মধ্য দিয়ে কার্যত তিনি গোটা বিশ্বকেই হুমকি দিচ্ছেন। উল্লেখ্য, গত বছর রাশিয়া থেকে তুরস্ক ৫৮ বিলিয়ন ডলারের,  ভারত ৩৮ বিলিয়ন ডলারের এবং ইউরোপীয় দেশগুলো ২৯ বিলিয়ন ডলারের তেল আমদানি করেছে, যার মধ্যে ভারতের জামনগরের তেল শোধনাগার থেকে পরিশোধিত তেল অনেক দেশেই রপ্তানি করা হয়েছে। যেখানে যুদ্ধকে তোয়াক্কা না করে মার্কিন নিষেধাজ্ঞাকে অবজ্ঞা করে রাশিয়ার তেলের বাজারকে যুক্তরাষ্ট্র নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হয়েছে, এমন অবস্থায় গোটা বিশ্বকে খেপিয়ে তুলে ট্রাম্প নিজের এবং যুক্তরাষ্ট্রের জন্য কার্যত বিপর্যয় ডেকে আনছেন কি না সেটা গভীর ভাবনার বিষয়। হামাস-ইসরায়েল, রাশিয়া-ইউক্রেন এবং ইরান-ইসরায়েল এসব বিষয়কে একসঙ্গে ধরে গোটা পরিস্থিতিকে বেশ জটিল করে ফেলেছেন তিনি।

 

লেখক : অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

mfulka@yahoo.com

মন্তব্য

এই লুটপাটের সংস্কৃতি আমাদের নয়

    অদিতি করিম
শেয়ার
এই লুটপাটের সংস্কৃতি আমাদের নয়

গাজা এখন জ্বলছে। সারা বিশ্বকে স্তম্ভিত করে গাজায় চলছে নারকীয় গণহত্যা, তাণ্ডব। মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের এক নিকৃষ্টতম উদাহরণ সৃষ্টি হয়েছে ইসরায়েলি বর্বরতায় গাজায়। গাজায় এই গণহত্যার প্রতিবাদ হচ্ছে বিশ্বজুড়ে।

সারা বিশ্বেই শান্তিকামী মানুষ এই গণহত্যা ও যুদ্ধ বন্ধের আহ্বান জানাচ্ছে। বাংলাদেশ সরকারও গাজায় গণহত্যা বন্ধ এবং অবিলম্বে যুদ্ধবিরতির জন্য আহ্বান জানিয়েছে। সারা বিশ্বে গত সোমবার ৭ এপ্রিল পালিত হয়েছে নো ওয়ার্ক, নো স্কুল কর্মসূচি। গাজার গণহত্যার প্রতিবাদে বিশ্বজুড়ে পালিত এই কর্মসূচি পালন করে বাংলাদেশও।
বাংলাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো সোমবার বন্ধ ছিল। দেশজুড়ে হয়েছে গণহত্যা বন্ধের দাবিতে প্রতিবাদ মিছিল, বিক্ষোভ। কিন্তু এই প্রতিবাদ মিছিল ও বিক্ষোভে কিছু সুযোগসন্ধানী বিভিন্ন স্থানে দোকানপাটে হামলা, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করেছে। একটা ভালো কাজ কিভাবে কিছু খারাপ মানুষের জন্য নষ্ট হয় তার এক নিকৃষ্ট উদাহরণ সৃষ্টি হলো গত ৭ এপ্রিল।
এসব ঘটনা কোনোভাবেই ইসরায়েলের প্রতি ক্ষোভের প্রকাশ নয়, বরং যারা এই ঘটনাগুলো ঘটিয়েছে তারা খুব সুস্পষ্টভাবে অপরাধী, সুযোগসন্ধানী এবং লুটেরা। এরা দুর্বৃত্ত, অপরাধী। এই ধ্বংসাত্মক তৎপরতায় না পবিত্র ইসলাম ধর্মের প্রতি সুবিচার করা হয়েছে, না গাজাবাসীর প্রতি জানানো হয়েছে সহানুভূতি। এভাবে প্রতিষ্ঠানগুলো ভাঙচুর, লুটপাট বরং বিশ্বজুড়ে নেতিবাচক ধারণা সৃষ্টি করবে। যারা এসব অপকর্ম করেছে তারা শুধু বাংলাদেশের ক্ষতি করেনি, পবিত্র ধর্মকে অবমাননা করেছে।

বাংলাদেশের জনগণ শান্তিপ্রিয়। বাংলাদেশের জনগণ হিংসা ও হানাহানি অপছন্দ করে। একে অন্যের সঙ্গে মমতার বন্ধনে থাকতে চায়। কিন্তু যখন এ দেশের মানুষ প্রতিবাদে মুখর হয় তখন তার অধিকার আদায়ের জন্য জীবন উৎসর্গ করে। এ দেশের মানুষ বারবার এটা প্রমাণ করেছে। কিন্তু কোনো কিছু লুটপাট করা, দুর্বৃত্তায়ন ইত্যাদি আমাদের সংস্কৃতি নয়। বরং অন্যের আমানত হেফাজত করাই আমাদের ঐতিহ্য। কিন্তু অত্যন্ত দুর্ভাগ্যের বিষয়, সাম্প্রতিক সময়ে এই লুটপাটের প্রবণতাগুলো ব্যাপকভাবে দেখা যাচ্ছে। কিছু কিছু সুযোগসন্ধানী দুর্বৃত্ত তৈরি হয়েছে, যারা সুযোগ পেলেই বিভিন্ন স্থানে লুটপাট, হামলা করছে এবং ভাঙচুর করছে। ৫ আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানের সময় থেকেই আমরা এই দুর্বৃত্তদের অপতৎপরতা লক্ষ করছি। সাধারণ মানুষ এতে বিরক্ত। তারা এই ঘৃণ্য তৎপরতাকে ঘৃণা করে। ৫ আগস্টের পর আমরা দেখলাম কিছু সুযোগসন্ধানী মানুষ বিভিন্ন স্থানে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটাল। তারা টার্গেট করে বিভিন্ন বাড়িতে গিয়ে লুটপাট করল। একজন ব্যক্তির বিরুদ্ধে অপরাধ থাকতেই পারে। ব্যক্তির দুর্নীতি, গণহত্যা বা বিভিন্ন অপরাধের বিচার আইনের বিষয়। যখন কোনো ব্যক্তিকে অপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয় তখন তার বিচারের জন্য নির্দিষ্ট আইন আছে। এই আইন অনুযায়ী তার বিচার হবে। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর এই বিচারপ্রক্রিয়া শুরু করেছে। কিন্তু বিচার নিজের হাতে তুলে নেওয়া এবং বিচারের নামে তার ঘরবাড়ি ভাঙচুর, লুটপাট করা কোনো সভ্য সমাজের কাজ নয়। এটি যারা করেছে তারা শুধু অসভ্য বর্বর নয়, তারা দেশদ্রোহীও বটে। এরা বাংলাদেশের জন্য ক্ষতিকর। এই রাষ্ট্রের জন্য বিপজ্জনক।

এই লুটপাটের সংস্কৃতি আমাদের নয়বাংলাদেশে গাজাবাসীর সমর্থনে যে বিক্ষোভ প্রতিবাদ হয়েছে সেটি অবশ্যই সমর্থনযোগ্য। বাংলাদেশের জনগণ বিশেষ করে তরুণসমাজ এই প্রতিবাদ বিক্ষোভে সবার আগে সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। তারা ৫ আগস্টের মতোই রাজপথে নেমে গাজাবাসীর প্রতি তাদের সমর্থন এবং সংহতি ব্যক্ত করেছে। এটা অত্যন্ত আশার কথা। এর ফলে সারা বিশ্বের মুসলিম সমাজের জন্য বাংলাদেশ সমর্থনের বার্তা দিয়েছে। কিন্তু এই পুরো আয়োজনকে নষ্ট করে দিয়েছে কিছু লুটেরা দুর্বৃত্ত। তারা এসব ভাঙচুর ও লুটপাট করে একটা ভিন্ন বার্তা দিয়েছে। এমন সময় তারা এই ধরনের ঘটনা ঘটিয়েছে যখন বাংলাদেশে বিনিয়োগ সম্মেলন চলছিল। শতাধিক বিদেশি বিনিয়োগকারী ঢাকায় অবস্থান করছিলেন। চার দিনের সম্মেলনে ৫০টি দেশের উদ্যোক্তাদের উপস্থিতিতে দেশে এই ঘটনা জঘন্য নিন্দনীয়। বিনিয়োগ সম্মেলনের উদ্বোধনী দিনে বিভিন্ন বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশের বৈদেশিক বিনিয়োগের ব্যাপারে আগ্রহ দেখাচ্ছিলেন। এ রকম সময়ে এই হামলা ও লুটপাটের ঘটনা বাংলাদেশ সম্পর্কে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের একটা নেতিবাচক ধারণা দেবে। বিদেশি বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থার সংকট সৃষ্টি হবে, তৈরি হবে নিরাপত্তাহীনতা।

কিছুদিন ধরেই বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের উত্থান নিয়ে নানা রকম কথাবার্তা হচ্ছে। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে শঙ্কা প্রকাশ করা হচ্ছে যে বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের উত্থান ঘটেছে। এ রকম শঙ্কার অন্যতম কারণ সব লুটপাট এবং বিচার নিজের হাতে তুলে নেওয়ার প্রবণতা। ৫ আগস্টে বিভিন্ন স্থাপনায় হামলা, বিভিন্ন বাসাবাড়িতে হামলা, ধানমণ্ডি ৩২ নম্বর গুঁড়িয়ে দেওয়া ইত্যাদি ঘটনা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ভালোভাবে নেয়নি। অনেকেই মনে করেন উগ্র মৌলবাদী গোষ্ঠী এসব ধ্বংসাত্মক তৎপরতার মূল হোতা। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে হিযবুত তাহরীরের সাম্প্রতিক তৎপরতা। ভারতে এসে মার্কিন গোয়েন্দাপ্রধান তুলসী গ্যাবার্ড বলেছেন, বাংলাদেশে খেলাফত প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা চলছে। বিশ্বজুড়ে যখন বাংলাদেশের বিরুদ্ধে এ ধরনের প্রচারণা হচ্ছে, ঠিক সেই সময় কেএফসি, বাটা বা পিত্জা হাটে সংঘবদ্ধ আক্রমণের ঘটনা উদ্বেগজনক নয় শুধু বাংলাদেশের জন্য ভীষণ ক্ষতিকর। এর ফলে বিশ্বে বাংলাদেশ সম্পর্কে একটা ভুল বার্তা যাবে। এত দিন ধরে যে প্রচারণাগুলো বাংলাদেশ সম্পর্কে হচ্ছিল যে এ দেশে উগ্র মৌলবাদীরা ক্ষমতা দখল করেছে বা ৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পর উগ্র মৌলবাদীদের দাপট বেড়েছে, সেই বক্তব্যগুলো আরো শক্ত ভিত্তি পাবে।

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশেই গাজার গণহত্যার প্রতিবাদে বিক্ষোভ সমাবেশ হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চলছে ব্যাপক বিক্ষোভ। ওইসব বিক্ষোভে তো কোনো ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেনি। কেউ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, দোকানপাট লুট করেনি। বাংলাদেশে কেন ঘটল? বাংলাদেশের মানুষ কখনোই এ ধরনের লুটপাট বা অগ্নিসংযোগ করে না। বরং বিশ্বের বড় বড় উন্নত দেশে আমরা লক্ষ করি, যেখানে এক মিনিটের জন্য বিদ্যুৎ গেলে ভয়ংকর কাণ্ড ঘটে, লুটপাট, ধর্ষণের মতো ঘটনা ঘটে ব্যাপকভাবে। সৃষ্টি হয় অরাজকতা। বাংলাদেশ সেখানে উজ্জ্বল একটি ব্যতিক্রম। বিদেশের মানুষ একে অন্যকে পাহারা দেয়। একে অন্যের সম্পদ সংরক্ষণ করে। এ দেশের গ্রামে অনেক বাড়িতে রাতে দরজা দেওয়া হয় না। খোলা উঠানে তারা একসঙ্গে সময় কাটায়। এ দেশের মানুষ কোনো কিছু পড়ে থাকলে তুলে নেয় না। এ দেশের মানুষ যেকোনো দোকানপাটে গিয়ে ভাঙচুরে অভ্যস্ত নয়। বরং এ ধরনের ঘটনা যখন ঘটে তখন সাধারণ মানুষ বাধা দেয়, প্রতিরোধ করে। এই দেশের বেশির ভাগ মানুষ সম্প্রীতির বন্ধন এবং একটি শান্তিময় জীবনযাপনে আগ্রহী। কিন্তু ইদানীং কিছু দুর্বৃত্ত সুপরিকল্পিতভাবে এ ধরনের ঘটনা ঘটাচ্ছে। দেশের বিপুল জনগোষ্ঠীর সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই। এর ফলে একদিকে যেমন বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে সৃষ্টি হচ্ছে আতঙ্ক, নিরাপত্তাহীনতা। অন্যদিকে বাংলাদেশ সম্পর্কে বিশ্বের কাছে একটা ভুল বার্তা যাচ্ছে। যারা এ ধরনের ঘটনা ঘটিয়েছে তারা কখনোই মানবতার পূজারি নয়। গাজার গণহত্যা নিয়ে তাদের কোনো আবেগ আছে বলে মনে হয় না। কারণ যে ভিডিওগুলো  প্রকাশিত হয়েছে তাতে দেখা যাচ্ছে তারা জুতা, জিনিসপত্র ইত্যাদি নিয়ে দুর্বৃত্তের মতো পালাচ্ছে। এরা কি শুধু লুট করার জন্য করেছে, না এর পেছনে সুদূরপ্রসারী একটি ষড়যন্ত্র রয়েছে তা খতিয়ে দেখতে হবে। আশার কথা যে পুলিশ প্রধান এই ঘটনার পর কঠোর বিবৃতি দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, যারা এই সমস্ত হামলার সঙ্গে জড়িত, তারা লুটপাটকারী এবং তাদের অবিলম্বে আইনের আওতায় আনার নির্দেশ দিয়েছেন। বিডার নির্বাহী পরিচালকও এ ঘটনা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।

বাংলাদেশ অর্থনীতিতে একটা কঠিন সময় পার করছে। সাম্প্রতিক সময়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের ওপর ৩৭ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছেন। এটি বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য একটা বড় ধাক্কা। এর ফলে বাংলাদেশের পোশাক খাতে বড় ধরনের বিপর্যয় নামার আশঙ্কা রয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কে টানাপড়েন চলছে। ৫ আগস্টের পর বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এক ধরনের স্থবিরতা নেমে এসেছে। বিভিন্ন কারখানায় আগুন দেওয়া হয়েছে। এসব ঘটনা ঘটিয়েছে এই দুর্বৃত্তরাই। এসব কারখানা এখন পর্যন্ত খোলেনি। বহু শ্রমিক বেকার হয়ে আছে। এখন যদি এ ধরনের ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে, তাহলে শুধু বিদেশি উদ্যোক্তারা নয়, দেশের উদ্যোক্তারাও তাদের উৎসাহ হারিয়ে ফেলবেন। কারো বিনিয়োগ এভাবে আগুনে পুড়ুক তা কেউ চায় না। জেনেশুনে কেউ লুটেরাদের হাতে নিজের সারা জীবনের অর্জিত সম্পদ ধ্বংস হতে দেবে না। আর এ কারণেই গত সোমবার যে ঘটনা ঘটেছে তা বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তা এবং বিনিয়োগকারীদের জন্য একটা ভয়ংকর বার্তা দিল। এর ফলে আবার অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়বেন দেশের ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তারা। নতুন করে বিনিয়োগের জন্য তাঁরা দশবার চিন্তা করবেন। সরকারের উচিত লুটেরাদের শুধু গ্রেপ্তার নয়, যেসব ব্যবসায়ী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তাঁদের পাশে দাঁড়ানো। একজন মানুষ তাঁর সারা জীবনের সম্পদ সঞ্চয় দিয়ে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। এই প্রতিষ্ঠানটি শুধু তাঁর আয়ের একমাত্র উৎস নয়, এই প্রতিষ্ঠানে চাকরি করা অনেকের আয়-রোজগারের একমাত্র পথ। এ রকম বাস্তবতায় যখন একটি প্রতিষ্ঠানে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়, প্রতিষ্ঠানটি লুট হয়ে যায় তখন ওই উদ্যোক্তা শুধু নিঃস্ব হন না, নিঃস্ব হয়ে যায় বাংলাদেশ। এই বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে। কাজেই অনেক হয়েছে। ৫ আগস্টের পর বাংলাদেশে যেভাবে থেমে থেমে লুটপাট এবং মব তাণ্ডব চলছে তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে এ দেশের জনগণকে। ব্যবস্থা নিতে হবে সরকারকে এবং তা এখনই।

 

লেখক : নাট্যকার ও কলাম লেখক

auditekarim@gmail.com

 

মন্তব্য

সর্বশেষ সংবাদ