মানুষ মাত্রই স্বপ্ন দেখে। মানুষ ঘুমের ভেতর যেসব স্বপ্ন দেখে তার কিছু সত্য হয়, আবার কিছু মিথ্যা। আবার কিছু মানুষের স্বপ্ন বেশি সত্য হয় এবং কিছু মানুষের স্বপ্ন বেশির ভাগই মিথ্যা হয়। প্রশ্ন হলো— কার স্বপ্ন বেশি সত্য হয় এবং কোন সময়ের স্বপ্ন সত্য হয়।
মানুষ মাত্রই স্বপ্ন দেখে। মানুষ ঘুমের ভেতর যেসব স্বপ্ন দেখে তার কিছু সত্য হয়, আবার কিছু মিথ্যা। আবার কিছু মানুষের স্বপ্ন বেশি সত্য হয় এবং কিছু মানুষের স্বপ্ন বেশির ভাগই মিথ্যা হয়। প্রশ্ন হলো— কার স্বপ্ন বেশি সত্য হয় এবং কোন সময়ের স্বপ্ন সত্য হয়।
স্বপ্ন তাৎপর্যহীন নয়
ইসলামের দৃষ্টিতে মানুষের স্বপ্ন তাৎপর্যহীন নয়, বরং মুমিনের স্বপ্ন বিশেষ গুরুত্ব রাখে। রাসুলুল্লাহ (সা.) সত্য স্বপ্নকে নবুয়তের অংশ বলেছেন। আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, ‘আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে বলতে শুনেছি, কেবল মুবাশশিরাত (সুসংবাদ) ছাড়া নবুয়তের আর কিছু অবশিষ্ট নেই। সাহাবিরা প্রশ্ন করেন, মুবাশশিরাত কী? তিনি বলেন, ভালো স্বপ্ন।
অন্য হাদিসে নবীজি (সা.) বলেন, ‘মুমিনের স্বপ্ন ৪৬ ভাগের এক ভাগের সমান।’ (সুনানে আবি দাউদ, হাদিস : ৫০১৮)
সব স্বপ্ন সত্য নয়
ভালো স্বপ্ন যেমন আল্লাহর পক্ষ থেকে, তেমনই মন্দ স্বপ্ন শয়তানের পক্ষ থেকে। তবে স্বপ্নের ভালো-মন্দ নির্ধারণে জ্ঞানী ব্যক্তিদের পরামর্শ গ্রহণ করা উচিত। নবী (সা.) বলেন, ‘তোমাদের কেউ যদি এমন কোনো স্বপ্ন দেখে, যা সে পছন্দ করে, তাহলে তা আল্লাহর পক্ষ থেকে।
যাদের স্বপ্ন সত্য হয়
নবী-রাসুলদের স্বপ্ন ছিল সন্দেহাতীতভাবে সত্য।
যাদের স্বপ্ন সত্য হয় না
প্রাজ্ঞ আলেমরা বলেন, স্বপ্ন সত্য হওয়া ও মিথ্যা হওয়ার বিবেচনায় মানুষ তিন শ্রেণির। তারা হলো—
১. নবী-রাসুল (আ.) : আম্বিয়ায়ে কিরামের সব স্বপ্ন সত্য। তাদের স্বপ্নের উদ্দেশ্যও তাদের কাছে স্পষ্ট। ফলে এর কোনো ব্যাখ্যার প্রয়োজন হয়।
২. নেককার মানুষ : সৎমানুষের বেশির ভাগ স্বপ্ন সত্য হয়। তাদের কিছু স্বপ্নের ব্যাখ্যার দরকার হয় এবং কিছু স্বপ্নের ব্যাখ্যা ছাড়াই তার উদ্দেশ্য বোঝা যায়।
৩. অন্যদের স্বপ্ন : নবী-রাসুল ও নেককার বান্দা ছাড়া অন্যদের স্বপ্নের সত্য ও মিথ্যার মিশ্রণ থাকে। তারা আবার তিন শ্রেণির : ক. যারা প্রকাশ্যে পাপ করে না, পাপ গোপন করে চলে। তাদের স্বপ্ন তাদের আমল অনুপাতে হয়ে থাকে; খ. যারা প্রকাশ্যে পাপ করে, তাদের স্বপ্ন বেশির ভাগ সময় মিথ্যা হয়, কখনো কখনো সত্য হয়; গ. যাদের ঈমান নেই, তাদের স্বপ্ন সত্য হয় না বললেই চলে। (রুয়াল আম্বিয়া ওয়াস সালিহিন, পৃষ্ঠা-২৬)
যে সময়ের স্বপ্ন সত্য হয়
দিন ও রাতের যেকোনো সময়ের স্বপ্ন সত্য হতে পারে। কোনো সময়কে সত্য স্বপ্নের জন্য নির্ধারণ করা হয়নি। তবে রাতের স্বপ্ন দিনের স্বপ্নের তুলনায় অধিক শক্তিশালী। আল্লামা মুহাম্মদ ইবনে সিরিন (রহ.) বলেছেন, দিনের স্বপ্ন রাতের স্বপ্নের মতো হয়। ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে উভয়ের বিধান এক। পুরুষ ও নারীর স্বপ্নের মধ্যেও কোনো পার্থক্য নেই। (তাফসিরুল আহলাম মিন কালামি আইম্মাতিল আলাম, পৃষ্ঠা-৯৩)
তবু মহানবী (সা.) এমন কিছু সময় উল্লেখ করেছেন যে সময়ের স্বপ্ন অধিক সত্য হয়। যেমন—
১. যখন দিন-রাতের পরিধি সমান হয় : যখন দিন ও রাতের ব্যাপ্তি সময় বা কাছাকাছি হয়, তখন মুমিনের স্বপ্ন সত্য হয়। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘সময় যখন কাছাকাছি হবে তখন মুসলিমের স্বপ্ন মিথ্যা হবে না।’ (সুনানে আবি দাউদ, হাদিস : ৫০১৯)
ইমাম বাগাভি (রহ.) এই হাদিসের ব্যাখ্যায় বলেন, বসন্ত ও শরৎকালের স্বপ্ন অধিক সত্য হয়। যখন গাছে ফল আসে ও তা পরিপক্ব হয়। কেননা তখন সময় নিকটবর্তী থাকে এবং দিন-রাতের পরিধি সমান থাকে। (তাজিলুস সুকয়া ফি তাবিরির রুয়া, পৃষ্ঠা-১৩)
২. শেষ রাতের স্বপ্ন : প্রাজ্ঞ আলেমরা বলেন, রাতের শেষ অর্ধাংশের স্বপ্ন বেশি সত্য হয়। চাই তা ফজরের আগে হোক বা পরে। কেননা এ সময় মহান আল্লাহ পৃথিবীর আসমানে অবতরণ করেন এবং এটা ফেরেশতাদের ছড়িয়ে পড়ার সময়। আর প্রথম অর্ধাংশের স্বপ্ন বেশির ভাগ সময় মিথ্যা হয়। কেননা এটা শয়তানের বিচরণ করার সময়। (তাজিলুস সুকয়া ফি তাবিরির রুয়া, পৃষ্ঠা-১৩)
এ বিষয়ে মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘শেষ রাতের স্বপ্ন অধিক সত্য হয়।’ (জামে তিরমিজি, হাদিস : ২২৭৪)
৩. কিয়ামতের পূর্ববর্তী সময় : কিয়ামতের পূর্বে মুমিনের স্বপ্ন অধিক পরিমাণে সত্য হবে। মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘যখন কিয়ামতের সময় নিকটবর্তী হবে, তখন মুমিনের স্বপ্ন খুব কমই মিথ্যা হবে।’ (জামে তিরমিজি, হাদিস : ২২৭০)
এর কারণ ব্যাখ্যায় আল্লামা সিন্ধি (রহ.) বলেন, কিয়ামত হলো সেই সত্য প্রকাশকারী, যা সব সত্য প্রমাণ করবে। সুতরাং যে জিনিস তার যত বেশি নিকটবর্তী হবে তা তত বেশি বাস্তব হবে। (মুসনাদে আহমদ (টীকা) : ১৩/৮২)
যে সময়ের স্বপ্ন দ্রুত প্রতিফলিত হয়
আল্লামা দিনওয়ারি (রহ.) বলেন, প্রথম রাতের স্বপ্ন বিলম্বে বাস্তবায়িত হয়। রাতের অন্য অংশের তুলনায় শেষ অর্ধাংশের স্বপ্ন দ্রুত প্রতিফলিত হয়। সবচেয়ে দ্রুত প্রতিফলিত হয় সাহরির (শেষ রাত) সময়ের স্বপ্ন, বিশেষ করে ফজর উদিত হওয়ার সময়। (ফাতহুল বারি : ১৬/৩৩৯)
স্বপ্নের ব্যাপারে মহানবী (সা.)-এর হুঁশিয়ারি
আবু রাজিন উকাইলি (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, স্বপ্নের ব্যাপারে যে পর্যন্ত আলোচনা করা না হয় সে পর্যন্ত এটা পাখির পায়ে (ঝুলে) থাকা জিনিসের মতো। আলোচনা করার সঙ্গে সঙ্গে তা যেন পা থেকে পড়ে গেল। তাই স্বপ্নদ্রষ্টা ব্যক্তি যেন জ্ঞানী ব্যক্তি অথবা পছন্দীয় ব্যক্তি ছাড়া অন্য কারো কাছে স্বপ্নের ব্যাপারে আলোচনা না করে। (জামে তিরমিজি, হাদিস : ২২৭৮)
আল্লাহ সবাইকে সঠিক বুঝ দান করুন। আমিন।
সম্পর্কিত খবর
ঈদের সময় আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে বেড়াতে যাওয়া মুসলিম সমাজের বিশেষ সংস্কৃতি। সারা বছর যাদের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ হয় না ঈদের সময় তাদের সঙ্গে যোগাযোগ হয় এবং তারা পরস্পরের বাড়িতে বেড়াতে আসে। এর মাধ্যমে আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা পায় এবং একে অন্যের দুঃখের অংশীদার হয়।
ইসলামের দৃষ্টিতে আত্মীয়-স্বজনের পারস্পরিক যাতায়াত প্রশংসনীয় কাজ।
পারস্পরিক সাক্ষাতের বিধান
আত্মীয়-স্বজনের পারস্পরিক দেখা-সাক্ষাৎ সাধারণত মুস্তাহাব। চাই তারা সুখে থাকুক বা দুঃখে, সুস্থ থাকুক বা অসুস্থ। কেননা মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি অর্জনের আশায় কোনো অসুস্থ লোককে দেখতে যায় অথবা নিজের ভাইয়ের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ করতে যায়, একজন ঘোষক (ফেরেশতা) তাকে ডেকে বলতে থাকেন, কল্যাণময় তোমার জীবন, কল্যাণময় তোমার এই পথ চলাও।
আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে কেন যাব?
মুমিন ব্যক্তি অন্যের বাড়িতে বেড়াতে যাবে আল্লাহর নির্দেশ আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষার মাধ্যমে তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য। কেননা যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য অপর ভাইয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যায়, তার ব্যাপারে একজন ফেরেশতা আল্লাহর পক্ষ থেকে এই সুসংবাদ পৌঁছায় যে ‘আল্লাহ তোমাকে ভালোবাসেন, যেমন তুমি তোমার ভাইকে তাঁরই সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য ভালোবেসেছ।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ৬৪৪৩)
সাক্ষাৎ যখন আবশ্যক
আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে যোগাযোগ ও সাক্ষাৎ সাধারণ সময়ে মুস্তাহাব।
১. মা-বাবার সাক্ষাৎ : মা-বাবার সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করা, নিয়মিত সাক্ষাৎ করা এবং তাদের খোঁজ-খবর রাখা সন্তানের দায়িত্ব। বিশেষত যখন মা-বাবা বার্ধক্যে উপনীত হন অথবা অক্ষম হয়ে পড়েন। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমার প্রতিপালক আদেশ দিয়েছেন...মা-বাবার প্রতি সদ্ব্যবহার করতে। তাদের একজন অথবা উভয়েই তোমার জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হলে তাদের ‘উফ’ বোলো না এবং তাদের ধমক দিয়ো না; তাদের সঙ্গে সম্মানসূচক কথা বোলো।
২. আত্মীয়তা ছিন্ন হওয়ার ভয় থাকলে : আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যাওয়ার ভয় থাকলে, তা রক্ষার জন্য আত্মীয়-স্বজনের বাড়ি যাওয়া আবশ্যক। মহানবী (সা.) বলেন, যখন আল্লাহ সৃষ্টি কাজ সমাধা করার জন্য আত্মীয়তার সম্পর্ককে বলেন, তুমি কি এতে খুশি নও যে তোমার সঙ্গে যে সুসম্পর্ক রাখবে, আমিও তার সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখব। আর যে তোমার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করবে, আমিও তার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করব। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৫৯৮৭)
৩. অসুস্থ হলে : অসুস্থ ব্যক্তির খোঁজ-খবর নেওয়া মুমিনের দায়িত্ব। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘কিয়ামতের দিন আল্লাহ বলবেন, হে আদম সন্তান, আমি অসুস্থ হয়েছিলাম, তুমি আমার সেবা-যত্ন করোনি। সে বলবে, হে আমার রব, আমি কিভাবে আপনার সেবা-যত্ন করব অথচ আপনি জগত্গুলোর প্রতিপালক? আল্লাহ বলবেন, তুমি কি জানতে না আমার অমুক বান্দা অসুস্থ হয়েছিল। অথচ তুমি তার সেবা করোনি। তুমি কি জানো না, যদি তুমি তার সেবা করতে, তবে তার কাছেই আমাকে পেতে।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ২৫৬৯)
৪. বিপদগ্রস্ত হলে বা মারা গেলে : কেউ বিপদগ্রস্ত হলে বা মারা গেলে তার পরিবারকে সান্ত্বনা দেওয়ার ব্যাপারে হাদিসে তাগিদ আছে। মহানবী (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি তার মুমিন ভাইকে তার বিপদে সান্ত্বনা দেবে, আল্লাহ তাআলা কিয়ামতের দিন তাকে সম্মানের পোশাক পরাবেন।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস : ১৬০১)
বিনা প্রয়োজনে দীর্ঘক্ষণ অবস্থান নয়
কারো বাড়িতে বেড়াতে গেলে, কারো সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গেলে বিনা প্রয়োজনে অবস্থান ও সাক্ষাৎ দীর্ঘ না করাই উত্তম। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমাদের আহবান করলে তোমরা (ঘরে) প্রবেশ কোরো এবং খাওয়া শেষে তোমরা চলে যেয়ো; তোমরা কথাবার্তায় মশগুল হয়ে পড়ো না। কেননা তোমাদের এই আচরণ নবীকে পীড়া দেয়, সে তোমাদের উঠিয়ে দিতে সংকোচ বোধ করে। কিন্তু আল্লাহ সত্য বলতে সংকোচ বোধ করেন না।’ (সুরা আহজাব, আয়াত : ৫৩)
পর্দার বিষয়ে সতর্ক থাকা
আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে বেড়াতে গেলে অনেক সময় পর্দার বিধান লঙ্ঘন করা হয়। রাসুলুল্লাহ (সা.) হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, ‘সাবধান! নারীদের কাছে তোমরা প্রবেশ করা পরিত্যাগ কোরো। সে সময় আনসারিদের এক লোক বলল, দেবর সম্পর্কে আপনার কি মত? তিনি বললেন, দেবর তো মৃত্যুতুল্য।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ৫৫৬৭)
উপহার নেওয়া কি আবশ্যক
কারো বাড়িতে বেড়াতে গেলে উপহার নিয়ে যাওয়া উত্তম এবং মেজবানের জন্য সাধ্যানুযায়ী অতিথির যত্ন করা আবশ্যক। এই ক্ষেত্রে ইসলাম লৌকিকতাকে অপছন্দ করে। তাই অতিথি যেমন সাধ্যের চেয়ে বেশি খরচ করে উপহার কিনবে না, মেজবানও আপ্যায়নে সামর্থ্যের চেয়ে অর্থ খরচ করবে না; বরং উভয়ে নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী আন্তরিকতার পরিচয় দেবে।
পবিত্র রমজান মাস ছিল মুমিনের আমলের মৌসুম। এ মাসের আমলগুলো যেন পুরো বছর অব্যাহত থাকে সেটাই এ মাসের প্রধান শিক্ষা। এর মাধ্যমে রোজার সামর্থ্যের জন্য মহান আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করা হয়। কোরআনে রোজা রাখার নির্দেশের পরই কৃতজ্ঞতা প্রকাশের কথা এসেছে।
রবের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ
কৃতজ্ঞতা প্রকাশের অন্যতম দিক হলো, আমল করা অব্যাহত রাখা। এর মধ্যে রমজানের পর শাওয়ালের ছয় রোজা রাখা গুরুত্বপূর্ণ আমল। রাসুলুল্লাহ (সা.) এ রোজা রাখতেন এবং সাহাবাদের তা রাখার নির্দেশ দিতেন।
ছয় দিনের রোজায় পুরো বছরের সওয়াব
রমজান মাসে রোজা রাখার পর শাওয়াল মাসে আরো ছয়টি রোজা রাখলে পুরো বছর রোজার সওয়াব পাওয়া যায়। সাওবান (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, মহান আল্লাহ সব ভালো কাজের প্রতিদান ১০ গুণ করে দেন। তাই রমজান মাস ১০ মাসের সমতুল্য এবং পরবর্তী (শাওয়াল মাসের) ছয় রোজার মাধ্যমে এক বছর পূর্ণতা লাভ করে।
পুরো বছর সওয়াব হয় যেভাবে
মূলত রমজান মাসের রোজার পর অতিরিক্ত ছয় রোজা মিলে সাধারণত ৩৬টি রোজা হয়। আর তা ১০ গুণ করলে মোট ৩৬০টি হয়। কারণ মুমিনের যেকোনো আমলের সওয়াব ১০ গুণ করে দেওয়া হয়। ইরশাদ হয়েছে, ‘কেউ কোনো ভালো কাজ করলে সে তার ১০ গুণ পাবে। আর কেউ কোনো খারাপ কাজ করলে তাকে শুধু তার প্রতিফলই দেওয়া হবে; তাদের ওপর কোনো জুলুম করা হবে না।
রমজানের রোজার পরিপূরক
নফল আমলের মাধ্যমে ফরজের ত্রুটি-বিচ্যুতি দূর করা হয়। তেমনি শাওয়ালের রোজার মাধ্যমে রমজানের রোজার ত্রুটিগুলো পূর্ণ করা হবে। নামাজ প্রসঙ্গে হাদিসে এসেছে, আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘কিয়ামতের দিন সর্বপ্রথম বান্দার ফরজ নামাজের হিসাব করা হবে। তা ঠিক থাকলে সে সফলকাম। আর তাতে সমস্যা হলে সে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আর কোনো ফরজ আমলে অপূর্ণতা দেখা দিলে মহান রব বলবেন, তোমরা দেখো, আমার বান্দার কি কোনো নফল নামাজ রয়েছে? নফল থাকলে তা দিয়ে ফরজকে পরিপূর্ণ করা হবে। এভাবে সব ফরজ আমলের ক্ষেত্রে ক্ষতিপূরণ করা হবে।’ (তিরমিজি, হাদিস : ৪১৩)
ইবনুল কায়্যিম (রহ.) বলেছেন, শাওয়াল মাসে ছয়টি রোজা হওয়ার মধ্যে বিশেষ রহস্য রয়েছে। তা হলো এই ছয়টি রোজা রমজানের রোজার পরিপূরক হিসেবে কাজ করে। রোজার মধ্যে যেসব ভুল-ত্রুটি হয়েছে অতিরিক্ত রোজাগুলো তা দূর করে দেয়। বিষয়টি ফরজ নামাজের পর সুন্নত ও নফল নামাজের মতো এবং নামাজে ভুল হলে সিজদায়ে সাহু দেওয়ার মতো।
যেভাবে রাখতে হয়
শাওয়াল মাসের যেকোনো দিন এই ছয়টি রোজা রাখা যাবে। কেউ চাইলে মাসের শুরুতে রাখতে পারবে। কেউ চাইলে মাসের মধ্য ভাগে কিংবা শেষ অংশেও রাখতে পারবে। কেউ চাইলে তা অল্প অল্প করে পুরো মাসে রাখতে পারবে। এ ক্ষেত্রে কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। তবে নফল আমলের ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা থাকা উচিত। সেই হিসেবে মাসের শুরুতেই এই আমল করা উত্তম।
মহান আল্লাহ আমাদের সবাইকে আমল করার তাওফিক দিন।
শাওয়াল মাসের ছয় রোজাকে ইসলাম বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে। পূর্বসূরি আলেমরা অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে রমজান মাসের রোজা পালন করতেন। শরিয়তের দৃষ্টিতে শাওয়াল মাসে ছয় রোজা রাখা মুস্তাহাব। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি রমজানের রোজা রাখল, অতঃপর তার সঙ্গে সঙ্গে শাওয়াল মাসের ছয়টি রোজা রাখল, সে যেন পূর্ণ বছরই রোজা রাখল।
এক বছরের সমান হয় যেভাবে : রাসুলুল্লাহ (সা.) এক বছরের সমান হওয়ার বিষয়টিও ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি বলেছেন, রমজানের রোজা ১০ মাসের রোজার সমতুল্য আর (শাওয়ালের) ছয় রোজা দুই মাসের রোজার সমান। সুতরাং এই হলো এক বছরের রোজা। (সুনানে নাসায়ি : ২/১৬২)
মুহাদ্দিসরা বিষয়টি আরো ব্যাখ্যা করে বলেন, আল্লাহ তাআলা বলেন ‘কেউ কোনো সৎকাজ করলে সে তার ১০ গুণ সওয়াব পাবে এবং কেউ কোনো অসৎকাজ করলে তাকে শুধু তারই প্রতিদান দেওয়া হবে।
এই হিসাবে রমজানের ৩০ রোজায় ৩০০ রোজার সওয়াব হয়। আর শাওয়ালের ছয় রোজায় ৬০ রোজার সওয়াব হয়। এভাবে রমজানের ৩০ রোজা ও শাওয়ালের ছয় রোজা মোট ৩৬০ রোজার সমপরিমাণ হয়।
যে ব্যক্তির রমজানের রোজা কাজা আছে, সে কোনো কারণে পূর্ণ রমজান মাস রোজা রাখেনি।
আরবি সাওম বা সিয়াম মানে রোজা। কিছু দিনে রোজা পালনে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। নিম্নে সেগুলো তুলে ধরা হলো—
১. সাওমে বিছাল (বিরতিহীন রোজা) : সাওমে বিছাল হচ্ছে ইফতারি ও সাহরি গ্রহণ ছাড়া দিনের পর দিন রোজা পালন করা। এটি নিষিদ্ধ।
২. সারা বছরের রোজা : সারা বছর রোজা পালন নিষিদ্ধ। আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) সারা বছর রোজা পালন করতে চাইলে রাসুল (সা.) দাউদ (আ.)-এর রোজার কথা উল্লেখ করে বলেন, এর চেয়ে উত্তম রোজা আর নেই। (বুখারি, হাদিস : ১৯৭৬)
অন্যত্র এসেছে, যে ব্যক্তি সারা বছর রোজা রাখে, সে মূলত রোজা রাখে না। (নাসাঈ, হাদিস : ২৩৭৩)
৩. শনিবারের রোজা : রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, তোমাদের ওপর ফরজ করা রোজা ছাড়া কেউ যেন শনিবারে রোজা না রাখে।
ইমাম তিরমিজি (রহ.) বলেন, এই রোজা মাকরুহ হওয়ার কারণ হচ্ছে, শুধু শনিবারকে (নফল) রোজার জন্য নির্দিষ্ট করা। কারণ ইহুদিরা শনিবারকে বিশেষ মর্যাদা দিয়ে থাকে।
৪. শুক্রবারের রোজা : জুয়াইরিয়া (রা.) বলেন, তিনি রোজারত অবস্থায় রাসুল (সা.)-এর কাছে প্রবেশ করেন।
বৃহস্পতিবার অথবা শনিবার রোজা রাখার নিয়ত না থাকলে শুধু শুক্রবার রোজা রাখতে রাসুল (সা.) এই হাদিসে নিষেধ করেছেন।
৫. দুই ঈদের দিনের রোজা : ওমর (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) এই দুই দিন রোজা পালন করতে নিষেধ করেছেন।
৬. আইয়্যামে তাশরিকের রোজা : জিলহজ মাসের ১১, ১২ ও ১৩ তারিখকে আইয়্যামে তাশরিক বলা হয়। ঈদুল আজহার দিনের পরের এই দিনগুলোতে আরবরা গোশত শুকাত বলে এই দিনগুলোকে আইয়্যামে তাশরিক বলা হয়। রাসুল (সা.) বলেন, আইয়্যামে তাশরিক হলো পানাহার ও আল্লাহর জিকিরের দিন। (মুসলিম, মিশকাত, হাদিস : ১৯৫২)