<p style="text-align:justify">সবচেয়ে বড় সংকটে এখন দেশের অর্থনীতি ও ব্যবসা-বাণিজ্য। সম্পদ ও অর্থ লুটপাটের জেরে বিদায়ি বছরের প্রথমার্ধে ফোকলা অর্থনীতির গতি ছিল টালমাটাল। আর গণ-অভ্যুত্থানের পরে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে এই অর্থনৈতিক পরিস্থিতি আরো বেসামাল। পরিস্থিতি উত্তরণে অন্তর্বর্তী সরকার নানা পদক্ষেপ নিলেও এর সুফল এখনো দৃশ্যমান নয়। ফলে নানা শঙ্কার মধ্যেই বিদায় নিচ্ছে ২০২৪ সাল।</p> <p style="text-align:justify">একদিকে টানা মূল্যস্ফীতির চাপ, অন্যদিকে ২৪০ বিলিয়ন ডলার পাচারের ধাক্কা। এসব সামলাতে এখন বেসামাল অর্থনীতি। তবে দেশের এই ভঙ্গুর অর্থনীতি নিয়ে ঘুড়ে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখছে অন্তর্বর্তী সরকার।</p> <p style="text-align:justify">ব্যাংকিং খাতসহ আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে পরিবর্তন আনা হয়। অর্থনীতি ও ব্যাবসায়িক পরিবেশ সংস্কার নিয়েও কাজ হচ্ছে।<br /> বিদায়ি বছর অর্থনৈতিক সূচকগুলো ছিল অনেকটা নেতিবাচক ধারায়। বছরজুড়েই ছিল অনেক চ্যালেঞ্জ। এ জন্য আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ঘটনা যতটা না দায়ী, তার চেয়ে বেশি দায়ী তত্কালীন রাজনৈতিক সরকারের দুর্বলতা ও সামষ্টিক অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা।</p> <p style="text-align:justify">আগের বছরের ধারাবাহিকতায় ২০২৪ সালেও উচ্চ মূল্যস্ফীতিতে ভুগেছে সর্বস্তরের মানুষ। বছরের শেষ ভাগে অন্তর্বর্তী সরকার প্রথম কাজ হিসেবে উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের চ্যালেঞ্জ নিলেও তা বাস্তবায়নে সক্ষম হয়নি। তাই দেশের মানুষ এখন বয়ে বেড়াচ্ছে সেই যন্ত্রণা।</p> <p style="text-align:justify">পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, ২০২৪ সালে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল ১০ শতাংশের বেশি। সরকার পরিবর্তনের পরে এই মূল্যস্ফীতি গড়ে ১১ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। আর খাদ্য মূল্যস্ফীতি সর্বশেষ ১৩.৮৮ শতাংশে পৌঁছেছে।</p> <p style="text-align:justify">যদিও বর্তমান সরকার ও অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এ রকম পরিস্থিতিতে প্রাথমিকভাবে আওয়ামী লীগ সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে ‘সমস্যার গভীরতার স্বীকৃতি’ দেয়নি। তথ্যবিভ্রাট ছিল। তাদের মতে, এ কারণে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে নেওয়া কৌশল কাজ করেনি। আর খাদ্যপণ্যের অস্বাভাকি দাম বৃদ্ধির পেছনে বাজার ব্যবস্থাপনায় অদক্ষতা দায়ী।</p> <p style="text-align:justify">অর্থনৈতিক দুর্বলতার কারণে চলতি অর্থবছরের মোট দেশজ উত্পাদনে (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে আনছে অন্তর্বর্তী সরকার। অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ এক বৈঠকে সম্প্রতি চলতি অর্থবছরের জিডিপি লক্ষ্যমাত্রা সংশোধন করে ৫.২৫ শতাংশে নামিয়েছে। </p> <p style="text-align:justify">সরকারের প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে উন্নয়ন সহযোগী সংস্থাগুলোর পূর্বাভাস আরো কম। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বলেছে, চলতি অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি হবে ৩.৮ শতাংশ। এর আগে বিশ্বব্যাংক বলেছে, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও সাম্প্রতিক বন্যার কারণে এই অর্থবছর শেষে দেশের প্রবৃদ্ধি কমে হবে ৪ শতাংশ। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) গত সেপ্টেম্বর মাসে ৫.১ শতাংশ প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস দিয়েছে।</p> <p style="text-align:justify"><strong>শ্লথ গতির ব্যবসা </strong></p> <p style="text-align:justify">একের পর এক ধাক্কার কারণে আগামী দুই বছর দেশের অর্থনীতিতে তিন ঝুঁকি—মুদ্রাস্ফীতি, অর্থনৈতিক মন্দা এবং দারিদ্র্য ও বৈষম্য থাকবে। ব্যাবসায়িক পরিবেশ সংস্কার নিয়ে এমনটা জানিয়েছে গবেষণা সংস্থা সিপিডি। সংস্থাটি জানায়, দুর্নীতি, মূল্যস্ফীতি, উচ্চকরহারসহ ১৭ বাধায় বিপর্যস্ত দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য। আছে জ্বালানি ঘাটতি, বেকারত্ব, স্বাস্থ্য খাতের দুরবস্থা ও সামাজিক অবক্ষয়। এ ছাড়া অর্থনীতির তুলনায় ব্যাবসায়িক প্রতিযোগিতায় অনেক পিছিয়ে বাংলাদেশ।  </p> <p style="text-align:justify">দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যবসা-বাণিজ্যে মূল্যস্ফীতি, ডলারসংকট ও কাঁচামাল আমদানির সংকট ছিল প্রকট। অস্থিরতার কারণে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যে বড় ধরনের ধাক্কা খেয়েছে। ব্যাংকঋণের সুদের হার এখন ১৫ শতাংশ ছাড়িয়েছে। ব্যবসায় নাজুক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে গেছে। এখনো অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এমন যে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগের ঝুঁকি কাটাতে কার্যকর পদক্ষেপ বাস্তবায়ন হয়নি। </p> <p style="text-align:justify">গত ১৬ বছরে বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়েছে ২৪০ বিলিয়ন ডলারের বেশি। খেলাপি ঋণ বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ হারে। ২০২৩ সালের ডিসেম্বর শেষে খেলাপি ঋণ ছিল এক লাখ ৪৫ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকা। চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে এই খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে দুই লাখ ৮৪ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা।</p> <p style="text-align:justify">চলতি বছরে রপ্তানি ও রাজস্ব আদায় কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় হয়নি। আর আমদানি, বিশেষ করে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি আগের চেয়ে কম হয়েছে। এতে বিনিয়োগ দুর্বলতা প্রকাশ পেয়েছে। </p> <p style="text-align:justify">দেশের অর্থনৈতিক সংকটকালেও অনেকেই লোভ সামলাতে পারেনি। ঘটেছে বেনজীরসহ কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তার ছিল আর্থিক কেলেঙ্কারি। থেমে ছিল না রাজস্ব আদায়ের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তা মতিউরের ছাগলকাণ্ডের মতো ঘটনা। শুধু সরকারি খাতে নয়, বেসরকারি খাতেও ছিল এস আলম, সামিট ও বেক্সিমকোর মতো কম্পানিগুলোর দুর্নীতি, অনিয়ম ও লুটপাটের চিত্র। এর প্রভাব পড়েছে ব্যাংক খাতে। দেখা দিয়েছে তারল্যসংকট।  </p> <p style="text-align:justify">অর্থনীতি-সংকটে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ না আসায় নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি ছিল সীমিত। বিপুল তরুণ জনগোষ্ঠীর চাহিদা অনুসারে কাজের ক্ষেত্র তৈরি হয়নি। পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০২৩ সালের জরিপ অনুসারে, দেশের বেকারত্বের হার ৩.৩৫ শতাংশ। ফলে দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমেছে প্রায় চার কোটি মানুষ। এরই মধ্যে তৈরি পোশাক খাতে ১৬১ কারখানা বন্ধ হওয়ায় দেড় লাখ শ্রমিক চাকরি হারিয়েছেন।</p> <p style="text-align:justify"><strong>উচ্চমূল্যে ডলার</strong></p> <p style="text-align:justify">ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন টানা তৃতীয় বছর অব্যাহত। ২০২৪ সালে টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে প্রায় ১২ শতাংশ। এই বাড়তি দামের কারণে আমদানি এবং তার ধারাবাহিকতায় দেশের ভেতর উত্পাদনও ব্যাহত হয়েছে। বেশি দামে পণ্য আমদানি করায় তা কেনার জন্য সাধারণ মানুষকেও গুনতে হয়েছে বেশি পরিমাণ টাকা।</p> <p style="text-align:justify"><strong>রিজার্ভ সংকট</strong></p> <p style="text-align:justify">বছরজুরেই সুখকর ছিল না রিজার্ভ। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে গত জানুয়ারিতে রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ১৯.৯৬ বিলিয়ন ডলার, যা মে মাসে কমে ১৮.২৪ বিলিয়ন ডলারে নেমেছিল। ২২ ডিসেম্বর ছিল ২০ বিলিয়ন ডলার। তবে ব্যয়যোগ্য রিজার্ভ এখনো ১৫ বিলিয়নের ঘরে। যদিও এটি নেমেছিল ১৩ বিলিয়ন ডলারে।</p> <p style="text-align:justify"><strong>রাজস্ব ছাপিয়ে সর্বোচ্চ ঋণ পরিশোধের চাপ </strong></p> <p style="text-align:justify">ক্রমাগত বাড়ছে সরকারের ঋণ ও ঋণের সুদ পরিশোধের চাপ। মন্ত্রণালয়ের তথ্য মতে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরেই ঋণের আসল ও সুদ পরিশোধ বাবদ সবচেয়ে বেশি অর্থ পরিশোধ করতে হবে সরকারকে। এমনকি এ ব্যয় এবার রাজস্ব আহরণকেও ছাড়িয়ে যেতে পারে। বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে আইএমএফ।</p> <p style="text-align:justify">জানা যায়, রাজস্ব আয় পর্যাপ্ত না হলেও আওয়ামী লীগ সরকারের দেড় দশকে প্রতিবছরই বাজেটের আকার বড় হয়েছে। পাশাপাশি ছিল বড় ঘাটতি বাজেট। এ ঘাটতি পূরণে স্থানীয় ও বিদেশি উত্স থেকে নেওয়া ঋণ ও ঋণের সুদ পরিশোধের ব্যয়ের পরিমাণ বাড়ছেই। </p> <p style="text-align:justify">মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরে সরকারকে স্থানীয় ও বিদেশি মিলিয়ে সাড়ে তিন লাখ কোটি টাকার ঋণ পরিশোধ করতে হবে। সুদ পরিশোধ খাতে বরাদ্দ বাড়িয়ে এক লাখ ২৩ হাজার কোটি টাকা করা হয়েছে। ফলে চলতি অর্থবছর শেষে আসল ও সুদ মিলিয়ে সরকারের ঋণ পরিশোধ চার লাখ ৭৩ হাজার কোটি টাকায় পৌঁছতে পারে।</p> <p style="text-align:justify">প্রতিবছর বাজেটে ঘোষিত রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে পারে না সরকার। চলতি অর্থবছরের বাজেটে পাঁচ লাখ ৪১ হাজার দুই কোটি টাকা রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত রয়েছে। তবে সামগ্রিক অর্থনৈতিক ও ব্যাবসায়িক পরিস্থিতির কারণে এবার রাজস্ব আহরণে সরকারকে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়তে হবে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।</p>