<p>স্কুলশিক্ষক থেকে রাজনীতিবিদ। এরপর আইন প্রণেতা (সংসদ সদস্য)। পরে প্রতিমন্ত্রী এবং শেষ পর্যন্ত মন্ত্রীও হন। বাংলাদেশবিরোধী বিশেষ মিশন নিয়ে ভূমি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব তাকে দেওয়া হয়। কিন্তু ৫ আগস্টের পর  সবকিছু যেন এলোমেলো হয়ে যায়। আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেত্রী যখন প্রকাশ্যে হেলিকপ্টারে পালিয়ে যান, তখন তার পদাঙ্ক অনুসরণ তো করতেই হয়। তাই হেলিকপ্টারের পরিবর্তে সীমান্ত দিয়ে ‘চোরের’ বেশে পালানোর চেষ্টা করেন তিনি।</p> <p>এ আমলনামা ঝিনাইদহের মহেশপুর সীমান্ত দিয়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার সময় বিজিবির হাতে ধরা পড়া নারায়ণ চন্দ্র চন্দের। খুলনা-৫ আসনের সাবেক এই সংসদ সদস্য মৎস্য ও প্রাণীসম্পদ প্রতিমন্ত্রী, মন্ত্রী এবং শেষ পর্যন্ত ভূমিমন্ত্রীর দায়িত্ব নেন তিনি। ছদ্মবেশী এই ভদ্র মানুষটি এবং তার পরিবারের সদস্যদের অনেক অপকর্মই তার ইমেজ নষ্ট করে। বিশেষ করে নিজের চারিত্রিক স্খলনের চেয়ে পারিবারিক দুর্নীতিই ছিল চোখে পড়ার মতো। টাকার বিনিময়ে চাকরি বা বদলি বাণিজ্যের সঙ্গে তার নিকটাত্মীয়রাই জড়িত ছিলেন বেশি। যার ফলে দুই সন্তানকেই আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে হয়। নিজে পতাকাধারী ব্যক্তি হয়েও প্রায়ই চলতেন সুন্দরী নারীদের নিয়ে। যেটি অনেকটা ‘মিউচুয়াল সম্পর্ক’ ছিল বলেই হয়ত কেউ আইনগত পদক্ষেপ নিতে যায়নি। কিন্তু তার এক সহচরের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ আনার পর হাসপাতালের ওসিসি থেকে ফিল্মি স্টাইলে ভুক্তভোগীকে তুলে নেওয়ার ঘটনায় আদালতে যে মামলা হয়েছে সেখানেও নারায়ণ চন্দ্র চন্দ ২ নম্বর আসামি।</p> <p>রবিবার (৬ অক্টোবর) রাতে ঝিনাইদহের মহেশপুর সীমান্ত থেকে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার সময় নারায়ণ চন্দ্র চন্দ আটক হওয়ার পর সোমবার সকালে তার নিজ এলাকা খুলনার ডুমুরিয়ায় গিয়ে স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বললে বেরিয়ে আসে তার মুখোশের আড়ালে নানা অজানা কাহিনি। অর্থাৎ তিনি যে এলাকার এমপি সেখানকার বাসিন্দারা বলছেন, দৃশ্যত ভদ্রলোক হলেও হেন অপকর্ম নেই যা নারায়ণ চন্দ্র চন্দ বা তার পরিবারের সদস্যরা করেননি। যেটি নিজে না পেরেছেন তা স্ত্রী-সন্তানদের দিয়ে করিয়েছেন এমনটিও জনশ্রুতি রয়েছে। নদী দখল করে ইটভাটা করা, টাকার বিনিময়ে চাকরি, পদোন্নতি দেওয়া, মনোনয়ন বাণিজ্য এসব যেন ছিল প্রকাশ্য বিষয়।</p> <p>নারায়ণ চন্দ্র চন্দের বড়ছেলের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপনার সুযোগটি সৃষ্টি হয়েছিল '৯৬ আমলের সরকারের স্বাস্থ্যমন্ত্রী প্রয়াত সালাহউদ্দিন ইউসুফের বদৌলতে। এরপর আর তাকে পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। ওই সময়ে আইন কমিশনের সদস্য হওয়ার সুযোগে অনেক বিচারককে চাকরি দেওয়া থেকে শুরু করে বদলি ও অন্যান্য বাণিজ্য করে হয়ে যান বিপুল অর্থের মালিক।</p> <p>মেজোছেলের নিয়ন্ত্রণে ছিল ডুমুরিয়া-ফুলতলা অঞ্চল। অনেক পরিবারের কাছ থেকে চাকরি দেওয়ার নাম করে টাকা নিলেও চাকরি দেওয়া হয়নি এমন অভিযোগও রয়েছে। এ নিয়ে বিরোধের জের ধরেই ২০১৭ সালে তার মেয়ে জয়ন্তী রানী চন্দ ওরফে বেবির আত্মহত্যা বলে জনশ্রুতি রয়েছে। </p> <p>এ ছাড়া ঘুষের টাকা ভাগাভাগিকে কেন্দ্র করে ছোট ছেলে অভিজিত চন্দ্র চন্দ হার পিক খেয়ে আত্মহত্যা করেন এমনটিও শোনা যায়। নগরীর বসুপাড়ার বাসায় চন্দের জামাতা ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সহকারী ব্যবস্থাপক প্রভাষ দত্তকে ২০১৮ সালের ৩০ নভেম্বর কেন গুলি করে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছিল সেটি নিয়েও ওই সময় গোয়েন্দা সংস্থাগুলো বেশি দূর এগোয়নি।</p> <p>ডুমুরিয়া বাজারের চা দোকানদার পলাশ ঘোষের ভাই প্রসুন ঘোষকে বনবিভাগে চাকরি দেওয়ার নামে চন্দ পরিবারকে দেওয়া হয়েছিল তিন লাখ ৮০ হাজার টাকা। সোমবার সকালে ওই চা দোকানে বসেই এ প্রতিবেদককে প্রসুন ঘোষ বলেন, আজও তিনি সম্পূর্ণ টাকা পাননি। তাই ভাইয়ের অবর্তমানে চা বিক্রি করেন তিনি।</p> <p>ডুমুরিয়া কলেজে চাকরি দেওয়ার জন্য ইন্টারভিউ দিয়েছিলেন তানজিলা খাতুন নামের এক প্রার্থী। কিন্তু তাকে না নিয়ে নেওয়া হয়েছে ইন্টারভিউতে টেকেননি এমন একজনকে। এ অভিযোগ তানজিলার স্বামী মো. সাদিক হোসেনের। তিনি বলেন, তার স্ত্রীকে চাকরি দেওয়ার জন্য ১৮ লাখ টাকাও দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু চাকরি হলো অন্যের। </p> <p>ফসলি জমিতেই ইটভাটা ডুমুরিয়ার খর্নিয়ার ভদ্রদিয়া পূর্বপাড়ায় গতকাল দুপুরে গিয়ে দেখা যায়, কেপিবি অর্থাৎ কালীপদ ব্রিকস অনেকটা অরক্ষিত। ৫ আগস্টের পর চন্দের লোকজন আর সেখানে যাচ্ছেন না। সেখানে অবস্থান করা এলাকার কয়েকজন বলেন, নারায়ণ চন্দ্র চন্দ দুই বছর আগে এই ইট ভাটাটি করেছেন স্থানীয় মানুষের ফসলি জমি দখল করে। যখন ভাটার কাজ শুরু করা হয় তখন ছিল সবুজের ক্ষেত। কিন্তু এখন সেখানকার কৃষকরা জোন খেটে সংসার চালান।</p> <p>স্থানীয় শিমুল দাস বলেন, তার বাবা একজন পঙ্গু। মা মারা গেছেন আগেই। স্ত্রী আর দুটি সন্তান নিয়ে তাদের পাঁচজনের সংসারে তিনি একাই উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। দুই বিঘা জমি লিজ নিয়ে তিনি সেখানে ধান ও সবজি চাষ করে সংসার চালাতেন। গত বছর এমন এক দিন সকালে এসে দেখেন কেপিবির মালিক নারায়ণ চন্দ্র চন্দ তার অন্তত ২০ মণ সিম মাটিতে পিষে দিয়েছেন। এক মুহূর্তও সময় দেওয়া হয়নি তাকে। কথা বলতে গিয়ে চোখে পানি এসে যায় শিমুলের। অসহায় শিমুল এখন দৈনিক মজুরি দিয়ে যা আয় হয় তা দিয়ে এক বেলা খেয়ে থাকেন তো অন্য বেলায় না খেয়ে থাকেন।</p> <p>এমনিভাবে সেখানে কথা হয় অরুণ মল্লিক, রামপ্রসাদ, জয়দেবসহ ভুক্তভোগী অনেকের সঙ্গে। তাদের সবার বক্তব্য নারায়ণ চন্দ্র চন্দ মন্ত্রী বলে একযোগে ৩০ বিঘা জমি জোর করে দখল করে ইটের ভাটা করেন। ভাটার নামকরণও করা হয় চন্দের বাবার নামে। এরপর ধীরে ধীরে ভাটা এলাকা সম্প্রসারণ করেন পার্শ্ববর্তী জমি নিয়ে। যেখানে আগে ফসল ফলতো আজ সেখানে কালো ধোয়া।</p> <p>অবশ্য ওই ইট ভাটাটি এখনও অনুমোদনবিহীন। পরিবেশ অধিদপ্তরের তৎকালীন বিভাগীয় পরিচালক মো. ইকবাল হোসেন বলেন, তিনি দুই বছর দায়িত্ব পালন করাকালীন অনেক বারই তাকে অনুরোধ করা হয়েছিল ইট ভাটার লাইসেন্স দেওয়ার জন্য। কিন্তু দেননি।</p> <p>জনশ্রুতি আছে, নারায়ণ চন্দ্র চন্দের অবৈধ টাকা হুন্ডি করে ভারতে পাঠানো হয় কয়েকজন ব্যবসায়ীর মাধ্যমে। এর মধ্যে কৈয়া এলাকার নদী দখল করে ইটের ভাটা তৈরি করা এক ব্যবসায়ী যেমন রয়েছেন তেমনি ঢাকার হাজী এয়ার ট্রাভেলসের মালিকের নামও শোনা যায়। রবিবার সীমান্তে গ্রেপ্তার হওয়ার পর ঢাকার একটি বাড়িতে শতকোটি টাকা রেখে যাচ্ছিলেন এমন খবরটিও খতিয়ে দেখছে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো।</p> <p>ইউপি নির্বাচনে মনোনয়ন বাণিজ্য ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে দল বিবেচনা না করেই মনোনয়ন দেওয়া হতো এমনকি নিজস্ব প্রার্থীকে যে কোনোভাবেই জিতিয়ে আনা হতো বলেও এলাকাবাসী জানান। এজন্য কোটি কোটি টাকার লেনদেন হতো বলেও ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করেন। </p> <p>তারা বলেন, ইউপি নির্বাচনে যারাই চন্দের লোক থাকবেন তারাই কেবল বিজয়ী হবেন এটি অনেকটা নিয়মে পরিণত হয়। আবার কেউ কোনোভাবে বিজয়ী হলেও পরে তাকে আর রাখা হবে না পৃথিবীতে। ৬ জুলাই শরাফপুর ইফপির চেয়ারম্যান শেখ রবিউল ইসলাম খুন হওয়ার পর এ বিষয়টি আরো স্পষ্ট হয়ে ওঠে।</p> <p>এভাবেই খুলনা-৫ আসনের সাবেক এমপি নারায়ণ চন্দ্র চন্দ ও তার পরিবারের নানা অপকর্মের কথা তুলে ধরেন এলাকাবাসী। অনেকে আবার ভয়ে এখনও মুখ খুলছেন না। তবে বিগত ১৬ বছরের ফ্যাসিবাদী শাসনামলে বিরোধী মতের যারা তার মাধ্যমে আশ্রয়-প্রশ্রয় পেয়েছিলেন তারা এখনও চন্দের যাতে কোন ক্ষতি না হয় সেটি দেখভাল করছেন বলেও জনশ্রুতি রয়েছে।</p> <p>গতকাল সকালে ডুমুরিয়া সদরের প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের সামনের চন্দের নিজ বাড়িতে গিয়ে গেট বন্ধ পাওয়া যায়। ভেতরে কেউ আছেন কি না সেটি বোঝার উপায় নেই। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে গেট নক করেও সাড়া মেলেনি। অর্থাৎ যেটি একসময় ছিল জমজমাট আজ সেটি নীরব স্থাপনা।</p> <p>ডুমুরিয়া বাজারের একজন ব্যবসায়ী বলেন, তারা অনেকটাই নাজেহাল হয়েছেন চন্দ পরিবারের দ্বারা। তবে তিনি কোনো প্রতিশোধ নিতে রাজী নন। এমনকি মামলাও করবেন না। কেননা, গ্রেপ্তারের পর যে অবস্থা হয়েছে সেই চেহারা দেখে অনুধাবনের সুযোগ এসেছে যার যার কর্মফল অবশ্যই একদিন ভোগ করতে হবে।</p>