গত ঈদে যে স্বজনরা অপেক্ষা করেছিল তাদের প্রিয়জনের বাড়ি ফেরার, এবার তাদের সেই প্রিয়জন অনেকেই নেই। সেই তালিকায় জন্মের আগেই বাবাহারা মো. রাইয়ান। তার জন্মের দুইমাস আগেই বাবা শহীদ হয়েছেন। সাত বছর বয়সী নৌফাও বাবাহারা।
তারা ভাই-বোন উৎসুক চোখে এখন কেবল বাবাকেই খোঁজে। সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন নিহতের স্ত্রী হ্যাপী আক্তার। সংসারের একমাত্র উপর্জনোক্ষম ব্যক্তি ছিলেন তিনি।
গত বছরের ৪ আগস্ট ছাত্রআন্দোলন চলাকালে কুমিল্লার দেবিদ্বার পৌরসভায় আওয়ামীলীগ-যুবলীগ কর্মীদের গুলিতে নিহত হন আবদুর রজ্জাক রুবেল।
রুবেলের স্ত্রী হ্যাপী আক্তার বলেন, ‘আমাদের কীসের ঈদ! ৭ বছরের নৌফা বারবার বাবাকে খুঁজে। সে এখনো জানে না তার বাবা নেই। কোলে পাঁচ মাসের মো. রাইয়ান বাবাকে দেখেনি। গত বছর ঈদে সবার জন্য নতুন জামা-কাপড় নিয়ে আসছিল নৌফার বাবা।
’
তিনি বলেন, ‘প্রতিবেশীদের ঘরে নতুন জামা কাপড় দেখে ঘরে এসে কান্না করছিল। ওর বাবা বেঁচে থাকলে কিনে দিত। পাষণ্ডরা আমার স্বামীকে গুলি করে হত্যা করেছে। আমাদের জীবনে আর কোনোদিন সেই ঈদের আনন্দ আসবে না। আর ঈদ নেই আমার পরিবারে।
’
আরো পড়ুন
মন ভালো নেই জুলাই শহীদ সাকিব পরিবারের
সবার ঘরেই বইছে ঈদুল ফিতরের আমেজ। কিন্তু কুমিল্লায় জুলাই আন্দোলনে শহীদ হওয়া ৩৮ শহীদ পরিবারে নেই ঈদ আনন্দের ছিঁটেফোটা। গত বছরও যে পরিবারগুলোতে ঈদের আনন্দ ছিল আজ তা শুধুই স্মৃতি। তাদের পরিবারে এবারের ঈদ যেন বিষাদের ঈদ। এসব শহীদদের অনেকেই ছিলেন সংসারের একমাত্র উপর্জনক্ষম ব্যক্তি। তাদের হারিয়ে দিশেহারা পরিবারগুলো। তাদের কেউ হারিয়েছেন বাবা, কেউবা সন্তান কেউ আবার স্বামী। জুলাই ছাত্র আন্দোলনে কুমিল্লা জেলায় ৩৮ শহীদের মধ্যে দেবিদ্বারেই শহীদ হয়েছেন ১৩ জন।
এছাড়াও বরুড়ায় ৩ জন, চান্দিনায় ২ জন, চৌদ্দগ্রামে ২ জন, দাউদকান্দিতে ৩ জন, হোমনায় ১ জন, লাকসাম ২ জন, মনোহরগঞ্জে ১ জন, মুরাদনগরে ৪ জন, নাঙ্গলকোটে ৩ জন, সদর দক্ষিণে ২ জন ও তিতাসে ১ জন শহীদ হয়েছেন।
বাড়ির পাশের একটি কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে ২০ জুলাই নিহত দেবিদ্বারের সূর্যপুর গ্রামের শহীদ কাদির হোসেন সোহাগকে। কবরের পাশে প্রায় সময়ই দাঁড়িয়ে কান্নাকাটি করেন তার মা নাসিমা বেগম। কাদির হোসেন সোহাগের বাড়ি সূর্যপুর গ্রামে।
তার মা নাসিমা বেগম বলেন, ‘স্বামীকে হারিয়েছি ২০ বছর আগে। মানুষের বাড়ি বাড়ি কাজ করে দুই সন্তানকে বড় করেছি। কাদির হোসেন সোহাগ কুরিয়ার সার্ভিসের ডেলিভারিম্যান হিসেবে কাজ করে সংসার চালাত। আর ছোট ছেলে শহীদুল লেখাপড়া করত। গত ২০ জুলাই রাতে সাড়ে ৮টার দিকে গোপীবাগ এলাকায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায় সোহাগ। এরপর থেকে সংসারে আনন্দ বলতে কিছু নেই। গত বছর ঈদে আমাকে কাপড় কিনে দিয়েছে সোহাগ। এই ঈদে আমার বুকের ধন কাছে নেই। আমি কীভাবে সন্তান ছাড়া ঈদ করব!’
চৌদ্দগ্রামের শহীদ সাখাওয়াত হোসেন সাদাতের বাবা আব্দুল মজিদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ছেলে হারানোর শোকে পুরো পরিবার স্তব্ধ। ঈদ বলতে কিছু নেই। সাদাতের মা এখনো ছেলের জন্য কান্নাকাটি করেন। তাকে সান্তনা দেওয়ার ভাষা হারিয়ে ফেলেছি।’
এ বিষয়ে কুমিল্লা জেলা প্রশাসক মো. আমিরুল কায়ছার বলেন, ‘কুমিল্লার ৩৮ শহীদ পরিবারের মধ্যে সংশ্লিষ্ট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের মাধ্যমে ঈদ উপহার ও খাদ্য সামগ্রী পাঠানো হয়েছে। এছাড়াও সরকারি অনুদানের সঞ্চয়পত্র প্রথম কিস্তির ১০ লাখ টাকা এসেছে। আমি নিজে এগুলো বিতরণ করেছি এবং যারা আহত আছেন তাদের জন্য ১ ক্যাটাগরিতে ২ লাখ ও ১ লাখ করে বিতরণ করা হয়েছে।’
তিনি আরো বলেন, ‘যারা জুলাই আন্দোলনে শহীদ ও আহত হয়েছেন আমরা তাদের পরিবারের সার্বক্ষণিক খোঁজ খবর রাখছি।’
২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে ঘটেছে দেশের ইতিহাসে অভূতপূর্ব রাজনৈতিক পটপরিবর্তন। শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকে গণঅভ্যুত্থান, ৩০ দিনের রক্তক্ষয়ী আন্দোলনের পর অবসান হয় শেখ হাসিনার সাড়ে ১৫ বছরের কর্তৃত্ববাদী শাসন।