<article> <p>গলগণ্ড বা ঘ্যাগ হলো আমাদের গলার সম্মুখভাগে নিচের অংশে অবস্থিত থাইরয়েড গ্রন্থির একটি রোগ, যার ফলে থাইরয়েড গ্রন্থি ফুলে গিয়ে গলায় ফোলাভাব দেখা যায়। থাইরয়েড একটি প্রজাপতি আকৃতির গ্রন্থি, যা আদম আপেলের ঠিক নিচে অবস্থিত এবং স্বাভাবিক অবস্থায় এটা দৃশ্যমান নয় এবং হাত দিয়ে অনুভব করা যায় না।<br /> থাইরয়েড গ্রন্থির কাজ হলো হরমোন তৈরি করা। এতে অবস্থিত ফলিকুলার কোষ থেকে নিঃসৃত হয় থাইরক্সিন ও ট্রাই আয়োডো থাইরোনিন নামক হরমোন। মানুষের বৃদ্ধি, বিকাশ, তাপমাত্রা, নাড়ির গতি, শারীরবৃত্তিক আর বিপাকীয় নানা ক্রিয়া-প্রক্রিয়া সাধন করার জন্য এই হরমোন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আর প্যারাফলিকুলার বা সি কোষ থেকে নিঃসৃত হয় ক্যালসিটোনিন নামক হরমোন।</p> </article> <article> <p><strong>কারণ</strong></p> <p>⬤     খাদ্য ও খাবার পানিতে আয়োডিনের অভাব<br /> ⬤     অটোইমিউন ডিজিজ (হাশিমোটোস থাইরয়ডাইটিস)<br /> ⬤     গ্রেভস ডিজিজ<br /> ⬤     থাইরয়েড নডিউল, টক্সিক থাইরয়েড নডিউল<br /> ⬤      থাইরয়েড ক্যান্সার<br /> ⬤     বয়ঃসন্ধিকাল এবং গর্ভাবস্থার মতো প্রাকৃতিক স্বাভাবিক অবস্থায়ও থাইরয়েডের আকার সামান্য বেড়ে যেতে পারে<br /> ⬤     প্রদাহজনিত কারণ<br /> ⬤     নির্দিষ্ট কিছু ওষুধ গ্রহণ (লিথিয়াম, এমায়োডেরন ইত্যাদি)<br /> ⬤     খাবারের কিছু কিছু উপাদান থাইরয়েড হরমোন তৈরি বাধাগ্রস্ত করে এবং এর ফলে গলগণ্ড হতে পারে। এদের মধ্যে কিছু কিছু সবজি যেমন বাঁধাকপি, ফুলকপি, শালগম, ব্রকোলি, ব্রাসেলস স্প্রাউটস, কেল, কলার্ড গ্রিনস, বোক চয় এবং সয়াসমৃদ্ধ খাবার যেমন - সয়া দুধ, সয়া সস, তোফু, টেম্প, মিসো অন্যতম।</p> </article> <p>তবে এগুলো পুষ্টিকর খাবার এবং স্বাভাবিক পরিমাণে, এমনকি প্রতিদিন খেলেও ক্ষতির আশঙ্কা নেই। তা ছাড়া ভালোভাবে সিদ্ধ করে খেলে এদের ক্ষতিকর উপাদান অনেক কমে যায়। তাই গলগণ্ড হলে এগুলো খাওয়া একেবারেই বন্ধ করা বিজ্ঞানসম্মত নয়। তবে থাইরক্সিন বড়ি খাচ্ছেন এমন রোগী এবং যাঁদের আয়োডিনের ঘাটতির আশঙ্কা রয়েছে তাঁদের সয়াসমৃদ্ধ খাবার গ্রহণে সতর্কতা জরুরি।</p> <p><strong>কাদের বেশি হয়</strong></p> <p>⬤     ৪০ বছরের ঊর্ধ্বে<br /> ⬤     পরিবারে কারো হয়ে থাকলে তাদের সম্ভাবনা বেড়ে যায়<br /> ⬤     সমুদ্র থেকে দূরবর্তী এলাকা, যেখানে খাবার ও পানিতে আয়োডিনের পরিমাণ কম<br /> ⬤     মহিলারা বেশি আক্রান্ত হয়। প্রেগন্যান্সি, মেনোপজ অবস্থায় বেশি দেখা যায়<br /> ⬤     অন্য কোনো রোগের কারণে আগে মাথা বা গলায় রেডিয়েশন থেরাপি পেয়েছেন এমন ব্যক্তি।</p> <article> <p><strong>লক্ষণ</strong><br /> গলগণ্ডের প্রাথমিক লক্ষণ হলো সাধারণত গলায় একটি লক্ষণীয় ফোলা বা চাকাভাব। যদি আপনার থাইরয়েড গ্ল্যান্ডে নডিউল থাকে, তবে সেগুলো আকারে খুব ছোট থেকে খুব বড় পর্যন্ত হতে পারে, এক পাশে কিংবা উভয় পাশে এবং এক থেকে একাধিক হতে পারে। গলগণ্ড সাধারণত ব্যথাহীন, কিন্তু যদি এটি খুব বড় হয়ে যায়, তবে এটি আপনার পক্ষে খাবার গিলতে বা শ্বাস নিতে সমস্যা করতে পারে, বিশেষ করে চিৎ হয়ে শুলে। এ ছাড়া খুসখুসে কাশি, মাথার ওপরে হাত বাড়ালে মাথা ঘোরা, কণ্ঠে কর্কশতা বা স্বরভঙ্গ ইত্যাদি হতে দেখা যায়।</p> </article> <article> <p><strong>পাশাপাশি হরমোনের তারতম্য দেখা দিলে যেমন—</strong><br /> ⬤     থাইরয়েড হরমোন কমে যাওয়া বা হাইপোথাইরয়েডিজম, এর কারণে শারীরিক দুর্বলতা বা অবসাদ, কর্মস্পৃহা কমে যাওয়া, ওজন বেড়ে যাওয়া, বন্ধ্যাত্ব, শীত সহ্য করতে না পারা, কোষ্ঠকাঠিন্য ইত্যাদি হতে পারে।<br /> ⬤     থাইরয়েড হরমোন বেড়ে যাওয়া বা হাইপারথাইরয়েডিজমের কারণে অনিয়মিত হৃদস্পন্দন বা বুক ধড়ফড় করা, অস্থিরতা,  ব্যাখ্যাতীত ওজন কমে যাওয়া, অতিরিক্ত ঘাম বা গরম অসহ্য লাগা, হাত কাঁপা, পাতলা পায়খানা ইত্যাদি লক্ষণ পরিলক্ষিত হয়।<br /> ⬤     কারো কারো ক্ষেত্রে গলগণ্ড আমাদের বুকের সামনের হাড়ের নিচে হতে পারে। এ ক্ষেত্রে রোগী ন্যূনতম পরিশ্রমে রোগীর শ্বাসকষ্ট হতে পারে। এ ছাড়া কাশি, দম বন্ধ লাগা।</p> <p><strong>রোগ নির্ণয়</strong><br /> আপনার চিকিৎসক শারীরিক পরীক্ষার সময় গলায় হাত দিয়ে থাইরয়েড গ্রন্থির ফোলা ভাব বা চাকা আবিষ্কার করতে পারেন। অনেক সময় অন্য কোনো কারণে গলার আলট্রাসাউন্ড বা ইমেজিং করার সময়ও এটা দেখা যেতে পারে। আবার কিছু ক্ষেত্রে রোগী নিজেও গলায় ফোলা বা চাকা অনুভব করে চিকিৎসকের কাছে আসেন।</p> <p><strong>পরীক্ষা-নিরীক্ষা</strong><br /> আপনার গলগণ্ড দেখা দিলে চিকিৎসক নিম্নোক্ত পরীক্ষাগুলো প্রয়োজন অনুসারে করবেন।<br /> <strong>হরমোন পরীক্ষা :</strong> রক্ত পরীক্ষা আপনার থাইরয়েড (সিরাম এফটি৩, এফটি৪) এবং পিটুইটারি গ্রন্থি (এসটিএসএইচ) দ্বারা উৎপাদিত হরমোনের সংখ্যা নির্ধারণে সাহায্য করে। এর মাধ্যমে আপনার থাইরয়েড গ্রন্থির নিষ্ক্রিয়তা বা অতি সক্রিয়তা নির্ণয় করা যায়।<br /> <strong>অ্যান্টিবডি পরীক্ষা :</strong> কিছু  অস্বাভাবিক অ্যান্টিবডি (টিপিও) আপনার শরীরে গলগণ্ড তৈরি করতে পারে। তাই একটি রক্ত পরীক্ষা এই অ্যান্টিবডিগুলোর উপস্থিতি নিশ্চিত করতে সাহায্য করবে, যা চিকিৎসা পদ্ধতি নিরূপণে সাহায্য করে।<br /> <strong>আলট্রাসনোগ্রাফি :</strong> প্রত্যেক গলগণ্ড রোগীর এই পরীক্ষা করা দরকার। এর মাধ্যমে থাইরয়েড গ্রন্থির আকার, আকৃতি, অবস্থান এবং বিস্তৃতি প্রকাশ করতে সক্ষম এবং এতে এমন কোনো নডিউল রয়েছে, যা আপনার ডাক্তার অনুভব করতে পারেননি, তা-ও নির্ণয় করা যায়। পাশাপাশি গলায় কোনো লিম্ফনোড আছে কি না যা মেটাস্টাসিস নির্দেশ করে তা নির্ণয় করা সম্ভব হয়।<br /> <strong>একটি থাইরয়েড স্ক্যান :</strong> এই পদ্ধতির সময় একটি তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ আপনার শিরাতে ইনজেকশনের মাধ্যমে দেওয়া হয়। পরবর্তী সময়ে আপনার থাইরয়েডের স্ক্যান করা হয়। থাইরয়েড স্ক্যানগুলো আপনার থাইরয়েডের প্রকৃতি এবং আকার সম্পর্কে নানা তথ্য প্রদান করতে সক্ষম, তবে এগুলো আলট্রাসাউন্ড পরীক্ষার চেয়ে বেশি আক্রমণাত্মক, সময়সাপেক্ষ এবং ব্যয়বহুল।<br /> <strong>একটি নিডেল পরীক্ষা :</strong> এটা খুবই জরুরি। এর মাধ্যমে একটা মোটা সুঁই আপনার ফোলা স্থানে প্রবেশ করানো হয়, যেখান থেকে খানিকটা তরল বা টিস্যু নিয়ে ল্যাবে টেস্ট করার জন্য পাঠানো হয়। এতে গলগণ্ড রোগের কারণ জানা যায়, বিশেষ করে ক্যান্সারের উপস্থিতি নির্ণয় করা যায়। তাই পরবর্তী চিকিৎসা ও অপারেশনের ধরন নির্ধারণের জন্য এই পরীক্ষা খুব জরুরি।<br /> এ ছাড়া রোগের বিস্তৃতি ও চিকিৎসা পদ্ধতি ঠিক করার জন্য অনেক সময় এক্স-রে, সিটি স্ক্যান, এমআরআই স্ক্যান ও অন্যান্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার প্রয়োজন হতে পারে।</p> <p><strong>চিকিৎসা</strong><br /> গলগণ্ডের আকার, অবস্থান, উপসর্গ এবং কারণের ওপর নির্ভর করে চিকিৎসা পদ্ধতি নির্ধারণ করা হয়। ক্যান্সার না হয়ে থাকলে এবং হরমোনের মাত্রা স্বাভাবিক থাকলে যেহেতু ছোট গলগণ্ড লক্ষণীয় নয় এবং সমস্যা সৃষ্টি করে না, তাঁদের সাধারণত কোনো চিকিৎসার প্রয়োজন হয় না, তবে নির্দিষ্ট সময় অন্তর ফলোআপ করা প্রয়োজন হয়।</p> <p><strong>ওষুধ</strong><br /> আপনার যদি হাইপোথাইরয়েডিজম (থাইরয়েড হরমোন স্বল্পতা) থাকে, তবে আপনার ডাক্তার থাইরয়েড হরমোন প্রতিস্থাপনের ওষুধ দেবেন, আবার হাইপারথাইরয়েডিজম (থাইয়য়েড হরমোন আধিক্য) থাকলে হরমোন নিষ্ক্রিয় করার ওষুধ দেবেন। প্রদাহজনিত গলগণ্ডের জন্য আপনাকে অ্যাসপিরিন বা কর্টিকোস্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ দিতে পারেন।</p> <p><strong>তেজস্ক্রিয় আয়োডিন</strong><br /> অত্যধিক সক্রিয় থাইরয়েডের চিকিৎসার জন্য আপনি এটি একটি ক্যপসুল হিসেবে গ্রহণ করতে পারেন। এটি কোষ মেরে আপনার থাইরয়েডকে সংকুচিত করতে সাহায্য করে। আবার ক্যান্সার অপারেশনের পর রেসিডুয়াল বা থেকে যাওয়া টিস্যু ধ্বংস করার জন্যও তেজস্ক্রিয় আয়োডিন খাওয়ানো হয়। তার পর থেকে আপনাকে হরমোনের ওষুধ সারা জীবন চালিয়ে যেতে হবে।</p> <p><strong>সার্জারি</strong><br /> ⬤     অনেক বড় আকারের গলগণ্ড, যা শ্বাসনালি, খাদ্যনালি, গলার স্নায়ু বা রক্তনালির ওপর চাপ প্রয়োগ করে শ্বাসকষ্ট, খাবার গিলতে অসুবিধা, কণ্ঠস্বর পরিবর্তন বা অন্যান্য সমস্যার সৃষ্টি করে (কমপ্রেশন সিম্পটম)।<br /> ⬤     পরীক্ষা-নিরীক্ষায় থাইরয়েডের ক্যান্সার ধরা পড়লে বা সন্দেহ হলে। এ ব্যাপারে দেরি করলে পরবর্তী চিকিৎসা জটিল করে তুলবে।<br /> ⬤     যদি ওষুধ বা তেজস্ক্রিয় আয়োডিন দিয়ে হাইপারথাইরয়েডিজম রোগ না সারে অথবা ওষুধ বা তেজস্ক্রিয় আয়োডিন দেওয়ার পর জটিল পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হয় বা রোগী এ ধরনের চিকিৎসা গ্রহণের জন্য সার্বিক বিচারে উপযোগী না হন। রোগী ওষুধ বা তেজস্ক্রিয় আয়োডিন দিয়ে চিকিৎসায় রাজি না থাকলেও বিকল্প হিসেবে থাইরয়েড সার্জারি করা হয়।</p> <p><strong>প্রতিরোধ</strong><br /> ⬤     বাংলাদেশের ভৌগোলিক ও ভূতাত্ত্বিক পরিস্থিতিতে আয়োডিনের অভাবজনিত হাইপোথায়রয়েডিজম এবং এর ফলস্বরূপ গলগণ্ড খুব বেশি দেখা যায়। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলীয় জেলাগুলো যেমন—বৃহত্তর রংপুর জেলা, বৃহত্তর দিনাজপুর জেলা, বৃহত্তর ময়মনসিংহ (বিশেষ করে শেরপুর ও জামালপুর জেলা) জেলার বিপুলসংখ্যক নারী ও পুরুষ আয়োডিনের অভাবজনিত গলগণ্ডে ভুগছে। তাদের জন্য পর্যাপ্ত আয়োডিনের ব্যবস্থা করতে পারলেই ব্যাপক জনগোষ্ঠী গলগণ্ডের হাত থেকে রেহাই পায়। বাংলাদেশে ১৯৭৭ সালে গলগণ্ড ও আয়োডিনঘটিত অন্যান্য অসুস্থতা প্রশমনের কার্যক্রম শুরু হয়। বর্তমানে নির্দিষ্ট মাত্রার আয়োডিন মিশ্রিত লবণ বাজারজাত করা বাধ্যতামূলক। পক্ষান্তরে আয়োডিনের আধিক্যও গলগণ্ড এবং থাইরয়েডের অন্যান্য সমস্যার কারণ হতে পারে। তাই এ ব্যাপারে ব্যাপক নজরদারি ও জনসচেতনতা প্রয়োজন।</p> <p>⬤     গলগণ্ড হয়েছে বা হচ্ছে মনে হলেও সংশ্লিষ্ট  চিকিৎসকের কাছে যাওয়া উচিত।<br /> ⬤     যাঁরা থাইরয়েড হরমোনের ওষুধ খাচ্ছেন, তাঁরা চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী নির্দিষ্ট সময় অন্তর হরমোন পরীক্ষা ও ফলোআপ করবেন। কোনো অবস্থায় নিজের ইচ্ছামতো হরমোনের ওষুধ বন্ধ বা মাত্রা পরিবর্তন করবেন না।<br /> ⬤     অপারেশনের পরও অনেক সময় কিছু ওষুধ এবং ফলোআপের প্রয়োজন হতে পারে। আপনার চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী প্রয়োজনে হরমোনের ওষুধ সেবন ও চেকআপ নির্দিষ্ট বিরতিতে করুন।</p> <p>লেখক : <strong>সিনিয়র কনসালট্যান্ট (ইএনটি)<br /> নাক, কান, গলা রোগ বিশেষজ্ঞ ও হেড নেক সার্জন<br /> চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল</strong></p> </article>