ইউক্রেনের মুসলিমরা চলমান যুদ্ধের মধ্যেও ঈদ উদযাপন করছেন। ঈদ উদযাপনে কিয়েভের মসজিদে জড়ো হয়েছিলেন ক্রিমিয়ার তাতার মুসলিমরা। চলমান সংঘাতের মধ্যেই কিয়েভে জড়ো হয়েছিলেন তারা। ক্রিমিয়ান তাতার সম্প্রদায় তাদের স্বদেশ প্রতিরক্ষায় ইউক্রেনীয়দের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ।
এ দিন সেনা এবং বেসামরিক নাগরিকরা ধর্মীয় সীমানা অতিক্রম করে বিশ্বাসের মাধ্যমে তাদের যৌথ সংগ্রামে সান্ত্বনা খুঁজে পেয়েছিলেন।
অনেক তাতাররা ইউক্রেন যুদ্ধকে রাশিয়ান আধিপত্যের বিরুদ্ধে তাদের শতাব্দীব্যাপী প্রতিরোধের আরেকটি অধ্যায় হিসেবে দেখেন। যুদ্ধ অব্যাহত থাকলেও ঈদের আনন্দ তাদের সাময়িক অবকাশ এবং শান্তি দিয়েছে। সম্প্রদায়টি দৃঢ়ভাবে তাদের ইউক্রেনীয় আনুগত্য প্রকাশ করে এবং তার সঙ্গে তাদের স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক পরিচয়ও বজায় রেখেছে।
তাদের গল্প যুদ্ধের মানবিক মূল্য এবং সংঘাতপূর্ণ অঞ্চলে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সম্প্রদায়ের স্থিতিস্থাপকতা উভয়কেই প্রতিফলিত করে।
ক্রিমিয়ার তাতাররা কৃষ্ণসাগরের উত্তরাঞ্চলে ক্রিমিয়া উপত্যকার ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী। তাদের মূল পেশা ছিল পশুপালন। ক্রিমিয়া সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্গত ছিল।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সোভিয়েত সরকার ক্রিমিয়া থেকে তাতারদের বিতাড়িত করে। যার মধ্যে সোভিয়েত সেনাবাহিনীতে কর্মরত ক্রিমিয়ান তাতারদের পরিবারও অন্তর্ভুক্ত ছিল। সোভিয়েত শাসক জোসেফ স্তালিনের কারণে তাতাররা মধ্য এশিয়ায়, বিশেষ করে উজবেকিস্তানে পাড়ি জমাতে বাধ্য হন।
১৯৪৪ সালে ক্রিমিয়ায় প্রায় ১ লাখ ৮০ হাজার তাতার বসবাস করত। সময় ক্ষুধা, শীত ও রোগে প্রায় অর্ধেক তাতার মারা যায়।
নির্বাসনের ফলে ক্রিমিয়ান তাতাররা তাদের জনসংখ্যার ১৮ থেকে ৪৬ শতাংশ হারায়। এ ঘটনাকে গণহত্যা হিসেবে চিহ্নিত করেছে ইউক্রেনসহ কয়েকটি দেশ।
সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে গেলে ৪৫ বছর পর তাতাররা ক্রিমিয়ায় ফিরতে সক্ষম হলেও রাশিয়া ২০১৪ সালে ক্রিমিয়া দখল করে নেয়, ফলে ফের দেশ ছাড়তে বাধ্য হয় তারা। ২০১৪ সালের মার্চে রুশ সেনারা ক্রিমিয়ার নিয়ন্ত্রণ নিলে প্রায় ৩০ হাজার তাতার ইউক্রেনে পাড়ি জমান। রুশ সেনারা তাতারদের ওপর চরম দমন-পীড়ন চালিয়েছিল তারা।
একসময় কয়েক হাজার তাতার সোভিয়েত রেড আর্মিতে কর্মরত ছিলেন। এরপরও সোভিয়েত শাসক জোসেফ স্তালিন বিশ্বাস করতেন, তাতাররা নাৎসিদের অনুগত। সোভিয়েত আমলে তাতারদের বিরুদ্ধে বছরের পর বছর ধরে এমন প্রচারণা চালানো হয়েছে। তিনি ক্রিমিয়ায় তাতারদের নিজস্ব ভাষাচর্চায় নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিলেন। এসব কারণে অতীত থেকেই তাতাররা সোভিয়েতবিরোধী মনোভাব পোষণ করেন। এখন সোভিয়েতের জায়গায় বসে আছে রাশিয়া।
২০১৪ সালের পর প্রায় ১০ শতাংশ তাতার ক্রিমিয়া থেকে ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভ, দেশটির দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর খেরসনে স্থানান্তর হয়।
১৯৬৭ সাল থেকে তাতারদের কয়েকজনকে ফিরে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। ১৯৮৯ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের সুপ্রিম সোভিয়েত ক্রিমিয়ান তাতারদের তাদের মাতৃভূমি থেকে অপসারণকে অমানবিক এবং আইনহীন বলে নিন্দা জানায়, কিন্তু ১৯৮৯ সালে প্রত্যাবর্তনের পূর্ণ অধিকারনীতিতে পরিণত হওয়ার আগে মাত্র একটি ক্ষুদ্র শতাংশ ফিরে আসতে সক্ষম হয়েছিল।
২০১৪ সাল থেকে তাতাররা আনুষ্ঠানিকভাবে ইউক্রেনের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী হিসেবে স্বীকৃত। বর্তমান রাশিয়ান প্রশাসন তাদের ‘জাতীয় সংখ্যালঘু’ বলে মনে করে, কিন্তু ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী নয়। যদিও সোভিয়েত ইউনিয়ন তাদের নির্বাসন এবং পরবর্তীকালে ক্রিমিয়ান স্বায়ত্তশাসিত সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র ভেঙে দেওয়ার আগে তাদের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী বলে মনে করত। ক্রিমিয়ান তাতাররা ক্রিমিয়ার জনসংখ্যার প্রায় ১৫ মতাংশ। তুরস্ক , উজবেকিস্তান, রোমানিয়া, বুলগেরিয়া এবং মহাদেশীয় ইউক্রেনে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে ক্রিমিয়ান তাতারপ্রবাসী রয়েছে।
কিয়েভের সড়কে বের হলে আশপাশে চোখে পড়বে তাতারদের অসংখ্য রেস্তোরাঁ। পশুপালন ছেড়ে তাতাররা এখন রেস্তোরাঁশিল্পে এসেছেন। কিয়েভের যেখানে-সেখানে উড়তে দেখা যায় তাতারদের স্বতন্ত্র পতাকা। রুশ আগ্রাসনে তাতাররা এখন ক্রিমিয়া ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। ইউক্রেন-রাশিয়ার সাম্প্রতিক উত্তেজনায় আবার অনিশ্চয়তায় পড়েছেন তাতাররা।
সূত্র : আলজাজিরা, উইকিপিডিয়া