যশোরের শংকরপুর এলাকার গাড়িচালক শাওন মির্জা (১৮) ২০১৭ সালের ৫ এপ্রিল বন্ধু সাইদুর রহমান সাইদের সঙ্গে স্থানীয় পার্কে বেড়াতে যান। এরপর তাঁর স্বজনরা খবর পায় সাইদসহ তাঁকে ধরে নিয়ে গেছে পুলিশের গোয়েন্দা শাখা (ডিবি)। স্বজনরা ছুটে যায় থানায়, খোঁজ নেয় ডিবি অফিসেও। কোথাও শাওনের সন্ধান মেলেনি।
আজ আন্তর্জাতিক গুম দিবস
অনিশ্চয়তা কুরে কুরে খায় স্বজনদের
- আসকের হিসাবে গত ৬ বছরে নিখোঁজ ২০৫ জন, স্বাধীন তদন্ত কমিশন দাবি
এস এম আজাদ

এমন পরিস্থিতিতে আজ ৩০ আগস্ট বিশ্বজুড়ে পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক গুম দিবস।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশে গুম আলোচিত ইস্যুতে পরিণত হয়েছে। গুমের অভিযোগের বিষয়টি দেশের সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের বার্ষিক প্রতিবেদনেও স্থান পেয়েছে। গুমের অভিযোগের বিষয়ে তথ্য চেয়ে ২০১১ সাল থেকে এ পর্যন্ত বাংলাদেশ সরকারকে অন্তত ১০ দফা চিঠি ও তাগিদ পাঠিয়েছে গুমবিষয়ক জাতিসংঘের ওয়ার্কিং গ্রুপ।
মানবাধিকার সংস্থাগুলোর তথ্য মতে, নিখোঁজ হওয়া ব্যক্তিদের বেশির ভাগই রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত নয়। অনেকের বিরুদ্ধে মামলা বা গুরুতর অভিযোগও নেই।
মানবাধিকারকর্মী ও অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, নিখোঁজের ঘটনাগুলো তদন্ত করে রহস্য উন্মোচন না করায় আইনের শাসন এবং আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে। এ জন্য স্বাধীন তদন্ত কমিশন গঠনের ওপর জোর দিয়েছেন তাঁরা।
যশোরে নিখোঁজ হওয়া শাওনের বড় ভাই ফয়সাল মির্জা কান্নাজড়িত কণ্ঠে এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘সবাই বলে পুলিশই নিয়া গেছে। আমার ভাইটা কমিশনারের গাড়ি চালাইত। বন্ধুর জন্যই হয়তো পুলিশ তারে খাইছে! জেলের কোথাও পাইলাম না। রূপসা নদীতে ফেলে দিল কি না, তা-ও জানি না! বেঁচে থাকলে তো পাইতাম...।’
ফয়সাল জানালেন, সাইদের মা হীরা খাতুন পুলিশের বিরুদ্ধে একটি মামলা করেছিলেন। শেষে তিনি চাপে পড়ে মামলাটি তুলে নেন। তাঁরা ভয়ে আছেন। কাপড়ের ব্যবসায়ী ফয়সালও ভয়ে কারো বিরুদ্ধে কিছু বলতে চাচ্ছেন না।
জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘নিখোঁজ কারো কারো বিরুদ্ধে মামলা ছিল, পরে তাদের অনেককে গ্রেপ্তারও করা হয়েছে। তাদের অনেকেই স্বেচ্ছায় পালিয়ে আছে বলা যায়। মামলা বা জিডি (সাধারণ ডায়েরি) হলে পুলিশ সেটির তদন্ত করছে।’
আসকের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪ থেকে চলতি বছরের জুলাই মাস পর্যন্ত ৩৪৪ জন নিখোঁজ হয়েছে বলে ভুক্তভোগী পরিবার ও স্বজনরা অভিযোগ তুলেছে। পরবর্তী সময়ে তাদের মধ্যে ৪৪ জনের লাশ উদ্ধার হয়েছে। ৬০ জনকে গ্রেপ্তার দেখিয়েছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। ৩৫ জন ফিরে এসেছে। এ হিসাবে গত ছয় বছরে নিখোঁজ রয়েছে ২০৫ জন।
আসকের তথ্য মতে, ২০১৮ সালে নিখোঁজ হয়েছে ৩৪ জন। এর মধ্যে দুজন ফেরত এসেছে। ১৭ জনকে পরবর্তী সময়ে গ্রেপ্তার দেখিয়েছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। বাকি ১৫ জনের এখনো হদিস নেই। চলতি বছরের সাত মাসে (জুলাই পর্যন্ত) নিখোঁজ হয়েছে ১০ জন। তাদের মধ্যে দুজন ফেরত আসে এবং একজনকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। বাকি সাতজন এখনো নিখোঁজ। নিখোঁজ ব্যক্তিদের মধ্যে রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী ছাড়াও ছাত্র, চাকরিজীবী, ব্যবসায়ী, দোকানদার, গাড়িচালক, চিকিৎসক ও শিক্ষানবিশ আইনজীবী রয়েছেন।
বাংলাদেশের সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের ২০১০ থেকে ২০১৮ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনগুলোর প্রতিটিতেই গুমের অভিযোগ স্থান পেয়েছে। ২০১৮ সালে ২৫টি নিখোঁজ/গুমের অভিযোগের তথ্য জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের প্রতিবেদনে উল্লেখ আছে। ২০১৭ সালে ২২টি ঘটনা চিহ্নিত করেছে। ২০১৬ সালের প্রতিবেদনে ১১টি গুমের অভিযোগ স্থান পেয়েছে। ২০১৫ সালের প্রতিবেদনে একটি রাজনৈতিক দলের মুখপাত্রের গুম হয়ে যাওয়ার ঘটনা স্থান পায়। ২০১৪ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনে ১৪টি গুমের তথ্য ছিল। ২০১২ সালের প্রতিবেদনে বল প্রয়োগের মাধ্যমে ২০টি নিখোঁজ এবং ২০১১ সালে আটটি গুমের অভিযোগ কমিশনের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির উপদেষ্টা ও আসকের সাবেক প্রধান নির্বাহী নূর খান লিটন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘গুমের শিকার পরিবারগুলো বলছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জড়িত। এদের কেউ ফিরছে, কেউ গ্রেপ্তার, আর কেউ ফিরছে না। বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণে এসবের প্রতিকার হচ্ছে না। আমি মনে করি, স্বাধীন কমিশন গঠন করে ঘটনাগুলোর তদন্ত করা দরকার।’
আসকের নির্বাহী পরিচালক শীপা হাফিজা বলেন, ‘গুমের প্রভাব সমাজ ও রাষ্ট্রে সুদূরপ্রসারী। রাষ্ট্র বা রাষ্ট্রীয় বাহিনীর বিরাগভাজন তথা নিখোঁজ হওয়ার ভয়ে মানুষ মুক্তবুদ্ধির চর্চা, মত প্রকাশ কিংবা সরকারের বা রাষ্ট্রীয় বাহিনীর কর্মকাণ্ডের যেকোনো ধরনের সমালোচনা করা থেকে নিজেদের বিরত রাখে, যা প্রকৃতপক্ষে মানবাধিকার, গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি ও সুশাসনের বিকাশ ব্যাহত করে।’ তিনি আরো বলেন, ‘গুমের ঘটনা প্রতিরোধে এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ কমিশন গঠনের জন্য আসক সরকারের কাছে জোর দাবি জানাচ্ছে। পাশাপাশি গুমসংক্রান্ত আন্তর্জাতিক সনদ স্বাক্ষর করে গুম প্রতিরোধে সরকারের সদিচ্ছার বহিঃপ্রকাশ ঘটানোর জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছে।’
মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পুলিশ ও অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক উমর ফারুক বলেন, ‘গুমের ঘটনাগুলো বছরের পর বছর অমীমাংসিত থাকছে। এগুলোর সুরাহা হওয়া জরুরি। তা না হলে সমাজের অপরাধ পরিস্থিতির ওপর এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।’
সম্পর্কিত খবর

এসএসএফের সাবেক ডিজি মুজিবুরের ফ্ল্যাট-জমি জব্দ
নিজস্ব প্রতিবেদক

স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্সের (এসএসএফ) সাবেক মহাপরিচালক (ডিজি) লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. মুজিবুর রহমান ও তাঁর স্ত্রী তাসরিন মুজিবের নামে থাকা ফ্ল্যাটসহ ৭৯ শতক জমি জব্দের আদেশ দিয়েছেন আদালত। একই সঙ্গে তাঁদের নামে থাকা ৩৪টি ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধ করা হয়েছে। এসব হিসাবে এক কোটি ৪৪ লাখ ৯৯ হাজার ২০০ টাকা রয়েছে।
গতকাল রবিবার ঢাকা মহানগর দায়রা জজ মো. জাকির হোসেন গালিবের আদালত দুদকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এই আদেশ দেন।
জব্দ হওয়া সম্পদের মধ্যে মুজিবুর রহমানের নিজ নামে থাকা মিরপুরের মাটিকাটায় চার হাজার ৫০ বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাট, নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে থাকা একটি প্লটসহ চার দলিলে খিলক্ষেত, মিরপুর, সাভার ও ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের জমি এবং স্ত্রীর নামে থাকা ঢাকার ক্যান্টনমেন্টের সাহারা এলাকায় একটি ফ্ল্যাট, ঢাকার ক্যান্টনমেন্টের বাউনিয়া এলাকায় সাত দলিলে জমি রয়েছে। এ ছাড়া অবরুদ্ধ ব্যাংক হিসাবের মধ্যে মুজিবুর রহমানের ২৪টি ও তাঁর স্ত্রীর ১০টি হিসাব রয়েছে।
এদিন দুদকের উপপরিচালক মো. সিরাজুল হক জব্দ ও অবরুদ্ধ চেয়ে আবেদন করেন।
শেখ হাসিনা সরকারের পতনের আগ পর্যন্ত মুজিবুর রহমান এসএসএফের মহাপরিচালক ছিলেন।

হাছান মাহমুদ ও তাঁর স্ত্রীর ৬৫ অ্যাকাউন্টে ৭২২ কোটি টাকা লেনদেন
নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রায় সাড়ে ছয় কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন এবং ৭২২ কোটি টাকার সন্দেহজনক লেনদেনের অভিযোগে সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ হাছান মাহমুদ ও তাঁর স্ত্রী নূরান ফাতেমার বিরুদ্ধে আলাদা দুটি মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। গতকাল রবিবার রাজধানীর সেগুনবাগিচায় দুদকের সমন্বিত জেলা কার্যালয়ে (ঢাকা-১) মামলা দুটি করা হয়েছে। দুদকের জনসংযোগ কর্মকর্তা উপপরিচালক মো. আকতারুল ইসলাম গণমাধ্যমকে এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
প্রথম মামলায় হাছান মাহমুদকে আসামি করা হয়েছে।
আর দ্বিতীয় মামলায় নূরান ফাতেমা ও তাঁর স্বামী হাছান মাহমুদকে আসামি করা হয়েছে। মামলায় পরস্পর যোগসাজশে জ্ঞাত আয়ের উৎসর সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ পাঁচ কোটি ৫২ লাখ ৭৬ হাজার ৯০ টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন ও তা দখলে রাখা এবং ৫৬টি ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমে ৬৮৩ কোটি ১৫ লাখ ৩৭ হাজার ৫৫৪ টাকার সন্দেহজনক লেনদেনের অভিযোগ আনা হয়েছে।
দুর্নীতি দমন কমিশন আইন, ২০০৪-এর ২৭(১) ধারা; মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২-এর ৪(২) (৩) ধারা; দুর্নীতি প্রতিরোধ আইন, ১৯৪৭-এর ৫(২) ধারা এবং দণ্ডবিধির ১০৯ ধারায় মামলা দুটি করা হয়েছে।
প্রসঙ্গত, হাছান মাহমুদ আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের পর শেখ হাসিনার নেতৃত্বে যে সরকার গঠিত হয়, তাতে তাঁকে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। এর আগের সরকারে তিনি তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন।
গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার ভারতে পালিয়ে যাওয়ার এক সপ্তাহের মধ্যেই সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতা হাছান মাহমুদ, তাঁর স্ত্রী ও মেয়ের সব ধরনের ব্যাংক হিসাব জব্দ করার নির্দেশ দিয়েছিল আর্থিক গোয়েন্দা বিভাগ বাংলাদেশ ফিন্যানশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)।

ব্যাংক ও আর্থিক খাত ধ্বংসের হোতা লোটাস কামাল
জয়নাল আবেদীন

পতিত আওয়ামী সরকারের অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ওরফে লোটাস কামাল মাত্র পাঁচ বছরে ব্যাংক খাতকে গভীর খাদে নিক্ষেপ করেন। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মূল্যায়ন, তাঁর সময় ব্যাংকে নিয়ম-শৃঙ্খলার চরম অবনতি ঘটে। ক্ষমতার অপব্যবহার করে নামে-বেনামে ব্যাংকঋণ প্রদানের ঘটনা ঘটেছে অহরহ। সেসব ঋণ এখন খেলাপিতে পরিণত হয়েছে।
২০১৯ সালের ৭ জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের ১০ জানুয়ারি পর্যন্ত বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী ছিলেন আ হ ম মুস্তফা কামাল। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য মতে, ২০১৮ সাল শেষে ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৯৩ হাজার ৯১১ কোটি ৪০ লাখ টাকা। যা ছিল মোট ঋণের ১০.৩০ শতাংশ। আর তিনি যখন অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব থেকে অবসরে যান তখন ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ গিয়ে দাঁড়ায় এক লাখ ৪৫ হাজার ৬৩৩ কোটিতে।
২০১৯ সালের ১০ জানুয়ারি নিজ দপ্তরে ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক শেষে অর্থমন্ত্রী মুস্তফা কামাল ঘোষণা দিয়েছিলেন, আর এক টাকাও খেলাপি ঋণ বাড়বে না।
সূত্র জানায়, লোটাস কামালের বিরুদ্ধে যাতে ব্যবস্থা না নেওয়া হয় সে জন্য শাসানো হতো তদন্ত কর্মকর্তাদের। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গত ৬ আগস্ট বাংলাদেশ ব্যাংকের এক অনুসন্ধানী দলের কর্মকর্তা শাজু এস হোসোইল ফেসবুক পোস্টে লেখেন, ‘ঘটনা ঠিক কভিডের আগে। সোনালী ব্যাংকের প্রধান কার্যালয় ইন্সপেকশনে গিয়েছিলাম ২০২০ সালের জানুয়ারির ১৯-২০ তারিখের দিকে। সেখানে লোন ক্লাসিফিকেশনের কনসোলিডেটেড সিএলের এক্সেল শিটে ফিল্টার করে দেখি অবজেক্টিভ ক্রাইটেরিয়ায় ক্লাসিফায়েড হওয়া লোন আন-ক্লাসিফায়েড বানানো হয়েছে। প্রায় ১.৫-২ হাজার কোটি টাকার এই লিস্টে অনেক কম্পানির নাম। এই লিস্টের একটা কম্পানি ছিল ‘লোটাস ইঞ্জিনিয়ারিং’, যার অফিশিয়াল মালিক তখনকার অর্থমন্ত্রী লোটাস কামালের মেয়ে ও স্ত্রী। ঋণের বকেয়া ১.৭৫ কোটি টাকা, আর কিস্তি মাত্র ১৮ লাখ টাকার মতো। মাত্র ১৮ লাখের কিস্তি, তা-ও তিনি নিয়মিত পরিশোধ করেন না বলে সেটা সাব-স্ট্যান্ডার্ড বা অন্তত তিন মাস (অথবা ৯ মাস পরের সার্কুলার অনুযায়ী, মনে নেই) ধরে বকেয়া ছিল। মেমো দেওয়ার পর সোনালীর লোকজন অনেক হম্বিতম্বি করেছে, সময়ক্ষেপণ করেছে জবাব দেওয়ার। টিম লিডার বহলুল স্যারকেসহ আমাদের চেম্বারে ডেকে তখনকার এমডি ধমকের সুরে বলেছিলেন, ‘এই বহলুল, এগুলা কি শুরু করলেন।’
তিনি আরো লেখেন, ‘কামাল সাহেবকে এর পরে খেলাপি ঋণ নিয়ে মিডিয়াতে বড় বড় কথা বলতে দেখতাম। এমনকি খেলাপি আর এক টাকাও বাড়বে না এমন বক্তব্যও দিতে শুনতাম। ওই সময়টায় আমি বলতাম, যে দেশের অর্থমন্ত্রী ব্যাংকের টাকা দেন না, সে দেশের ভবিষ্যৎ অন্ধকার। আমার কথা সত্যি হতে বেশি সময় নেয়নি। পালানোর তালিকায় উনার নাম সবার আগে দেখলাম। কেন? আপনারা এখন জানেন।’
শেয়ারবাজার কারসাজি : ২০১০ সালে শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির ঘটনায় লোটাস কামালের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি অভিযোগ ওঠে। তিনি তখন অর্থ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ছিলেন। নানা অভিযোগ থাকার পরও শেখ হাসিনা সরকারের আমলে কোনো ধরনের শাস্তির মুখে পড়তে হয়নি লোটাস কামালকে। অনেকের অভিযোগ, তাঁর সিন্ডিকেটের কারসাজিতে নিঃস্ব হয়েছেন শেয়ারবাজারের লাখ লাখ বিনিয়োগকারী। লোপাট করে নেওয়া হয়েছে তাঁদের পুঁজি।
২০১০ সালের শেয়ারবাজার কারসাজিতে তৎকালীন পরিকল্পনামন্ত্রী লোটাস কামালের পকেটে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা গেছে বলে বিভিন্ন তদন্তে জানা যায়। শেয়ার জালিয়াতি করে প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেন বলে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে। ২০১০ সালের ওই কেলেঙ্কারির পর কৃষি ব্যাংকের তৎকালীন চেয়ারম্যান খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদকে প্রধান করে তদন্ত কমিশন গঠন করা হয়।
ব্যাংক হিসাব জব্দের আগেই সরানো হয় টাকা : গত ২২ আগস্ট আ হ ম মুস্তফা কামাল, তাঁর স্ত্রী কাশমেরী কামাল ও মেয়ে নাফিসা কামালের ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হয়। একই সঙ্গে তাঁদের মালিকানাধীন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাবের লেনদেন স্থগিত করা হয়। সূত্রের দাবি, দেশে-বিদেশে মুস্তফা কামাল ও তাঁর স্বজনের নামে কয়েক হাজার কোটি টাকার সম্পদ রয়েছে। সরকার পতনের আগেই কামাল ব্যাংক, রাজধানীর বাসা-অফিস থেকে টাকা ও স্বর্ণালংকার সরিয়ে নিয়েছেন।
লোটাস কামালের বর্তমান দায় : জানা যায়, এখনো সোনালী, পদ্মা ও প্রিমিয়ার ব্যাংকে দায়-দেনা পরিশোধ বকেয়া রয়েছে মুস্তফা কামালের। দেনা পরিশোধ না করার পরও তাঁকে খেলাপি দেখাচ্ছে না ব্যাংকগুলো। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, সোনালী ব্যাংকের লোকাল অফিসের এখনো লোটাস ইঞ্জিনিয়ারিং থেকে পাঁচ হাজার ১৯৩ টাকা পাওনা রয়েছে। কিন্তু এই তথ্য মানতে নারাজ সোনালী ব্যাংক লোকাল অফিস। ব্যাংক জানায়, ঋণ পরিশোধ হয়ে গেছে।
প্রিমিয়ার ব্যাংকের বনানী শাখায় এখনো ৯৯ লাখ টাকার এলসি বকেয়া রয়েছে মুস্তফা কামালের। ২০২৩ সালের ২১ অক্টোবর এলসি পরিশোধের মেয়াদ শেষ হয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত ঋণটি বকেয়া রয়েছে। পদ্মা ব্যাংকে পর পর দুটি এলসি করে কোনো টাকা পরিশোধ করেননি সাবেক এই অর্থমন্ত্রী। প্রথম এলসিটির মেয়াদ শেষ হয়েছে ২০১৬ সালের ৮ মার্চ। যেখানে বকেয়ার পরিমাণ চার কোটি ৫০ লাখ টাকা। দ্বিতীয় এলসি পরিশোধের শেষ তারিখ ছিল ২০২০ সালের ৯ এপ্রিল। এখানেও চার কোটি ৫০ লাখ টাকা বকেয়া রেখেছেন কামাল। বিষয়টি সম্পর্কে জানার জন্য চলতি দায়িত্বে থাকা পদ্মা ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী কাজী মো. তালহা জানান, তাঁদের সঙ্গে আমাদের ব্যবসা ছিল অনেক আগে। এখন কোনো ব্যবসাও নেই, আর বকেয়াও নেই। হয়তো কোথাও কোনো তথ্যগত ভুল বোঝাবুঝি হচ্ছে।