২০২১ সালের পর থেকেই দেশি-বিদেশি বিনিয়োগে ভাটা পড়েছে। এমনকি সরকার পরিবর্তনের পরেও বিনিয়োগে ইতিবাচক সাড়া মেলেনি। বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালে এক হাজার ৮৩টি ব্যবসা প্রকল্পের জন্য এক হাজার ৩৩৪ কোটি ৫১ লাখ ডলার বিনিয়োগের প্রস্তাব নিবন্ধন হয়েছে। পরের বছর এক হাজার ৮১টি ব্যবসা প্রকল্প নিবন্ধনের মাধ্যমে এক হাজার ২৮৮ কোটি ৩৫ লাখ ডলার বিনিয়োগ প্রস্তাব এসেছিল। ২০২৩ সালে আরো কমে ব্যবসার ৯৯৮টি প্রকল্পে ৮৯৭ কোটি ৮৫ লাখ ডলার হয়। আর চলতি বছরে ব্যবসার ৭৪২টি প্রকল্পে এক হাজার ১৬৩ কোটি ডলার বিনিয়োগ নিবন্ধন হলেও এপ্রিল-জুন প্রান্তিকেই ২৫৪ প্রকল্পে ৬৬৬ কোটি ৮০ লাখ ডলার হয়। রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সরকার পরিবর্তনকালীন জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে তা কমে ১৮৬ প্রকল্পে মাত্র ১৮৬ কোটি ৭১ লাখ ডলার হয়েছে।
বিনিয়োগ আনার সক্ষমতা ও চলমান গতি বিবেচনায় নিয়ে অর্থনৈতিক অঞ্চলের মহাপরিকল্পনাকে সীমিত করে আনছে সরকার। এ বিষয়ে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ও বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেজা) নির্বাহী চেয়ারম্যান চৌধুরী আশিক মাহমুদ বলেন, আগামী দিনে পাঁচটি ইজেডকে গুরুত্ব দেওয়া হবে। কারণ ১০০ ই-জেডে বিনিয়োগের অফার করার সক্ষমতা আছে কি না তা দেখতে হবে। এ জন্য অধিগ্রহণ করা জমি ফেলে না রেখে অব্যবহৃত জমিতে সোলার পার্ক করা হবে।
চৌধুরী আশিক মাহমুদ বলেন, ‘১০০ ই-জেড নির্মাণ থেকে আমরা সরে যাচ্ছি না। সীমিত আকারে বাস্তবায়ন করে এগোতে চাই। বিনিয়োগ আনতে হলে সরকারের সব বিভাগের সমন্বিত উদ্যোগ লাগবে। যে বিনিয়োগকারী জমি নিয়ে যেকোনো কারণেই হোক কার্যক্রম শুরু করেনি, তাদের শিল্প নির্মাণে উৎসাহিত করা হচ্ছে। যারা কাজ শুরু করতে অপারগ, তাদের জমি বেজার কাছে ফেরত দিতে অনুরোধ করা হচ্ছে। বিনিয়োগের জন্য নেওয়া সেসব জমি ফেরত দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।’
রিজার্ভের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলছে বিদেশি বিনিয়োগ। রিজার্ভ যেমন কমছে বিদেশি বিনিয়োগও কমছে। আগের বছরের তুলনায় ২০২৩-২৪ অর্থবছরে দেশে নেট বিদেশি বিনিয়োগ কমেছে ৮.৮ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন মতে, ২০২৩-২৪ অর্থবছর শেষে নেট বিদেশি বিনিয়োগ হয়েছে ১৪৭ কোটি ডলার, ২০২২-২৩ অর্থবছর শেষে যা ছিল ১৬১ কোটি ডলার। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে বিদেশি বিনিয়োগ কমেছে ১৪ কোটি ২০ লাখ ডলার।
আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পাঁচ মাস পার হতে চললেও দেশে ব্যবসা-বাণিজ্যের স্বাভাবিক পরিবেশ এখনো ফেরেনি। বরং আইন-শৃঙ্খলার অবনতি এবং সংস্কার, নির্বাচনসহ নানা ইস্যুতে সৃষ্ট রাজনৈতিক অস্থিরতায় নানা ধরনের ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। এতে ব্যবসায়ী-শিল্পপতি ও উদ্যোক্তারা নতুন বিনিয়োগে আগ্রহ হারাচ্ছে। অর্থনৈতিক মন্দায় ব্যবসা গুটিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছেন ব্যবসায়ীরা।
দেশের এমন পরিস্থিতিতে সম্প্রতি অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, ‘দুর্নীতির পাশাপাশি অতীতে অনেক ভুল নীতি গ্রহণ করা হয়েছিল এবং এর জন্য আমাদের মূল্য দিতে হচ্ছে। অতীতে ভুল নীতির কারণে অনেক বিনিয়োগকারী চলে গেছেন। সৌদি আরবের আরামকো এবং দক্ষিণ কোরিয়ার স্যামসাংকে তাড়ানো ছিল ভুল নীতি। এখন এসব শুধরে নিতে হবে।’
পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন বলেছেন, ‘আমাদের দেশে অর্থনীতির সুযোগে আকৃষ্ট করার জন্য অনেক কিছু করতে হবে। এই বাস্তবতা আমাদের মেনে নিতে হবে। আমরা দীর্ঘদিন ধরে দাবি করে আসছি যে আমাদের দেশ সবচেয়ে ভালো বিনিয়োগবান্ধব, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এটি সব সময় সত্যি নয়। বর্তমান সরকার অবস্থার পরিবর্তন করার চেষ্টা করছে এবং বিনিয়োগকারীদের জন্য ব্যবসা সহজ করার ব্যবস্থা নিচ্ছি।’
বিদেশি বিনিয়োগের প্রতিবন্ধকতা তুলে ধরে বাংলাদেশে নিযুক্ত সৌদি আরবের বিদায়ি রাষ্ট্রদূত ইসা ইউসুফ ইসা আল দুহাইলান বলেছেন, ‘আরামকো ২০১৬ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধিদল নিয়ে তিনবার বাংলাদেশে এসেছিল, কিন্তু তাদের কেউ অভ্যর্থনা জানায়নি। কিন্তু আমরা অতীত নিয়ে কথা বলব না। আমরা ভবিষ্যৎ নিয়ে কথা বলব। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় তেল কম্পানি আরামকো বাংলাদেশে আসতে আগ্রহী। তারা বঙ্গোপসাগরে একটি তেল শোধনাগার স্থাপন করতে চায়।’
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো প্রফেসর ড. মোস্তাফিজুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘২০২৫ সালে অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা ও রাজনৈতিক দিক থেকে অস্থিরতা থাকবে। কারণ কয়েক বছর ধরে চলা সমস্যা—উচ্চ মূল্যস্ফীতি, স্তিমিত বিনিয়োগ ও সীমিত কর্মসংস্থানের চাপ আছে। এ কারণে আগামী দিনে বিনিয়োগের চ্যালেঞ্জ অব্যাহত থাকবে। বিশেষ করে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগের গতি ধীর হবে। ফলে কর্মসংস্থান আরো চ্যালেঞ্জের মধ্যে থাকবে। বিদ্যমান অর্থনৈতিক সমস্যা কাটাতে আরো কিছু সময় লাগবে।’
অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা বলছেন, সামষ্টিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতির অগ্রগতির ওপর নির্ভর করবে বিনিয়োগ। বিশেষ করে বিনিময় হার, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, ব্যাংকব্যবস্থা, বন্দরের সক্ষমতা, অভ্যন্তরীণ বাজার ও বৈদেশিক বাণিজ্য পরিস্থিতি নাজুক থাকলে বিনিয়োগ বাড়বে না। দেশের রাজনৈতিক ও আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতিসহ বিনিয়োগ অনুকূল পরিবেশ দেখেই আসবেন উদ্যোক্তারা। আর বিদেশি বিনিয়োগ আসার বিষয়টি শ্রম সংস্কার, প্রধান রপ্তানি খাত তৈরি পোশাকে স্থিতিশীলতা ইত্যাদি সামগ্রিক পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করবে।
দেশের বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি তলানিতে নেমেছে। গত নভেম্বর মাসে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি ছিল ৭.৬৬ শতাংশ। এই প্রবৃদ্ধি গত সাড়ে তিন বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন।
বিনিয়োগের বাস্তব চিত্র ফুটে উঠে প্রধান উপাদান মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানিতে। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাস জুলাই-নভেম্বরে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির ঋণপত্র বা এলসি খোলা আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ২৬ শতাংশ কমেছে। একইভাবে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির ঋণপত্র নিষ্পত্তি কমেছে প্রায় ২২ শতাংশ। এতেই দেশে নতুন বিনিয়োগ কমার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে।
উচ্চ সুদের হারই বড় চ্যালেঞ্জ : মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সুদের হার বাড়ানোর কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ জন্য দফায় দফায় নীতি সুদহার বাড়ানো হয়েছে। ফলে ব্যাংকঋণের সুদহার ৯ থেকে বেড়ে ১৫ শতাংশ ছাড়িয়েছে। এতে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি কমেছে। সুদের হার বৃদ্ধির কারণে অনেকে বিনিয়োগ থেকে পিছিয়ে যাচ্ছেন।
বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্প্রতি প্রকাশিত এক জরিপের ফলাফলে বলা হয়, দেশে দীর্ঘদিন ধরে ব্যবসা-বাণিজ্যের মূল চ্যালেঞ্জ দুর্নীতি। ২০২৪ সালে প্রায় ১৭ শতাংশ ব্যবসায়ী দুর্নীতিকেই ব্যবসায়ের প্রধান বাধা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। দুর্নীতিসহ অর্থায়নের সীমাবদ্ধতা, বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে অস্থিরতা, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, অদক্ষ আমলাতন্ত্র, উচ্চ করহারসহ ব্যবসা-বাণিজ্যে ১৭টি চ্যালেঞ্জ চিহ্নিত করেন ব্যবসায়ীরা। এমন অবস্থায় বিনিয়োগ করতে ভয় পাচ্ছেন তাঁরা।
বন্ধ হচ্ছে শিল্প-কারখানা : সূত্রে জানা যায়, গত পাঁচ মাসে ব্যবসা গুটিয়ে নেওয়ার সংখ্যা নেহাত কম নয়। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে ছোট-বড় মিলিয়ে কম্পানি বন্ধের পরিমাণ তিন শতাধিক। বিশেষ করে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে এই দলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত অনেকে ব্যবসা সীমিত করেছেন। আবার অনেকে বন্ধ করে দিয়েছেন। বিশেষ করে সালমান এফ রহমানের মালিকানাধীন বেক্সিমকো গ্রুপের পোশাক ও বস্ত্র খাতের ১৬টি কারখানা গত ডিসেম্বরে বন্ধ হয়েছে। এস আলম গ্রুপের মালিকানাধীন আটটি কারখানা বন্ধ হয়েছে। এস আলমের ছেলে আহসানুল আলমের ইনফিনিয়া গ্রুপ এবং জামাতা বেলাল আহমাদের ইউনিটেক্স গ্রুপের অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। আওয়ামী লীগের সঙ্গে যোগসূত্র থাকা কয়েকটি গ্রুপ অব কম্পানি বিনিয়োগ পরিকল্পনা থেকে সরে আসছে।
নতুন উদ্যোক্তাদের বিনিয়োগেও ভাটা : দেশের স্টার্টআপ খাতে বিনিয়োগও শ্লথ। গত এক দশকে দেশে প্রায় ৯৮ কোটি ৯০ লাখ মার্কিন ডলার বিনিয়োগ এসেছে। দেশীয় পরামর্শক প্রতিষ্ঠান লাইটক্যাসল পার্টনার্স গত নভেম্বরে বাংলাদেশের স্টার্টআপে বিনিয়োগের এক দশকের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, ২০১৩ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত আসা বিনিয়োগের মধ্যে ৯২ শতাংশ বিদেশি। দুই বছর ধরে বিনিয়োগ কমার পেছনে বৈশ্বিকভাবে ডলারের মূল্যবৃদ্ধি, যুদ্ধের প্রভাব, দেশীয় নীতির পাশাপাশি ডিজিটাল সেবা নেওয়ার বাজার বড় না হওয়াকে দায়ী করছেন খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে এক হাজার ২০০টির বেশি স্টার্টআপ রয়েছে। এককভাবে সর্বোচ্চ ৪৩ কোটি ৪৮ লাখ ডলার বিনিয়োগ এসেছিল ২০২১ সালে। ২০২৪ সালে বিনিয়োগ এসেছে তিন কোটি ৪৭ লাখ ডলার। আগের ছয় বছরের মধ্যে এটা সবচেয়ে কম।
দেশের আবাসন খাতে বিনিয়োগ স্থবিরতা চলছে বলে দাবি করেছে আবাসন ব্যবসায়ীদের সংগঠন রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (রিহ্যাব)। বাণিজ্য সংগঠনটির শীর্ষ নেতারা বলছেন, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের আগ থেকে নানামুখী সংকটে জর্জরিত ছিল দেশের আবাসন খাত। উচ্চ নিবন্ধন ব্যয়, সুদের হার বৃদ্ধি, ত্রুটিপূর্ণ ও বৈষম্যমূলক বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনার (ড্যাপ) কারণে এই খাতের বিনিয়োগে স্থবিরতা চলছে।
২০২৪ সালে বিশ্বজুড়ে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অস্থিরতা ছিল। বিশেষ করে ট্রাম্পের শুল্ক পরিকল্পনা এবং চলমান বিভিন্ন যুদ্ধ ও সংঘাত উল্লেখযোগ্য। চলতি বছরের অর্থনীতি ও বাণিজ্যে এর বড় প্রভাব থাকবে। এ অবস্থায় নতুন বিনিয়োগের কোনো পূর্বাভাস মিলছে না; বরং বৈশ্বিক যুদ্ধ ও বাণিজ্য ঝুঁকি বাড়বে।