মাদক সেবনে কবিরা গুনাহ হয়, যা তাওবা ছাড়া ক্ষমা করা হয় না। আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) বলেছেন, ‘মাদক সেবন বড় কবিরা গুনাহ ও মন্দকর্মসমূহের জন্মদাত্রী। অতএব, তোমরা মদ ও মাদক সেবন কোরো না। কেননা তা প্রত্যেক অনিষ্টের দ্বার উন্মোচনকারী।
মাদক সেবনে কবিরা গুনাহ হয়, যা তাওবা ছাড়া ক্ষমা করা হয় না। আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) বলেছেন, ‘মাদক সেবন বড় কবিরা গুনাহ ও মন্দকর্মসমূহের জন্মদাত্রী। অতএব, তোমরা মদ ও মাদক সেবন কোরো না। কেননা তা প্রত্যেক অনিষ্টের দ্বার উন্মোচনকারী।
মাদক সব মন্দকর্মের জন্মদাত্রী। মাদকতা বহু পাপের জন্ম দেয়। হাদিস থেকে এ বিষয়ে নির্দেশনা পাওয়া যায়। উসমান (রা.) বলেন, তোমরা সব অনিষ্টের জন্মদাত্রী মাদক সেবন থেকে বিরত থাকো।
পূর্ববর্তী উম্মতে এক বুজুর্গ ব্যক্তি ছিলেন, যিনি শুধু আল্লাহর ইবাদত করতে মানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকতেন। একজন মন্দ চরিত্রা নারী তার পেছনে পড়ল এবং স্বীয় পরিচারিকার মাধ্যমে ওই ব্যক্তিকে নিজের বাসায় ডেকে আনল। বাসায় প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে পরিচারিকা সব দরজা বন্ধ করে দিল। ঘরে প্রবেশ করে তিনি একজন সুন্দরী নারীকে দেখতে পেলেন, যার পাশে একটি ফুটফুটে ছেলে এবং মদের পাত্র রাখা ছিল।
ওই নারী বললেন, আমি আপনাকে ডেকেছি এই ছেলেটিকে হত্যা করার জন্য। যদি সেটা করতে না চান তাহলে আমার সঙ্গে ব্যভিচারে লিপ্ত হতে হবে, নয়তো আমার সামনে রাখা মদ পান করতে হবে। এগুলোর কোনো একটি অবশ্যই আপনাকে করতে হবে। যদি অস্বীকৃতি জানান, তাহলে আমি চিৎকার করব এবং লোকসমাজে আপনাকে লাঞ্ছিত ও অপদস্থ করব। তিনি উপায়ান্তর না দেখে, তুলনামূলক সহজ মনে করে মদ পানে রাজি হন।
(নাসাঈ, হাদিস : ৫৬৬৬)
মদের নেশায় বিভোর মানুষ এমন সব কাণ্ডকীর্তি করে বসে, যা পারস্পরিক ক্রোধ, প্রতিহিংসা ও লড়াইয়ের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। মাদকতার মাধ্যমে সমাজে অশ্লীলতা বৃদ্ধি পায়। নেশাগ্রস্ত মানুষগুলো অপরাধপ্রবণ হয়ে ওঠে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, নেশায় উন্মত্ত ব্যক্তিরা চুরি, ডাকাতি, ছিনতাইসহ বহু অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। আধুনিক যুগে সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ হিসেবে চালকের মদ পানকে দায়ী করা হয়ে থাকে। সবচেয়ে বড় কথা হলো, মদ পান ও নেশাদ্রব্য গ্রহণের ফলে মানুষের অন্তর মরে যায়। মানুষ আল্লাহর স্মরণ, ইবাদত ও নামাজ থেকে উদাসীন হয়ে পড়ে।
সম্পর্কিত খবর
আয়াতের অর্থ : ‘আমি তোমাদের কাছে অবতীর্ণ করেছি সুস্পষ্ট আয়াত, তোমাদের পূর্ববর্তীদের দৃষ্টান্ত এবং মুত্তাকিদের জন্য উপদেশ। আল্লাহ আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর জ্যোতি, তাঁর জ্যোতির উপমা যেন একটি দীপাধার, যার মধ্যে আছে একটি প্রদীপ, প্রদীপটি একটি কাচের আবরণের মধ্যে স্থাপিত, কাচের আবচরণটি উজ্জ্বল নক্ষত্রসদৃশ্য; তা প্রজ্বলিত করা হয় পূতঃপবিত্র জায়তুনগাছের তেল দ্বারা, যা প্রাচ্যের নয়, প্রতীচ্যেরও নয়...’ (সুরা : নুর, আয়াত : ৩৪-৩৫)
আয়াতদ্বয়ে আল্লাহর নুর বা জ্যোতি নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।
শিক্ষা ও বিধান
১. কোরআনের মৌলিক দান বা সুফল হলো দ্বিনের অকাট্য প্রমাণ, আবশ্যক জ্ঞান ও উপদেশ।
২. আল্লাহর নুর বা জ্যোতি হলো মানবজীবনের সবচেয়ে বড় পাথেয়।
৩. পাঁচটি আমল মুমিনের অন্তর্দৃষ্টি তৈরি করে : ক. সুন্নতের অনুসরণ, খ. আল্লাহর স্মরণ ও ধ্যান, গ. হারাম দৃষ্টি থেকে বাঁচা, ঘ. প্রবৃত্তি থেকে বাঁচা, ঙ. হালাল খাদ্য গ্রহণ।
৪. যে ব্যক্তি হারাম বিষয় থেকে নজর বা দৃষ্টি সংযত রাখে আল্লাহ তাঁর চোখে নুর দান করেন।
৫. মুমিনের প্রজ্ঞা হলো জ্যোতি আর তার সঙ্গে যখন কোরআন-হাদিসের জ্ঞান যুক্ত হয় তখন জ্যোতির ওপর জ্যোতি হয়।
(আল কোরআন তাদাব্বুর ওয়া আমল : ১৯/১৩)
সুরা ইয়াসিন
সুরার শুরুতে কোরআনের কসম করে বলা হয়েছে যে মহানবী (সা.) অবশ্যই আল্লাহর রাসুল। তিনি সঠিক পথে সুপ্রতিষ্ঠিত। তাঁকে পাঠানো হয়েছে এমন একটি সম্প্রদায়কে ঈমানের দাওয়াত দেওয়ার জন্য, যাদের পূর্বসূরিদের সতর্ক করা হয়নি। এরপর মক্কার কাফিরদের ঈমান না আনার কারণ ব্যাখ্যা করা হয়েছে যে তাদের অন্তর তালাবদ্ধ।
আদেশ-নিষেধ-হিদায়াত
১. আলেমদের কাজ পৌঁছে দেওয়া।
(আয়াত : ১৬-১৭)
২. মানুষ নিজের অমঙ্গল নিজে ডেকে আনে। (আয়াত : ১৯)
৩. মানুষের জন্য নিঃস্বার্থভাবে কাজ করো।
৪. দ্বিন নিয়ে উপহাসকারীদের জন্য আফসোস। (আয়াত : ৩০)
৫. শস্য উৎপাদন আল্লাহর দান।
(আয়াত : ৩৩)
৬. আল্লাহর কৃতজ্ঞতা আদায় করো। (আয়াত : ৩৪-৩৫)
৭. আল্লাহর নিদর্শন থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ো না। (আয়াত : ৪৬)
৮. জান্নাতে মুমিনের সব প্রত্যাশা পূরণ হবে।
৯. শারীরিক সুস্থতা আল্লাহর ইচ্ছাধীন। (আয়াত : ৬৬)
১০. কোরআন কোনো কাব্য নয় এবং আলেমদের জন্য কাব্যচর্চা শোভনীয় নয়। (আয়াত : ৬৯)
১১. পাপীদের কথায় ব্যথিত হয়ো না। (আয়াত : ৭৬)
১২. নিজের অস্তিত্বের কথা ভুলে যেয়ো না। (আয়াত : ৭৭)
১৩. আল্লাহর উপমা সৃষ্টি কোরো না। (আয়াত : ৭৮)
১৪. সর্বময় ক্ষমতা আল্লাহর জন্য।
(আয়াত : ৮৩)
সুরা সাফফাত
সুরা সাফফাতের মধ্যে প্রধানত তিনটি গায়েবি বিষয় যথা—ফেরেশতা, জিন ও পরকাল সম্পর্কে বর্ণনা করা হয়েছে। শুরুতেই ফেরেশতাদের শক্তিমত্তা এবং আল্লাহর হুকুম পালনে একনিষ্ঠতা সম্পর্কে বর্ণনা করা হয়েছে। এরপর জিনদের বিষয় আনা হয়েছে। জিনদের একটি দল ফেরেশতাদের পারস্পরিক কথাবার্তা জানার জন্য আকাশে ওঠার চেষ্টা করে। আর তখনই জ্বলন্ত উল্কা তাদের ধাওয়া করে। এই সুরায় কাফিরদের কিয়ামতের দিনের করুণ পরিণতির কথা বর্ণনা করা হয়েছে। উপদেশের জন্য নুহ, ইবরাহিম, ইসমাঈল, হারুন, ইলিয়াস, লুত ও ইউনুস (আ.)-এর ঘটনার কিছু অংশ আনা হয়েছে। ফেরেশতাদের প্রশংসা করে সুরাটি শেষ করা হয়েছে।
আদেশ-নিষেধ-হিদায়াত
১. মন্দ লোকেরাই উপদেশ গ্রহণ করে না। (আয়াত : ১৩)
২. আল্লাহর নিদর্শন নিয়ে উপহাস কোরো না। (আয়াত : ১৪-১৫)
৩. আল্লাহ একনিষ্ঠ বান্দাদের সম্মানিত করবেন। (আয়াত : ৪০-৪১)
৪. পূর্বসূরিদের ভ্রান্তপথ পরিহার করো। (আয়াত : ৬৯-৭০)
৫. আল্লাহর কাছে বিশুদ্ধ মনে উপস্থিত হও। (আয়াত : ৮৪)
৬. সুসন্তান লাভের জন্য প্রার্থনা করো। (আয়াত : ১০০)
৭. আল্লাহর সাহায্যেই মানুষ বিজয়ী হয়। (আয়াত : ১১৬)
সুরা সাদ
এই সুরায় দাউদ, সুলায়মান, আইয়ুব ও আদম (আ.)-এর ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে। অন্যান্য মাক্কি সুরার মতো এই সুরায়ও তাওহিদ, রিসালাত ও আখিরাত সম্পর্কে বর্ণনা করা হয়েছে। মুশরিকদের ভ্রান্ত আকিদা খণ্ডন করা হয়েছে। জান্নাতের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ও জাহান্নামের আজাবের ভয়াবহতা সম্পর্কে বর্ণনা করা হয়েছে। নুহ (আ.)-এর জাতি, ফেরাউনের জাতি, আদ জাতি, সামুদ জাতি, লুত (আ.)-এর জাতি ও মাদিয়ানবাসীদের ধ্বংসের ঘটনার দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে। আনা হয়েছে ইয়াকুব, ইসমাঈল, ইয়াসআ ও জুলকিফল (আ.)-এর ঘটনা। একেবারে শেষের দিকে আদম (আ.)-এর ঘটনা আনা হয়েছে।
আদেশ-নিষেধ-হিদায়াত
১. কোরআন উপদেশপূর্ণ কিতাব।
(আয়াত : ১)
২. কোরআন অবিশ্বাসকারীদের জন্য রয়েছে শাস্তি। (আয়াত : ৮)
৩. সৃষ্টিজগৎ আপন কাজের মাধ্যমে আল্লাহর ইবাদত করে। (আয়াত : ১৮)
৪. ইসলামী রাষ্ট্রের রাষ্ট্রনায়ক জ্ঞানী ও বাগ্মী হবে। (আয়াত : ২০)
৫. শরিকদের প্রতি অবিচার কোরো না। (আয়াত : ২৪)
৬. মুমিন ভুল স্বীকার করে অনুতপ্ত হয়। (আয়াত : ২৪)
৭. খেয়ালখুশির অনুসরণ মানুষকে সত্যচ্যুত করে। (আয়াত : ২৬)
৮. আল্লাহর কোনো সৃষ্টিই অনর্থক নয়। (আয়াত : ২৭)
৯. কোরআন নিয়ে চিন্তা ও গবেষণা করো এবং অনুধাবনের চেষ্টা করো।
(আয়াত : ২৯)
১০. আল্লাহর অনুগ্রহ থেকে দান করো। (আয়াত : ৩৯)
১১. বিপদে আল্লাহকে স্মরণ করো।
(আয়াত : ৪১)
১২. পাপের উপলক্ষ হইয়ো না।
(আয়াত : ৬১)
১৩. নিষ্ঠাবানরাই শয়তানের ধোঁকা থেকে বাঁচতে পারে।
(আয়াত : ৮২-৮৩)
গ্রন্থনা : মুফতি আতাউর রহমান
কয়েকজন পালাক্রমে ইতিকাফ করে ১০ দিন পূরণ করা
প্রশ্ন : আমাদের মসজিদে রমজানের শেষ ১০ দিন ইতিকাফ করার লোক খুঁজে পাওয়া যায় না। তাই সবাই মিলে এটা নির্ধারণ করে নেয় যে লোকজন পালাক্রমে ১০ দিন ইতিকাফ করবে। প্রশ্ন হলো, এর দ্বারা এলাকার সবার পক্ষ থেকে ইতিকাফ আদায় হবে?
মাসরুর, ঝিনাইদহ
উত্তর : ইতিকাফ মাসনুন আদায় হওয়ার জন্য একই ব্যক্তিকে রমজানের শেষের ১০ দিন ইতিকাফ করতে হয়। সুতরাং প্রশ্নে বর্ণিত পদ্ধতিতে ইতিকাফ আদায় হবে না, বরং মহল্লার সবার জিম্মায় সুন্নতে মুয়াক্কাদায়ে কিফায়া থেকে যাবে।
(বুখারি, হাদিস : ২০২৭, ফাতাওয়ায়ে মাহমুদিয়া : ১৩/১৫২-১৫৬, ফাতাওয়ায়ে ফকীহুল মিল্লাত : ৫/৪৯০)
সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন স্থানে মব জাস্টিসের প্রবণতা দেখা দেয়, যা কখনো পরিকল্পিত আবার কখনো অপরিকল্পিত। পরিকল্পিত এ দৃষ্টিকোণ থেকে যে পূর্বেই ঘোষণা দিয়ে কারো ওপর আক্রমণ করে বসা। আর অপরিকল্পিত এ বিবেচনায় যে কোথাও সন্দেহভাজন কাউকে পাওয়া গেল অথবা কাউকে অপরাধী মনে হলো অথবা প্রকৃত পক্ষেই অপরাধী—ফলে প্রথমে দু-একজন তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করল, সন্তোষজনক না হলে তাকে মারধর করে কিংবা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে মব তৈরি করে। অতঃপর দেখা যায় আরো কিছু লোক জড়ো হয়ে এক পর্যায়ে সবাই মারধর করতে থাকে।
প্রকৃত পক্ষে এ ধরনের মব জাস্টিসকে প্রচলিত ও ইসলামী আইনের কোথাও অনুমতি দেওয়া হয়নি। ব্যক্তি পর্যায়ে কেউ কাউকে শাস্তি দেওয়ার ক্ষমতা ইসলামে দেওয়া হয়নি। কেউ অপরাধ করলে ইসলামের বিধান হলো, আইন ও বিচার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তাকে শাস্তির আওতায় আনা হবে।
ন্যায়সংগত কর্তৃপক্ষ ছাড়া অন্য কারো দণ্ড কার্যকর করার ক্ষমতা নেই। ইমাম ইবনু তাইমিয়্যা (রহ.) বলেন, ইসলামী দণ্ডবিধি যথাযথভাবে প্রয়োগ করা রাষ্ট্রপ্রধানের দায়িত্ব।
(আল-হিসবাহ, পৃষ্ঠা-৪৫)
সুতরাং রাষ্ট্র কিংবা রাষ্ট্র কর্তৃক নিয়োজিত ব্যক্তি ছাড়া ফৌজদারি অপরাধের বিচারকার্য সম্পন্ন করার সুযোগ নেই।
ব্যক্তি পর্যায়ে কাউকে শায়েস্তা করার প্রবণতা পাল্টাপাল্টি প্রতিশোধের সংস্কৃতিতে রূপ দিতে পারে, যা সমাজকে অস্থিতিশীলতা ও অরাজকতার দিকে ঠেলে দেবে। বিদায় হজের ভাষণের এক পর্যায়ে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তোমাদের জন্য আফসোস অথবা ধ্বংস! তোমরা আমার পরে একে অপরের গর্দানে আঘাত করে কুফরির দিকে ফিরে যেয়ো না।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৬৪০৩)
উপর্যুক্ত হাদিস যারা রাষ্ট্রব্যবস্থাকে উপেক্ষা করে যারা আইন নিজের হাতে তুলে নেয়, তাদের জন্য ধ্বংসের কথা বলা হয়েছে।
লেখক : পিএইচডি গবেষক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়