দেশে গত দুই দশকে মা ও শিশুর স্বাস্থ্যসেবায় উল্লেখযোগ্য অগ্রগতির পর তা থমকে গেছে। এতে নবজাতক ও মাতৃমৃত্যু একই জায়গায় অবস্থান করছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এভাবে চলতে থাকলে বাংলাদেশকে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) পূরণে বড় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হতে পারে।
সর্বশেষ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদনের তথ্যানুযায়ী, ২০২৩ সালে বাংলাদেশে এক লাখ শিশু জন্ম দিতে গিয়ে ১২৩ জন মায়ের মৃত্যু হয়েছে।
এ হার ২০২০ সাল থেকে একই ছিল। এদিকে ২০২৩ সালে বাংলাদেশে প্রতি এক হাজার জীবিত শিশুর জন্মের পর ২১ জনের মৃত্যু হয়েছে। ২০২১ সালে প্রতি হাজার নবজাতকের মধ্যে মারা গেছে ২২ জন।
টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অনুযায়ী, ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশে মাতৃমৃত্যুর হার ৭০-এর নিচে এবং নবজাতক মৃত্যুর হার ১২ জনের নিচে নামিয়ে আনতে হবে।
মা ও নবজাতক নিয়ে মাঠ পর্যায়ে কাজ করা কয়েকজন বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘এখনো অনেক হাসপাতালে মিডওয়াইফ নেই, জরুরি ওষুধ নেই, কোনো কোনো সময় রোগী আনার মতো অ্যাম্বুল্যান্স নেই, এমনকি চিকিৎসক থাকলেও প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম থাকে না। এই চিত্র শুধু অব্যবস্থাপনাই নয়, এটি আমাদের জাতীয় অগ্রাধিকার ও মূল্যবোধের নগ্ন প্রতিফলন। যার ফলে মাতৃমৃত্যুতে অগ্রগতি হচ্ছে না।’
তাঁরা বলছেন, দেশে পাঁচ বছরের কম বয়সে শিশুমৃত্যুর মধ্যে প্রায় অর্ধেক মারা যায় জন্মের ২৮ দিনের মধ্যে, অর্থাৎ নবজাতক অবস্থায়।
অপরিণত জন্ম, জন্মের সময় ওজন কম হওয়া, জন্মের সময় শ্বাসকষ্ট, সংক্রমণ, জন্মগত ক্রটি নবজাতক মৃত্যুর কারণ। এসব কারণ দূর করা সম্ভব হচ্ছে না বলে শিশুমৃত্যু কমছে না।
এমন পরিস্থিতির মধ্যে আজ সোমবার পালিত হচ্ছে বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস-২০২৫। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্ধারিত প্রতিপাদ্যের আলোকে এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে, ‘জন্ম হোক সুরক্ষিত, ভবিষ্যৎ হোক আলোকিত’। দিবসটি উপলক্ষে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এবং স্বাস্থ্য বিষয়ে কাজ করে এমন বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলো নানা কর্মসূচি গ্রহণ করেছে।
দিবসটি উপলক্ষে প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস বাণী দিয়েছেন।
বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক অ্যান্ড হেলথ সার্ভের (বিডিএইচএস) সর্বশেষ সমীক্ষা বলছে, নানা সংকটের কারণে মাতৃমৃত্যুর ৪৮ ভাগই হচ্ছে সরকারি হাসপাতালে। এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে নিতে গিয়ে মারা যাচ্ছে ১৯ শতাংশ। এ ছাড়া বেসরকারি হাসপাতালে মারা যায় ১৩ শতাংশ।
আইসিডিডিআরবির মা ও শিশু স্বাস্থ্য বিভাগের বিজ্ঞানী আহমদ এহসানূর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘একজন মা যদি নিরাপদে সন্তান জন্ম দিতে না পারেন, যদি একটি নবজাতক প্রথম সপ্তাহেই মারা যায়, তাহলে অন্য যে উন্নয়নের গল্পই বলা হোক না কেন, সেই উন্নয়ন অসম্পূর্ণ। উন্নয়ন তখনই অর্থবহ হয় যখন তা মানুষের জীবনের প্রতি যত্ন ও সম্মানকে কেন্দ্রে রাখে। এই মৃত্যু শুধু একটি পরিবারকে নাড়া দেওয়া হয় না, বরং পুরো জাতির বিবেককে নাড়া দেওয়া উচিত।’
সম্প্রতি প্রকাশিত প্রসব-পরবর্তী সেবা ও প্রসব-পরবর্তী পরিবার পরিকল্পনা বৃদ্ধিতে বহুদেশীয় গবেষণামূলক প্রকল্প ‘সংযোগ’-এর ফলাফলে দেখা গেছে, ৪৩ শতাংশ মা সন্তান ধারণ করছেন ১৮ বছর বয়সে। ৩১ শতাংশ নারীর (১৫ থেকে ১৯ বছর) দুই সন্তানের মধ্যে ব্যবধান ১৭ মাস। প্রসূতিদের ৪৭ শতাংশ প্রসব-পরবর্তী সেবা গ্রহণ করছেন না।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. আবু জাফর কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এবার বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবসে মাতৃ ও শিশু স্বাস্থ্যকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। এ অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে আমাদের কার্যক্রম পুরো বছর পরিচালিত হবে। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অনুযায়ী ২০৩০ সালের মধ্যে সবার জন্য সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। এর প্রধান লক্ষ্য হলো প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা। প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার মূল উদ্দেশ্য হলো রোগ প্রতিকার নয়, প্রতিরোধ করা।
ডা. জাফর বলেন, ‘টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জন করতে হলে ২০৩০ সালের মধ্যে মাতৃমৃত্যুর হার ৭০-এর নিচে এবং নবজাতক মৃত্যুর হার ১২ জনের নিচে নামিয়ে আনতে হবে। আমরা এ লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছি।’
তিনি বলেন, ‘আমরা সবচেয়ে গুরুত্ব দিচ্ছি মাতৃ স্বাস্থ্য, নবজাতক স্বাস্থ্য, শিশু স্বাস্থ্য ও কিশোর স্বাস্থ্য। আমরা মনে করি, মা সুস্থ থাকলে বাচ্চা সুস্থ থাকবে, জাতি সুস্থ থাকবে। মা যদি দুর্বল হয়, শিশু পুষ্টিহীনতায় ভুগবে, শিশুর ওজন কম হবে, সময়ের আগে জন্মাবে। এসব শিশুর নানা সংক্রমের ঝুঁকি থাকে। নানা রোগে ভোগে। তাই নবজাতক ও মাতৃ স্বাস্থ্যের অগ্রগতির জন্য সরকারের পাশাপাশি এনজিও ও জনগণকে এগিয়ে আসতে হবে।’