ঢাকা, সোমবার ০৭ এপ্রিল ২০২৫
২৪ চৈত্র ১৪৩১, ০৭ শাওয়াল ১৪৪৬

ঢাকা, সোমবার ০৭ এপ্রিল ২০২৫
২৪ চৈত্র ১৪৩১, ০৭ শাওয়াল ১৪৪৬

জন্মদিনের শাড়ি

মাসউদ আহমাদ
মাসউদ আহমাদ
শেয়ার
জন্মদিনের শাড়ি
অঙ্কন : মাসুম

বরিশাল বিএম কলেজের টিচার্স রুমে বই খুলে বসে আছেন জীবনানন্দ দাশ। একটু পরই ক্লাসে যাবেন। এখানে তিনি ইংরেজি পড়ান। তাঁর সহকর্মীদের অনেকে ক্লাসরুমে, কেউ পরের ক্লাসে যাওয়ার আগে বইপত্র দেখে নিচ্ছেন; হয়তো ভাবছেন, প্রস্তুতি নিচ্ছেন।

পরস্পর আড্ডাও দিচ্ছেন দু-একজন।

বই থেকে চোখ তুলে দেয়ালে ঝোলানো ছবির দিকে তাকালেন জীবনানন্দ। খেয়াল করলেন, জ্ঞানেন্দ্রনাথ রায় চৌধুরী মহাশয়ের ছবির ফ্রেমে ধুলোর আস্তরণ পড়েছে।

কেউ পরিষ্কার করে না।

ঠিক তখনই পিয়ন এসে চা দিয়ে গেল।

ভরদুপুরে শুধু চা খেতে ইচ্ছা করছে না। একটা নিমকি বা শিঙ্গাড়া হলে ভালো লাগত। ভাবলেন বটে; কথাটি কাউকে বলতে গেলেন না।

দেয়ালে ঝোলানো ছবির দিকে আর একবার তাকালেন জীবনানন্দ।

ব্রজমোহন কলেজের প্রথম অধ্যক্ষ জ্ঞানেন্দ্রনাথ রায় চৌধুরী। ১৮৮৯ সালে তিনি যোগ দিয়েছিলেন। বছরখানেকের কিছু বেশি সময় এখানে দায়িত্ব পালন করেছেন। তারপর তিনি কি পলায়ন করেছিলেন, সহকর্মীদের কথা ও ব্যবহারে অতিষ্ঠ হয়ে?

বহুকাল আগের কথা।

কেউ বলতে পারেন না।

বাংলা বিভাগের অধ্যাপক হরিচরণ দে এসে জীবনানন্দর পাশে বসলেন। বললেন, কবি সাহেব, দেয়ালে কী দেখছেন?

জীবনানন্দ সে কথার জবাব না দিয়ে বললেন, মানুষ মরে গেলে কেউ তাকে পোছে না, না?

হরিচরণ বিস্মিত; হঠাৎ এ কথা যে?

জীবনানন্দ হরিচরণ দের কৌতূহলের কোনো উত্তর দিলেন না।

জ্ঞানেন্দ্রনাথের পাশের ছবিটি অশ্বিনীকুমার দত্তের। তিনি বরিশালের গর্ব। বিএম কলেজ গড়ে ওঠার পেছনে তাঁর ভূমিকা ও ত্যাগ স্মরণীয়।

অশ্বিনীবাবুর সঙ্গে বারকয়েক দেখা হলেও সেভাবে আলাপ হয়নি জীবনানন্দর।

দ্বিতীয়বার শোধানোতে ছবির প্রতি ইঙ্গিত করলেন জীবনানন্দ। প্রথমবার বুঝতে পারলেন না হরিচরণ। পরে বুঝলেন এবং মুখে আফসোসের ভঙ্গি করলেন। কানের পর্দা কাঁপিয়ে ক্লাসের ঘণ্টা বেজে ওঠে। জীবনানন্দ চমকে উঠলেন।

হরিচরণ বললেন, বড় ভালো লোক ছিলেন।

চেয়ার ছেড়ে উঠতে উঠতে জীবনানন্দ পাশ ফিরে তাকালেন।

ক্লাসে পড়ানোর সময় কিছু একটা বোঝাতে গিয়ে অন্য জগতে চলে যান জীবনানন্দ। ছাত্র-ছাত্রীদের চোখে-মুখে না তাকিয়ে ছাদের দিকে তাকান। কখনো জানালা গলিয়ে বাইরে ছড়িয়ে দেন দৃষ্টি। এটা তাঁর নিজস্ব ভঙ্গি।

সরাসরি কেউ কিছু বলে না। কিন্তু এসব নিয়ে ক্লাসে ও বাইরে কথা হয়। তিনি টের পান।

মেয়েদের একটু ভয়ই পান জীবনানন্দ। পারতপক্ষে ক্লাসের মেয়েদের কোনো কিছু জিজ্ঞেস করেন না।

দুটি মেয়ে পরস্পর কথা বলছে। জীবনানন্দ লেকচার থামিয়ে বললেন, ক্লাসে একটু মন দাও, বাবারা।

মেয়ে দুটি ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে গেল।

ছাত্র-ছাত্রীদের তিনি প্রিয় শিক্ষক নন, জীবনানন্দ বুঝতে পারেন। ‘আমারই বা কী দোষ’—আত্মপক্ষ সমর্থন করে ভাবেন। ইংরেজি বিভাগের শিক্ষকরা সহজ ও পড়িয়ে সুবিধা হয়, সেই বিষয়গুলো বেছে নেন। তাঁকে দেওয়া হয় জটিল ও রসকষহীন বিষয়। তিনি পড়িয়ে জুত পান না। ছাত্র-ছাত্রীরাও আগ্রহ পায় না।

ঘণ্টা বেজে উঠল। কোনো দিকে না তাকিয়ে নিজস্ব হাঁটার ভঙ্গিতে ফড়িঙের মতো লাফিয়ে ক্লাসরুম থেকে বেরিয়ে এলেন জীবনানন্দ।

থার্ড পিরিয়ডে জীবনানন্দের কোনো ক্লাস নেই। লাবণ্য বলেছিল, কলেজ থেকে তাড়াতাড়ি ফিরতে। প্রিন্সিপালকে বলে তিনি টিচার্স রুম থেকে বেরিয়ে বাড়ির পথ ধরলেন।

ভাত হয়ে গেছে, তরকারি এখনো চুলায়। জীবনানন্দকে বাড়ি ফিরতে দেখে ঘরে এলো লাবণ্য—চা খাবে?

ঘরের ভেতর পায়চারি করার ছলে কিছু ভাবছিলেন জীবনানন্দ। —না। একটু লেবুর শরবত করে দিতে পারো।

লেবুর শরবত?

লেবু নেই? তাহলে থাক। ঘরের পেছনের গাছে পাকা পেঁপে আছে।

আচ্ছা, বানিয়ে দিচ্ছি।

লাবণ্য দাঁড়িয়ে রইল। কোনো কথা নয়, প্রসঙ্গ নয়, গল্প নয়। তবু।

জীবনানন্দ একবার মুখ তুলে তাকালেন, কিছু বললেন না।

লাবণ্য বলল, এই শোনো, এ মাসে একটা শাড়ি কিনে দেবে?

শাড়ি? কোথাও বেড়াতে যাবে বুঝি?

না।

জীবনানন্দ অবাক; তাহলে?

পরে বলব।

পরে কেন, এখনই বলো। রহস্য করো না।

কোনো রহস্য নেই।

তাহলে?

কথার উত্তর না দিয়ে লাবণ্য ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।

বিশ মিনিট পরে পেঁপের শরবত নিয়ে লাবণ্য আবার ঘরে এলো।

জীবনানন্দ শরবতের গ্লাসে চুমুক দিলেন—বাহ, পেঁপেটা খুব মিষ্টি।

লাবণ্য মৃদু হাসল—পাখিতে একটা পেঁপের অর্ধেকটা খেয়ে গেছে।

তুমিও এক গ্লাস খাও। পেঁপে পেটের জন্য খুব ভালো।

লাবণ্য বেরিয়ে গেল। কিছুক্ষণ পর আবারও সে ঘরে এলো। বলল, একটু পুরুষ হও, বুঝলে? সারা জীবন ভেজা বিড়াল হয়ে থেকো না।

খানিকটা আনমনা হয়ে পড়েছিলেন জীবনানন্দ।

লাবণ্য কথাটি আর একবার শোনাল—একটু পুরুষ হও, বুঝলে?

তোমার কথার মানেটা ঠিক বুঝতে পারলাম না।

তুমি তো অকর্মা কোনো লোক নও। ইংরেজিতে পাস করা পণ্ডিত মানুষ। কলেজের অধ্যাপক। কবি হিসেবেও তোমার ভালো পরিচিতি আছে।

তা একটু আছে।

কিন্তু তোমাকে দেখে তা মনে হয় না।

কী মনে হয়?

লাবণ্য বলল, তোমাকে দেখে মনে হয়, বউ মরা অসহায় একজন মানুষ। সারাক্ষণ গম্ভীর মুখ। হাসি নেই। কথা নেই। ঘরে ও বাইরে কোনো বিষয়ে তেজ নেই।

ওহ, এই কথা?

এটা কোনো সাধারণ কথা নয়।

নিশ্চয়ই। আমি তোমার কথা সিরিয়াসলি নিচ্ছি তো।

খবরদার, হাসবে না বলছি।

জীবনানন্দ এবার সত্যিই হেসে ফেললেন।

পাজি লোক। সময়ে মুখে হাসি থাকে না, আর এখন হি হি।

জীবনানন্দ তবু হাসছিলেন।

লাবণ্য বলল, তুমি তো মানুষের সঙ্গে সহজভাবে মেশো না। কথা বলো না। দু-একটা কথা বলেই কেমন গম্ভীর হয়ে যাও। এসব তো ঠিক নয়।

জীবনানন্দ হেঁয়ালি করলেন, কী জানি, আমার মুখটাই হয়তো এমন।

না, এটা তুমি ঠিক বলোনি।

এবার যদি তোমাকে দেখি যে গম্ভীর হয়ে আছ, তোমার মাথায় আমি বাঁশ মারব।

বাঁশ মারলে তো মাথা ফেটে যাবে।

তোমার একটু মাথা ফাটাই দরকার।

জীবনানন্দ হা হা করে হাসতে লাগলেন।

শোনো, এত হেসো না। দুপুরে স্নানের আগে শাড়িটা নিয়ে আসবে।

শাড়ি দিয়ে কী করবে?

সেটা সময় হলেই জানতে পারবে।

জীবনানন্দ পেঁপের শরবতটা শেষ করলেন।

 

শাড়ি কেনা নিয়ে লাবণ্য রহস্য করায় বহুদিন আগের একটি ঘটনা মনে পড়ে যায় জীবনানন্দর। বিয়ের বছর দুয়েক পরের ঘটনা। এক সকালে লাবণ্য বলল, আমাকে একটা শাড়ি কিনে দাও।

জীবনানন্দ বললেন, এখন তো হাতে কোনো টাকা নেই।

সে আমি জানি। তুমি বাবার কাছে যাও। তাঁকে বলো, আমাদের বাড়িতে যে দোকান থেকে কাপড় আসে, সেখানে যেন বাবা চিরকুট লিখে দেন।

এখন তোমার শাড়ির দরকার হলো কেন?

আছে দরকার। তুমি বাবাকে বলো।

তোমার কাপড়ের জন্য বাবাকে বলতে হবে? এটা কেমন কথা? আমার নিজের কোনো প্রয়োজনেও বাবাকে কখনো বলি না।

লাবণ্য বলল, আমি যদি বাবাকে বলি, তিনি কি রাগ করবেন?

তা বলে দেখতে পারো।

আচ্ছা, আমিই যাচ্ছি বাবার কাছে।

জীবনানন্দ বললেন, কিন্তু...

কিন্তু কী?

জীবনানন্দ বিব্রত; তুমি এ বাড়ির নতুন বউ। ব্যাপারটা কি ভালো দেখাবে?

লাবণ্য হাতের তালুতে কিল মেরে বলল, দেখাই যাক, কী হয়।

সত্যানন্দ নিজের ঘরে শুয়ে বই পড়ছিলেন।

লাবণ্য কোনো ভূমিকা না করেই বলল, বাবা, আমি কাপড় কিনতে চাই। দোকানে একটা চিঠি লিখে দিন।

সত্যানন্দ বই থেকে চোখ তুলে উঠে বসলেন। বললেন, নিশ্চয়ই কাপড় কিনবে। তুমি আমার একমাত্র পুত্রবধূ।

লাবণ্য আনত মুখে দাঁড়িয়ে রইল।

তুমি কখানা কাপড় চাও মা, বলো। আমি লিখে দিচ্ছি।

সত্যানন্দর চিরকুট পেয়ে অল্প সময়েই কাপড়ের দোকানের কর্মচারী কয়েকটি দামি ও কম দামি শাড়ি নিয়ে হাজির হলো।

এত কাপড় দেখে জীবনানন্দ বিস্মিত। লাবণ্যকে আড়ালে ডেকে বললেন, কাপড় তুমি সত্যি সত্যি আনিয়ে নিলে? বাবাকে তুমি সরাসরি কাপড়ের কথা বলতে পারলে? আমি ভেবেছিলাম, তুমি হয়তো শেষ পর্যন্ত বলতে পারবে না।

লাবণ্য মৃদু হাসল।

তোমার তো এখনো বেশ কখানা শাড়ি আছে। নাহ, তুমি আমাকে আর বরিশালে থাকতে দেবে না দেখছি।

লাবণ্য শাড়িতে চোখ রেখে বলল, হুম।

জীবনানন্দ ভাবলেন, কী অদ্ভুত মেয়ে রে বাবা। শ্বশুরকে এ ধরনের আবদার কেউ করে? বাবাকে কাপড়ের দাম দিতে হবে, ভাবতেই লজ্জায় তিনি যেন নুয়ে পড়লেন।

লাবণ্য হাসছে। দোকানের কর্মচারীকে বলছে, এটা নয়, ওটা দেখান। পাড়টা ভালো করে দেখান।

অনেক দেখেশুনে একটা সুন্দর সাদা ঢাকাই শাড়ি বেছে রেখে বাকি কাপড় ফেরত দিল।

 

বিকেলে বাড়িভর্তি মানুষ। দূর থেকেও এসেছেন আত্মীয়। জীবনানন্দ বুঝতে পারলেন না ব্যাপারটা কী? লাবণ্য বেশ ব্যস্ত। বাড়িতে ভালো-মন্দ রান্নাও হচ্ছে। পোলাও, পায়েস, মিষ্টি।

একফাঁকে জীবনানন্দ লাবণ্যকে ডাকলেন; ব্যাপারটা কী, বলো তো?

লাবণ্য না বোঝার ভান করে বলল, কিসের ব্যাপার?

এই যে এত লোক আসছে বাড়িতে?

লাবণ্য রহস্যময় হাসি হাসল।

আহা, বলো না।

আজ মায়ের জন্মদিন।

জীবনানন্দ জিভে কামড় দিলেন। আহা, আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম। বেকার মানুষ। মায়ের জন্মদিন মনে রেখেই বা আমি কী করতে পারতাম।

তোমাকে কিছু করতে হবে না। এ জন্য তোমার কাছে আবদার করিনি। জানি, তুমি দুঃখ পাবে। আজ সকালে মায়ের জন্যই শাড়িটা কিনলাম। বাবাকে না বলে উপায় ছিল না।

জীবনানন্দ হাত বাড়িয়ে লাবণ্যকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন।

লাবণ্য লজ্জা পাওয়া গলায় বলল, এই কী করো? ছাড়ো। বাড়িভর্তি মানুষ।

সর্বানন্দ ভবনে জন্মদিন পালনের রেওয়াজ অনেক পুরনো। লাবণ্য এ বাড়িতে এসেই জেনেছে এবং নিজেও পালন করে। মুশকিল হলো, কুসুমকুমারী নিজের জন্মদিনে আনন্দ করবে, মানুষকে ভালো-মন্দ খাওয়াবে; কিন্তু পুরনো মলিন শাড়ি পরে ঘুরে বেড়াবে। জন্মদিনে মা আধময়লা শাড়ি পরে ঘুরছে, দৃশ্যটা দেখে লাবণ্যর বুকে বেঁধে।

জীবনানন্দ বললেন, তুমি ঠিকই বলেছ। মা নিজের দিকে খেয়াল রাখেন না। মানুষের সেবা করাতেই তাঁর আনন্দ।

সে জন্যই এমন একটা রহস্য করতে হলো। তুমি কি রাগ করেছ?

আরে নাহ।

জন্মদিনে মায়ের একটা নতুন শাড়ি জুটবে না, বিষয়টা কেমন দেখায় বলো?

তুমি খুব ভালো কাজ করেছ।

জীবনানন্দ একটা স্নেহের হাত লাবণ্যর মাথায় রাখলেন।

কুসুমকুমারী সবার সঙ্গে কুশল বিনিময় আর খাবার পরিবেশন করছেন। লাবণ্য শাশুড়ির আঁচল ধরে টেনে আনল। বলল, মা, আপনি এই বেশে মানুষজনের সামনে যেতে পারবেন না।

কেন, কী হলো মা লাবু?

দেখি, আপনি এদিকে আসুন। এখানে বসুন।

ঘর থেকে চিরুনি এনে কুসুমকুমারীর মাথাটা ভালো করে আঁচড়ে দেয় লাবণ্য। কুসুমকুমারী অবাক। তিনি কপোট বিরক্তি প্রকাশ করে বললেন, আমার কি আর সাজবার বয়স আছে রে, মা।

লাবণ্য শাশুড়ির কথায় কান দিল না। বলল, নিন, এই শাড়িটা পরুন।

কুসুমকুমারী বললেন, এত লোকের সামনে এমন সেজেগুজে কেমন করে বের হই বলো তো?

কী আর করবেন, মা। না হয় একটু বেশি করে ঘোমটা টেনে দিয়ে যাবেন। কিন্তু এই শাড়িটা না পরলে আমি কিছুতেই আপনাকে আর বের হতে দেব না।

অবশেষে কুসুমকুমারী শাড়িটা পরলেন। লাবণ্য পেছন ফিরে জীবনানন্দকে ডাকলেন; এই, এদিকে এসো। একবার দেখে যাও মাকে।

জীবনানন্দ মায়ের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসলেন। বললেন, মা, সত্যি তোমাকে শাড়িটাতে খুব সুন্দর লাগছে। বেশ মানিয়েছে।

উপস্থিত মানুষজন এসে কুসুমকুমারীকে ঘিরে ধরল।

...কালীবাড়ি রোডের এক দোকান থেকে শাড়ি কিনে ফেরার সময় ঝুম বৃষ্টি নামল। বাড়ি ফিরতে ফিরতে জীবনানন্দ প্রায় ভিজে গেলেন।

বিকেলে ছেলে-মেয়ে নিয়ে লাবণ্যর বড় বোন প্রমীলা বেড়াতে এলো।

জামাইবাবু, কেমন আছেন?

জীবনানন্দ বললেন, আমরা ভালো। আপনি কেমন আছেন?

হ্যাঁ, ভালো।

আপনার সাহিত্যচর্চা কেমন চলছে?

এই তো, চলছে আর কি।

প্রমীলার বাচ্চাটা উঠোনে খেলছিল, দৌড়াতে গিয়ে পড়ে গেছে। আচমকা কেঁদে উঠল।

প্রমীলা বাচ্চাকে সামলাতে উঠে গেল। জীবনানন্দ খেয়াল করলেন, দুপুরে যে শাড়ি তিনি নিয়ে এসেছেন, সেই শাড়িটা পরে আছে প্রমীলা।

প্রাসঙ্গিক
মন্তব্য

সম্পর্কিত খবর

আদিচির নতুন বই

শেয়ার
আদিচির নতুন বই

এ মাসের ৪ তারিখে নাইজেরিয়ার আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন কথাসাহিত্যিক চিমামান্দা নগোজি আদিচির নতুন উপন্যাস ড্রিম কাউন্ট প্রকাশ করা হয়েছে পেঙ্গুইন র‌্যান্ডম হাউস থেকে । তাঁর আগের বই আমেরিকানাহ প্রকাশের এক যুগ পরে প্রকাশ করলেন ড্রিম কাউন্ট। বেশ দীর্ঘ সময় পরে প্রকাশ করার কারণে এবং যথারীতি তাঁর লেখার প্রতি পাঠকের টান থাকার কারণে ড্রিম কাউন্ট প্রকাশ করার সঙ্গে সঙ্গে পাঠকদের নজর পড়েছে এই নতুন উপন্যাসের ওপর। আফ্রিকার সাহিত্যের পণ্ডিত পাঠক ডারিয়া টুনকা মনে করেন, এক যুগ পরে প্রকাশের কারণে পাঠক সমালোচকের প্রত্যাশা অনেক বড় হওয়ার কথা।

তিনি মনে করেন, পাঠকের চাহিদা পূরণ করার মতো যথেষ্ট সমৃদ্ধ উপন্যাস ড্রিম কাউন্ট। চরিত্রদের জীবনের ওপর বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে আলো ফেলা হয়েছে। নারী চরিত্ররা আবেগের দিক থেকে জোরালো, অনেক ক্ষেত্রে বিপদের সম্মুখে তারা দুর্বল; আবার কোনো কোনো পরিস্থিতিতে তারা প্রাপ্য সম্মানের অধিকারী। কোনো ক্ষেত্রে বিরূপ পরিস্থিতির শিকার তারা।
আদিচির লেখার মধ্যে তির্যক, ব্যঙ্গ এবং কঠিন রসাত্মক বিষয়াদি খুব সাধারণ বিষয়।  অন্যদিকে আফ্রিকান-আমেরিকান স্টাডিজের বর্ষীয়ান প্রফেসর এডমান্ড গর্ডন মনে করেন, যে ভয়াবহ যৌন নিপীড়নের বাস্তব ঘটনার ওপর লেখা হয়েছে সেটার মতো গাম্ভীর্য ড্রিম কাউন্ট উপন্যাসে ধরে রাখা হয়নি। তিনি মনে করেন, যে চারজন প্রধান নারী চরিত্র তৈরি করা হয়েছে তাদের তিনজনের সামাজিক স্তরের সঙ্গে খাপ খায় না নিপীড়িত নারীর চরিত্র। তার অস্তিত্বে অন্য তিনজনের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন গর্ডন।
তাঁর মতে, উপন্যাসের শেষে কেন্দ্রীয় নারী চরিত্র কাদিয়াতু এবং তার মেয়ে বিন্তাকে যেভাবে আলোকিত পরিবেশে দেখানো হয়েছে তাতে উপন্যাসের ভাবগম্ভীর পরিবেশ খানিকটা নষ্ট হয়েছে। সমালোচকদের কথা যা-ই হোক আশা করা যায়, সময়ের সঙ্গে পাঠকের দৃষ্টি নিরপেক্ষ বিচারে গ্রহণ করবে আদিচির ড্রিম কাউন্ট

ফাহমিদা দ্যুতি

প্রাসঙ্গিক
মন্তব্য
বিশ্ব সাহিত্য

পেঙ্গুইন সাহিত্য পুরস্কারের সংক্ষিপ্ত তালিকা প্রকাশ

শেয়ার
পেঙ্গুইন সাহিত্য পুরস্কারের সংক্ষিপ্ত তালিকা প্রকাশ

পেঙ্গুইন র‌্যান্ডম হাউস অস্ট্রেলিয়া ২০২৫ সালের পেঙ্গুইন সাহিত্য পুরস্কারের সংক্ষিপ্ত তালিকা প্রকাশ করেছে। পেঙ্গুইন র‌্যান্ডম হাউসের অস্ট্রেলীয় শাখা সাহিত্য পুরস্কার দেওয়া শুরু করে ২০১৭ সালে। এ পুরস্কারের উদ্দেশ্য হলো, কথাসাহিত্যের সম্ভাবনাময় লেখকদের খুঁজে বের করার মাধ্যমে নতুন এবং বৈচিত্র্যময় সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়া। শুরু থেকে প্রতিবছরই অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন এলাকা থেকে বিচিত্র বিষয়ের লেখা জমা পড়ে থাকে।

অস্ট্রেলিয়া থেকে প্রকাশ করার পর পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখকদের বই বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়ে থেকে। এবারের তালিকায় রয়েছে এমা ক্ল্যান্সির থ্রিলারধর্মী উপন্যাস ব্যাড মেডসন, টিকে থাকার গল্পের ওপর তৈরি সিওভান ডারমোডির উপন্যাস সল্ট, মেরি কলুসির আধিভৌতিক বিষয়ের কাহিনি টাচ গ্রাস, র‌্যাচেল বাউম্যানের প্রত্যন্ত পরিবেশে সত্যের প্রকাশ প্রদর্শন করা উপন্যাস দ্য ফিয়ার অব এম্পটি স্পেসম সামারা লোয়ের পুরাণনির্ভর কাহিনি হয়ার দ্য লোটাস স্ট্যান্ডস এবং ডেনিস রাওয়ার্ডের প্রেম, বিরহ ও তাড়া করে ফেরা গোপন বিষয় নিয়ে লেখা উপন্যাস সো, দ্যা ওয়ার্ডস। এযাবৎ পেঙ্গুইন সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছেন ক্যাথরিন হাইন্ড, ইম্বি নিমি, সোফি ওভারেট, জেমস ম্যাকেঞ্জি ওয়াটসন, অ্যানেট হিগস, মিশেল সি-থো এবং ক্লো অ্যাডামস।  উল্লেখ্য, পেঙ্গুইন র‌্যান্ডম হাউস অস্ট্রেলিয়া ২০২৫-এর চূড়ান্ত পুরস্কার ষোষণা করবে জুন মাসের ১২ তারিখে।
বিজয়ী লেখক পাবেন ২০ হাজার ডলার।  

মন্তব্য
চীনের চিঠি

দক্ষিণের মেঘ : প্রাকৃতিক সৌন্দর্যঘেরা ক্যাম্পাস

    শান্তা মারিয়া
শেয়ার
দক্ষিণের মেঘ : প্রাকৃতিক সৌন্দর্যঘেরা ক্যাম্পাস

চারদিকে সবুজ পাহাড়। তার ছায়া পড়েছে লেকের জলে। সেখানে ভেসে বেড়াচ্ছে ব্ল্যাক সোয়ান বা কালো রাজহাঁস। চেরিফুলের শোভায় রঙিন হয়ে আছে চারপাশ।

এমনি সৌন্দর্যময় এক ক্যাম্পাসে আমার প্রতিদিন কাটে। এটি হলো চীনের ইয়ুননান বিশ্ববিদ্যালয়ের ছ্যংকুং ক্যাম্পাস।

চীনের দক্ষিণ-পশ্চিমের আরণ্যক প্রদেশ হলো ইয়ুননান। এর প্রাদেশিক রাজধানী কুনমিং শহর।

এই শহরের এক প্রান্তে বিশাল এলাকা নিয়ে গড়ে উঠেছে ছ্যংকুং জেলা। এখানে বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে।

এর আগে আমি এখানকারই ইয়ুননান মিনজু বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষার শিক্ষক হিসেবে বেশ কয়েক বছর চাকরি করেছি। করোনার সময় দেশে গিয়েছিলাম।

এখন আবার এসেছি ইয়ুননান বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষার শিক্ষক হিসেবে।

চীনের অন্যতম সেরা বিশ্ববিদ্যালয় হলো ইয়ুননান বিশ্ববিদ্যালয়। কুনমিং শহরে এর দুটি ক্যাম্পাস রয়েছে। দুটি ক্যাম্পাসই পর্যটন স্থান হিসেবেও বিখ্যাত।

ইয়ুননান বিশ্ববিদ্যালয় ১৯২২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়।

এর পুরনো ক্যাম্পাসটি শহরের প্রাণকেন্দ্রে সুইহু লেক বা গ্রিনলেকের কাছে অবস্থিত। বিশ্ববিদ্যালয়টি স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছে ইয়ুনতা নামে বেশি পরিচিত।

ইয়ুননান বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরনো ক্যাম্পাস বা তংলু ক্যাম্পাস এবং ছ্যংকুংয়ে অবস্থিত নতুন ক্যাম্পাস দুটোই পর্যটন স্থান হিসেবে জনপ্রিয়। তংলু ক্যাম্পাসে অনেকে আসেন এখানকার প্রাচীন গিংকোগাছগুলো দেখার জন্য। এখানে একটি দীর্ঘ হাঁটাপথ রয়েছে। শরৎকালে বা ফল সিজনে পুরো হাঁটাপথটি গিংকোগাছের সোনালি পাতায় অনন্য সুন্দর হয়ে ওঠে। এখানে ঝরাপাতার দৃশ্য আলোকচিত্রীদের দারুণভাবে আকর্ষণ করে। গ্রীষ্মকালে গিংকোগাছের সবুজ ছায়া এবং চেরি ও প্লাম ফুলের সৌন্দর্য দেখতে আসেন অনেকে।

তংলু ক্যাম্পাস একটি ছোট টিলার ওপর অবস্থিত। কাছেই বিখ্যাত গ্রিন লেক পার্ক। এখানে শীতকালে পরিযায়ী পাখিরা উড়ে আসে। সাইবেরিয়া থেকে উড়ে আসা পাখিরা তংলু ক্যাম্পাসেও আসে। পুরো ক্যাম্পাস এলাকার আয়তন চার লাখ ২৬ হাজার ৬৬৯ বর্গমিটার। এখানকার বিজ্ঞান ভবন, গ্রন্থাগার ভবন এবং শিক্ষা ভবন দৃষ্টিনন্দন নির্মাণশৈলীর জন্য বিখ্যাত।

তংলু ক্যাম্পাসে প্রচুর কাঠবিড়ালি রয়েছে। এখানে বাদামগাছে কাঠবিড়ালির বাসা আছে। শিক্ষার্থীরা কাঠবিড়ালিকে খাবার দেয়। কাঠবিড়ালির খেলা দেখতে এই ক্যাম্পাসে অনেকে আসেন।

ইয়ুননান বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন ক্যাম্পাস কুনমিংয়ের প্রান্তে বিশ্ববিদ্যালয় টাউন নামে পরিচিত ছ্যংকুং এলাকায় অবস্থিত। এই ক্যাম্পাসটি বিশাল বড়। এখানে পাহাড়, লেক, অরণ্য এবং গোলাপ ও ল্যাভেন্ডার ফুলের বাগান রয়েছে।

এখানে পাহাড়ের ওপর থেকে কুনমিংয়ের বিখ্যাত তিয়ানছি লেক এবং সিশান পাহাড়ের দৃশ্য দেখা যায়। ছ্যংকুং ক্যাম্পাসে জাকারান্দা, চেরি ও প্লাম ফুলের শোভা বিখ্যাত। এখানে ল্যাভেন্ডার ফুলের বড় বাগানের পাশে হাঁটাপথ পর্যটকদের কাছে খুব প্রিয়।

ইয়ুননান বিশ্ববিদ্যালয় চীনের অন্যতম সেরা তো বটেই, বিশ্ব র‌্যাংকিংয়েও জায়গা করে নিয়েছে। এখানে বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় গবেষণার জন্য বিশ্বমানের একাধিক গবেষণাগার রয়েছে। এখানকার গবেষক ও ছাত্র-শিক্ষকরা আন্তর্জাতিকভাবে বিভিন্ন টিমের সঙ্গে যুক্ত হয়ে বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় গবেষণা করছেন।

কম্পিউটার সায়েন্সেও এই বিশ্ববিদ্যালযের সুনাম রয়েছে।

ইয়ুননান বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাদেশের বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী রয়েছেন। এরা বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের বৃত্তিও দিয়ে থাকে।

এখানে এসে মনে হচ্ছে লেখাপড়ার পরিবেশ এমন না হলে কি চলে? এই শান্ত-স্নিগ্ধ, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ঘেরা পরিবেশে ছেলেমেয়েরা তাদের সবটুকু মন-প্রাণ দিয়ে বিদ্যাচর্চা করছেন। শিক্ষকরাও শিক্ষাদান ও গবেষণায় ব্যস্ত।

এখানে বাংলা বিভাগে ছাত্রছাত্রীদের যখন বাংলা ভাষা ও সাহিত্য সম্পর্কে আলোচনা হয় তখন বাংলাদেশের কথা খুব মনে পড়ে। বিশেষ করে আমার আলমা ম্যাটার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালযের কথা। সেই সঙ্গে আরেক প্রিয় বিশ্ববিদ্যালয় জাহাঙ্গীরনগরের কথাও। সংবাদমাধ্যমে দেখলাম জুলাই গণ-আন্দোলনে ছাত্র-জনতার ওপর হামলা করায় অনেককে বহিষ্কার করা হয়েছে।

মনে পড়ল এই বিশ্ববিদ্যালয়েই ধর্ষণে সেঞ্চুরি করা ছাত্রলীগ নেতা মানিকের কথা। এমন ভয়াবহ জঘন্য অপরাধ করার পরও তার কি এমন শাস্তি হয়েছিল? সে তো দিব্যি কানাডায় বিন্দাস লাইফ কাটাচ্ছে।

অসুস্থ রাজনীতি বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থাকেই ধ্বংস করে দিয়েছে। শিক্ষকরা যখন দলীয় লেজুড়বৃত্তিতে মেতে ওঠেন আর ক্ষমতায় যাবার খেলায় নিজেদের মহান পেশাকে কলুষিত করেন তখন আর কী-ইবা বলার থাকে। সেই সঙ্গে ছাত্ররাও নিজেদের জীবনকে ধ্বংস করে দলীয় রাজনীতির হাতিয়ারে পরিণত হন।

আমি নব্বইয়ের দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছি। সেসব আমার তারুণ্যের সোনালি গল্প। কিন্তু তখন ক্যাম্পাস রাজনীতির ভয়াবহ কুিসত দিকও চোখে পড়েছে। আমার অনেক বন্ধুর জীবন শেষ হয়ে গেছে দলীয় ক্যাডার হওয়ায়। অস্ত্রবাজিও ছিল পুরোদমে।

আমেরিকার ওকলাহোমা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতা বিষয়ে শিক্ষা গ্রহণেরও সুযোগ হয়েছে আমার। সেখানেও দেখেছি শিক্ষার পরিবেশ কত সুন্দর।

ছাত্রছাত্রীরা রাজনীতি সচেতন অবশ্যই হবেন। অন্যায়ের প্রতিবাদও নিশ্চয়ই করবেন। কিন্তু দলীয় কুিসত রাজনীতির হাতিয়ার তাঁরা হবেন কেন? কেনই বা ক্যাম্পাসে চলবে অস্ত্রবাজি?

ফিরে আসি ইয়ুননান বিশ্ববিদ্যালয় প্রসঙ্গে। এখানে ছাত্রছাত্রীরা কত সুন্দর শান্তিময় জীবন কাটাচ্ছে। তার ভবিষ্যৎ জীবন গড়ার জন্য উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করছে। এরা ক্লাস, গবেষণাগার, লাইব্রেরিতে ব্যস্ত থাকে। পাশাপাশি ক্রীড়া ও সংস্কৃতিচর্চায়ও অনেক সময় কাটায়। আহা, আমার দেশের ছেলেমেয়েদের যদি এমন সুযোগ দেওয়া যেত।

ইয়ুন শব্দের অর্থ মেঘ। আর নান মানে দক্ষিণ। দক্ষিণের মেঘে ঢাকা এই সুন্দর স্থান থেকে বাংলাদেশের জন্য পাঠালাম অশেষ ভালোবাসা।

লেখক : সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও শিক্ষক, ইয়ুননান বিশ্ববিদ্যালয়

মন্তব্য

কাবুলিওয়ালার দ্বিতীয় অধ্যায়

    মহিবুল আলম
শেয়ার
কাবুলিওয়ালার দ্বিতীয় অধ্যায়
অঙ্কন : তানভীর মালেক

কাবুলিওয়ালা গল্পটা দিয়েই শুরু করি। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাবুলিওয়ালা গল্পটার কথা আমরা কে না জানি? ছোটবেলায় বাবার বুকে শুয়ে এই গল্প কতবার শুনেছি! কাবুলিওয়ালার মিনিকে খোঁজা, কাবুলিওয়ালার চলে যাওয়ার শেষ দৃশ্যটা শুনে কতবার যে কেঁদে বুক ভাসিয়েছি! বাবা নাটকের লোক ছিলেন। নিজে নাটক লিখতেন। তাঁর নাটক তাঁদের অফিসের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে মঞ্চস্থ হতো।

বাবা যখন এই কাবুলিওয়ালা গল্পটা বলতেন তখন একধরনের নাটুকে পরিবেশের সৃষ্টি হতো। বাবার গল্প বলার ঢঙটাই এমন ছিল, খোঁখী, তোমি সসুরবাড়ি কখুনু যাবে না...! বা সসুরাকে মারিতাম, কিন্তু কী করিব, হাত বাঁধা...।

দীর্ঘদিন ধরে বিদেশবিভুঁই আছি। আটাশ বছর তো হয়ে গেল।

সেই উনিশশো সাতানব্বই সালে দূরদেশে আসা সেই তরুণটির এখন মধ্যবয়স পেরিয়ে যাচ্ছে। বয়স বাড়তে থাকলে যা হয়, মানুষ খুব স্মৃতিকাতর হয়ে ওঠে। আমারও তা-ই হচ্ছে। কোনো গোধূলিলগ্নে পাহাড়ের ওপর বসে বা প্রশান্ত মহাসাগরের কোনো সৈকতে গা এলিয়া দিয়ে বাল্যকালের স্মৃতি নিয়ে বড্ড বেশি ভাবি।
কোনো মনোরম সবুজে, বিকেলের সূর্য ডোবার পূর্বলগ্নে বা সন্ধ্যায় পাখিদের নীড়ে ফেরা দেখে বুকটা অসম্ভব হাহাকার করে ওঠে। ফিরে যাই গ্রামে। ফিরে যাই আমাদের সেই ছোট্ট শহরে।

আসলে আমরা যেন এই পরবাসে একেকজন কাবুলিওয়ালা। স্মৃতি নিয়েই বেঁচে আছি।

কেউ কেউ তো এখানে সত্যিকারের কাবুলিওয়ালা হয়ে ওঠে। রহমত কাবুলিওয়ালার চেহারাটা স্পষ্টই ভর করে। আমাদের আজমল স্যার সে রকমই একজন কাবুলিওয়ালা ছিলেন।

আজমল স্যারের কাবুলিওয়ালা হয়ে ওঠার যে গল্প, সেটা বলার আগে তাঁর সম্বন্ধে বিস্তারিত কিছু বলি। তিনি ছিলেন বাংলাদেশে একটি স্বনামধন্য কলেজের রসায়নের সহকারী অধ্যাপক। ছাত্রজীবনেও তিনি ছিলেন খুবই মেধাবী। রসায়ন বিষয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রথম শ্রেণি পেয়ে মাস্টার্স করেছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হয়ে সরাসরি একটা কলেজে প্রভাষকের চাকরি নেন। একটু দেরিতে অবশ্য বিয়ে করেন। একটা ছেলেসন্তান ছিল।

এমন ভালো ছাত্র হওয়ার পরও তিনি চাকরিজীবনে খুব একটা সফলতার মুখ দেখেননি। এর পেছনে একটাই কারণ ছিল, তিনি অত্যন্ত সহজ-সরল ছিলেন। আজকালকার সমাজে নয়কে ছয় বা ছয়কে নয় করা, এর কিছুই বুঝতেন না। তাঁর সহকর্মী বন্ধুরা যখন তরতর করে ওপরে উঠে যাচ্ছিল, তখন তিনি সেই একই কলেজে সহকারী অধ্যাপক হয়ে পড়ে ছিলেন।

আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি। সূর্য সেন হলের আবাসিক ছাত্র। আজমল স্যার মাঝেমধ্যে আমার ছাত্রাবাসে চলে আসতেন। কখনো একা, কখনো আমার বাবার সঙ্গে। তিনি আমার বাবার বন্ধু ছিলেন।

একদিন আজমল স্যার আমার ছাত্রাবাসে এসে বলেন, আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি নিউজিল্যান্ড যাব।

আমি অবাক হই। জিজ্ঞেস করি, কেন?

তিনি বলেন, হায়ার স্টাডি করতে।

হায়ার স্টাডি?

হ্যাঁ, হায়ার স্টাডি। কলেজে আমার কলিগরা বলেছে, বিদেশে হায়ার স্টাডি করে এলে এখানে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে বা বড় কোনো প্রতিষ্ঠানে চাকরি হবে। আর মানুষ তো বাইরে গিয়ে হায়ার স্টাডি করেই

আজমল স্যারের কথা ঠিক। এটা সত্য, মানুষ তো বাইরে হায়ার স্টাডি করতেই যায়। অনেকে হায়ার স্টাডি করে বিদেশেই সেটেল্ড হয়ে যায়। কিন্তু আজমল স্যার এই বয়সে যাবেন? তাঁর বয়স তো পঞ্চাশের ওপরে। তেপ্পান্ন-চুয়ান্ন বছর হবে। আমি তাই মুখ ফসকে বলে ফেলি, স্যার, এই বয়সে?

আজমল স্যার অবশ্য সেদিন বুদ্ধিমানের মতো কথা বলেন, লেখাপড়ার কোনো বয়স নেই। 

 

দুই.

আজমল স্যার উনিশশো পঁচানব্বই সালে নিউজিল্যান্ডে চলে যান। বিদেশ যাওয়ার পর তাঁর সঙ্গে আমার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। উনিশশো সাতানব্বই সালের জানুয়ারিতে আমি নিউজিল্যান্ডে এলে এর এক মাস পর হকসবে অঞ্চলের হেস্টিং শহরে ফেব্রুয়ারির এক সকালে তাঁর সঙ্গে আমার দেখা হয়। তাঁকে দেখে আমি চমকে উঠি। তাঁর এ কী হাল! চেহারা ভেঙে গেছে। চোখ দুটো বসে গেছে। বয়সটা বেড়ে গিয়ে মনে হচ্ছে ষাট হয়ে গেছে। অথচ তিনি দেখতে খুব ফরসা ও সুন্দর ছিলেন। যে কেউ তাঁকে দেখলে বলত, রাজপুরুষ। তিনি সত্যি রাজপুরুষ ছিলেন। একবার কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে বাংলা সিনেমের শুটিং দেখতে গেলে এক চলচ্চিত্র পরিচালক তো তাঁকে নায়ক বানানোর জন্য উঠেপড়ে লেগেছিল। কিন্তু তাঁর অতিরিক্ত সহজ-সরল স্বভাবের জন্য তিনি জীবনে এক কলেজের শিক্ষক বাদে কিছুই হতে পারেননি। আর কলেজে শিক্ষকতা করতে গিয়ে খুব যে সুখে ছিলেন, তা নয়। সাদাসিধে হওয়ার জন্য পদে পদে কলিগ, প্রিন্সিপাল, এমনকি ছাত্রদের কাছে অপদস্থ হতেন।

আমি সেদিন আজমল স্যারের সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে হেস্টিংস শহরের একিনা সাবার্বের উইলো পার্কের এক বেঞ্চিতে গিয়ে বসে জিজ্ঞেস করি, স্যার, আপনার কী হয়েছে?

আজমল স্যার সরল গলায় জিজ্ঞেস করেন, কেন, কিছু হয়েছে নাকি?

আপনার চেহারা কী বানিয়েছেন?

টেনশনে, অতিরিক্ত টেনশনে

কেন এত টেনশন?

আমি বিদেশ আসার আগে তুমি একদিন ঠিকই বলেছিলে, আমার এই বয়সে বিদেশে আসা ঠিক হয়নি। আমার জন্য বিদেশ না। এখন নিউজিল্যান্ডে কিছুই করতে পারছি না। ওদিকে বাংলাদেশের কলেজের চাকরিটাও যায় যায় অবস্থা।

খুলে বলেন তো। এই দুই বছর তো আপনার কোনো খবর পাইনি।

আজমল স্যার চেহারা একটু ভারী ও বিষণ্ন করে বলেন, তুমি তো জানো, আমি হ্যামিল্টনের ওয়াইকাটো বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজের টাকায় টিউশন ফি দিয়ে ভর্তি হয়ে এসেছি। কোনো স্কলারশিপ নিয়ে নয়। বাংলাদেশে অনেকের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে ও নিজের জমিজমা বিক্রি করে আমার বাইশ হাজার ডলার টিউশন ফি জমা দিতে হয়েছে। এ ছাড়া এয়ার ফেয়ার আরো কত কী! কিন্তু নিউজিল্যান্ডে এসে তো অকূল দরিয়া নয়, রীতিমতো প্রশান্ত মহাসাগরে পড়ি। হ্যামিল্টন শহরে এমনিতেই ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্টরা কোনো চাকরি পায় না। তার ওপর আমার বয়স অনেক বেশি।

আমি নড়েচড়ে বসে জিজ্ঞেস করি, তারপর?

তারপর আমার না খেয়ে থাকার মতো অবস্থা। ওখানকার কিছু বাঙালি আমাকে পরামর্শ দেয় তাওরাঙ্গা বা হেস্টিংস শহরে চলে আসতে। এখানে তো ফলের বাগানে প্রচুর কাজ

আপনি তাই করলেন?

আজমল স্যার মাথা ঝাঁকিয়ে বলেন, হ্যাঁ

আমি জিজ্ঞেস করি, তারপর?

আজমল স্যার বলেন, তারপর আর কি, আমি কিছুদিন তাওরাঙ্গা শহরে কাজ করে পরে হেস্টিংসে চলে আসি।

আপনার ওয়াইকাটো ইউনিভার্সিটিতে স্টাডি?

ওটা আর করা সম্ভব হয়নি। একে তো দেশে অনেকের কাছ থেকে ঋণ করে নিউজিল্যান্ডে এসেছি। ওরা চাপ দিচ্ছিল। তাই ওয়াইকাটো ইউনিভার্সিটি থেকে আমার টিউশন ফি তুলে ফেলেছি। তুলে দেশে আবার টাকা পাঠিয়ে দিয়েছি।

তাহলে এখন কী করবেন, দেশে চলে যাবেন?

হ্যাঁ, তাইতো করতে হবে। আমার ছেলেটার কথা খুব মনে পড়ে। এখানে মন টিকছে না। আমি তিন মাস হ্যামিল্টন শহরে বসে বসে খেয়েছি। বেশ ঋণ হয়ে গেছে। দেশে আরো কিছু ঋণ আছে। নিজেও কিছু টাকা না নিয়ে যাই কিভাবে?

আমি মাথা ঝাঁকিয়ে বলি, তাইতো!

 

তিন.   

আজমল স্যারের আর দেশে যাওয়া হয়নি। দেশে কলেজের গভর্নিং বোর্ড তাঁর দীর্ঘ অনুপস্থিতিতে তাঁকে চাকরি থেকে ইস্তফা দেয়। আধাসরকারি কলেজ। গভর্নিং বোর্ড এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিতেই পারে। কলেজের চাকরিটা চলে যাওয়ার পর আজমল স্যার দেশে যাওয়ার চিন্তা বাদ দেন। এদিকে তাঁর নিউজিল্যান্ডে লিগেল স্টুডেন্ট ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। তিনি দ্বিধা ও দ্বন্দ্বে অনেকটা দেরি করে সঠিক কোনো গ্রাউন্ড তৈরি না করেই রাজনৈতিক আশ্রয় চান। যেহেতু তিনি স্টুডেন্ট ভিসা শেষ হওয়ার পর অবৈধ হয়ে রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়েছিলেন, তাই নিউজিল্যান্ড সরকার তাঁকে সোশ্যাল বেনিফিটও দেয়নি। ব্যাপারটা এমন হয়েছিল, তাঁর রাজনৈতিক আশ্রয়ের কেস যত দিন ইমিগ্রেশনে চলবে তত দিন তিনি থাকতে পারবেন, কিন্তু সরকারের কোনো সুযোগ-সুবিধা তিনি পাবেন না। 

আমি যখন তাওরাঙ্গা শহরের কাছে মাউন্ট মাঙ্গানুই শহরে মামার বাসায় থাকি, তখন আজমল স্যারকে মামার বাসায় নিয়ে আসি। পুরো এক বছর তিনি আমার সঙ্গে রুম শেয়ার করেন। স্যারের সঙ্গে কত সুখদুঃখের আলাপই না করতাম। স্যার আমার দ্বিগুণ বয়সী হলেও আমরা কেমন বন্ধু হয়ে উঠি। স্যার সারাক্ষণ শুধু ছেলের গল্পই করতেন। স্যারের ছেলের নাম ছিল আবরার হোসেন। আজমল হোসেন স্যার নিজের নামের সঙ্গে মিলিয়ে রেখেছিলেন। স্যার যখন ছেলেকে বাংলাদেশে রেখে আসেন তখন আবরারের বয়স ছিল আট বছর। রুমে থাকলে স্যার সারাক্ষণ শুধু আট বছর বয়সী আবরারের একটি ছবির দিকেই ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকতেন। কতবার তাঁকে ছেলের ছবির দিকে তাকিয়ে একা একা কাঁদতে দেখেছি!

আজমল স্যার একটা কথা প্রায়ই বলতেন, নিউজিল্যান্ডে এই অনিশ্চিত জীবন, এত লাঞ্ছনা-বঞ্চনা, এত কষ্ট সবই সহ্য করছি আমার এই ছেলেটার জন্য। আবরারের একটা গতি করে যেতে পারলে আমি মরে গিয়েও শান্তি পাব!

আজমল স্যারের সঙ্গে উইকএন্ডে বা কোনো বিকেলে হাঁটতে বের হলে আমি একটা ব্যাপারে খুব বিরক্ত হতাম। তিনি ফুটপাতে বা পার্কে আট বছর বয়সী কোনো ছেলে দেখলেই গায়ে পড়ে কথা বলতেন। ওদের কেউ কেউ কথা বলত। কেউ কেউ না বুঝে স্যারকে অবহেলা করে চলে যেত। একটা সময় দেখলাম, স্যার পকেটে চকোলেট, ললি বা ললিপপ নিয়ে হাঁটেন। আট বছর বয়সী কোনো ছেলে দেখলেই চকোলেট বা ললিপপ সাধাসাধি করেন। অনেকেই তাঁর দেওয়া ললিপপ বা চকোলেট নিত। অনেকে নো থ্যাংকস বলে চলে যেত। আমি স্যারকে সতর্কও করেছিলাম এটা না করতে। কিন্তু স্যার তো অতশত বোঝেন না।

আরেকটা ব্যাপার আমাকে অবাক করত, আজমল স্যারের মাথায় শুধু তাঁর ছেলের আট বছর বয়সটাই কাজ করত। ছেলের আট বছর বয়স থেকে তিনি বের হতে পারতেন না। আবরারের যে বয়স বাড়ছে, ওটা স্যারের মাথায়ই ছিল না। এর পেছনে আরেকটা কারণও ছিল। আবরারের আট বছর বয়সী ছবিটা। তখন অবশ্য ইন্টারনেটের তেমন যুগ ছিল না। সবার হাতে মোবাইলও ছিল না। আমি যে গল্পটা করছি সেটা উনিশশো সাতানব্বই-আটানব্বই সালের গল্প। 

 

চার.

উনিশশো আটানব্বই সালের মাঝামাঝি বা শেষের দিকে আমি অকল্যান্ডে চলে যাই। আজমল স্যার মাউন্ট মাঙ্গানুই ছেড়ে আবার হেস্টিংস শহরে চলে যান। মাঝখানে কর্মব্যস্ততায় স্যারের সঙ্গে আমার যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। একদিন শুনি, আজমল স্যারকে হেস্টিংস পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে। আমি খবরটা শুনে আঁতকে উঠি। হেস্টিংসে বন্ধুসম একজনকে ফোন করে জানতে পারি, স্যার বিকেলে পার্কে হাঁটতে গিয়ে আট বছরের এক ছেলের হাত ধরে টানাটানি করেছেন। এ জন্য ছেলেটা ভয় পেয়ে চিৎকার করে বাসায় গিয়ে তার মা-বাবাকে গিয়ে বলে। ছেলের মা-বাবা তৎক্ষণাৎ পুলিশ ডাকে। আজমল স্যার অ্যারেস্ট হন।

এদিকে নিউজিল্যান্ডের বাঙালি মহলে ছড়িয়ে পড়ে, ওয়ান এইট ইয়ার্স ওল্ড বয় হ্যাজ বিন সেক্সুয়ালি এসাল্টেড বাই আজমল হোসাইন...! হেস্টিংসের কমিউনিটি নিউজপেপারে মনে হয় এই সংবাদটি ছাপাও হয়। কিন্তু আমি তো জানি কী হয়েছে। আমি স্যারকে আগেও কয়েকবার সতর্ক করেছিলাম। তিনি সরল মনে যা-ই করুন, নিউজিল্যান্ডে ছেলেমেয়েদের এ ব্যাপারগুলো খুব গুরুত্ব দিয়ে দেখে। পুলিশ সর্বোচ্চ পন্থা অবলম্বন করে।

আজমল স্যারের সেই ব্যাপারটা অবশ্য বেশিদূর গড়ায়নি। কোর্ট পর্যন্ত ওঠেনি। হেস্টিংস শহরে বসবাস করে আবু সাইদ ও আসাদ রহমান নামের দুই ভালো মনের মানুষ স্যারের হয়ে বেশ পরিশ্রম করে সেই ছেলেটার মা-বাবাকে অনেক বুঝিয়ে কেসটি কোর্ট পর্যন্ত তুলতে দেয়নি। তিন দিন পর আজমল স্যারকে হেস্টিংস পুলিশ স্টেশন থেকেই ছাড়িয়ে নিয়ে আসে।

তারপর আজমল স্যার আর হেস্টিংস শহরে বেশিদিন থাকেননি। তাওরাঙ্গা শহরের অদূরের ছোট্ট শহর টিপুকিতে চলে আসেন। আমিও তত দিনে অকল্যান্ড ছেড়ে হ্যামিল্টন শহরে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করি।

একদিন স্যারকে হ্যামিল্টন থেকে টিপুকি শহরে দেখতে আসি। স্যার তখন বাঙালিদের থেকে একটু দূরে দূরে থাকেন। আদিবাসী মাউরিদের সঙ্গে এক বাসায় রুম শেয়ার করে থাকেন। স্যার আরো শুকিয়ে গেছেন। গাল-চোখ অরো বসে গেছে। খানিকটা কুঁজো হয়ে গেছেন। অথচ তাঁর বয়স তখন বড়জোর সাতান্ন কি আটান্ন  হবে।

সেদিন আজমল স্যারকে দেখে আমার এতই কষ্ট হয়েছিল যে আমি স্যারের শারীরিক অবস্থার বিষয়ে কিছুই জিজ্ঞেস করিনি। বিকেলে একটা কফিশপ থেকে দুই কাপ কফি নিয়ে আমরা টিপুকির একটা পার্ক ধরে হাঁটতে বের হই। পার্কে দেখি কিছু ছেলেমেয়ে খেলা করছে। ওদের মধ্যে আট বছর বয়সীও কেউ কেউ আছে।

স্যার ও আমি পার্কে পাশাপাশি হাঁটছিলাম। হঠাৎ স্যারকে দেখি তিনি পার্কের ছেলেমেয়েদের দেখে খানিকটা দূর দিয়ে ঘুরে যেতে চাচ্ছেন। তিনি কেমন যেন ভয় পাচ্ছেন। ভয় পেয়ে এদিক-ওদিকও তাকাচ্ছেন। আমি বুঝতে পারি, তিনি হেস্টিংসের সেই ঘটনার পর এই ব্যাপার নিয়ে ভয় পাচ্ছেন।

আমি স্যারের রুমে ফিরে অনিচ্ছা সত্ত্বেও জিজ্ঞেস করি, স্যার, হেস্টিংসে আসলে কী হয়েছিল?

আজমল স্যার কিছুক্ষণ চুপ করে থাকেন। তারপর কী ভেবে বলেন, হেস্টিংসের উইলোপার্ক। সেই পার্কটা তো তুমি চিনোই। তুমি যখন হেস্টিংসে ছিলে তোমাকে নিয়ে কয়েকবার হাঁটতে গিয়েছি। সেই পার্কে একটা আট বছরের ছেলে বাইক চালাচ্ছিল। আমি তাকে ডেকে চকোলেট দিতে যাই। সে কোনো কারণ ছাড়া চিৎকার দিতে শুরু করে। আমি তাকে তার হাত ধরে বোঝানোর চেষ্টা করি, এটা চকোলেট, অন্য কিছু না। ছেলেটা আরো চিৎকার- চেঁচামেচি করে বাইক নিয়ে চলে যায়। একটু পরে পুলিশ এসে পার্ক থেকে আমাকে ধরে নিয়ে যায়।

আমি বলি, আমি তো আগেই আপনাকে সতর্ক করেছিলাম। আপনার সরলতা সবাই বুঝবে না। কোনো আট বছরের ছেলেও না।

আজমল স্যার বেশ কিছুক্ষণ কোনো জবাব দেননি। তারপর নিজের ছেলের প্রসঙ্গ টানেন। আস্তে আস্তে সেদিনের সন্ধ্যাটা আরো ভারী হয়ে ওঠে। তিনি একসময় ছেলে আবরারের আট বছর বয়সের ছবিটা ব্যাগের একটা ডায়েরি থেকে বের করে দেখতে দেখতে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠেন।

আমার চোখও তখন কেমন ভিজে আসে। আমার মনে হয়েছে স্যারকে কিছু বলি। কোনো সান্ত্বনা। কিন্তু এর কিছুই বলতে পারিনি। আমার বারবার মনে হয়েছিল, এই ছাপ্পান্ন-সাতান্ন বছরের সরল শিশুটাকে কে বোঝাবে যে এই পৃথিবী তাঁর নয়। তাঁর সেই আট বছরের ছেলে আবরার আর আট বছরের নেই।

সেদিন রাতে টিপুকি শহর থেকে হ্যামিল্টনে ফিরতে ফিরতে একটা কথাই মনে হয়েছিল, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেই রহমত কাবুলিওয়ালাই শেষ কাবুলিওয়ালা নয়। পিতৃ হৃদয়ের সেই কাবুলিওয়ালাদের আজও প্রতিদিন পৃথিবীর প্রতিটি শহরেই দেখা যায়। শুধু একজন আজমল স্যার নন, শতজন। সহস্রজন বা তারও অধিক।

প্রাসঙ্গিক
মন্তব্য

সর্বশেষ সংবাদ