ডলার সংকটেও ওয়েজ আর্নার্স বন্ড নিয়ে বিড়ম্বনা

  • নিরঞ্জন রায়
শেয়ার
ডলার সংকটেও ওয়েজ আর্নার্স বন্ড নিয়ে বিড়ম্বনা

বাংলাদেশে বৈদেশিক মুদ্রা, বিশেষ করে মার্কিন ডলার সংগ্রহের যতগুলো মাধ্যম আছে, তার মধ্যে ওয়েজ আর্নার্স ডেভেলপমেন্ট বন্ড (ওয়েজ আর্নার্স বন্ড) অন্যতম। কেননা দেশে বৈদেশিক মুদ্রা সংগ্রহের অন্যান্য যেসব পন্থা আছে, যেমনরপ্তানি আয়, বৈদেশিক রেমিট্যান্স এবং বৈদেশিক ঋণ, এর সবগুলোর বিপরীতে তাত্ক্ষণিক ব্যয় থাকে। অর্থাৎ এসব উৎস থেকে একদিকে ডলার সংগ্রহ করা হয় এবং অন্যদিকে সেই ডলার আমদানিমূল্য ও ঋণ পরিশোধসহ অন্যান্য খাতে ব্যয় হয়ে যায়। সেদিক থেকে ওয়েজ আর্নার্স বন্ড কিছুটা ভিন্ন।

অবশ্য বাস্তবে ওয়েজ আর্নার্স বন্ডের মাধ্যমে সংগৃহীত ডলার তাত্ক্ষণিক ব্যয় করতে কোনো বাধা নেই। কিন্তু ক্রেতা মেয়াদপূর্তিতে বন্ডের আসল অর্থ ডলারে রূপান্তর করে তাঁর নিবাসী দেশে বা অন্য কোনো দেশে ফিরিয়ে নিতে পারে। এ কারণে মেয়াদপূর্তিতে বন্ডের আসল অর্থ ডলারে ফেরত দেওয়ার স্বার্থে মোট বিক্রীত ওয়েজ আর্নার্স বন্ডের সমপরিমাণ ডলার বিশেষভাবে সংরক্ষণ করতে হয়, যা মূলত সরকারের টেকসই বা দীর্ঘমেয়াদি ডলার ফান্ড হিসেবে কাজ করে। যদিও এই ডলার ফান্ড শুধু ওয়েজ আর্নার্স বন্ডের অর্থ পরিশোধে ব্যয় করার কথা, তার পরও দেশের জরুরি প্রয়োজনে বন্ডের মেয়াদপূর্তির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে এই বিশেষ ফান্ডের অর্থ ব্যয় করার সুযোগ থাকে।
এটাই সরকারের দিক থেকে ওয়েজ আর্নার্স বন্ডের সবচেয়ে বড় সুবিধা।

ওয়েজ আর্নার্স বন্ডের মাধ্যমে সরকারের পাশাপাশি প্রবাসী বাংলাদেশিরাও বিশেষ সুবিধা পেয়ে থাকে। প্রথমত, এই বন্ডে বিনিয়োগের সুযোগ থাকায় প্রবাসীরা তাদের কষ্টার্জিত বৈদেশিক মুদ্রা বৈধভাবে ব্যাংকিং চ্যানেলে দেশে পাঠাতে আগ্রহী থাকে। দ্বিতীয়ত, এই বন্ডের আসল অর্থ যেহেতু মেয়াদপূর্তিতে পুনরায় ডলারে রূপান্তর করে বিদেশে নিয়ে যাওয়া যায়, তাই অনেকেই, বিশেষ করে যেসব প্রবাসী স্থায়ীভাবে বিদেশে বসবাস করে, তারা এই বন্ডে বিনিয়োগ করতে সবচেয়ে বেশি আগ্রহ দেখায়।

যদিও বন্ডে প্রদত্ত সুযোগ অনুযায়ী এর আসল অর্থ ক্রেতা তার নিবাসী দেশে নিয়ে যেতে পারে, কিন্তু বাস্তবে বেশির ভাগ ক্রেতা না নিয়ে এখানে রেখে দেয়, যতক্ষণ পর্যন্ত পুনর্বিনিয়োগের সুযোগ থাকে। তৃতীয়ত, এই বন্ডের ওপর প্রদত্ত সুদ তুলনামূলক বেশি থাকায় প্রবাসীরা তাঁদের কষ্টার্জিত অর্থ দেশে এনে প্রয়োজনীয় এবং অপ্রয়োজনীয় খাতে খরচ করার পরিবর্তে এই বন্ডে বিনিয়োগ করে রাখতে পারে।

ডলার সংকটেও ওয়েজ আর্নার্স বন্ড নিয়ে বিড়ম্বনাএ রকম একটি বিশেষ সুবিধাসংবলিত ওয়েজ আর্নার্স বন্ড যতটা জনপ্রিয় হওয়ার কথা ছিল এবং যেভাবে ব্যাপক হারে এই বন্ডে প্রবাসীদের ডলার বিনিয়োগ করার কথা ছিল, তেমনটা হয়নি। এর অনেক কারণও আছে। প্রথমত, এটি যে প্রবাসীদের জন্য বিশেষ এক বিনিয়োগ ব্যবস্থা, সে ব্যাপারে তেমন প্রচার-প্রচারণা নেই বললেই চলে।

দ্বিতীয়ত, এই বন্ডে বিনিয়োগ করার পদ্ধতি বেশ জটিল। অনেক রকম ফরম পূরণ করতে হয় এবং অ্যাম্বাসি বা হাইকমিশনের সহযোগিতা নিতে হয়, যা বেশ কষ্টসাধ্য। তার ওপর বন্ড ইস্যু করা এবং ইস্যুকৃত বন্ড সংগ্রহ করাও খুব সহজ হয় না। এর সঙ্গে নতুন করে যোগ হয়েছে বিনিয়োগ করা ওয়েজ আর্নার্স বন্ড পুনর্বিনিয়োগের সুযোগ সীমিত করে দেওয়া। এসব কারণে ওয়েজ আর্নার্স বন্ড ক্রয় এবং নবায়ন করা নিয়ে যথেষ্ট বিড়ম্বনার শিকার হতে হচ্ছে। এই বন্ড নবায়নের সুযোগ সীমিত করার পেছনে উচ্চ হারের সুদ প্রদানকে যুক্তি হিসেবে দেখানো হতে পারে। কিন্তু আপাতদৃষ্টিতে সুদের হার বেশি মনে হলেও প্রকৃত অর্থে সরকার সঞ্চয়পত্রের চেয়ে অনেক কম সুদ এই বন্ডের ওপর দিয়ে থাকে। বিষয়টি অনেকে হয়তো মানতে চাইবেন না, তাই তাদের জ্ঞাতার্থে একটি কাল্পনিক উদাহরণের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে।    

আজ থেকে পাঁচ বছর আগে ডলারের বিনিময় মুল্য যখন ৮০ টাকা ছিল তখন সরকার একজন প্রবাসীর কাছ থেকে এক লাখ ডলার ক্রয় করে ৮০ লাখ টাকার ওয়েজ আর্নার্স বন্ড ইস্যু করেছে। এখন যখন সেই বন্ড মেয়াদ পূর্ণ করেছে তখন দেশে ডলারের বিনিময় মূল্য ১২০ টাকা এবং সে অনুযায়ী বন্ডের আসল অর্থ ৮০ লাখ টাকার বিনিময়ে ডলারের বর্তমান বিনিময় মূল্য অনুযায়ী ৬৭ হাজার ডলার। এই পাঁচ বছর সময়ে সরকারের এক্সচেঞ্জ গেইন হবে ১৩ হাজার ডলার, যা বর্তমান বিনিময় মূল্য অনুযায়ী ১৬ লাখ টাকা। বন্ডের পাঁচ বছর মেয়াদকালে সরকার টাকায় সুদ প্রদান করবে ৪৮ লাখ টাকা যদি বন্ডের ওপর সুদের হার ১২ শতাংশ হয়। বিনিময় লাভ বিবেচনায় নিলে সরকার ওয়েজ আর্নার্স বন্ডের ওপর প্রকৃত সুদ প্রদান করবে ৩২ লাখ টাকা। পক্ষান্তরে যদি ওয়েজ আর্নার্স বন্ডে বিনিয়োগের পরিবর্তে সরকারি সঞ্চয়পত্রে এই ৮০ লাখ টাকা বিনিয়োগ করে রাখা হয় এবং সঞ্চয়পত্রের ওপর যদি সুদের হার হয় ১০ শতাংশ, তাহলে সরকারকে সুদ দিতে হবে ৪০ লাখ টাকা। অর্থাৎ এক লাখ ডলারের ওয়েজ আর্নার্স বন্ডের ওপর প্রদত্ত প্রকৃত সুদ সমপরিমাণ সঞ্চয়পত্রের চেয়ে আট লাখ টাকা কম হবে।   

পাঠকদের বোঝার সুবিধার্থে আলোচ্য উদাহরণে চক্রবৃদ্ধি সুদের পরিবর্তে সরল সুদ ব্যবহার করা হয়েছে। উল্লেখ্য যে চক্রবৃদ্ধি সুদের ক্ষেত্রে পরিমাণটা বেশি হবে, কিন্তু পার্থক্যের পরিমাণ এ রকমই থাকবে। এ কারণেই দেখা যায় সঞ্চয়পত্রের পরিবর্তে ওয়েজ আর্নার্স বন্ডের ওপর সরকার প্রকৃত সুদ কম প্রদান করে থাকে। আলোচ্য উদাহরণে যে বিনিময় হারের পতন দেখানো হয়েছে তা খুবই অস্বাভাবিক, যা বিশেষ কারণ ছাড়া সাধারণত হয় না। যেমনব-এখন হয়েছিল রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ডলার হার্ড কারেন্সি হয়ে যাওয়ায়। কিন্তু স্বাভাবিক সময়েও টাকার যে অবমূল্যায়ন ঘটে, সেটি বিবেচনায় নিলেও সরকার ওয়েজ আর্নার্স বন্ডের চেয়ে সঞ্চয়পত্রের ওপর প্রকৃত সুদ অনেক বেশি প্রদান করে থাকে। এ কারণে প্রবাসীদের বিনিয়োগ করা ওয়েজ আর্নার্স বন্ড যত দিন পর্যন্ত পুনর্বিনিয়োগের সুযোগ দেওয়া যায়, ততই সরকারের লাভ। এটি জানা সত্ত্বেও সরকার এই ওয়েজ আর্নার্স বন্ড পুনর্বিনিয়োগের সুযোগ সীমিত করে দিয়েছে। এখন থেকে বিনিয়োগের পর সর্বোচ্চ দুইবারের জন্য ওয়েজ আর্নার্স বন্ড পুনর্বিনিয়োগ করা যাবে।

ওয়েজ আর্নার্স বন্ড পুনর্বিনিয়োগের পথ বন্ধ করে দিলে নানা রকম সমস্যা দেখা দিতে বাধ্য। প্রথমত, দেশের ডলার সংকটের মুহূর্তে এই সিদ্ধান্ত ডলারের চাহিদা বাড়িয়ে দেবে এবং সংকট কিছুটা হলেও তীব্র হতে পারে। দ্বিতীয়ত, ওয়েজ আর্নার্স বন্ড যখন পুনর্বিনিয়োগের সুযোগ থাকবে না, তখন বন্ডের বিনিয়োগকারীর সামনে দুটো পথ খোলা থাকবে। বন্ডের অর্থ ডলারে রূপান্তর করে বিদেশে নিয়ে যাওয়া এবং এর ফলে দেশ থেকে ভালো অঙ্কের ডলার বিদেশে চলে যেতে পারে। বিকল্প হিসেবে এই বন্ডের টাকা দিয়ে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করা। কিন্তু সে ক্ষেত্রে সরকারের এমন কী লাভ হবে তা আমাদের কাছে মোটেই বোধগম্য নয়। কেননা এতে সরকারকে প্রকৃত সুদ বেশি দিতে হবে, যা আগেই ব্যাখ্যা করা হয়েছে। তৃতীয়ত, অনেক প্রবাসী যখন জানবে যে ওয়েজ আর্নার্স বন্ড পুনর্বিনিয়োগের সুযোগ সীমিত হয়ে গেছে, তখন তারা এই বন্ডে বিনিয়োগে আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে। এর ফলে দেশে ডলার আসা যে অনেকটা হ্রাস পাবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। অথচ ওয়েজ আর্নার্স বন্ড পুনর্বিনিয়োগের সুযোগ অব্যাহত রাখার মাধ্যমে বর্তমানে এই খাতে বিনিয়োগ করা ডলার ধরে রাখা যেমন সম্ভব হবে, তেমনি এই বন্ডে নতুন বিনিয়োগ উৎসাহিত করে দেশের ডলার সরবরাহ উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি করার সুযোগ থাকবে। 

এ রকম বাস্তবতায় বিশেষ করে দেশ যেহেতু ডলার সংকট কাটিয়ে উঠতে পারেনি, ঠিক সেই সময়ে ওয়েজ আর্নার্স বন্ড পুনর্বিনিয়োগের সুযোগ সীমিত করার পদক্ষেপ মোটেই যুক্তিসংগত এবং বাস্তবসম্মত হয়নি। তা ছাড়া এতে সরকারের ক্ষতি ছাড়া লাভ নেই। যদি তর্কের খাতিরে এক্সচেঞ্জ গেইনের মতো জটিল বিষয়টি সরিয়ে রেখে সোজাসুজি ধরে নিই যে উচ্চ সুদের হারই ওয়েজ আর্নার্স বন্ড পুনর্বিনিয়োগের সুযোগ সীমিত করার পেছনে একমাত্র বিবেচ্য বিষয়। সে ক্ষেত্রে ওয়েজ আর্নার্স বন্ডের ওপর সুদের হার হ্রাস করে সঞ্চয়পত্রের ওপর প্রদত্ত সুদের হারের সমান করে দেওয়া যেতে পারে। এখানে একটি বিষয় বলে রাখা ভালো যে ওয়েজ আর্নার্স বন্ডের সুদ যেহেতু টাকায় প্রদান করা হয়, তাই এই বন্ডের ওপর এবং সঞ্চয়পত্রের ওপর সুদ প্রদানের ক্ষেত্রে সরকারের ব্যয়ের তেমন কোনো তারতম্য নেই। অবশ্য যারা নতুন ওয়েজ আর্নার্স বন্ডে বিনিয়োগ করবে, তাদের উৎসাহিত করার স্বার্থে শুরুতে উচ্চ সুদ প্রদান করলেও তৃতীয়বারের বেশি পুনর্বিনিয়োগ করার ক্ষেত্রে সঞ্চয়পত্রের সমান সুদ প্রদান করা যেতে পারে। মোটকথা যেকোনোভাবেই হোক না কেন, এই ওয়েজ আর্নার্স বন্ড পুনর্বিনিয়োগের সুযোগ সীমিত না করে অব্যাহত রাখার বিষয়টি নিশ্চিত করা প্রয়োজন। সেই সঙ্গে ওয়েজ আর্নার্স বন্ড নতুনভাবে ক্রয় এবং পুনর্বিনিয়োগের পদ্ধতি যথেষ্ট সহজ করা প্রয়োজন। এমনটা করতে পারলে দেশ এবং প্রবাসী উভয়ই উপকৃত হতে পারবে। সেই সঙ্গে ডলার সংকট নিরসনে ওয়েজ আর্নার্স বন্ড কিছুটা ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে বলেই আমাদের বিশ্বাস। আশা করি, অর্থ মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ ব্যাংক বিষয়টি ভেবে দেখবে।

 

লেখক : সার্টিফায়েড অ্যান্টি মানি লন্ডারিং স্পেশালিস্ট ও ব্যাংকার, টরন্টো, কানাডা

nironjankumar_roy@yahoo.com

 

মন্তব্য

সম্পর্কিত খবর

ফিরে দেখা উত্তাল মার্চ

    মযহারুল ইসলাম বাবলা
শেয়ার
ফিরে দেখা উত্তাল মার্চ

জালালাবাদের পাহাড়েতে রক্তে লিখেছি কত নাম, চট্টগ্রাম, বীর চট্টগ্রাম। ব্রিটিশবিরোধী লড়াই-সংগ্রামের অগ্নিযুগের বীর পুরুষ মাস্টারদা সূর্য সেনের নেতৃত্বে চট্টগ্রামের বীর সন্তানরা পরাক্রমশালী ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছিল ১৯৩০ সালে। দেশপ্রেমের বীরত্বপূর্ণ সেই আত্মত্যাগের নজির দেশ ও জাতির জন্য অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল বীর চট্টলা। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ সালে চট্টগ্রামে থাকা সেনা-জনতা সম্মিলিতভাবে ঘটিয়েছিল প্রায় একই রকম ঘটনার পুনরাবৃত্তি।

১৯৩০ সালের ১৮ থেকে ২১ এপ্রিল তিন দিন চট্টগ্রাম ছিল স্বাধীন, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনমুক্ত। চট্টগ্রামে ওই তিন দিন ব্রিটিশের পতাকার পরিবর্তে উড়েছিল স্বাধীন ভারতবর্ষের পতাকা। একইভাবে একাত্তরের ২৫ মার্চ-পরবর্তী তিন দিন হানাদার পাকিস্তানি জান্তামুক্ত ছিল চট্টগ্রাম। চট্টগ্রামের সর্বত্র উড়েছিল স্বাধীন বাংলাদেশের মানচিত্রসংবলিত জাতীয় পতাকা।

একাত্তরের মার্চের উত্তাল দিনগুলোতে পাহাড়তলীস্থ ওয়্যারলেস কলোনি, শেরশাহ কলোনি ও ফিরোজশাহ কলোনির অবাঙালিদের বাঙালিবিরোধী নির্মম তাণ্ডবে স্থানীয় বাঙালিরা ক্ষোভে ফেটে পড়েছিল। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রত্যক্ষ সহযোগিতা-সমর্থনে, এমনকি অস্ত্র জোগানের মাধ্যমে অবাঙালি বিহারিদের দৌরাত্ম্যের সীমা-পরিসীমা ছিল না। কৈবল্যধাম মন্দিরসহ হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িতে, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে বেপরোয়া হামলা-লুণ্ঠন চালায় তারা। ২ ও ৩ মার্চ রেলওয়ে কলোনি, ওয়্যারলেস কলোনি ও শেরশাহ কলোনি এলাকায় চট্টগ্রামের সামরিক প্রশাসক কর্নেল ফাতেমির নেতৃত্বে পাকিস্তানি সেনারা এবং বিহারিরা যৌথভাবে বাঙালিদের আবাসে, স্থাপনায় অগ্নিসংযোগ ও হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করে।

চট্টগ্রামে মার্চের শুরু থেকেই ঘটতে থাকে এমনই নানা অঘটন।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কালরাতে সেনানিবাস, ইপিআর, পুলিশ লাইনসহ দেশজুড়ে পাকিস্তানি হানাদাররা শুরু করে নারকীয় গণহত্যা। ঘুমন্ত বাঙালি সেনা, ইপিআর ও পুলিশের ওপর অতর্কিত হামলা চালায়। চট্টগ্রাম সেনানিবাসেও চালিয়েছিল একই কায়দায় গণহত্যা। প্রকৃতপক্ষে মার্চের শুরুতেই চট্টগ্রামে এমভি সোয়াত জাহাজ থেকে অস্ত্র নামানোকে কেন্দ্র করে শুরু হয়েছিল সর্বস্তরের ছাত্র-জনতার প্রতিবাদ-প্রতিরোধ।

২ থেকে ২৪ মার্চ পর্যন্ত সর্বস্তরের মানুষের সম্মিলিত প্রতিরোধে এমভি সোয়াত জাহাজ থেকে অস্ত্র খালাস করা সম্ভব হয়নি।

ফিরে দেখা উত্তাল মার্চ২৫ মার্চ রাতে চট্টগ্রাম সেনানিবাসে ঘুমন্ত ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালি সেনাদের ওপর অতর্কিত আক্রমণে হতবিহ্বল বাঙালি সেনারা ঝাঁকে ঝাঁকে গুলির মুখে আত্মরক্ষার্থে ক্রলিং করে কেউ অস্ত্র নিয়ে, কেউ বা অস্ত্র ছাড়াই রাতের অন্ধকারে পশ্চিমের পাহাড়-জঙ্গল ডিঙিয়ে বহু কষ্টে মিরসরাই-সীতাকুণ্ডের বিভিন্ন লোকালয়ে আশ্রয় নেন এবং স্থানীয় জনগণের কাছে ঘটনা সবিস্তারে বর্ণনা করেন। স্থানীয় মানুষ তাঁদের আশ্রয়, খাবার ও বিশ্রামের বন্দোবস্তে পূর্ণ সহায়তা করে।

জাতীয়-প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচিত সদস্যবৃন্দ, স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও ছাত্র-জনতার সম্মিলিত অংশগ্রহণে তখন চট্টগ্রাম ছিল সম্পূর্ণরূপে হানাদারমুক্ত। চট্টগ্রামের নিয়ন্ত্রণ পাকিস্তানি হানাদাররা নিতে পারেনি। সেনানিবাসে অবরুদ্ধ থেকেছে। একইভাবে অবরুদ্ধ থেকেছে বিহারি অধ্যুষিত ফিরোজশাহ কলোনি, শেরশাহ কলোনি ও ওয়্যারলেস কলোনিতে বসবাসকারী অবাঙালি বিহারিরাও। কালুরঘাট বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র থেকে স্বাধীনতা ঘোষণা বিপন্ন দেশ-জাতিকে উজ্জীবিত ও নতুন পথের দিশা দিয়েছিল।

২৬ থেকে ২৮ মার্চ দুপুর পর্যন্ত সারা চট্টগ্রাম ছিল হানাদার পাকিস্তানি নিয়ন্ত্রণমুক্ত। চারদিকে চলছিল প্রতিরোধ যুদ্ধের প্রস্তুতি। ২৮ মার্চ ঢাকা ট্রাংক রোড ধরে কুমিল্লা সেনানিবাস থেকে আসে বিশাল সাঁজোয়া বহর। শুভপুর ব্রিজ থেকে মিরসরাইয়ের বিভিন্ন স্থানে এবং সীতাকুণ্ডের বাঁশবাড়িয়া, কুমিরা, জোড়া আমতল, মাদাম বিবির হাট, ভাটিয়ারী, ফৌজদারহাট, নিউ পতেঙ্গা, পাকিস্তান বাজার, দক্ষিণ সলিমপুরের ঢাকা ট্রাংক রোডের পূর্ব ও পশ্চিম পাশের সুবিধাজনক স্থানে সেনা ও ইপিআর জওয়ানরা প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশ নেন। বিশাল সাঁজোয়া বাহিনীর বিরুদ্ধে মাত্র কয়েক ঘণ্টার বেশি তাঁরা টিকতে পারেননি, পারা সম্ভবও ছিল না। হানাদার বাহিনী যেসব স্থানে বাধাপ্রাপ্ত হয়েছে, সেসব এলাকা নির্বিচারে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দিয়েছিল। প্রতিরোধ যুদ্ধের বাধা অতিক্রম করে কুমিল্লা থেকে আসা সাঁজোয়া যানগুলো সন্ধ্যার আগেই চট্টগ্রাম শহরে ঢুকে পড়ে এবং ওই দিনই তিন দিনের পাকিস্তানি হানাদারমুক্ত স্বাধীন চট্টগ্রামের পতন ঘটে।

পাকিস্তানি হানাদারদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায় স্বাধীন চট্টগ্রাম। ভীতসন্ত্রস্ত শহরের মানুষ পরিবার-পরিজন নিয়ে সমুদ্রের তীর-গ্রামের মেঠোপথ ধরে হেঁটে আত্মরক্ষার্থে শহর ছেড়ে শহরতলি ও গ্রাম অভিমুখে কাফেলার মতো ছুটে আসে। গ্রামগুলো অপরিচিত লোকে লোকারণ্য হয়ে যায়। স্থানীয় লোকজন যে যার সাধ্যানুযায়ী তাদের সাহায্য-সহযোগিতাসহ আশ্রয় প্রদান করে। সে বছর টমেটো ও কহির মাত্রাতিরিক্ত ফলনের কারণে মানুষের প্রাণ রক্ষা সহজ হয়েছিল। ভাতের সঙ্গে টমেটোর ঝোল এবং কহির ভাজি-নিরামিষ দুর্গত মানুষের খাদ্যতালিকায় ছিল একমাত্র বস্তু। চট্টগ্রাম শহরের নিয়ন্ত্রণের পরই হানাদার বাহিনী নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ শুরু করে। পথঘাট, পাকিস্তানি বিরোধীদের এবং সংখ্যালঘুদের খুঁজে খুঁজে চিনিয়ে দেওয়ার ঘৃণিত কাজে যুক্ত হয় মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলাম দলের নানা স্তরের নেতাকর্মীসহ বিহারিদের একটি বড় অংশ। বাঙালি কারো জীবনই নিরাপদ ছিল না। নির্মম হত্যাযজ্ঞে কত মানুষের প্রাণ গেছে সেই সংখ্যা নিরূপণ আজও সম্ভব হয়নি এবং হওয়ারও নয়।

চট্টগ্রাম সেনানিবাস থেকে জীবন নিয়ে পালিয়ে আসা ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের এক সেনার কাছে জেনেছিলাম, ২৫ মার্চ দিনে তাঁদের দীর্ঘ সময় মাত্রাতিরিক্ত পিটি, প্যারেড করানো হয়। অতিরিক্ত শারীরিক পরিশ্রমে এমনিতেই তাঁরা ছিলেন ক্লান্ত এবং বিছানায় গিয়েই ঘুমিয়ে পড়েন। সেই সুযোগে ঘুমিয়ে থাকা বাঙালি সেনাদের হানাদাররা ব্রাশফায়ারে, ট্যাংকের গোলা নিক্ষেপে হত্যা করে এবং অনেকে গুলির শব্দে দিশাহারা হয়ে এদিক-সেদিক ছোটাছুটিতে গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রাণ হারান। তিনি নিজে এবং অনেকে ক্রলিং করে বহু কষ্টে সেনানিবাস ছেড়ে রাতের অন্ধকারে পাহাড়-জঙ্গল অতিক্রম করে এখানে এসেছেন।

পরিস্থিতির ভয়াবহ অবনতির আশঙ্কা সবাই করছিল। সেই সেনা সদস্য নিজেও বুঝেছিলেন। বেশ কয়েকজন সেনা আমাদের ফৌজদারহাটের বাড়িতে সেদিন আশ্রয় নিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশ নিতে তাঁরা ২৮ তারিখ সকালে সেই যে চলে গিয়েছিলেন আর ফেরেননি।

 

লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, নতুন দিগন্ত

মন্তব্য

স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা ও দেশ নির্মাণের খোঁজ

    শায়রুল কবির খান
শেয়ার
স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা ও দেশ নির্মাণের খোঁজ

দক্ষিণ এশিয়ায় একমাত্র সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে একটি রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছে, স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ। দেশটির প্রধান সত্তা গণতন্ত্রএই গণতন্ত্রের আকাঙ্ক্ষা নিয়ে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল। লাখো শহীদের রক্ত ও মা-বোনের আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে যে আকাঙ্ক্ষা নিয়ে অর্জিত হয়েছিল, তা স্বাধীনতার উষালগ্নেই তার স্বপ্ন ভঙ্গ হয়েছে।

তবে স্বাধীনতার হিরণ্ময় ঘোষক শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বীর-উত্তম পঁচাত্তরের পটপরিবর্তনের পর রাষ্ট্রের নেতৃত্বে আসার মধ্য দিয়ে গণতন্ত্রের আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ হতে শুরু করে।

তিনি একদলীয় শাসনের অবসান ঘটিয়ে বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রবর্তন করেন। মাত্র সাড়ে চার বছরের মাথায় বিশ্বদরবারে বাংলাদেশ তলাবিহীন ঝুড়ির বদনাম গুছিয়ে আধুনিক স্বনির্ভর রাষ্ট্র হিসেবে সামনে আসে।

আমাদের কাছে একাত্তর শুধু মুক্তিযুদ্ধের আন্দোলন ও সংগ্রাম নয়, আমাদের ইতিহাসের সবচেয়ে গৌরবময় অধ্যায়এটি আমাদের জাতীয় সত্তার কেন্দ্রবিন্দু। দেশের প্রতি অপরিসীম ভালোবাসা এবং দেশপ্রেমের চেয়ে বড় প্রেম হতে পারে না।

কিন্তু আজ ৫৩ বছর পেরিয়ে গেলেও একাত্তর নিয়ে দেশ এক অমোঘ বাস্তবতার মুখোমুখি। কতটা অপরিপক্বতা থাকলে কেউ কেউ একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের তুল্য করে চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানকে দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ বলতে পারেন!

শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বিগত আওয়ামী ফ্যাসিবাদ স্বাধীনতার সেই আকাঙ্ক্ষাকে চেতনার নামে লুণ্ঠিত করে জাতির সঙ্গে প্রতারণা করেছে। একই সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল ব্যক্তি স্বার্থপরতাও। এর রেশ ধরে সৃষ্টি হয় দলীয় বিভক্তি, যার মধ্য দিয়ে সৃষ্টি হয় সামাজিক বিভক্তি।

ছিল ক্ষমতার অপব্যবহার ও লাগামহীন লুটপাট। এ নিয়ে আলোচনা বা বিতর্কের চেয়ে অতীতকে হাতের তালুয় রেখে গণতন্ত্র উত্তরণে সবার ঐক্য ও একনিষ্ঠ লক্ষ্য স্থির করার বাইরে কোনো বিকল্প নেই।

যে কারণে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বীর-উত্তমের দেখানো পথ বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ দর্শন এবং ১৯ দফা কর্মসূচিই আমাদের সামনে অন্যতম প্রধান মুক্তির উপায়, যার ওপর ভিত্তি করে গণতন্ত্রের মাতা দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার ভিশন ২০৩০ ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ৩১ দফা রূপরেখা বাস্তবায়নই হবে প্রধান পদক্ষেপ।

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ শুধু অস্ত্রের লড়াই ছিল না। এটি ছিল আমাদের জাতীয় পরিচয়, ভাষা এবং সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যের জন্য লড়াই।

একজন কৃষক, একজন ছাত্র, একজন গৃহিণী, প্রত্যেকেই এ যুদ্ধে ভূমিকা রেখেছিলেন। দেশমাতৃকার জন্য এই ত্যাগ কোনো ব্যক্তিগত স্বার্থে নয়, বরং সমষ্টিগত মুক্তির লক্ষ্যে ছিল।

বর্তমান প্রজন্মের সামনে একাত্তরের আকাঙ্ক্ষাকে চেতনার নামে ইতিহাসের পাতায় শুধু স্মৃতিসৌধ এবং তাদের দলীয় ও পারিবারিক কর্মসূচিতে সীমাবদ্ধ করেছিল আওয়ামী ফ্যাসিবাদ। তাদের প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল একটি শোষণমুক্ত, উন্নত ও সমৃদ্ধ সমাজ প্রতিষ্ঠার পরিবর্তে ক্ষমতার স্বার্থ রক্ষা করে চলা। কিন্তু আমাদের পূর্বপুরুষরা কল্পনা করেছিলেন এমন একটি বাংলাদেশ, যেখানে মানুষে-মানুষে বৈষম্য থাকবে না, যেখানে স্বাধীনতার সুফল সবার কাছে পৌঁছাবে। তৈরি হবে সাম্য, মানবিক মর্যাদার বাংলাদেশ।

মুক্তিযুদ্ধের আকাঙক্ষা ও স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে গিয়ে রাজনৈতিকভাবে যে সমস্যাগুলোর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ, তার মধ্যে অন্যতম হলো মুক্তিযুদ্ধের আকাঙ্ক্ষাকে চেতনার নামে বিকৃত করে প্রথাগত স্বার্থ হাসিলের চেষ্টা। একাত্তরের প্রত্যাশাকে আওয়ামী ফ্যাসিবাদ নিজেদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করেছে। এই বিভ্রান্তিকর প্রক্রিয়া দেশের ভবিষ্যৎ নির্মাণের জন্য বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বস্তুত স্বাধীনতার অর্জন ধরে রাখা এবং সঠিক পথে পরিচালিত করা এখন ততটাই চ্যালেঞ্জিং হয়ে দাঁড়িয়েছে আমাদের জন্য।

 দলীয় স্বার্থের ফ্যাসিবাদী প্রবণতা শুধু রাজনীতিতে সীমাবদ্ধ নয়, এটি সমাজের প্রায় প্রতিটি স্তরে ছড়িয়ে পড়েছে। ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর স্বার্থে দেশের সম্পদ অপব্যবহারের নজির প্রতিনিয়তই বাড়ছে। অথচ একাত্তরের আকাঙ্ক্ষা ছিল এর সম্পূর্ণ বিপরীত। এটি ছিল ঐক্যের, ত্যাগের এবং সাধারণ মানুষের অধিকারের। ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসে একাত্তরের গল্প শুধু আমাদের অতীত নয়, এটি আমাদের ভবিষ্যৎ গঠনের জন্য সমান গুরুত্বপূর্ণ। তরুণ প্রজন্মের মধ্যে একাত্তরের আকাঙ্ক্ষাকে জাগ্রত করা আজ অত্যন্ত জরুরি। কিন্তু প্রশ্ন হলো, তরুণরা এই আকাঙ্ক্ষা কিভাবে ধারণ করবে? 

স্বাধীনতার ইতিহাসকে রাজনৈতিক মতাদর্শের আলোকে না দেখে এই বিভাজনকে দূর করতে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা এবং পরিবারকেন্দ্রিক শিক্ষায় গুরুত্ব দিতে হবে। একাত্তরের সত্য ঘটনাগুলো তুলে ধরে তাদের দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। শুধু ইতিহাস জানালেই কি হবে? তরুণদের মধ্যে ত্যাগ, দায়িত্ববোধ এবং সামাজিক ন্যায়বিচারের চেতনাও গড়ে উঠতে হবে। কেবল বই পড়ে বা বক্তৃতা শুনে নয়, তরুণদের বাস্তব জীবনে এসব মূল্যবোধের চর্চার ক্ষেত্র তৈরি করে দেবেন জাতীয় নেতারা। দেশ পরিচালনার প্রতিটি ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা এবং দায়িত্বশীলতা নিশ্চিত করতে পারলে এই তরুণ প্রজন্ম গঠনমূলক লক্ষ্য নিয়ে গড়ে উঠবে এবং গোড়ায় যা ছিল, তা হয়তো কিছুটা হলেও খুঁজে নিতে সক্ষম হবে আজকের ও আগামীর প্রজন্ম।

লেখক : রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মী

মন্তব্য

মুডির ক্রেডিট রেটিংকে গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন

    নিরঞ্জন রায়
শেয়ার
মুডির ক্রেডিট রেটিংকে গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন

সম্প্রতি বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের ক্রেডিট রেটিং আরো এক ধাপ নিম্নগামী করেছে বিশ্ববিখ্যাত ক্রেডিট রেটিং এজেন্সি মুডি। মুডি দেশের ব্যাংকিং খাতের ক্রেডিট রেটিং বি-ওয়ান থেকে বি-টুতে নামিয়েছে। ক্রেডিট রেটিংয়ের এই মানকে বলা যেতে পারে বিনিয়োগ প্রতিকূল অবস্থান। সংবাদটি এই মুহূর্তে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত, ব্যবসায়ী এবং দেশের অর্থনীতির জন্য একটি খারাপ সংকেত।

মুডি বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের ক্রেডিট রেটিং নিম্নমান করার রিপোর্ট এমন সময় প্রকাশ করেছে, যখন জাতিসংঘের মহাসচিব বাংলাদেশ সফর করছিলেন। জাতিসংঘ মহাসচিবের এই সফর সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পাওয়ায় মুডির গুরুত্বপূর্ণ এই রিপোর্ট চাপা পড়ে গেছে। কিন্তু অর্থনীতি এমন একটি স্পর্শকাতর বিষয়, যার কোনো কিছুই চাপা থাকে না। বিশেষ করে অর্থনীতিতে নেতিবাচক কোনো কিছু ঘটলে, সেটি কোনো অবস্থায়ই চাপা থাকবে না।
ভালো কিছু ঘটলে, সেটি অনেক খবরের ভিড়ে চাপা পড়ে যেতেই পারে। কিন্তু অর্থনীতির কোনো নেতিবাচক সংবাদ চেপে রাখার সুযোগ নেই। সাময়িক আড়ালে থাকলেও একসময় তা প্রকাশ পাবেই। 

মুডি যদি ব্যাংকিং খাতের ক্রেডিট রেটিং (ঋণমান) উন্নত করত, তাহলে সেটি অনেক গুরুত্বপূর্ণ সংবাদের ভিড়ে চাপা পড়ে গেলে হয়তো চাপাই থাকত এবং তাতে তেমন কোনো সমস্যা হতো না।

কিন্তু মুডি যেহেতু ব্যাংকিং খাতের ঋণমাণ নিম্নগামী করেছে, তাই এই বিষয়টিকে আড়াল করে রাখার সুযোগ নেই। আর কেউ না জানলেও দেশের ব্যাংকার এবং ব্যবসায়ীরা কিছুদিনের মধ্যেই সরাসরি এর প্রভাব বুঝতে পারবেন, যখন অন্যান্য দেশের ব্যাংক আমাদের দেশের ব্যাংকের ইস্যু করা এলসি (লেটার অব ক্রেডিট) বা অন্যান্য ফিন্যান্সিং সুবিধার ওপর অধিক হারে সুদ এবং চার্জ ধার্য করতে শুরু করবে। অনেক ব্যাংক অবশ্য লেনদেন করতেই আগ্রহ দেখাবে না। জনগণ এর প্রভাব বুঝতে পারবে আরেক দফা দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে, যদিও তারা এই কারণটি মেলাতে পারবে না। অবশ্য এটিও ঠিক যে এতসব ডামাডোলের মধ্যেও বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য উদ্বেগের এই ক্রেডিট রেটিং নিম্নমান করার রিপোর্টটি অনেকেরই দৃষ্টি কেড়েছে।
বিশেষ করে যাঁদের দেখার কথা, তাঁরা ঠিকই দেখেছেন এবং বেশ উদ্বিগ্নও হয়েছেন।

যেমনটি আগেই উল্লেখ করেছি যে এই ক্রেডিট রেটিং নিম্নমানের খেসারত দিতে হবে দেশের ব্যাংকিং খাতকে, ব্যবসায়ীদের এবং সর্বোপরি সাধারণ মানুষকে। আমাদের দেশের ব্যাংকের সঙ্গে বিদেশি ব্যাংক লেনদেন করতে আগ্রহ দেখাবে না। এমনিতেই আমাদের দেশের ব্যাংকের সঙ্গে উন্নত বিশ্বের বেশির ভাগ ভালো ব্যাংক কোনো রকম লেনদেন সম্পর্ক রাখে না। এ কারণেই দেখা যায়, আমাদের দেশের ব্যাংকগুলো উন্নত বিশ্বের ব্যবসায়ীদের পক্ষে সরাসরি এলসি খুলতে পারে না। এলসি খুললেও সেটি অ্যাডভাইস করতে সমস্যার সম্মুখীন হয়। আর ইস্যু করা এলসির অ্যাড-কনফার্মেশন দিতে পারে না। তিন-চারটি ব্যাংক হয়ে এই কাজগুলো করতে হয় বিধায় আমদানি মূল্য মাত্রাতিরিক্ত বেড়ে যায়, যার প্রভাব পড়ে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিতে এবং এর চরম খেসারত দিতে হয় দেশের জনগণকে। এমনকি বিদেশ থেকে প্রবাসীরা ব্যাংকিং চ্যানেলে দেশে অর্থ প্রেরণ করার ক্ষেত্রে একই রকম সমস্যার সম্মুখীন হন। একাধিক ব্যাংক হয়ে অর্থ প্রেরণ করতে গেলে রেমিট্যান্স ফি এবং সময়, দুটিই বৃদ্ধি পায়। ফলে প্রবাসীরা ব্যাংকিং চ্যানেলে অর্থ প্রেরণে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। ব্যাংকিং খাতের ক্রেডিট রেটিং নিম্নগামী হওয়ার কারণে এই সমস্যা আরো বেড়ে যাবে।

মুডির ক্রেডিট রেটিংকে গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজনক্রেডিট রেটিং নিম্নগামী হওয়ার কারণে ব্যবসায়ীদের এবং ব্যাংকগুলোর স্বল্পমেয়াদি ঋণ গ্রহণের সুবিধা, বিশেষ করে রি-ফিন্যান্সিং সুবিধা পাওয়ার সুযোগ একেবারেই সীমিত হয়ে যাবে। ফলে দেশে বিদেশি বিনিয়োগ, যা এমনিতেই নেতিবাচক অবস্থায় আছে, তা আরো খারাপ হবে। এর সার্বিক প্রভাব পড়বে দেশের অর্থনীতিতে। এ কারণেই ক্রেডিট রেটিং রিপোর্টে মুডি স্পষ্ট করে উল্লেখ করেছে যে চলতি অর্থবছর, যা আগামী জুনে শেষ হবে; তখন দেশের জিডিপি ৪.৫ শতাংশে নেমে আসবে। এর আগে আইএমএফ বলে রেখেছে যে দেশের জিডিপি ৪ শতাংশের নিচে চলে আসবে অর্থাৎ ৩.৮ শতাংশ। অথচ নানা প্রতিকূলতা, আলোচনা এবং সমালোচনা সত্ত্বেও দেশের অর্থনীতি দেড় দশক ধরে ধারাবাহিকভাবে ৬ শতাংশের বেশি জিডিপি ধরে রাখতে পেরেছে। অনেকেই বলে থাকেন যে আগের সরকার দেশের জিডিপি নিয়ে মিথ্যা তথ্য প্রদান করেছে। হতে পারে, কিন্তু সে সময় আইএমএফ (আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল) এবং এডিবি (এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক) দেশের জিডিপি নিয়ে যে তথ্য দিত, তা সরকার প্রদত্ত তথ্যের চেয়ে কম থাকলেও ৬ শতাংশ বা তার বেশিই থাকত। দেশের ব্যাংকিং খাতের ক্রেডিট রেটিং নিম্নমানের নেতিবাচক প্রভাব দেশের জিডিপির ওপর পড়ার সমূহ সম্ভাবনা আছে।      

এখানেই শেষ নয়। এই ক্রেডিট রেটিং নিম্নমানের নেতিবাচক প্রভাব পড়বে দেশের সার্বভৌম ক্রেডিট রেটিংয়ের ওপর। এর প্রভাবে দেশের যে স্বতন্ত্র ক্রেডিট রেটিং আছে, সেটিও নিম্নগামী হতে পারে। ফলে দেশের বিনিয়োগ সুবিধা হ্রাস পাবে। এসব ভেবেই হয়তো আইএমএফ তাদের ঋণের তৃতীয় কিস্তি ছাড় করার সিদ্ধান্ত স্থগিত করেছে। অথচ এই আইএমএফ চার বিলিয়ন ডলার ঋণ মঞ্জুর করেছিল বেশ আগে এবং এরই মধ্যে ঋণের দুটি কিস্তি যথাসময়ে ছাড়ও করেছে। কিন্তু সম্প্রতি তাদের প্রতিশ্রুত তৃতীয় কিস্তির টাকা আটকে দিয়েছে। এখন আইএমএফের দৃষ্টান্ত এবং ক্রমাগত নিম্নমান ক্রেডিট রেটিংয়ের কারণে অন্যান্য বিনিয়োগ সুবিধাও পুনর্বিবেচনার অধীনে চলে আসতে পারে। এমনিতেই নানা কারণে দেশে বিনিয়োগ আশঙ্কাজনকভাবে কমে গেছে। দেশে সাত মাস ধরে বিদেশি বিনিয়োগ নেই বললেই চলে, কিন্তু সেই সঙ্গে নেই দেশীয় বিনিয়োগ, যা নিম্নমান ক্রেডিট রেটিংয়ের কারণে আরো খারাপ হবে বলেই ধারণা করা যায়। 

দেশের ব্যাংকিং খাতের যে করুণ দশা, তাতে মুডির রিপোর্ট দেখে বলার প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। দেশের সাধারণ মানুষ ও ব্যবসায়ী মাত্রই হারে হারে বুঝতে পারছে। দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের খুবই খারাপ অবস্থা। বেকারত্ব বেড়েই চলেছে, যা ভালো হওয়ার লক্ষণ নয়। আরো অসংখ্য শ্রমিক-কর্মচারী যে ভবিষ্যতে বেকার হবেন, সেই আলামতও বেশ স্পষ্ট। দেশের ব্যবসায়ী সম্প্রদায় অনেক অনুনয়-বিনয় করেও তাদের দিকে সে রকম কোনো সহযোগিতা বা সহানুভূতি লাভ করতে পারছে না। ফলে দেশের অর্থনীতির ধারাবাহিক উন্নতি ব্যাহত হবে। একবার দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য এবং অর্থনীতি অগ্রযাত্রার গতিপথ থেকে ছিটকে পড়লে দেশের মারাত্মক ক্ষতি হয়ে যাবে। অনেক চেষ্টা করেও সেটিকে পরে সঠিক পথে ফেরানো কষ্টকর হয়ে দাঁড়াবে।

এ কথা ঠিক যে আমাদের দেশের বা দেশের ব্যাংকিং খাতের ক্রেডিট রেটিং নিম্নমান এবারই যে প্রথম হয়েছে, তেমন নয়। এর আগেও এই ক্রেডিট রেটিং নিম্নমান হয়েছে। কিন্তু দেখার বিষয় হচ্ছে, কোন সময় এই নিম্নমান হয়েছে। একটি দেশ এবং দেশের ব্যাংকিং খাত ও অর্থনীতি যখন ভালো অবস্থায় থাকে, তখন ক্রেডিট রেটিং নিম্নমানে তেমন কিছু আসে যায় না। যেমনযুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ইউরোপের বিভিন্ন দেশ এবং এমনকি অনেক উন্নয়নশীল দেশের ক্রেডিট রেটিং প্রতিনিয়ত পরিবর্তন হয় এবং মাঝেমধ্যে নিম্নগামীও হয়, কিন্তু তাতে তেমন কোনো সমস্যা হয় না। মানুষ সে খবর ঠিকমতো রাখেও না। কিন্তু দেশে যদি অর্থনীতি এবং আর্থিক খাত স্বাভাবিক অবস্থায় না থাকে, তখন ক্রেডিট রেটিং নিম্নগামী হওয়ার প্রভাব হয় মারাত্মক এবং যথেষ্ট উদ্বেগের, তা সে যুক্তরাষ্ট্রের মতো উন্নত এবং সুশৃঙ্খল অর্থনীতিই হোক বা বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল এবং সমস্যাজর্জরিত অর্থনীতিই হোক। বিগত ওবামা সরকারের সময় ২০০৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক খাতে ধস নামার ফলে যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেডিট রেটিং সামান্য নিম্নগামী হয়েছিল। আর তাতেই সমগ্র বিশ্বে শোরগোল পড়ে গিয়েছিল।   

দেশের সরকারপ্রধান একজন অর্থনীতিবিদ, অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে যিনি আছেন, তিনিও একজন সাবেক গভর্নর ও অর্থনীতিবিদ এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্বে যিনি আছেন, তিনিও একজন অর্থনীতিবিদ ও মুদ্রাবাজার বিশেষজ্ঞ। এ রকম তিনজন উপযুক্ত ব্যক্তির হাতে যদি দেশের ব্যাংকিং খাত ও অর্থনীতি ভালো অবস্থায় না থাকে এবং সঠিকভাবে চলতে না পারে, তাহলে সেটি হবে সবচেয়ে দুঃখজনক। এ কথা ঠিক যে আগের সরকারের আমলে অনেক অনিয়ম এবং অব্যবস্থাপনা ছিল। সেগুলো হয়তো ঠিক করতে হবে। কিন্তু যেভাবে চলছিল বা যে গতিতে অগ্রসর হচ্ছিল, তার থেকে যদি ভালো কিছু আপাতত কিছুদিন না-ও হয়, অন্তত সেই গতি ধরে রেখে তো সব কিছু ঠিক করতে হবে। তা না হলে জনগণ তো মানতে চাইবে না এবং এক পর্যায়ে তারাও অধৈর্য হয়ে উঠবে। সবচেয়ে বড় কথা, দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য এবং অর্থনীতি যদি একটি পর্যায়ে রাখা সম্ভব না হয়, তাহলে পরবর্তী সময়ে নির্বাচিত হয়ে যে সরকার দেশ পরিচালনার সুযোগ পাবে, তারা তখন সবচেয়ে বড় সমস্যায় পড়বে এবং সব দায়ভার তখন তাদের ওপরই বর্তাবে। কেননা মানুষ স্বভাবসুলভভাবেই বর্তমান দেখে, অতীত খুব একটা মনে রাখে না। সুতরাং মুডির ক্রেডিট রেটিং নিম্নমান করার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিতে হবে এবং ভবিষ্যতে যেন আর নিম্নমান না হয়, বরং কিভাবে পরবর্তী ক্রেডিট রেটিং উন্নত করা যায়, সেই পদক্ষেপ দ্রুত গ্রহণ করা প্রয়োজন।

লেখক : সার্টিফায়েড অ্যান্টি মানি লন্ডারিং স্পেশালিস্ট ও ব্যাংকার, টরন্টো, কানাডা

Nironjankumar_roy@yahoo.com

মন্তব্য
বিশ্বনাট্য দিবস আজ

শান্তির সংস্কৃতির পদযাত্রা

    ফরিদুর রহমান
শেয়ার
শান্তির সংস্কৃতির পদযাত্রা

বিশ্বনাট্য দিবসের সূচনা ১৯৬১ সালে হলেও বাংলা ভাষায় নাট্যচর্চার ইতিহাস অনেক পুরনো। সেই কবে ১৭৯৫ সালে গেরাসিম লেবেদেফের হাত ধরে কলকাতায় প্রথমবারের মতো মঞ্চস্থ হয়েছিল বাংলা নাটক। ২৩০ বছরে নাটকের আঙ্গিকে, প্রকরণে, মঞ্চসজ্জায়, অভিনয়ে, আলো ও শব্দের ব্যবহারে যে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছে, সে কথা না বললেও চলে। নাটকে নিবেদিতপ্রাণ প্রবীণ নাট্যামোদী পরিচালক এবং নাটকপ্রিয় একদল তরুণ নাট্যকর্মী তাঁদের শ্রমে ও প্রতিভায় নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার ভেতর আমাদের নাটককে একটি মানসম্পন্ন আধুনিক শিল্পের পর্যায়ে উন্নীত করেছেন।

 

১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধ আমাদের শিল্প-সাহিত্য, সংগীত, নৃত্যকলা, চলচ্চিত্র, নাটকসহ বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে সম্ভাবনার যে দ্বার খুলে দিয়েছিল, নির্দ্বিধায় বলা যায় তা সবচেয়ে সফলভাবে কাজে লাগিয়েছিলেন নাট্যজনরা। স্বাধীনতার অব্যবহিত পরেই ঢাকার মঞ্চে গ্রুপ থিয়েটার পরিচয়ে এক নতুন নাট্য আন্দোলন দ্রুত দানা বাঁধতে থাকে। স্বাধীনতার আগে নাটকের মঞ্চায়ন প্রধানত শৌখিন নাটকের দল এবং ব্যাংক-বীমা কিংবা অফিস-আদালতের কর্মকর্তাদের বার্ষিক বিনোদনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। এসব নাটকে হালকা হাসি থেকে স্থূল হাস্যরস পর্যন্ত পুরো নাটকের মূল উদ্দেশ্যই ছিল সাময়িক বিনোদন।

অস্বীকার করার উপায় নেই, মঞ্চের দর্শক নাটক দেখতে আগ্রহ বোধ করে মূলত বিনোদনের প্রত্যাশায়। স্বাধীনতা-উত্তর গ্রুপ থিয়েটারের নাটক দর্শকের আকাঙ্ক্ষাকে সাধারণ মনোরঞ্জনের স্তর থেকে পরিশীলিত বুদ্ধিবৃত্তিক জগতে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিল। সংলাপের মধ্য দিয়ে যেসব তথ্য, তত্ত্ব ও দর্শন এবং ব্যাপক অর্থে চিন্তা-চেতনা দর্শকের মনোজগতে সঞ্চারিত হয়, তা নাটকের যবনিকা পতনের পরেও দর্শককে ভাবতে সহায়তা করে। এ সময়ে রচিত ও মঞ্চস্থ নাটকে তুলে ধরা হয়েছে দেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা, সমাজের নানা অসংগতি, গণমানুষের অধিকার এবং সাম্য, মৈত্রী ও শান্তির প্রসঙ্গ।
মুক্তিযুদ্ধের গৌরবগাথা ও স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকার-আলবদরের ভূমিকা এবং রাষ্ট্রযন্ত্রের দুর্নীতি ও দুর্বলতার সুযোগে সমাজে তাদের ক্রমবর্ধমান প্রভাব বিস্তারের বিষয়ও নাটকের বিষয়বস্তু হিসেবে উপস্থাপিত হয়েছে।

স্বাধীনতার আগে শৌখিন নাটকের দলগুলো প্রধানত কলকাতাকেন্দ্রিক নাটকের পাণ্ডুলিপি অথবা প্রসাদ বিশ্বাস, কল্যাণ মিত্রের মতো জনপ্রিয় নাট্যকারের নাটক মঞ্চায়নে আগ্রহী ছিল। কিছুসংখ্যক অভিজাত ক্লাব এবং দু-একটি নাট্য সংস্থা সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, নূরুল মোমেন, মুনীর চৌধুরী, সাঈদ আহমদ, আশকার ইবনে শাইখের নাটক মঞ্চায়ন করেছে। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে নতুন দলগুলোর চাহিদার কারণে আবদুল্লাহ আল মামুন,  সৈয়দ শামসুল হক, জিয়া হায়দার, সেলিম আল দীন, এস এম সোলায়মান, মমতাজউদদীন আহমদ, সৈয়দ মহিদুল ইসলাম, জিয়া আনসারীসহ বেশ কয়েকজন নতুন নাট্যকারের লেখা নাটক বাংলাদেশের মঞ্চকে সমৃদ্ধ করেছে। একই সঙ্গে মাইকেল মধুসূদন দত্ত, রবীন্দ্রনাথ ও মীর মশাররফ হোসেন মঞ্চে এসেছেন নতুন আঙ্গিকে।

ঢাকা শহরের দর্শক এই সময় বিপুলসংখ্যক অনূদিত ও রূপান্তরিত নাটক দেখার সুযোগ লাভ করেছে। শেকসপিয়ার, ইবসেন, স্ট্রিন্ডবার্গ, মলিয়ের, ব্রেখট, টেনাসি উইলিয়ামস এবং ইউজিন ওনিলের মতো নাট্যকারদের চিরায়ত নাটকের সঙ্গে বাংলাদেশের দর্শকের পরিচয় ঘটেছে।   

সত্তর ও আশির দশকজুড়ে রাজধানী ঢাকা ছাড়াও সারা দেশের অনেক শহরেই নতুন নাট্যচর্চা প্রসার লাভ করেছিল। নিয়মিত নতুন নাটক মঞ্চায়ন, দর্শনীর বিনিময়ে নাটকে বিপুলসংখ্যক মানুষের উপস্থিতি, নাটকের অগ্রযাত্রাকে সে সময় গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলন হিসেবে চিহ্নিত করেছিল। এ সময় বিশ্ববিদ্যালয় হলগুলোতে নাট্য প্রতিযোগিতা, যেকোনো আন্দোলন-সংগ্রামে পথনাটক রচনা ও তাত্ক্ষণিক মঞ্চায়ন এবং একদল নতুন নাট্যকারের আবির্ভাব ও কুশলী অভিনেতা-অভিনেত্রীদের পদচারণে মুখর নাট্যাঙ্গন দেশে একটি নাট্য সংস্কৃতি বিনির্মাণে সাফল্য অর্জন করেছিল বলা যায়। এর ফলে নাটক সমাজ বদলের হাতিয়ার’—এই জনপ্রিয় স্লোগানটি দীর্ঘদিন ব্যাপক উদ্দীপনার সঙ্গে উচ্চারিত হতে থাকে। শুধু দেশে নয়, দেশের বাইরেও বাংলাদেশের নাটক মঞ্চস্থ ও প্রশংসিত হয়েছে এবং আন্তর্জাতিক নাট্য সংস্থায় বাংলাদেশের প্রতিনিধিরা একাধিকবার সভাপতিসহ উচ্চতর সম্মানজনক পদ অলংকৃত করেছেন।

বিগত কয়েক দশকে নাটকের ক্ষেত্রে আরো দুটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা আমাদের নাট্যাঙ্গনের সৃজনশীলতায় ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছে, তা হলো দেশি-বিদেশি নাটকের দলের সমন্বয়ে প্রতিবছরই নাট্যোৎসব আয়োজন ও নাট্যকলায় প্রথাগত শিক্ষা। নাট্যোৎসবগুলো অভিজ্ঞতা বিনিময় এবং নিজস্ব প্রযোজনায় উৎকর্ষ লাভের ক্ষেত্রে অবদান রাখার পাশাপাশি দেশে ও বিদেশে নাট্যকর্মীদের পারস্পরিক সহযোগিতা ও সৌহার্দ্যের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। দেশের অনেকগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ে নাট্যকলার প্রথাগত শিক্ষার ক্ষেত্র উন্মোচিত হওয়ার ফলে প্রতিবছরই মঞ্চ, টেলিভিশন, চলচ্চিত্র, বিজ্ঞাপনসহ সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে প্রশিক্ষিত জনবল তৈরি হতে শুরু করেছে। তবে নাট্যকলায় শিক্ষা অর্জনের পর সবারই যে সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে কাজের সংস্থান করা সম্ভব হচ্ছে তা নয়। দেশের বেশির ভাগ মানুষকে সংগীত, নাটক, চলচ্চিত্রসহ সব ধরনের সুকুমার কলার যে জগৎ তার বাইরে রেখে নাটকে কর্মসংস্থান বা নাটকের  উত্তরোত্তর সাফল্য আশা করা যায় না।   

দীর্ঘ মহড়া, মঞ্চসজ্জাসহ প্রয়োজনীয় কৌশলগত আয়োজন সম্পন্ন করে একটি নাটক মঞ্চে উপস্থাপন করা কতটা ব্যয়বহুল ও কষ্টসাধ্য, তা সংশ্লিষ্ট সবারই জানা থাকার কথা। কিন্তু নাটক মঞ্চায়নে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার অভাব শুধু নয়, স্বাধীন বাংলাদেশেও ১৮৭৬ সালের অভিনয় নিয়ন্ত্রণ আইন প্রয়োগ করে বিভিন্ন সময়ে মঞ্চায়ন বাধাগ্রস্ত করা হয়েছে। ১৯৮০ সালে সারা দেশের নাটকের দলগুলোর সম্মিলিত সংস্থা গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন গঠিত হলে সরকারের সঙ্গে ২০ বছর ধরে দেনদরবার করার পর নাটকের এই কালাকানুন বাতিল করা হয়। তবে আইন বাতিল করা হলেও মফস্বল শহরে, এমনকি জেলা পর্যায়ে নাটকের পাণ্ডুলিপি নিরীক্ষণ বা মঞ্চায়নের অনুমোদনের নামে সরকারের স্থানীয় প্রতিনিধিরা এখনো ১৮৭৬ সালের আইন প্রয়োগে কার্পণ্য করেন না।   

প্রতিবছরের মতো এ বছরও বিশ্বনাট্য দিবসের প্রতিপাদ্য ঞযবধঃত্ব ধহফ ধ ঈঁষঃঁত্ব ড়ভ চবধপব. শান্তির সংস্কৃতি বিনির্মাণে থিয়েটার বিশ্বব্যাপী এবং বিশেষ করে বাংলাদেশে আদৌ কোনো ভূমিকা রাখতে পারছে কি না, তা ভেবে দেখার সময় এসেছে। যে উৎসাহ-উদ্দীপনা নিয়ে এবং সুখী, সুন্দর বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে স্বাধীনতা-পরবর্তী নাট্য আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল, নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি থেকেই সেই আবেগ-উচ্ছ্বাস অনেকটাই স্তিমিত হয়ে এসেছে। নাটকের মানসম্পন্ন পাণ্ডুলিপির অভাব, বিপুলসংখ্যক বাণিজ্যিক টেলিভিশনের উত্থানের ফলে অভিনেতাদের মধ্যে তারকা খ্যাতি লাভের প্রতিযোগিতা এবং দক্ষ শিল্পী ও কলাকুশলীদের অনেকেরই বেসরকারি সাহায্য সংস্থা বা করপোরেটের প্রচার-প্রোপাগান্ডায় অংশগ্রহণ গ্রুপ থিয়েটারের লক্ষ্য অর্জনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে। ফলে সারা দেশে পুরনো অনেক মঞ্চেই নিয়মিত নাটক মঞ্চস্থ হয় না। জেলা শহরগুলোতে শিল্পকলা একাডেমির মঞ্চে নাটক মঞ্চায়নের সুযোগ থাকলেও নাটক এখন পর্যন্ত সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছাতে পারেনি।

সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পটপরিবর্তন ও তার অবশ্যম্ভাবী প্রতিক্রিয়া নাটকের ক্ষেত্রেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। শিল্পকলা একাডেমির মঞ্চে একটি নাটক মাঝপথে বন্ধ করে দেওয়া, কয়েকজন প্রথিতযশা অভিনেতা-অভিনেত্রীকে মঞ্চে অভিনয় থেকে বিরত থাকতে বলা এবং একাধিক নাট্যোৎসব বাতিল বা স্থগিত করা স্বাধীন নাট্যচর্চার ক্ষেত্রে নতুন করে অস্থিরতা সৃষ্টি করেছে। শুধু নাটকের ক্ষেত্রে নয়, দেশের বিভিন্ন স্থানে লালন উৎসব আয়োজনে নিষেধাজ্ঞা, মফস্বল শহরে নাটক মঞ্চায়ন ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে বাধা, বাউলশিল্পীদের হয়রানিসহ পুরো সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে চলেছে। অতএব শান্তির সংস্কৃতির পথে আমাদের যে আরো অনেক দূর হাঁটতে হবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

লেখক : সাবেক উপমহাপরিচালক

বাংলাদেশ টেলিভিশন

মন্তব্য

সর্বশেষ সংবাদ