বিশেষ করে যাঁদের দেখার কথা, তাঁরা ঠিকই দেখেছেন এবং বেশ উদ্বিগ্নও হয়েছেন।
যেমনটি আগেই উল্লেখ করেছি যে এই ক্রেডিট রেটিং নিম্নমানের খেসারত দিতে হবে দেশের ব্যাংকিং খাতকে, ব্যবসায়ীদের এবং সর্বোপরি সাধারণ মানুষকে। আমাদের দেশের ব্যাংকের সঙ্গে বিদেশি ব্যাংক লেনদেন করতে আগ্রহ দেখাবে না। এমনিতেই আমাদের দেশের ব্যাংকের সঙ্গে উন্নত বিশ্বের বেশির ভাগ ভালো ব্যাংক কোনো রকম লেনদেন সম্পর্ক রাখে না। এ কারণেই দেখা যায়, আমাদের দেশের ব্যাংকগুলো উন্নত বিশ্বের ব্যবসায়ীদের পক্ষে সরাসরি এলসি খুলতে পারে না। এলসি খুললেও সেটি অ্যাডভাইস করতে সমস্যার সম্মুখীন হয়। আর ইস্যু করা এলসির অ্যাড-কনফার্মেশন দিতে পারে না। তিন-চারটি ব্যাংক হয়ে এই কাজগুলো করতে হয় বিধায় আমদানি মূল্য মাত্রাতিরিক্ত বেড়ে যায়, যার প্রভাব পড়ে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিতে এবং এর চরম খেসারত দিতে হয় দেশের জনগণকে। এমনকি বিদেশ থেকে প্রবাসীরা ব্যাংকিং চ্যানেলে দেশে অর্থ প্রেরণ করার ক্ষেত্রে একই রকম সমস্যার সম্মুখীন হন। একাধিক ব্যাংক হয়ে অর্থ প্রেরণ করতে গেলে রেমিট্যান্স ফি এবং সময়, দুটিই বৃদ্ধি পায়। ফলে প্রবাসীরা ব্যাংকিং চ্যানেলে অর্থ প্রেরণে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। ব্যাংকিং খাতের ক্রেডিট রেটিং নিম্নগামী হওয়ার কারণে এই সমস্যা আরো বেড়ে যাবে।
ক্রেডিট রেটিং নিম্নগামী হওয়ার কারণে ব্যবসায়ীদের এবং ব্যাংকগুলোর স্বল্পমেয়াদি ঋণ গ্রহণের সুবিধা, বিশেষ করে রি-ফিন্যান্সিং সুবিধা পাওয়ার সুযোগ একেবারেই সীমিত হয়ে যাবে। ফলে দেশে বিদেশি বিনিয়োগ, যা এমনিতেই নেতিবাচক অবস্থায় আছে, তা আরো খারাপ হবে। এর সার্বিক প্রভাব পড়বে দেশের অর্থনীতিতে। এ কারণেই ক্রেডিট রেটিং রিপোর্টে মুডি স্পষ্ট করে উল্লেখ করেছে যে চলতি অর্থবছর, যা আগামী জুনে শেষ হবে; তখন দেশের জিডিপি ৪.৫ শতাংশে নেমে আসবে। এর আগে আইএমএফ বলে রেখেছে যে দেশের জিডিপি ৪ শতাংশের নিচে চলে আসবে অর্থাৎ ৩.৮ শতাংশ। অথচ নানা প্রতিকূলতা, আলোচনা এবং সমালোচনা সত্ত্বেও দেশের অর্থনীতি দেড় দশক ধরে ধারাবাহিকভাবে ৬ শতাংশের বেশি জিডিপি ধরে রাখতে পেরেছে। অনেকেই বলে থাকেন যে আগের সরকার দেশের জিডিপি নিয়ে মিথ্যা তথ্য প্রদান করেছে। হতে পারে, কিন্তু সে সময় আইএমএফ (আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল) এবং এডিবি (এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক) দেশের জিডিপি নিয়ে যে তথ্য দিত, তা সরকার প্রদত্ত তথ্যের চেয়ে কম থাকলেও ৬ শতাংশ বা তার বেশিই থাকত। দেশের ব্যাংকিং খাতের ক্রেডিট রেটিং নিম্নমানের নেতিবাচক প্রভাব দেশের জিডিপির ওপর পড়ার সমূহ সম্ভাবনা আছে।
এখানেই শেষ নয়। এই ক্রেডিট রেটিং নিম্নমানের নেতিবাচক প্রভাব পড়বে দেশের সার্বভৌম ক্রেডিট রেটিংয়ের ওপর। এর প্রভাবে দেশের যে স্বতন্ত্র ক্রেডিট রেটিং আছে, সেটিও নিম্নগামী হতে পারে। ফলে দেশের বিনিয়োগ সুবিধা হ্রাস পাবে। এসব ভেবেই হয়তো আইএমএফ তাদের ঋণের তৃতীয় কিস্তি ছাড় করার সিদ্ধান্ত স্থগিত করেছে। অথচ এই আইএমএফ চার বিলিয়ন ডলার ঋণ মঞ্জুর করেছিল বেশ আগে এবং এরই মধ্যে ঋণের দুটি কিস্তি যথাসময়ে ছাড়ও করেছে। কিন্তু সম্প্রতি তাদের প্রতিশ্রুত তৃতীয় কিস্তির টাকা আটকে দিয়েছে। এখন আইএমএফের দৃষ্টান্ত এবং ক্রমাগত নিম্নমান ক্রেডিট রেটিংয়ের কারণে অন্যান্য বিনিয়োগ সুবিধাও পুনর্বিবেচনার অধীনে চলে আসতে পারে। এমনিতেই নানা কারণে দেশে বিনিয়োগ আশঙ্কাজনকভাবে কমে গেছে। দেশে সাত মাস ধরে বিদেশি বিনিয়োগ নেই বললেই চলে, কিন্তু সেই সঙ্গে নেই দেশীয় বিনিয়োগ, যা নিম্নমান ক্রেডিট রেটিংয়ের কারণে আরো খারাপ হবে বলেই ধারণা করা যায়।
দেশের ব্যাংকিং খাতের যে করুণ দশা, তাতে মুডির রিপোর্ট দেখে বলার প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। দেশের সাধারণ মানুষ ও ব্যবসায়ী মাত্রই হারে হারে বুঝতে পারছে। দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের খুবই খারাপ অবস্থা। বেকারত্ব বেড়েই চলেছে, যা ভালো হওয়ার লক্ষণ নয়। আরো অসংখ্য শ্রমিক-কর্মচারী যে ভবিষ্যতে বেকার হবেন, সেই আলামতও বেশ স্পষ্ট। দেশের ব্যবসায়ী সম্প্রদায় অনেক অনুনয়-বিনয় করেও তাদের দিকে সে রকম কোনো সহযোগিতা বা সহানুভূতি লাভ করতে পারছে না। ফলে দেশের অর্থনীতির ধারাবাহিক উন্নতি ব্যাহত হবে। একবার দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য এবং অর্থনীতি অগ্রযাত্রার গতিপথ থেকে ছিটকে পড়লে দেশের মারাত্মক ক্ষতি হয়ে যাবে। অনেক চেষ্টা করেও সেটিকে পরে সঠিক পথে ফেরানো কষ্টকর হয়ে দাঁড়াবে।
এ কথা ঠিক যে আমাদের দেশের বা দেশের ব্যাংকিং খাতের ক্রেডিট রেটিং নিম্নমান এবারই যে প্রথম হয়েছে, তেমন নয়। এর আগেও এই ক্রেডিট রেটিং নিম্নমান হয়েছে। কিন্তু দেখার বিষয় হচ্ছে, কোন সময় এই নিম্নমান হয়েছে। একটি দেশ এবং দেশের ব্যাংকিং খাত ও অর্থনীতি যখন ভালো অবস্থায় থাকে, তখন ক্রেডিট রেটিং নিম্নমানে তেমন কিছু আসে যায় না। যেমন—যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ইউরোপের বিভিন্ন দেশ এবং এমনকি অনেক উন্নয়নশীল দেশের ক্রেডিট রেটিং প্রতিনিয়ত পরিবর্তন হয় এবং মাঝেমধ্যে নিম্নগামীও হয়, কিন্তু তাতে তেমন কোনো সমস্যা হয় না। মানুষ সে খবর ঠিকমতো রাখেও না। কিন্তু দেশে যদি অর্থনীতি এবং আর্থিক খাত স্বাভাবিক অবস্থায় না থাকে, তখন ক্রেডিট রেটিং নিম্নগামী হওয়ার প্রভাব হয় মারাত্মক এবং যথেষ্ট উদ্বেগের, তা সে যুক্তরাষ্ট্রের মতো উন্নত এবং সুশৃঙ্খল অর্থনীতিই হোক বা বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল এবং সমস্যাজর্জরিত অর্থনীতিই হোক। বিগত ওবামা সরকারের সময় ২০০৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক খাতে ধস নামার ফলে যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেডিট রেটিং সামান্য নিম্নগামী হয়েছিল। আর তাতেই সমগ্র বিশ্বে শোরগোল পড়ে গিয়েছিল।
দেশের সরকারপ্রধান একজন অর্থনীতিবিদ, অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে যিনি আছেন, তিনিও একজন সাবেক গভর্নর ও অর্থনীতিবিদ এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্বে যিনি আছেন, তিনিও একজন অর্থনীতিবিদ ও মুদ্রাবাজার বিশেষজ্ঞ। এ রকম তিনজন উপযুক্ত ব্যক্তির হাতে যদি দেশের ব্যাংকিং খাত ও অর্থনীতি ভালো অবস্থায় না থাকে এবং সঠিকভাবে চলতে না পারে, তাহলে সেটি হবে সবচেয়ে দুঃখজনক। এ কথা ঠিক যে আগের সরকারের আমলে অনেক অনিয়ম এবং অব্যবস্থাপনা ছিল। সেগুলো হয়তো ঠিক করতে হবে। কিন্তু যেভাবে চলছিল বা যে গতিতে অগ্রসর হচ্ছিল, তার থেকে যদি ভালো কিছু আপাতত কিছুদিন না-ও হয়, অন্তত সেই গতি ধরে রেখে তো সব কিছু ঠিক করতে হবে। তা না হলে জনগণ তো মানতে চাইবে না এবং এক পর্যায়ে তারাও অধৈর্য হয়ে উঠবে। সবচেয়ে বড় কথা, দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য এবং অর্থনীতি যদি একটি পর্যায়ে রাখা সম্ভব না হয়, তাহলে পরবর্তী সময়ে নির্বাচিত হয়ে যে সরকার দেশ পরিচালনার সুযোগ পাবে, তারা তখন সবচেয়ে বড় সমস্যায় পড়বে এবং সব দায়ভার তখন তাদের ওপরই বর্তাবে। কেননা মানুষ স্বভাবসুলভভাবেই বর্তমান দেখে, অতীত খুব একটা মনে রাখে না। সুতরাং মুডির ক্রেডিট রেটিং নিম্নমান করার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিতে হবে এবং ভবিষ্যতে যেন আর নিম্নমান না হয়, বরং কিভাবে পরবর্তী ক্রেডিট রেটিং উন্নত করা যায়, সেই পদক্ষেপ দ্রুত গ্রহণ করা প্রয়োজন।
লেখক : সার্টিফায়েড অ্যান্টি মানি লন্ডারিং স্পেশালিস্ট ও ব্যাংকার, টরন্টো, কানাডা
Nironjankumar_roy@yahoo.com