জীবনের অমূল্য সম্পদ সাহিত্যপাঠ

  • আহমদ রফিক
শেয়ার
জীবনের অমূল্য সম্পদ সাহিত্যপাঠ
প্রতিকৃতি : প্রসূন হালদার

নানা অঘটন ও সীমাবদ্ধতার মধ্যেও সৌভাগ্যই বলতে হয়, আমার শিক্ষার্থীজীবনটা কেটেছে চিত্রাতীর থেকে ধলেশ্বরীতীর ছুঁয়ে বুড়িগঙ্গাতীরে ঐতিহাসিক ঢাকা শহরে, যদিও ঢাকা তখন এক অনুন্নত নাগরিক-চেতনার অবহেলিত শহর। বাঙালি মুসলমানের গভীর আকাঙ্ক্ষার ধন, স্বপ্নের ভুবন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরও ঢাকায় উন্নয়নের ধারা, আধুনিকতার চেহারা বাঞ্ছিত মাত্রার নয়, যদি পশ্চিম পাকিস্তানের দুই প্রাদেশিক রাজধানী শহর করাচি ও লাহোরের সঙ্গে তুলনা করা যায়।

পাকিস্তান ইস্যুভিত্তিক ১৯৪৬-এর নির্বাচনী ফলাফল বিশ্লেষণে একটি সত্যই প্রকাশ পায় যে বাঙালি মুসলমানের ভোটেই পাকিস্তান অর্জনের বাস্তবতা বা প্রেক্ষাপট রচিত হয়। অথচ কী দুর্ভাগ্য পূর্ববঙ্গের যে জনসংখ্যার গরিষ্ঠতা সত্ত্বেও পাকিস্তানের প্রথম রাজধানী হলো করাচি, পরে বিরানভূমিকে সুসজ্জিত করে ইসলামাবাদে।

উন্নয়নের জাদুকাঠির ছোঁয়ায় সমৃদ্ধি প্রধানত পাঞ্জাব ও সিন্ধু প্রদেশ ঘিরে—যেমন আধুনিক শিল্প-কারখানা স্থাপনে, তেমনি নানা স্তরে অবকাঠামো নির্মাণে।

পূর্ববঙ্গ তথা পূর্ব পাকিস্তান হলো আর্থ-সামাজিক বৈষম্যের শিকার। কী দুঃখজনক ঘটনা যে ইংরেজ আমলে অনেক যত্নে তৈরি ও দুর্লভ সংগ্রহের মনিপুরি ফার্ম (উদ্যান) কেটেকুটে তৈরি করা হয় রাজধানী ঢাকার মধ্যেই তথাকথিত দ্বিতীয় রাজধানী (সেকেন্ড ক্যাপিটাল), যদিও ঢাকা কখনো কেন্দ্রীয় রাজধানীর বিকল্প মর্যাদা লাভ করতে পারেনি, পশ্চিম পাকিস্তানের এক সহৃদয় ব্যক্তির প্রস্তাব সত্ত্বেও।

এমন সব কারণে পূর্ব পাকিস্তানি রাজনীতিতে বাঙালি জাতীয়তাবাদের জোয়ারি আবেগের প্রকাশ ঘটে, যা সমাজবদল ও শ্রেণিসংগ্রামের রাজনীতিকে অতিক্রম করে যায়।

মওলানা ভাসানীর মতো পরাক্রমী জননেতাও শেষোক্ত রাজনীতিকে টেনে তুলতে পারেননি, পারেনি বহুবিভক্ত বামপন্থী দলগুলো। এই রাজনৈতিক পরাজয়ের অবশ্য আরো কারণ রয়েছে, যেসব আমাদের আলোচনার বিষয় নয়।

কথাগুলো আপাতদৃষ্টিতে বিষয় তুলনায় অপ্রাসঙ্গিক মনে হলেও পাকিস্তানবিষয়ক বেশির ভাগ আলোচনায় এ তথ্যগুলোর প্রাসঙ্গিকতা অনস্বীকার্য। আমাদের রাজনীতিতে জয়-পরাজয়ের দ্বান্দ্বিক ভিত্তিটি বুঝতে হলে জাতিসত্তার আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারসংক্রান্ত সূত্রটির রাজনৈতিক গুরুত্ব ও তাৎপর্য বোঝা অনিবার্য হয়ে ওঠে।

 

দুই

শৈশব ও বালক বয়সের কথা বাদ দিলে আমার প্রকৃত শিক্ষার্থীজীবন শুরু চিত্রাতীরের দুর্গম, আধাপ্রাকৃত গ্রাম্য চেহারার নড়াইল মহকুমা শহরে। শিক্ষিত হিন্দু মধ্যবিত্ত পেশাজীবীপ্রধান এই শহরচিত্রে যে স্বল্পসংখ্যক শিক্ষিত মুসলমান মধ্যবিত্ত পেশাজীবী ছিলেন, তাঁদের বেশির ভাগই জাতীয়তাবাদী গণতন্ত্রী ঘরানার।

শহরটিতে আধুনিক উন্নয়নের স্পর্শ তেমন না লাগলেও এর শিক্ষাসচেতন পরিবেশ অনস্বীকার্য। অদূরে চিত্রাতীরেই স্থানীয় জমিদারবাবুদের কল্যাণে স্থাপিত স্কুল-কলেজ ও ব্যবসাকেন্দ্রের কল্যাণে রূপগজ (কতনগঞ্জ) শহরের চেয়ে কয়েক পা এগিয়ে ছিল। শুধু ব্যবসাকেন্দ্রই নয়, বইপত্রের দোকান, বিনিময় মূল্যে বইপত্রের লেনদেনের পাঠাগারও কম ছিল না।

মহকুমা শহরের সঙ্গে জেলা শহর যশোরের যোগাযোগ একটিমাত্র কাঁচা সড়কের মাধ্যমে রূপগঞ্জকে স্পর্শ করে গেছে। পত্র-পল্লবে শোভিত দেবদারুর ছায়া গায়ে মেখে শেষ দুপুরে আমি আর স্কুল সহপাঠী দেবু (দেবব্রত বসু) দিনের পর দিন রূপগঞ্জে গেছি গোয়েন্দা গল্পের বই আনতে। আমরা দুজন সেখানকার একটি পাঠাগারের সদস্য ছিলাম সামান্য অর্থের বিনিময়ে। বিভিন্ন উৎসব-অনুষ্ঠান উপলক্ষে সেখানে বেচাকেনার ছোটখাটো মেলাও বসত, যেমন—রথযাত্রার মেলা। সেখানে নানা ধরনের বইয়ের বেচাকেনা চলত। প্রায়ই সেখানে গেছি। একবার রথের মেলায় আমরা দুই বন্ধু (দেবু আর আমি) ওই মেলা থেকে রবীন্দ্রনাথের দুটি উপন্যাস ‘গোরা’ ও ‘নৌকাডুবি’ কিনে পরস্পরকে উপহার দিই। তখন ভাবিনি ‘গোরা’ এত কষ্টপাঠ্য হবে, বিশেষ করে গোরার হিন্দুত্ব বনাম ব্রাহ্মত্ব নিয়ে এত কচকচিতে। তবে এর সুখপাঠ্য দিকও ছিল। যেমন—চরঘোষপুরে গোরার গ্রাম পরিক্রমায় কৃষকনেতা ফরু সর্দার ও তার শিশুপুত্র তমিজ প্রসঙ্গ। এর অসাম্প্রদায়িক দিকটি দুজনেরই ভালো লাগে। আর আকর্ষণীয় ললিতার একক স্টিমারযাত্রার প্রসঙ্গ।

চিত্রাতীরে ঐতিহ্যবাহী নীলকুঠির (তখন সংস্কারের মাধ্যমে মহকুমা শাসকের বাসভবন) পাশে বিশাল মোটা বকুলগাছতলায় বসে দুজনের ওই উপন্যাস পাঠ, অভিভাবকের নজর এড়িয়ে এবং আলোচনা। তখন দুজনে কত যে বই এনেছি ওই রূপগঞ্জের পাঠাগার থেকে—গোয়েন্দা গল্প, অ্যাডভেঞ্চার ও ভ্রমণকাহিনি। সেগুলোর কিছু উল্লেখ তখনকার পাঠাভ্যাসের একচিলতে চিত্রের পরিচয় দেবে। যেমন—হেমেন্দ্রকুমার রায়ের গোয়েন্দা রহস্যগল্প, আফ্রিকার জঙ্গলের রোমাঞ্চকর ভ্রমণকাহিনি, তেমনি ভৌতিক কাহিনি (মানুষ পিশাচ) এবং আরো অনেক বিখ্যাত লেখকের বই, যেমন—বুদ্ধদেব বসু, প্রেমেন্দ্র মিত্র, প্রভাবতী দেবী সরস্বতী, সৌরিন্দ্র মোহন মুখোপাধ্যায় প্রমুখের লেখা।

‘দেব সাহিত্য কুটির’ এসব বইয়ের অন্যতম প্রকাশক। এ ছাড়া আমার প্রিয় গোয়েন্দা থ্রিলার সিরিজের রহস্যলহরী উপন্যাসগুলো দীনেন্দ্রনাথ রায় এবং রোমাঞ্চ সিরিজের বইগুলো। এগুলোর পাঠকপ্রিয়তা দেখেই বোধ হয় ক্রমান্বয়ে প্রকাশিত হতে থাকে রহস্য-রোমাঞ্চ-অ্যাডভেঞ্চার সিরিজের বইগুলো। এদের কাটতিও কম ছিল না। স্কুলের অষ্টম শ্রেণি থেকে আমাদের এই পাঠপরিক্রমার অ্যাডভেঞ্চার। পরিণামে (অবশ্য কিছু সময় পর) আমার হাতে গোয়েন্দা কাহিনির একটি বই লেখা, বলা বাহুল্য লুকিয়ে, বিশেষ করে পাশের কক্ষের বাসিন্দা সেজো ভাইয়ের চোখ এড়িয়ে, বন্ধু দেবুর উৎসাহে।

কেন জানি না, আমার এই সেজো ভ্রাতাটির এক ধরনের বিরূপতা ছিল আমার প্রতি। নানা ঘটনায় তা প্রকাশ পেয়েছে। সেটা কি মেধাবী ছাত্র হিসেবে আমার খ্যাতি ও প্রশংসার কারণে, নাকি কনিষ্ঠতম সদস্য বলে বড়দা ও মায়ের আমার প্রতি কিছুটা অধিকমাত্রার স্নেহের কারণে, তা আমার জানা নেই। স্বরচিত পাণ্ডুলিপিটি ছিল দুই পৃষ্ঠায় লেখা (আমার অজ্ঞতার কারণে) দেবুর আগ্রহের আতিশয্যে, রোমাঞ্চ সিরিজের অফিসে, বই থেকে ঠিকানা নিয়ে। যথারীতি উত্তর মেলেনি। হতাশ দুই বন্ধু।

ওই বয়সে শহরের রাজনীতির প্রভাবেই বোধ হয় একাধারে রাজনীতি ও সাহিত্যের প্রতি আমার আগ্রহ জন্মে। তেমনি কিছু লেখার চেষ্টা। স্কুলের দেয়াল পত্রিকায় অতীব রোমান্টিক কবিতা বা স্বদেশমুক্তির কথিকা লেখা। আমার ওইসব অপরিণত রচনার সমাধি অকুস্থলেই। এ পর্বের শেষ কথাটি হলো সাহিত্যপাঠের কিছু সচেতন বাঁক ফেরা। দায় যশুরে ম্যালেরিয়ায় দীর্ঘ সময় শয্যাশায়ী থাকা এবং রোগীর পথ্য হিসেবে ভাবির আনা রবিনসন বার্লি বা সাগুর খাদ্যকাপ সবার অলক্ষ্যে বারান্দা সন্নিহিত বাগানে গতিকরণ। বড় অসহ্য ছিল ওই সাগু বার্লির স্বাদ। তেমনি মেকাক্রিন ও প্যালুড্রিন সেবন, মাঝেমধ্যে ভয়ানক তেতো কুইনাইন মিক্সচার।

 

তিন

অবশ্য আমার তুলনায় অধিক সময় জুড়ে মেজো ভাইয়ের থেকে থেকে ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হওয়া তাঁর শিক্ষাজীবনে মানসিক বিপর্যয় সৃষ্টি করেছিল কি না বলতে পারব না। তবে আমার জন্য তা ভিন্ন পরিণাম বহন করে—অর্থাৎ সাহিত্য, বিশেষ করে কাব্যসাহিত্যের প্রতি অনুরাগ। কারো চোখে এটা ইঁচড়ে পাকামি মনে হতে পারে, কিন্তু আমি নিশ্চিত জানি, শয্যাশায়ী না থাকলে এবং বইপ্রেমী বড়দার আনা রচনাবলি ও বাঁধানো ‘বসুমতী’, ‘ভারতবর্ষ’, ‘প্রবাসী’ ঘরে না এলে আমার এসব গ্রন্থ ও প্রবন্ধ পাঠ কবে হতো তা জানি না।

এ সময় আমি পড়ি মধুসূদন গ্রন্থাবলি, বঙ্কিম রচনাবলি, রঙ্গলালের পদ্মিনী উপাখ্যান ও নবীনচন্দ্র সেনের পলাশীর যুদ্ধবিষয়ক কাব্যগ্রন্থ। পড়ে কিছু বিভ্রান্তি দূর হয়। অন্যদিকে ‘মেঘনাদবধ’ কাব্য ও চতুর্দশপদী কবিতাবলি এবং কবির প্রহসন দুটি। মধুসূদন প্রিয় কবি হয়ে ওঠেন বিশেষ করে তাঁর স্বাদেশিকতা, দেবত্ব মহিমা অস্বীকার ও অসাম্প্রদায়িকতার কারণে।

একই সঙ্গে বঙ্কিমচন্দ্রের ‘কপালকুণ্ডলা’র মতো উপন্যাস পাঠে যেমন মুগ্ধ হই, তেমনি দুঃখ পাই ‘আনন্দমঠ’-এর উগ্র সাম্প্রদায়িকতায়, বিশেষ করে তাঁর মুসলমানবিদ্বেষে—যার প্রকাশ ‘নেড়ে’ শব্দের বহুল ব্যবহারে, সেই সঙ্গে ইংরেজভক্তিতে, যেমন ‘আনন্দমঠ’-এর উপসংহারে, তেমনি ‘চন্দ্রশেখর’-এর মতো উপন্যাসে। ‘সাহিত্যসম্রাট’ বঙ্কিমচন্দ্র সম্বন্ধে আমার পূর্বধারণা সম্পূর্ণ পাল্টে যায় বাস্তবের আঘাতে। অথচ এই আমিই কিনা স্বাদেশিকতার টানে বন্ধুদের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে একসময় গেয়েছি ‘বন্দে মাতরম’ গানটি।

এতে চিত্রিত অপূর্ব প্রাকৃত দৃশ্যপট আমার প্রকৃতিপ্রেমী রোমান্টিক মনটিকে স্পর্শ করে ও মুগ্ধ করে; যেমন—শুভ্র জ্যোত্স্নাপুলকিত যামিনী/ফুল্লকুসুমিত ক্রমদল শোভিনী ইত্যাদি। তৎসম শব্দের ব্যঞ্জনাগর্ভ ধ্বনি মাধুর্যের প্রতি আমার ওই সময় বঙ্কিম রচনাবলি পাঠ থেকে। দুর্ভাগ্য আমার যে তখন বিদ্যাসাগর রচনা পাঠের সুযোগ পাইনি। কিন্তু রঙ্গলালের ‘স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচতে চায় হে’ কবিতাটি ‘যবনের দাস’ জাতীয় অনুরূপ আপত্তিকর শব্দাবলিও আমার মনে অনুরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। সাহিত্যে সাম্প্রদায়িকতার মতো রাজনৈতিক তাৎপর্যের বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে, পরবর্তী জীবনের সাহিত্যপাঠ ও পরিণত বয়সের বিশ্লেষণে তা স্থায়ী হয়ে ওঠে। সেক্যুলারিজমের গুরুত্বের প্রতি অধিকমাত্রায় আকৃষ্ট হই ভারতীয় রাজনীতির বৈশিষ্ট্যর কারণে, মার্ক্সবাদী রাজনৈতিক আদর্শের প্রতি পরবর্তীকালের বিশ্বাস সত্ত্বেও।

 

চার

সাহিত্যপাঠের পরিণাম ও আমার চেতনায় এর প্রভাবের কথা আমি খোলা মনে প্রকাশ করছি তা আমার সম্পর্কে বিরূপ ধারণা সৃষ্টির কথা মনে রেখেই। কারণ আমার জীবনাদর্শ রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক বিশ্বাসের আদর্শ জীবনের অমূল্য সম্পদ সাহিত্যপাঠনিয়ে আমার মনে কোনো দ্বিধা-সংশয় গোটা জীবনে দেশি-বিদেশি সাহিত্যপাঠের প্রভাব এ সম্পর্কে আমাকে চিন্তামুক্ত করেছে। আমার রাজনৈতিক আদর্শ যেমন প্রথম জীবনে বিদেশি শাসন থেকে মুক্তির স্বাধীনতাসংগ্রামে বিশ্বাসী ছিল, ক্ষমতা হস্তান্তরের পর একদিকে সমাজবদলের চাহিদায় মার্ক্সবাদী রাজনীতিতে শতভাগ বিশ্বাসী, তেমনি বাস্তব পরিস্থিতির দহনে অনুরূপ মাত্রায় অসাম্প্রকায়িকতা তথা সেক্যুলারিজমে বিশ্বাসী। এই বাস্তবতা মার্ক্সবাদবিরোধী নয় এবং তা কোনো মার্ক্সবাদীরই অস্বীকার করা যুক্তিসংগত নয় বলে মনে করি।

প্রকৃতপক্ষে নবম শ্রেণি থেকে আমার সাহিত্যপাঠে একটি ব্যতিক্রমী ঘটনা আমার জীবনে তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে হয় আর তা হচ্ছে স্কুল লাইব্রেরি থেকে আনা একেবারেই ভিন্নধারার একটি বই কী মনে করে এনেছিলাম বলা কঠিন। বহু উল্লিখিত বইটি হলো—ঝবষবপঃবফ চড়বসং ড়ভ ঝযবষষু ধহফ ঙসধত্শযধরধস, দ্বিতীয়াংশ ইংরেজ কবি ফিটজেরাল্ডের বিখ্যাত অনুবাদের নির্বাচিত চতুষ্পদী।

ওই অপরিণত বয়সে শেলি আমাকে যতটা আকৃষ্ট করেছিল, তার চেয়ে অনেক গুণ বেশি ইরানি কবি-দার্শনিক বিজ্ঞ ওমর খৈয়ামের রুবাইগুলোর অনুবাদ—সংশয়বাদী মধ্যম দার্শনিকতার কারণে। এই প্রভাব আমার জীবনে একটি স্থায়ী ঘটনা, যদিও তা নান্দনিক চরিত্রের। প্রসঙ্গত, একটি না-বলা ঘটনা গুরুত্বপূর্ণ। আর তা হলো গ্রামের বাড়িতে থাকাকালীন পাশের পাড়ার এক মারফতি জলসায় গিয়ে হাতে লেখা বই ‘মারফত সোপান’ পাঠ এবং তা ভালো লাগার স্মৃতি জীবনসায়াহ্নেও সজীব। এ বইয়ের একটি মরমি ধারার প্রতীকী গানের কয়েক পঙক্তি থেকে উদ্ধার করে লিপিবদ্ধ করে রেখেছি একাধিক প্রবন্ধে, বিশেষভাবে স্মৃতিচারণামূলক গ্রন্থ ‘পথ চলতে যা দেখেছি’তে। উল্লেখ্য, আমার পিতা মরমি গানের, বিশেষ করে মারফতি সাধনার অনুরাগী ছিলেন। মেঘনার ওপারে এক মারফতি গানের জলসায় গিয়ে ফেরার পথে তুমুল ঝড়ে মেঘনায় নৌকাডুবিতে তাঁর করুণ অকালমৃত্যু। আমার এক চাচা শেষ বয়সে আমৃত্যু তাঁর নিজস্ব ধারার মারফতি সাধনায় মগ্ন ছিলেন। আর আমি, তাঁদের পরবর্তী প্রজন্মের সদস্য, ষাটের দশকে গ্রামাঞ্চলে মরমি সাধনার ইতিকথা সংগ্রহের চেষ্টা করি এবং নিজ গ্রাম শাহবাজপুর থেকে বেশ কিছু গান ও গানের বই সংগ্রহ করি। সাতমোড়ার মনমোহন সাধুর ‘মলফ’ এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কয়েকজনের বই। কিন্তু এ ধারায় গবেষণাকর্মে হাত দেওয়া সম্ভব হয়নি নানা কারণে। এরপর যে কাজটি করি, তা হলো খৈয়ামের রুবাইয়ের সব কটি বাংলা অনুবাদ সংগ্রহ—কান্তিচন্দ্র ঘোষ, নরেন্দ্র দেব, কাজী নজরুল প্রমুখের অনুবাদ।

একফাঁকে লিখি দারিদ্র্যের ওপর একটি ছোট প্রবন্ধ, পাঠাই দেশ পত্রিকায়, যথারীতি ছাপা হয়নি। ১৯৪৫-এর দিকে আমার তৎকালীন রাজনৈতিক চিন্তার মিলে প্রবল অনুরাগ জন্মে বিদ্রোহী বিপ্লবী কবি কাজী নজরুলের প্রতি। কলকাতা থেকে ভিপিপি ডাকে কিনে আনি নজরুলের শ্রেষ্ঠ ও সর্বাধিক পাঠকপ্রিয় কবিতার বই ‘অগ্নিবীণা’ (দশম সংস্করণ), ১৯৪৫ সালে। বই এখনো আমার সংগ্রহে আছে। নজরুলের স্বাধীনতাসংগ্রামী ভাবনা (কামাল পাশার প্রেরণীয়), তাঁর বিদ্রোহ ও বিপ্লব তখন আমাকে গভীরভাবে টেনেছে (‘ধূমকেতু’র রোমান্টিক বিপ্লব স্মর্তব্য)।

বুঝতে পারি, তাঁর সমকালীন তরুণরা কেন নজরুলের প্রবল অনুরাগী ছিল, বিশেষ করে তাঁর ‘অগ্নিবীণা’, ‘ভাঙার গান’ ও ‘ধূমকেতু’ পত্রিকা নিয়ে। এই মুগ্ধতার উল্লেখ করেছেন ‘কল্লোল যুগ’-এর চিত্ররূপ অঙ্কনে।

রচনা দীর্ঘ হয়ে যাচ্ছে, রাশ টানা দরকার। কিন্তু কী করব, পাঠ বিবরণ তো শেষ হচ্ছে না। তবু সংক্ষিপ্ত রেখাচিত্রে এ পর্বটির ইতি টানি। উল্লিখিত ম্যালেরিয়া পর্বে এবং পরে আরো কয়েকজন স্বনামখ্যাত লেখকের বই পড়ি; যেমন—বনফুল (বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়) ও প্রনাবি (প্রমথনাথ বিশী)। শেষোক্তজন শান্তিনিকেতনের ছাত্র হওয়া সত্ত্বেও তাঁর তীক্ষ-তির্যক শরসন্ধানী রচনা, বিশেষত গল্প-উপন্যাস ছিল অসাধারণ। জানি না কেন তিনি শরত্চন্দ্রের ‘শ্রীকান্ত’ নিয়ে (চতুর্থ খণ্ড লিখে) তির্যক রঙ্গ-রসিকতা করেছিলেন। তাঁর এ প্রবণতা বেশির ভাগ লেখায় প্রকট, বৈশিষ্ট্যটি তাঁর নিজস্ব।

আমি তখন দশম শ্রেণির ছাত্র। এ সময় বন্ধু দেবুর আগ্রহে প্রবোধকুমার সান্যালের ‘প্রিয়বান্ধবী’ ও ‘আঁকাবাঁকা’র সাহসী আধুনিকতা আমাদের মুগ্ধ করে। ডাকবাংলার বারান্দায় বসে দুজনে মিলে এসব বই পড়ি। আর আমি এককভাবে পড়ি মনোজ বসুর বিপ্লবী উপন্যাস ‘ভুলি নাই’ আর ‘সৈনিক’। ‘ভুলি নাই’-এর বিপ্লবী রোমান্টিকতার জন্যই বোধ হয় অসম্ভব জনপ্রিয় হয়েছিল। বইয়ের প্রথম বাক্যটি ছিল—কুন্তলদা, তোমাদের ভুলি নাই।

স্কুলজীবনের এই পাঠ পর্বে আরো বই পাঠ, সব মিলিয়ে একটিই কথা—এই বিচিত্র পাঠ আমার সাহিত্য ও রাজনৈতিক চেতনা সমৃদ্ধ করেছিল। যদিও পরবর্তী পর্যায়ে মার্ক্সবাদী দর্শনের প্রভাব ধুয়েমুছে ফেলি। কিন্তু খৈয়াম থেকেই যান, এমনকি এখনো কৈশোরের প্রভাব বলে কথা। হয়তো তাই পরিণত বয়সের অবসরে শার্লক হোমস আর আগাথা ক্রিস্টির বেশির ভাগ বই উপভোগ্য হয়ে ওঠে।

এখন (অক্টোবর ১৯৪৭ থেকে) আমি ধলেশ্বরীতীরে হরগঙ্গা কলেজের ছাত্র, থাকি নির্মলা কুটির-এ, সেলিমদাদের বাসায়। তিনি আমার মার্ক্সবাদী চেতনার প্রেরণা বলা চলে। কলকাতার ছাত্রজীবনে তিনি ছিলেন ছাত্র ফেডারেশনের অনুরাগী কর্মী। তাঁর আগ্রহে বাসায় এসেছে ‘পরিচয়’, ‘অগ্রণী’ বা ‘অরণির’ মতো পত্রিকা এবং মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নতুন নতুন সদ্যঃপ্রকাশিত বই। কেন জানি আমাকে পড়তে দেন ওয়েব দম্পতির লেখা ঢাউস বই ‘সোভিয়েট কমিউনিজম’। পড়তে বেশ কষ্টই হয়েছিল। তবে উপভোগ্য ছিল সুকান্ত ভট্টাচার্যের কবিতা। ‘ছাড়পত্র’, ‘ঘুম নেই’ ইত্যাদির প্রচণ্ড পাঠকপ্রিয়তা পূর্ববঙ্গের পাঠকসমাজের একাংশেও।

একই ধারায় ‘পূর্ণিমার চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি’র মতো তাঁর কিছু কাব্যপঙক্তি তরুণদের মুখে মুখে ‘মিথ’ রচনা করে। কিংবা ‘হিমালয় থেকে সুন্দরবন’, ‘হঠাৎ বাংলাদেশ’ অথবা ‘রানার’ কবিতার পঙক্তিবিশেষ, যা পরে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সুকণ্ঠগায়নে তরুণদের চিত্ত জয় করে, যেমন করে ‘অবাক পৃথিবী’র গায়ন। আমি কলেজ ম্যাগাজিনে লিখি সুকান্তর কবিতা নিয়ে প্রবন্ধ।

আমার ইংরেজির শিক্ষক অরবিন্দ পোদ্দার প্রবন্ধটির প্রশংসা ও সমালোচনা দুই-ই করেন এই বলে যে এতে যুক্তিবাদী বিশ্লেষণের চেয়ে রোমান্টিক আতিশয্য প্রকাশ পেয়েছে। কথাটা আমার গোটা সাহিত্যজীবনে আদর্শস্বরূপ হয়ে থেকেছে।

এই কলেজজীবনে প্রধান পাঠ্য ছিল প্রগতিবাদী বাংলা সাহিত্য। মানিক থেকে ননী ভৌমিক, নবেন্দু ঘোষ, তারাশংকর (‘গণদেবতা’, ‘পঞ্চগ্রাম’, ‘হাসুলিবাকের উপকথা’ ইত্যাদি) এবং ক্বচিত বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। চাচির গ্রামোফোনে প্রচুর রবীন্দ্রসংগীত শোনা এবং বহু গান মুখস্থ হয়ে যাওয়া আমার জীবনের অক্ষয় সম্পদ।

 

পাঁচ

চেতনায় মার্ক্সবাদী দর্শনের এই বীজতলা নিয়ে আমার বুড়িগঙ্গাতীরের ঢাকা শহরে থিতু হওয়া এবং মেডিক্যাল কলেজের ছাত্রজীবনে (১৯৪৯ থেকে) এন্তার পশ্চিমবঙ্গীয় প্রগতি সাহিত্য ও বিদেশি সাহিত্য পাঠ (পেঙ্গুইন, পেলিক্যান ইত্যাদি পাতলা মলাট সংস্করণ)। এই পাঠে অন্তর্ভুক্ত ছিল কবিতা, গল্প ও উপন্যাস। ক্বচিৎ নাটক চার্লস ডিকেন্সের আত্মজীবনীমূলক ঢাউস উপন্যাসের স্কুল পাঠ্যরূপ পড়েই ডেভিড কপারফিল্ড শেষ, কিন্তু মেডিক্যাল কলেজ জীবনে পড়া ‘ওলিভার টুইস্ট’ বা ‘টেল অব টু সিটিজ’-এর মতো বই, মুগ্ধ হয়েছি। মনে দাগ কেটেছে সিডনি কার্টনের আত্মত্যাগী চরিত্রটি। ভেবেছি ‘শ্যামা’ নাটকের অনুরূপ উত্তীয় চরিত্রটির কথা। এই পর্বের সাহিত্যপাঠ নিয়ে বলতে গেলে রচনা সুদীর্ঘ রূপ নেবে। কারণ এ পর্বে বিস্তর বিদেশি সাহিত্যপাঠ আমার নান্দনিক চেতনাকে ঋদ্ধ করেছে, কোনো কোনো সৃষ্টি চেতনায় গভীর দাগ কেটেছে। আয়তন বৃদ্ধির শঙ্কায় লেখক এবং দু-চারটি বইয়ের নাম উল্লেখ করেই এ লেখায় ইতি টানব, পরবর্তী জীবনের পাঠ এখানে ঊহ্যই থেকে যাবে। সেখানে ছিল বৈচিত্র্য। কথাসাহিত্যে তাই গুটিকয় নাম—রলাঁর ‘জ্যাক্রিস্তফ’, হুগোর ‘লা মিজারেবল’ ছাড়া ডিএমসিতে শিক্ষার্থীজীবনে সর্বাধিক পাঠ—মোটা মলাট যতটা, তার চেয়ে বেশি পেপারব্যাক বিভিন্ন প্রকাশনার।

সদ্যঃপ্রতিষ্ঠিত নিউমার্কেটের পশ্চিম দিকটাতে কেবল বইয়ের দোকান—বেচাকেনাও ভালো, সেখানে ছাত্র ও বিভিন্ন বয়সী মানুষের বইকেনা দেখেছি, যতটা কলকাতার বই, তার চেয়ে অনেক বেশি বিদেশি বই, কবিতা থেকে কথাসাহিত্য, সেই সঙ্গে প্রবন্ধের বই। সেখান থেকে আমার যত বই কেনা। হাতে কড়ির অভাবে পেপারব্যাকই বেশি। অনেক ঝড়-বাদলের মুখে বেশির ভাগ হারিয়ে এখনো কিছু টিকে আছে; যেমন—শর ‘ম্যান অ্যান্ড সুপারম্যান’, সার্ভের ‘রোডস টু ফ্রিডম’ ট্রিজলির দুটি, কামুর ‘স্ট্রেঞ্জার’ ও ‘দ্য ফল’; কবিতা ও নাট্যবইগুলোর মধ্যে নেরুদা, লোকা, এলিয়ট, ইয়েটস, ব্রাউনিং। তবে ইন্টারন্যাশনাল ব্রিগেডে যোগ দিতে গিয়ে শহীদ ক্রিস্টোফার কডওয়েলের ইলিগুশ অ্যান্ড রিয়ালিটিসহ ডাইয়িং কালচার সিরিজের দুটি বই-ই অক্ষত আছে। আর টমাস মানের ‘ম্যাজিক মাউন্টেইন’। আর বিতর্কিত বই ‘গড দ্যাট ফেইলড’। হাওয়ার্ড ফাস্টের ‘লাস্ট ফ্রন্টিয়ার’, ‘সাক্কো ভ্যানজেত্তি’। ওঁর বাকি বইগুলো ‘স্পার্টাকাস’সহ পরে কেনা।

শর ‘সিজার’ ও ‘ক্লিওপেট্রা’র চেয়ে আমার চেতনায় দাগ কেটেছিল ‘সেন্ট জোয়ান’ (জোয়ান অব আর্ক) ও ‘অ্যান্ড্রোক্লিস অ্যান্ড দ্য লায়ন’, সর্বোপরি ‘ম্যান অ্যান্ড সুপারম্যান’। সুখপাঠ্য বই হিসেবে মোপাসা সমগ্র এবং শেখভ (চেখফ) সমগ্র ছোটগল্পের দুই গ্রেটমাস্টার। তলস্তয়ের ‘আনা কারেনিনা’ ও দস্তয়েভস্কির ‘ইডিয়ট’ আর মায়াকোভস্কির কবিতা ও গোর্কির ‘মা’। লুই আবাগ এখনো আমার প্রিয় কবি এবং পল এলুয়ার।

সুখপাঠ্য ও মানবিক চরিত্রের গল্পকার ও’ হেনরির ছেঁড়াখোঁড়া বইটি এখনো আমার শেলফে—সেই পঞ্চাশের দশকে কেনা। মপাসাঁর ‘নেকলেস’ এখনো মনে দাগ কাটে। যেমন শেখভের ‘কেরানির মৃত্যু’। ইচ্ছা ছিল শেখভ ও মপাসাঁর নির্বাচিত গল্প বাংলায় অনুবাদ করব, হেমিংওয়ের ‘দ্য কিলার’-এর মতো। হয়ে ওঠেনি হাজার কাজে। কলকাতায় লেখকদের মাতামাতি সত্ত্বেও ‘লেডি চ্যাটার্লিজ লাভার’ বা ‘লোলিটা’ বিশেষ কারণে আমার ভালো লাগেনি। শিক্ষার্থীজীবনের আরো অনেক বই ও লেখকের কথা স্থানাভাবে বলা গেল না। এইসব পাঠ আমার জীবনের অমূল্য সম্পদ।

 

মন্তব্য

সম্পর্কিত খবর

শীত বিকেল

    শরিফুল ইসলাম ভূঁইয়া
শেয়ার
শীত বিকেল
অঙ্কন : বিপ্লব চক্রবর্ত্তী

বাইরে কা কা করছে একটা কাক। নাজুকে শোনাতে পারলে খুশি হতো। সেদিন বলছিল, ‘ভোরে এখন আর কাকের ডাক শুনি না। কাক কি হারিয়ে যাচ্ছে? কাকের শহর ঢাকায় সাতসকালে একটা কাক ডাকবে না—এ কেমন কথা!’

কাক নিয়ে অবশ্য মাথাব্যথা নেই মাশুকের।

যে শহরে তার নিজেরই ঠিকানার ঠিক নেই, সেখানে আবার কাক!

মাশুকের ভাবনায় বাদ সাধে এক খদ্দের। দিনের প্রথম কাস্টমার।

‘অরিজিনাল লেদার শু আছে?’

প্রশ্নটা বিরক্তিকর! সমিতির মার্কেটে এসেছে লেদার শু কিনতে? মাশুক কুশলী জবাব দেয়, ‘পিওর লেদার পাবেন না, মিক্সড হবে। তবে এগুলা লেদারের চেয়ে কম না।

‘দেখান তো ভাই।’

র্যাক ভর্তি বিভিন্ন ধরনের জুতা সাজানো। এক দিকে আঙুল তুলে মাশুক বলল, ‘ওইখানে নতুন কিছু শু আছে। দেখেন কোনটা পছন্দ হয়।

লোকটা এগিয়ে গেল র্যাকের দিকে। মাশুক এই জুতার দোকানে ক্যাশ আগলায়। জুতা দেখানো বা খদ্দেরের পায়ে গলিয়ে মাপ ঠিক করা তার কাজ নয়। অল্পবয়সী দুই তরুণ কাজটা করে। কিন্তু সকাল সাড়ে দশটায়ও কারো আসার নাম নেই।

দুজনই মোবাইল নিয়ে রাতভর পড়ে থাকে। ফেসবুক, টিকটক—আরো কত কী দেখে! ফাঁক পেলেই এসব নিয়ে কথা বলে দুজন। ফেসবুক অবশ্য মাশুকও দেখে। রাতে ঘুম না এলে ফেসবুকের ভিডিওগুলো দেখে।

অঙ্কন : বিপ্লব চক্রবর্ত্তী

‘ভাই, এই জোড়া নামান। নিয়া আসেন, দেখি।’

নরম কুশনের টুলে গিয়ে বসল ক্রেতা। ছোকরা দুটো আসছে না কেন? মাশুকের মাঝেমধ্যে এমন রাগ হয়, দুজনের নামে মালিকের কাছে নালিশ দিতে ইচ্ছা করে। কিন্তু দমে যায়। ওরা দুজনই ছেলের বয়সী। মায়া লাগে।

মাশুক বাধ্য হয়ে লেগে গেল খুবই অপ্রিয় একটা কাজে। লোকটা ধুলোমলিন পুরনো জুতা থেকে পা দুটি বের করতেই ছুটে পালাতে ইচ্ছা করল তার। মোজায় এমন গন্ধ, কেনার পর চিজ দুখানায় কখনো পানি পড়েছে কি না সন্দেহ!

লোকটা নতুন জুতা পায়ে গলিয়ে মচমচ করে কয়েক কদম হেঁটে দেখল। তারপর মুখ বাঁকা করে বলল, ‘নাহ, জুত নাই। রাইখ্যা দেন।’

লোকটার ধুলোমলিন পুরনো জুতা ডাকঘরের সিলমোহরের মতো একটা ছাপ রেখে যায় মাশুকের মনে। পরিবার থেকে দলছুট এই দেহটা এখনো বয়ে বেড়ানো যাচ্ছে। যখন আরো বয়স হবে, কর্মক্ষম থাকবে না, ঠিক ওই ধুলোমলিন জুতা বনে যাবে সে। হায় জীবন!

তাড়াহুড়া করে আসায় সকালের নাশতাটাও সারা হয়নি আজ। পেটে সারিন্দা বাজাচ্ছে ক্ষুধা। কিছু মুখে দেওয়া দরকার। কিন্তু ওরা না এলে বাইরে যাবে কী করে?

পরিষ্কার থাকার একটু বাতিক আছে মাশুকের। লোকটার নোংরা মোজা হাতড়ে গা ঘিনঘিন করছে। হাত না ধুলেই নয়। এ সময় সুরেলা আওয়াজ তোলে মোবাইলের রিংটোন। কল দিয়েছে নাবিলা। হাত ধোয়ার কথা ভুলে কল রিসিভ করে মাশুক।

‘কী করছ, বাবা?’

‘এইতো—দোকানে বসছি।’

‘আজ দুপুরে আসতে পারবা?’

‘কেন?’

‘তোমার এই একটা বিশ্রী স্বভাব, একটা প্রশ্ন করলে জবাব না দিয়া পাল্টা প্রশ্ন করো। আসতে পারবা কি না?’

‘খুব দরকার?’

‘উহু রে, আবার প্রশ্ন! আইসো।’

‘দেখি।’

‘দেখি আবার কী? দেখার কী আছে? আসবা, ব্যস।’

লাইন কেটে দেয় নাবিলা। মাশুকের হৃদয়গভীরে একটা কুলুকুলু স্রোত বয়ে যায়। ওদের কাছে যাওয়ার সুযোগ হলে এমন অনুভূতি হয়। আজব এক পরিস্থিতি। পরিবার নিজের, কিন্তু বাসা ওদের।

মাস কয়েক আগে মিরপুরের রুফটপ ওই ফ্ল্যাটে উঠেছে ওরা। নাজু, নাবিলা আর নাহিদ। বড় একটা রুম দুই ভাগ করে দুটি বানানো হয়েছে। একটায় রান্নাবান্না চলে। সেখানেই এক কোণে খাট পেতে থাকে নাজু আর নাবিলা। বাথরুম একটাই। সেটা ছাদের আরেক প্রান্তে। আরেকটা রুম নাহিদের। সেখানে জায়গা হয়নি মাশুকের। মা-মেয়ে যত স্বচ্ছন্দে একসঙ্গে থাকা যায়, বাপ-ছেলের এক রুমে থাকাটা সহজ নয়। বিশেষ করে ছেলে যদি তরুণ হয় আর মুখের ওপর বলে, ‘কী করলা জীবনে? মায়ের জীবন তো তামা করছই, আমাদের জন্যও তো কিছু করতে পারলা না!’

বাধ্য হয়ে মেসে উঠেছে মাশুক।

এর মধ্যে দোকানের ছেলে দুটি এসেছে। সমিতির মার্কেটের দোকানগুলোতে ক্রেতার ভিড় জমছে। এখানে বেশির ভাগই নিম্নমধ্যবিত্ত। তারা দেখে বেশি, কেনে কম। কিনলেও দোনামনা থাকে—ঠকলাম কি না। এর পরও জুতার দোকানে বিক্রি মন্দ না। দিনে সাত-আট জোড়া বিক্রি করতে পারলে ভালো লাভ থাকে।

দুপুরের দিকে ফোনে মালিকের কাছ থেকে ঘণ্টা তিনেকের জন্য ছুটি নেয় মাশুক। বলে, বাসায় জরুরি কাজ। ছেলে দুটির ওপর দোকানের ভার বুঝিয়ে দিয়ে মিরপুরের বাস ধরে সে। মাথায় এলোমেলো চিন্তা। হঠাৎ এই জরুরি তলব কেন? টাকার দরকার, না অন্য কোনো সমস্যা? নাজু আজকাল নিজে ফোন করে না, মেয়েকে দিয়ে করায়। এখন মাসের তৃতীয় সপ্তাহ চলছে। এই মুহূর্তে টাকা দেওয়া সম্ভব না, যা দেওয়ার তা তো দিয়েছেই।

মিরপুর-১০ গোলচত্বরে বাস থেকে নেমে যায় মাশুক। এখান থেকে বাসায় যেতে রিকশায় ৫০ টাকার মতো লাগে। মাশুক হেঁটেই যায়। গলির মাথায় সবজির ভ্যান। বাসায় কিছু সবজি নেওয়া যায়। খুশি হবে ওরা। কিন্তু দাম শুনে দমে যায় মাশুক। নতুন আলু ৭০ টাকা, করলা ৮০ টাকা, বেগুন ১০০ টাকা। সবজির দামের কাছে জীবনের দাম পানি। সস্তার সবজি অবশ্য আছে। মুলা। বিশ টাকা কেজি। মাশুক নেয় কেজিখানেক।

এ বাসায় লিফট নেই। সিঁড়ি ভেঙে ছয়তলায় ওঠা কষ্ট। প্রবল ইচ্ছাশক্তি মাশুককে টেনে তোলে। টুকটুক করে মৃদু টোকা দেয়। নাজু দরজা খোলে।

‘তুমি!’

যেন তিরিশ বছরের জীবনসঙ্গীকে চিনতে অনেক কষ্ট। মাশুক গা করে না। সয়ে গেছে। তবে নাজুর জন্য মাশুকের এখনো অনেক মায়া।

মাশুক বিরস মুখে বলে, ‘নাবু ফোন দিয়া আসতে বলল। ভাবলাম জরুরি।’

‘আসো।’

দরজা থেকে সরে জায়গা করে দেয় নাজু। পেছনে নাবিলা এসে দাঁড়িয়েছে। মাকে তীক্ষ কণ্ঠে বলে, ‘বাবাকে দেইখা চমকানোর কী আছে, মা? নয় দিন পর আসল বেচারা!’

নাজু বলে, ‘আমাকে তো বললি না?’

‘তোমাকে বইলা কী হইব? তিতা কথা ছাড়া কিছু জানো?’

‘তিতা কথা তো এমনিই বাইর হয় না। তোর বাপের চুল পাইকা সাদা হইয়া যাইতেছে, তবু আক্কেল-বুদ্ধি পাকল না! দেখ, মুলা নিয়া আসছে! এইসব বলে কোনো বাসায় নেওয়ার জিনিস!’

‘মাসের কয় তারিখ আইজ? তুমি আমার পকেটের অবস্থা দেখবা না?’

‘টাকা না থাকলে আনবা না। তাই বইলা গ্যাসের ফ্যাক্টরি নিয়া আসবা?’

নাবিলা ফিক করে হেসে ফেলে। নাজুও যোগ দেয়।

মাশুক বিরক্ত হয়ে বলে, ‘এই জন্যই তোদের কাছে আসতে ইচ্ছা করে না। ভালো কিছু করলেও মরণ! মুলা দিয়া পাতা শুঁটকির চচ্চড়ি তুমি পছন্দ করো না? এই জন্যই তো...। এখন বলো কী হইছে?’

নাবিলা বলে, ‘কিছু হয় নাই, বাবা। বাসায় আজ ভালো কিছু রান্না হইছে। আমরা পোলাও-মাংস খাব, আর তুমি বাদ থাকবা, সেইটা কি হয়?’

মাশুক এতক্ষণে খেয়াল করে, রান্নাঘর প্লাস থাকার ঘরটায় দারুণ সুবাস! কয়েক দিনের না-খাওয়া অভাগার মতো হাসি ফোটে তার। বলে ফেলে, ‘পোলাওয়ের সঙ্গে কী করছ তোমরা? গরু, না মুরগি?’

নাবিলাও হাসে, ‘দুইটাই।’

‘কী উপলক্ষে এত কিছু?’

নাজু বলে, ‘আরে, নাহিদ ওর এক বন্ধুরে খাওয়াইব। সেও রাইড শেয়ার করে।’

এখন দুপুর দুইটা। এত বেলা পর্যন্ত না-খাওয়া মাশুকের আর তর সয় না। বলে, ‘কী দিবা দাও। খুব ক্ষুধা লাগছে।’

নাজু ভেতরে ভেতরে টেনশনে অস্থির। আজকের দাওয়াতের বিশেষ উদ্দেশ্য আছে। নাহিদ যে বন্ধুকে নিয়ে আসবে, সেও পড়াশোনা ছেড়ে রাইড শেয়ার করে। নাহিদ বলেছে, ওর জানা মতে ছেলেটির বাজে কোনো নেশা নেই। কোনো মেয়ের সঙ্গেও নেই, তবে খুঁজছে। পছন্দমতো পেলে বিয়ে করবে। নাবিলাকে দেখে সে রকম আগ্রহ দেখালে বিয়ের কথা পাড়বে নাহিদ।

নাবিলা দেখতে-শুনতে মন্দ না। মেধাবীও। এসএসসিতে সায়েন্স থেকে জিপিএ ফাইভ পেয়েছে। মেডিক্যালে পড়ার ইচ্ছা। না হলে পাবলিক ভার্সিটি। কিন্তু নাহিদ বলে, বাবার যে অবস্থা, কলেজে থাকতে থাকতে নাবিলাকে পার করতে হবে। আইবুড়ো হলে তখন ছেলে পাওয়া মুশকিল।

নাজু একটু আপত্তি তুলেছিল, অমনি রেগে গেল ছেলেটা। বলল, ‘আমি এত বিয়ার করতে পারব না, মা। বোঝা হালকা করতে হইব। আমারও তো ভবিষ্যৎ আছে। বি প্র্যাকটিক্যাল!’

নাজু আর কিছু বলেনি। টাকা-পয়সা না থাকলে এ বয়সে অনেক অধিকার বেদখল হয়ে যায়। নাহিদ পইপই করে বলেছে, ‘বাবা যেন কিছুতেই জানতে না পারে। পরে জানাইলেই হইব।’

এ জন্যই নাজু কিছু জানায়নি মাশুককে। নাবিলাও জানে না এই দাওয়াতের আসল কারণ। মেয়েটা হুট করে বাবাকে নিয়ে আসায় এখন ভারি বিপদ হয়েছে। কখন যে ওরা এসে পড়ে! বাবাকে দেখলে নাহিদ এখন হয়তো কিছু বলবে না, পরে ঠিকই ঝাল ওঠাবে।

নাজু বলে, ‘তাড়াতাড়ি খাইয়া চইলা যাও। দেরি করলে দোকানের মালিক আবার কী বলে!’

হাতমুখ ধুয়ে বিছানায় বসে পড়ে মাশুক। নাবিলা ঘরে রাখা  মোটা কাগজের একটা শপিং ব্যাগ ছিঁড়ে বিছিয়ে দেয় বাবার সামনে। বলে, ‘সকালে কী দিয়ে নাশতা করছ, বাবা?’

মাশুক এড়িয়ে যায়, ‘সকালের কথা এখন জানার দরকার আছে?’

‘রোজ সকালে নাশতা করার সময় তোমার কথা মনে পড়ে, বাবা। মা দুধ-চা দিত, তুমি তেল ছাড়া পরোটা ভিজাইয়া খাইতা। মা বলে আর কাঁদে।’

‘তুইও এখন কাঁদবি নাকি?’

নাবিলা ওদিক ফিরে মুখ আড়াল করে। মাশুকের বুকের গভীর থেকে দীর্ঘশ্বাস উঠে আসে। করোনার আগে ভালোই ছিল ওরা। তখন এত লোয়ার লেভেলে না, বেশ ভালো একটা আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানে হিসাব বিভাগে ছিল। দুই কামরার একটা ছিমছাম বাসায় ছিল। আলাদা কিচেন, দুটি বাথরুম। নাহিদ তখন ঢাকা কলেজে অনার্সে পড়ে। নাবিলা স্কুলে। হুট করে করোনা এলো, ভোজবাজির মতো উধাও হলো চাকরিটা। তারপর কয়েকটা মাস একদম বেহদ্দ বেকার। করোনা গেলে ব্যাংকে যা ছিল, তা দিয়ে শেষরক্ষা হিসেবে একটা ফাস্ট ফুডের দোকান দিয়েছিল। জমল না। পুরো ১০ লাখ টাকা গচ্চা। নাহিদের পড়াশোনা ওখানেই শেষ। তবু ভাগ্যিস, ধারদেনা করে ওকে একটা মোটরবাইক কিনে দিতে পেরেছে। চারটা বছর ছোট-বড় নানা ঢেউ সামলে শেষে এই জুতার দোকানে ঢুকেছে মাশুক। বেতন যা পায়, তা দিয়ে কোনোমতে টেকা যায়, কিন্তু সোজা হয়ে দাঁড়ানো যায় না।

বাবাকে পোলাও-মাংস বেড়ে দেয় নাবিলা। অনেক দিন এমন ভালো খাবার খায় না মাশুক। রাজ্যের ক্ষুধা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে।

সব শেষে দই খেয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তোলে মাশুক। নাবিলা বলে, ‘তোমার বেতন কি আর বাড়বে না, বাবা?’

‘বাড়বে কিভাবে? বাড়ানোর কথা বলারই তো সাহস হয় না।’

‘তোমার সাহস নাই দেইখাই তো আমাদের এই অবস্থা। ভাইয়া ঠিকই বলে। মালিককে বলবা যে জিনিসপত্রের দাম বেশি, চলা যায় না।’

মাশুক কিছু বলে না। হালকা নিঃশ্বাস ছাড়ে। নাজুর ফোনে রিংটোন। কল দিচ্ছে নাহিদ। বুকটা ধড়াস করে ওঠে। এসে গেছে নিশ্চয়ই! ভয়ে ভয়ে ফোন ধরে। কিন্তু না, জরুরি কি একটা কাজ পড়েছে। এখন না, রাতে আসবে ওরা। হাঁপ ছাড়ে নাজু। যাক, এ যাত্রা বাঁচা গেছে!

নাজু এবার বলে, ‘খেয়ে একটু আরাম করেই যাও। একদিন একটু লেট হইলে কী আর বলবে?’

মাশুকেরও ভরপেট খেয়ে নড়তে ইচ্ছা করে না। ওই বিছানায়ই চিত হয়ে শুয়ে পড়ে। নাবিলা মাথার কাছে বসে। বাবার মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলে, ‘আর কয়েকটা মাস কষ্ট করো, বাবা। আমি এইচএসসি দিয়া টিউশনি করব। তোমাকে আর মেসে থাকবে হইব না। তখন আরেকটা ভালো বাসায় উঠব।’

নাবিলা বলেই চলে, ‘আর যদি ভার্সিটিতে ভর্তি হই, হলে উঠতে পারি...’

নাবিলার সব কথা কানে যায় না মাশুকের। আবেশে চোখ বুজে আসে। ঘোরলাগা চোখে স্বপ্ন দেখে সে। সবাই একসঙ্গে নতুন একটা বাসায় উঠেছে। বারান্দায় আসা নরম রোদে গা পেতে বসে আছে সে। ভেতরে চায়ের কাপে টুং টাং। এখনই আসবে ভাপ ওঠা চা। কিন্তু শীত বিকেলটা বড্ড ক্ষণস্থায়ী। কখন যে মিষ্টি বিকেল অস্তাচলে বিলীন হয়, টের পায় না মাশুক।

 

 

 

 

 

 

প্রাসঙ্গিক
মন্তব্য

একটি পুরনো গল্প

    ইউসুফ শরীফ
শেয়ার
একটি পুরনো গল্প
অঙ্কন : শতাব্দী জাহিদ

পুরনো হলেও এখনো চাপা রিনঝিন হাসি ঢেউ খেলে যায় ছ’ফুটি এই গলিতে—বাঁ দিকে সালেহা মঞ্জিলের উঁচু দেয়াল, ডান দিকে আম-কাঁঠালগাছের নিরিবিলি ছায়ায় পর পর দুটি টিনশেড বাংলোবাড়ি। সামনে গলি গিয়ে পড়েছে দু’পায়া পথে আর পেছনে এল সাইজ টিনশেড এই এলাকার থেকে যাওয়া একমাত্র মেস—ইঞ্জিনিয়ার্স মেস। যে ইঞ্জিনিয়াররা গাছপালায় ছাওয়া শান্ত পরিবেশে এই মেসবাড়িটার প্রথম বাসিন্দা ছিলেন, এখন নিশ্চিত কোনো না কোনো অভিজাত পাড়ায় তাঁরা বিলাসবহুল জীবন যাপন করছেন।

ইলিয়াস ঢুকতে গিয়ে পুরনো ভাঙাপ্রায় টিনের গেটের সামনে দাঁড়িয়ে যায়।

বেশ ক’দিন ধরে এই রিনঝিন চাপা সুবাস ছড়ানো হাসির ঢেউ ঠিক এখানে পৌঁছার সঙ্গে সঙ্গেই তার ওপর আছড়ে পড়ে।

সুবাসটা চেনা চেনা, অথচ মোটেই চেনা নয়। হাসিটাও এই রকম—পুরনো হাসির ধরন, যা চেনা যায় যায় না। চকিতে মনে পড়ে ইলিয়াসের মানুষকে চেনার আগেই বোধ হয় তার হাসি চেনা যায়।

হাসি মানবীয় সম্পর্কের এক আদি নির্ভরযোগ্য সেতু। এটা আদৌ যদি তত্ত্বকথা হয়, তাহলে ভাবতে পেরে ইলিয়াস মুচকি হাসল—অতৃপ্ত মানুষের তৃপ্তির হাসি।

স্কুলে হেডমাস্টার সাব আজ বলে দিয়েছেন—আমি দুঃখিত ইলিয়াস সাব, আপনার জন্য বোধ হয় কিছু করতে পারলাম না। কিভাবে করব বলুন, একজন মন্ত্রী যদি সামান্য একটা স্কুল শিক্ষকের চাকরির জন্য রিকমেন্ড পাঠিয়ে আবার টেলিফোনে রিকোয়েস্ট করেন, তাহলে কী করা যাবে! আপনি সাময়িক নিযুক্তি নিয়ে কাজ করেছেন—আপনার একটা দাবি আছে, কিন্তু আমার করার নেই কিছুই।

তবে আমি কথা দিচ্ছি, দু-একটা ভালো টিউশনি আপনাকে জোগাড় করে দেওয়ার চেষ্টা করব।

অঙ্কন : শতাব্দী জাহিদ

মন্ত্রীদের হাত কত দীর্ঘ! একটা মানুষের হাত কত দীর্ঘ হতে পারে? কোনো কোনো বংশের লোকদের হাত নাকি তুলনামূলকভাবে দীর্ঘ হয়—এ রকম কথা বলা হয়ে থাকে। সেটাও তো আর শরীর ছাড়িয়ে যায় না। তবে মন্ত্রীর হাত শরীরের তোয়াক্কাই করে না, অশ্বখুরের দাগের পরিমাণ ফাঁকফোকরে ননি-মাখনের খানিকটা আভাসও জিহ্বাগত হওয়ার বাইরে থাকে না!

হাত নিয়ে ভাবতে ভাবতে ইলিয়াস মেসে ঢুকছিল। টিনের ভাঙা গেটে হাত রাখার সঙ্গে সঙ্গে ওই হাসি আজও দুরন্ত তরঙ্গের মতো আছড়ে পড়ল।

তার হাত যদি তেমন হতো তাহলে হয়তো এই হাসির খনিকটা উপড়ে নিয়ে আসতে পারত! তবু হাসিটাকে সে ঠিক চিনে ফেলেছে—এই হাসি অদৃশ্য হাতের আঙুল হয়ে হৃদয়ের গোপন দরজায় টুকটুক করে কড়া নাড়ে।

গোপন কড়া নাড়ার এই শব্দ ঝরনার মতো বইছে এখন তার বুকের ভেতর। অবাক কাণ্ড, দীর্ঘ হাতের ছোবল যে ক্ষত তৈরি করেছে, তার ওপর ঝরনার পানি পড়তেই বেদনা ধোঁয়ার মতো উড়তে থাকল—আসলে উড়তে থাকল কী! পুরনো অভ্যাস তো থাকে!

মুচকি হাসিটা ধরে রেখেই রুমে ঢুকল। রুমমেট পানি উন্নয়ন বোর্ডের ডেপুটি অ্যাকাউন্টস অফিসার রফিক মাড়ির গোড়ায় গুল ঠেসে দিয়ে পুরনো অভ্যাসে অস্বাভাবিক জোরে হাত ঝাড়ছিল।

ইলিয়াস ঢোকামাত্র তার মুখে দৃষ্টি স্থির করে হাতঝাড়া ভুলে উৎসাহিত হয়ে উঠল, কী কাম হইয়া গ্যাচে! হবে না ভাই, আপনের কপাল ভালো। কইছিলাম না—চিন্তা কইরেন না। আরে ভাই—আপনে আপনের কপাল দেখতে না পাইলে কী হইব—আমরা তো দেখতে পাই। আপনের কপালের গড়ন আলাদা—এই রকম গড়নপদের কপাল দেখলেই চিনবার পারি—হেই ইস্ট পাকিস্তান ওয়াপদার আমলে ক্লার্ক হইয়া ঢুকছি—কত কপাল দেখছি। অহন একনজর দেখলেই কইয়া দিতে পারি কী আছে কপালে। না, কপালতত্ত্ব নিয়া পড়াশোনা করি নাই, এইডা অভিজ্ঞতা। বুঝলেন ভাই, অভিজ্ঞতার কোনো বিকল্প নাই।

রফিক গুলের ক্রিয়ায় মুখে জমে ওঠা পানি দরজা দিয়ে বাইরে পিক করে ছুড়ে দিয়ে আত্মতৃপ্তির হাসিতে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল।

ইলিয়াসের হাসি মিলিয়ে গেছে—জামার বোতাম খুলতে খুলতে বলল, কাম হয় নাই, রফিক ভাই!

রফিক বিছানা থেকে উঠে ইলিয়াসের সামনে এসে দাঁড়াল, কন কী, হয় নাই! হয় নাই ক্যান? আপনে তিন মাস কাজ করছেন—অহন আপনে, ডিপার্টমেন্টাল ক্যান্ডিডেট রুলে আছে আপনের প্রিফারেন্স।

ইলিয়াস বলল, কলোনিতে পাঁচ বছর আগে আপনার নামে বাসা অ্যালট হয়েছে—তার পরও বাসায় উঠতে পারছেন না কেন?

রফিক হতাশ হয়ে বিছানায় বসে পড়ে বলল, আরে ভাই, এই কিচ্ছা না কত দিন কইছি। গত পাঁচ বছরে আমি যত কথা কইছি—তার বেশি অর্ধেক খরচ হইছে এই কিচ্ছা কইতেই। তো আর কওয়া যাইব না, পরশু দিন অফিসে হুমকি দিয়া গ্যাছে।

ইলিয়াস বলল, কন কী! হুমকি দেওয়ার জন্য অফিসে গুণ্ডা লেলিয়ে দিয়েছে?

রফিক হাত-পা ছেড়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল, আরে ভাই, গুণ্ডা হইলে বুঝতাম—গুণ্ডায় হুমকি দিব না তো কী করব, হুমকি দিয়া গ্যাছে ওই মেয়েটা। কই নাই যারা জবরদখল কইর্যা রাখছে বাসা ওদের ওই মেয়েটা। কয় গান গায়—শিল্পী। এ যে কোন শিল্প সে কি আর বুঝি না! জানেন, ছোটবেলায় গেরামে দেহতত্ত্বের গান শুনছি, আর অহন এই সময়ে ঢাকার শহরে দেখছি দেহশিল্পের দাপট!

ইলিয়াস বলল, গোটা দেশটাই এখন মাসলম্যানদের হাতে জিম্মি—এদের হাত থেকে উদ্ধার না পেলে দেশ চলবে না!

রফিক বলল, আরে দূর সাব, আপনে কী কন! এই যে মেয়েটা আমারে রীতিমতো হুমকি দিয়া গ্যাল—সে কি মাসলম্যান? এ হলো সফট মাসল ওম্যান। এখন এদের যুগ, এদের হাতে জিম্মি এখন সমাজ। হার্ডওয়্যারের যুগ শেষ, এখন সফটওয়্যারের যুগ!

ইলিয়াস বিছানায় বসে পড়ে বলল, বুঝলাম না ভাই কী কইলেন সাংকেতিক ভাষায়।

রফিক বলল, আরে ভাই, আপনেরে আর কত বুঝাইবাম। সাংকেতিক ভাষা হইল এই যুগের ভাষা। আপনে তো ম্যালা নভেলটভেল পড়েন। দেখেন না আজকাল মডার্ন জনপ্রিয় লেখকরা কেমন শর্টহ্যান্ডের মতো সংকেত দিয়া দিয়া তরতর কইর্যা লেইখ্যা যায়। মনে হয় চিন্তা নাই ভাবনা নাই—কাগজ-কলম নিয়া বসে আর ফরফরায়্যা লেখা শেষ কইর্যা ফালায়। এই কথা কইছে এক মহাজনপ্রিয় লেখক এক সাপ্তাহিকে সাক্ষাৎকারে। কথা বেঠিক না—চিন্তা-ভাবনা যদি কিছু করতে হয় তো করব পাঠকরা।

ইলিয়াস বলল, এটা আপনার অন্যায়, রফিক ভাই—আপনি জানেন সারা বিশ্বের সাহিত্যে পরিবর্তন এসেছে। আমাদের লেখকরাও—

রফিক তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, রাত কয়টা দেখছেন? অহন হাতমুখ ধুইয়া খাইতে বসেন।

লোকটার মেজাজ এই বাসা নিয়ে ইদানীং খিটখিটে হয়ে উঠেছে। তবে সময়মতো খাওয়া আর ঘুমানোর ব্যাপারে ইলিয়াসকে প্রতিদিন তাগিদ দিতে ভোলে না।

খাওয়াদাওয়া সেরে বিছানায় শুয়ে বাতি নিভিয়ে দিল ইলিয়াস। অন্ধকারের সঙ্গে সঙ্গে সেই রিনঝিন হাসিটা তার মশারির ভেতর ঢুকে পড়ল—সে এখন থইথই হাসির ঢেউয়ে নিমজ্জিত। এমন তো হতে পারে, কাল খুব ভোরে এই গলির বাসিন্দারা জেগে ওঠার আগে ভাঙা গেট দিয়ে বের হতেই দেখবে—কী দেখবে! কোনো ছবি স্পষ্ট হয় না। সাদা কাগজের মতো একটা ভোর ওত পেতে রয়েছে—এ রকম সাদার মুখোমুখি হতে ভয় পায় সে, দম আটকে আসে তার।

ইলিয়াস উঠে বসে বিছানায়। মশারি গুটিয়ে টেবিলের ওপর থেকে হাতড়ে পানির গ্লাসটা তুলে নেয়—ঢকঢক করে খানিকটা পানি পান করে।

তারপর ডাকে, রফিক ভাই ঘুমিয়েছেন?

রফিক জিজ্ঞেস করল, ঘুম আসছে না? ঘুমান, ঘুম হইল শরীরের বিশ্রাম। চিন্তা কইর্যা কিছু হয় না—যা হওয়ার এমনিই হয়। ঢাকার শহরটা একটা সমুদ্র—এইখানে রুই-কাতলার পাশাপাশি মলা-পুঁটিও থাকে। তবে থাকার একটা ফরম্যাট আছে—আয়ত্ত না হওয়া পর্যন্ত অস্থির অস্থির লাগে, হইয়্যা গ্যালে দেখবেন একেবারে নিশ্চিন্ত পানির মতো জীবন। নেন ঘুমান।

ইলিয়াস বলল, আপনি সজাগ ছিলেন—ঘুমান নাই?

রফিক বলল, আরে কইয়েন না, হঠাৎ আপনের ভাবিরে দেখলাম—

ইলিয়াসের কণ্ঠে বিস্ময়, ভাবিরে দেখলেন! কী স্বপ্ন দেখছেন?

রফিক হেসে ওঠে, আরে না—ঘুমাই নাই তো স্বপ্ন দেখব ক্যামনে!

ইলিয়াস বলল, তাহলে ভাবিরে দেখলেন কেমনে?

রফিক বলল, মশারির পাশে আইস্যা দাঁড়াইল। আপনে যখন পানি খাইলেন তখন কইল—যাইগা, ইলিয়াস ভাইয়ে দেখলে কী কইব? শত হউক এইডা মেস তো!

ইলিয়াস থ—লোকটা বলে কী—মাথায় গোলমাল দেখা দেয়নি তো! সে চুপ হয়ে যায়—মুখ থেকে কোনো শব্দ বের করে না।

অনেকক্ষণ পর রফিক কথা বলে ওঠে—কী, ঘুমাইলেন?

ইলিয়াস সাড়া দেয়, না।

রফিক বলল, ইলিয়াস সাব, আপনে আমার ছোট ভাইয়ের মতন, কী কই আপনেরে। জানেন, বিয়া করলাম—দু’টা ছেয়েমেয়েও হইল, কিন্তু সংসার করতে পারলাম না। একজন ব্রাহ্মণবাড়িয়া আর একজন ঢাকায়। সংসার বলতে যা বোঝায়, প্রতিদিনের সংসার, তা হয়!

রফিকের দীর্ঘশ্বাস ঘরের বাতাস ভারী করে তোলে—এত ভারী যে শ্বাস নিতে কষ্ট হয়।

ইলিয়াস জিজ্ঞেস করল, রফিক ভাই, আমি যখন এলাম, তখন বাইরে কোনো হাসির শব্দ শুনেছিলেন?

রফিকের কণ্ঠে বিস্ময়, হাসি! কার হাসি?

ইলিয়াস বলল, এই—এই কোনো মহিলার!

রফিক আপন মনে আওড়াল—মেয়েমানুষের হাসি! না তো—কন কী! শুনছেন আপনে?

ইলিয়াস বলল, হ্যাঁ। গত কয় দিন যাবৎই শুনি—ভাঙা গেটটায় হাত রাখতেই রিনঝিন হাসি...

রফিক হেসে ওঠে, দূর কী কন! আপনে শোনেন আর আমি শুনি না, কেউ শুনে না—এইটা হয় নাকি? এইটা আপনের ভেতরে লুকাইয়া আছে—ফাঁক পাইলেই বাইর হয়!

ইলিয়াস বলল, এটা কী কন রফিক ভাই? আমি স্পষ্ট শুনেছি, একদিন-দুইদিন না, গত এক সপ্তাহ ধরে শুনছি—মিষ্টি সুরেলা হাসি, ঠিক ঝরনা থেকে পানি গড়ায় যেমন শব্দ করে!

রফিক ওকে থামিয়ে দেয়—ব্যস, হইয়া গ্যাছে, আর কইতে হইব না। এই যে আপনের ভাবি আইস্যা দাঁড়াইল—এইটা ক্যামনে? আরে ভাই, ভেতরে লুকাইয়া থাকলে ফাঁক পাইলেই বাইর হইয়া আসে। ভেতরটা যখন অসহ্য হইয়া ওঠে, তখনই বাইর হয়।

ইলিয়াসের গা ছমছম করে ওঠে—সে বুকে হাত দেয়—অনুভব করার চেষ্টা করে সত্যই রিনঝিন হাসিটা ভেতরে আছে কি না! 

 

 

প্রাসঙ্গিক
মন্তব্য

ঈদে অভিজাত সাজ

    ঈদে গরম থাকবে, তাই স্টাইলের সঙ্গে সাজে আরামের দিকটাও খেয়াল রাখুন। ঈদের সাজ নিয়ে পরামর্শ দিয়েছেন রেড বিউটি স্যালনের রূপ বিশেষজ্ঞ আফরোজা পারভীন। লিখেছেন মোনালিসা মেহরিন
শেয়ার
ঈদে অভিজাত সাজ

ঈদের দিনের অনুভূতিই অন্য রকম। এদিন সাজে সুন্দর ও সাবলীল থাকা চাই। ঈদ সকালটা শুরু হয় কাজের ব্যস্ততা দিয়ে। দুপুরে অতিথি আপ্যায়নে সময় কাটে।

বিকেল আর রাতে নিজের জন্য একটু বেশি সময় পাওয়া যায়। প্রিয়জনকে সঙ্গে নিয়ে ঘোরাঘুরি, আড্ডা কিংবা দাওয়াতে যাওয়া হয়। এ জন্য তিন বেলায় চাই তিন রকম সাজ।

সকালে হালকা সাজ

সকালে হালকা ও আরামদায়ক পোশাক পরা উচিত কারণ এসময় ছিমছাম, স্নিগ্ধ সাজই সুন্দর লাগে।

সকালে যেহেতু কাজের ব্যস্ততা থাকে তাই সাজ-পোশাক আরামদায়ক হওয়া চাই। শোভন মেকওভারের স্বত্বাধিকারী শোভন সাহা বললেন, ‘ঈদের দিন ব্যস্ততায় তিনবার লুক বদলানো বেশ ঝামেলার কাজ। সকালের সাজ দিয়েই দুপুর ও রাতের সাজটা সেরে ফেলতে পারেন। সকালে হালকা ফাউন্ডেশন দিন।
ঠোঁটে এ সময় ন্যুড রঙের লিপস্টিক দিতে পারেন। চোখ সাজাতে হালকা আইশ্যাডো দিলে সুন্দর লাগবে।’

সকালের পরিবেশে হালকা যেকোনো কিছুই ভালো মানায়। মেকআপ, কনট্যুরিং, ব্লাশ ও মাশাকারায় হালকা ভাব ধরে রাখতে পারেন। সকালে চুলের সাজে পনিটেল করে নিন।

কম বয়সীরা কপালের দুই পাশে একটু স্টাইলিশ বেণি করে নিলে সুন্দর দেখাবে।

 

ঈদে অভিজাত সাজ

দুপুরে চাই আরাম

গরম আবহাওয়া এখন। রেড বিউটি স্যালনের স্বত্বাধিকারী ও রূপ বিশেষজ্ঞ আফরোজা পারভীন বললেন, ‘ঈদের দিন দুপুরে ভারী মেকআপ না করাই ভালো। বেইস মেকআপ ম্যাট রাখুন। গরমে ত্বক বেশি ঘামলে বা তেলতেলে হলে ভালো করে মুখ ধুয়ে টোনার লাগিয়ে নিন। চেষ্টা করুন মেকআপের সব উপাদান যেন ম্যাট হয়। এতে গরমে ঘামলেও মেকআপ নষ্ট হবে না। চোখে ঘন মাশকারা ও আইলাইনার দিতে পারেন। চোখের সাজে স্মোকি ভাবও এই সময় সুন্দর লাগবে। পোশাকের রঙের সঙ্গে মিলিয়ে লিপস্টিক দিন ঠোঁটে। ন্যুড কালার লিপস্টিকও রাখতে পারেন। কানে দুল আর গলায় হালকা লকেট বেছে নিতে পারেন। দুপুরের সাজে চুল বেঁধে রাখাই বেশি আরামদায়ক হবে।’

 

ঈদে অভিজাত সাজ

রাতে জমকালো

রাতের বেইস মেকআপ মানায় ভালো। সাজও জমকালো হয়। রাতে জমকালো কাজ করা পোশাকের সঙ্গে ভারী মেকআপ, ভারী গয়না, চোখের সাজে রঙের বাহার, ঠোঁটে গাঢ় লিপস্টিক রাতে আরো বেশি সৌন্দর্য ফুটিয়ে তুলবে। বিন্দিয়া এক্সক্লুসিভ কেয়ারের স্বত্বাধিকারী শারমিন কচি বললেন, ‘রাতের সাজে মানানসই হাইলাইটার ব্যবহার করুন। গাঢ় ব্লাশ অন বেছে নিন। ঠোঁটেও থাকবে উজ্জ্বল রং। চোখে রঙিন সাজ বা স্মোকি আই রাতে ভালো দেখাবে। চুলের সাজে লম্বা বেণি সুন্দর মানাবে। চাইলে চুল ছেড়েও রাখতে পারেন।’

যখন যেমনই সাজুন, সবার আগে নিজের ব্যক্তিত্ব ও আরামদের দিকটা প্রাধান্য দিন। গরমে সাজবেন তো অবশ্যই, তবে তা যেন নিজের সৌন্দর্য আর সুস্থতায় কোনো ব্যাঘাত না ঘটায়। মনে রাখবেন, সবার আগে নিজেকে সুস্থ রাখা সবচেয়ে জরুরি। তবেই তো ঈদের আনন্দ সবার সঙ্গে মিলেমিশে উপভোগ করবেন।

 

 

 

প্রাসঙ্গিক
মন্তব্য
ফ্যাশন

ঈদের ফ্যাশনেবল পাঞ্জাবি

    ঈদের দিন পাঞ্জাবি না পরলে ছেলেদের ফ্যাশন যেন অপূর্ণ থেকে যায়। প্রতিবছর নতুন নকশা, থিম ও প্যাটার্নের পাঞ্জাবি নিয়ে আসে ফ্যাশন হাউসগুলো। ডিজাইনারদের সঙ্গে কথা বলে এবারকার ঈদের পাঞ্জাবির খোঁজ জানাচ্ছেন আতিফ আতাউর
শেয়ার
ঈদের ফ্যাশনেবল পাঞ্জাবি

পাঞ্জাবি পরতে ভালোবাসেন না এমন পুরুষ কমই। ঈদের দিন তো নতুন পাঞ্জাবি ছাড়া জমেই না। এ জন্য ঈদ ঘিরে নতুন নতুন পাঞ্জাবির পসরা সাজিয়ে বসে ফ্যাশন হাউসগুলো। ফ্যাশন হাউস কে ক্রাফটে এসেছে বর্ণিল নকশার পাঞ্জাবি।

লাল, নীল, সাদা, কালো, খয়েরিসহ বিভিন্ন রঙের সংমিশ্রণ ঘটেছে পাঞ্জাবিতে। গলা ও হাতায় রয়েছে আলাদা নকশা ও কাজ। ঐতিহ্যবাহী কাঁথা স্টিচ, মোগল শৈলী, উইভিং মোটিফের অনুপ্রেরণা ছাড়াও গুজরাটি, ইক্কত, কলকা আর্ট, জামদানি, ফ্লোরাল, ট্র্যাডিশনাল, টার্কিশ আর্ট ও ইসলামিক মোটিফ ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। রয়েছে আরামদায়ক কাপড়ের ব্যবহার।
প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার খালিদ মাহমুদ খান বলেন, ‘পাঞ্জাবির গলা, বুক ও হাতার পাশাপাশি কাঁধেও নতুন নকশা করা হয়েছে। কটন, ডিজাইন কটন, হ্যান্ডলুম কটন, লিনেন, জর্জেট, সিল্ক, হাফসিল্ক, টিস্যু ও সাটিনের মতো আরামদায়ক কাপড় বেছে নেওয়া হয়েছে। যেন গরমে স্বস্তি পাওয়া যায়। হাতের কাজ, এমব্রয়ডারি, স্ক্রিন ও ব্লক প্রিন্ট, কারচুপি ও টাইডাইয়ের সাহায্যে পাঞ্জাবির নকশা ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।

বিশ্বরঙের শোরুমে ম্যানিকুইনগুলোর বেশির ভাগই ঈদের পাঞ্জাবি পরা। প্রতিষ্ঠানটির স্বত্বাধিকারী ডিজাইনার বিপ্লব সাহা বলেন, ‘এবার নকশা ও থিমের চেয়ে আরামই বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে পাঞ্জাবির কাপড়ে। কারণ গরমের মধ্যে। সে জন্যই আরামকে বেছে নেওয়া। সুতি, কটন, সেমিকটন, লিনেন ও পাতলা তাঁতের কাপড়ে তৈরি হয়েছে এবারকার ঈদ পোশাক।

একই সঙ্গে মোটিফেও থাকছে ইসলামিক, ফ্লোরাল, ফুল, লতাপাতা ও মোগল কারুকার্য।’

 

ঈদের ফ্যাশনেবল পাঞ্জাবি

প্রিন্টে পরিপাটি

প্রিন্টের পাঞ্জাবির প্রতি ছেলেদের আকর্ষণ সব সময়ই। এবারও প্রিন্টের পাঞ্জাবির জয়জয়কার। ফ্যাশন হাউস ওটু, জেন্টল পার্ক, লা রিভ, টুয়েলভ, অঞ্জন’স, লুবনান, রিচম্যান থেকে শুরু করে ছোট-বড় সব প্রতিষ্ঠান ঈদ উপলক্ষে প্রিন্টের নতুন পাঞ্জাবি এনেছে। লালচে সুতি পাঞ্জাবিতে কালো প্রিন্টের নকশা, হাতায় কালো রঙের পাইপিংয়ের প্রিন্ট যেমন দারুণ সাড়া ফেলেছে, তেমনি গাঢ় সবুজ শেডের জমিনে হালকা সবুজ প্রিন্ট, তার সঙ্গে এমব্রয়ডারির নকশা যুক্ত করে অভিজাত ভাব আনা হয়েছে। এসব পাঞ্জাবির বোতামের আলাদা নকশা ও ম্যাটেরিয়ালেও পাওয়া যাবে ভিন্নতা। এ ছাড়া ফুল, ফল, পাখি, লতাপাতা ও প্রকৃতির নানা মোটিফ যুক্ত হয়েছে এবারকার প্রিন্টের পাঞ্জাবিতে।

 

কাটছাঁটে নতুন কী

গলা, বুক, হাতা ও কাঁধের কাটছাঁটে রয়েছে আলাদা বৈচিত্র্য। সারা লাইফস্টাইলের ডিজাইনার শামীম রহমান বলেন, ‘কম বয়সীদের জন্য জমকালো ও ভিন্ন ধাঁচের প্যাটার্নের পাঞ্জাবি এনেছি। আলাদা কাপড় জুড়ে দেওয়া, বোতামের পরিবর্তন, বুকের কাটে ভিন্নতা, এমব্রয়ডারি ও সুই-সুতার কাজের সাহায্যে নতুনত্ব যোগ করা হয়েছে। কখনো বুকের এক পাশ খালি রেখে আরেক পাশে নকশা, কখনো কাঁধের কাছে ভিন্ন কাপড় জুড়ে দিয়ে ভিন্নতা আনা হয়েছে।’

একেকজনের একেক রকম চাহিদার কথা মাথায় রেখে পাওয়া যাবে তিন ধরনের পাঞ্জাবি—রেগুলার ফিট, স্লিম ফিট ও স্লিম শর্ট। এখনকার ট্রেন্ড লম্বা কাটের লুজ ফিট পাঞ্জাবি। অভিজাত লুকেরও পাঞ্জাবি পাওয়া যাবে বিভিন্ন ফ্যাশন হাউসে। সিল্ক, মসলিনের মতো দামি কাপড়ে তৈরি এসব পাঞ্জাবিতে অভিজাত ভাব তুলে ধরতে অতিরিক্ত ভ্যালু অ্যাড করতে ব্যবহার করা হয়েছে নানা রকম ম্যাটেরিয়ালের অলংকার।

 

কখন কেমন পাঞ্জাবি

ঈদের সকালে হালকা রঙের পাঞ্জাবি বেশি মানানসই। ঈদের জামাতে বেশি উজ্জ্বল রং বেমানান মনে হবে। হালকা রঙের পাঞ্জাবি সকালের আবহে স্নিগ্ধ ভাব এনে দেবে। ঈদ বিকেলে ও রাতে উজ্জ্বল রঙের পাঞ্জাবি বেছে নিন। কমলা, হালকা সোনালি, হলুদ ও গাঢ় নীল রঙের পাঞ্জাবি পরা যাবে। বিকেলের সূর্যের সোনালি রং কিংবা রাতের আলো-আঁধারি পরিবেশে দারুণ মানিয়ে যাবে এমন পাঞ্জাবি। বেছে নিতে পারেন ম্যাচিং পাঞ্জাবিও। কয়েক বছর ধরেই ট্রেন্ডে রয়েছে ম্যাচিং পোশাক। সব বয়সী সদস্যদের জন্য পাওয়া যাবে একই নকশার পাঞ্জাবি।

 

কোথায় পাবেন, কেমন দাম

বসুন্ধরা সিটি শপিং মল, যমুনা ফিউচার পার্ক, সুবাস্তু আর্কেড, রাপা প্লাজা, পুলিশ প্লাজার মতো বড় বড় মার্কেটের বিভিন্ন ব্র্যান্ডের শোরুমগুলোতে পাওয়া যাবে ঈদের নতুন পাঞ্জাবি। একটু কম দামে ভালো মানের পাঞ্জাবি পাওয়া যাবে নিউমার্কেট, আজিজ সুপার মার্কেট, বেইলি রোড, মিরপুর শাহ আলী মার্কেটসহ ছোট-বড় মার্কেটগুলোতে। মিরপুর, নিউমার্কেট, গুলিস্তান, বায়তুল মোকাররম, বঙ্গবাজারে আলাদা পাঞ্জাবির মার্কেট রয়েছে। ব্র্যান্ডের পাঞ্জাবি পাবেন এক হাজার ৩০০ টাকা থেকে পাঁচ হাজার ৫০০ টাকার মধ্যে। ব্র্যান্ডের বাইরের পাঞ্জাবির দাম পড়বে ৩০০ থেকে এক হাজার টাকার মধ্যে।

 

 

মন্তব্য

সর্বশেষ সংবাদ