ঢাকা, শনিবার ২৯ মার্চ ২০২৫
১৫ চৈত্র ১৪৩১, ২৮ রমজান ১৪৪৬
সার্থক জাদুশিল্পীর রোমাঞ্চকর জীবন

সার্থক জাদুশিল্পীর রোমাঞ্চকর জীবন

  • হাসান হাফিজ
শেয়ার
সার্থক জাদুশিল্পীর রোমাঞ্চকর জীবন

জুয়েল আইচ। বিশ্বনন্দিত জাদুশিল্পী। প্রকৃতই জুয়েল তিনি। বীর মুক্তিযোদ্ধা।

নিবিষ্ট বংশীবাদক, চারুশিল্পী। অসামান্য কথক। শিক্ষকতা পেশা থেকে চলে এলেন ঐন্দ্রজালিক ভুবনে। বিশ্বের দেশে দেশে মাতৃভূমির লাল-সবুজ পতাকা তিনি সগর্বে উড্ডীন করেছেন।
জন্ম পিরোজপুরের সমুদয়কাঠি গ্রামে। স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ঢাকার জগন্নাথ কলেজ (বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়) থেকে। শিশু অধিকার নিয়ে কাজ করেছেন। ইউনিসেফের শুভেচ্ছাদূত।
তাঁর বিখ্যাত জাদুর মধ্যে রয়েছে কাগজ থেকে ডলার বানানো, চোখ বেঁধে গাড়িচালনা, যেকোনো দর্শককে শূন্যে ওড়ানো, ইলেকট্রিক করাতে তরুণীকে দ্বিখণ্ডিত করা ইতাদি। মঞ্চে প্রথম পারফরম্যান্স স্বাধীনতা অর্জনের অব্যবহিত পরে, ১৯৭২ সালে। বিশ্বের প্রায় সব দেশেই জাদু প্রদর্শন করেছেন। ভূষিত হয়েছেন একুশে পদক, যুক্তরাষ্ট্রের সেরা পুরস্কার ‘বেস্ট ম্যাজিশিয়ান অব দ্য ইয়ার’সহ অজস্র সংবর্ধনা, পদক ও সম্মাননায়। তাঁর জীবনটাও ম্যাজিকের মতোই ঘটনা ও বর্ণবহুল।

২৭ জানুয়ারি ২০২৫ কালের কণ্ঠের সম্পাদক ও জাতীয় প্রেস ক্লাবের সভাপতি হাসান হাফিজের সঙ্গে দীর্ঘ আলাপচারিতা হয় তাঁর—উত্তরায়, নিজ বাড়িতে, যে বাড়ির নাম ‘ম্যাজিক ক্যাসল’। সেটি ছিল সুদীর্ঘ ভিডিও সাক্ষাৎকার। কালের কণ্ঠ মাল্টিমিডিয়ায় মোট ১৩টি এপিসোডে সেই চমকপ্রদ চাঞ্চল্যকর তথ্যাদি সংবলিত সাক্ষাৎকার আপলোড করা হয়। দীর্ঘ দুই ঘণ্টা ধরে তিনি নিজেকে উজাড় করে খোলামেলা কথা বলেছেন। জীবনের অন্তিম ইচ্ছা, অপূর্ণ স্বপ্ন, জীবনের পরতে পরতে ছড়ানো রোমাঞ্চ রহস্য, ভয়াবহ-অম্লমধুর অভিজ্ঞতাও বয়ান করেছেন। গ্রন্থনা করেছেন অপর্ণা বর্ষা ও তারতিবা ফারুহী। এখানে সেই সাক্ষাৎকার, বিশদে—

স্বরূপকাঠি থেকে আপনি যে বিশ্বজয়ের পথে গেলেন, এই দীর্ঘ অভিযাত্রাটা কেমন ছিল? এখন কী মনে হয়, কত বছরের সাধনা, কখন শুরু করলেন, কিভাবে স্বপ্নটা বাস্তবে রূপ নিল?

স্বরূপকাঠি এসেছি আমি আরো পরে, এর আগে আমার শৈশব, যেখানে জন্মগ্রহণ করেছি, ওটা ছিল সমুদয়কাঠি। ওখানে ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত পড়ার পর বাবা আমাকে পিরোজপুরে নিয়ে যান। পিরোজপুর গভর্নমেন্ট স্কুল তখন খুবই নামকরা। ওখানে ভর্তি হই, তার পরে কলেজ পর্যন্ত পিরোজপুরে ছিলাম, পরে ঢাকায় পড়তে আসি।

ফ্লাইং কার্পেটে শূন্যে উড়ছেন সংগীতশিল্পী কনা

ফ্লাইং কার্পেটে শূন্যে উড়ছেন সংগীতশিল্পী কনা

জাদুর প্রতি আকৃষ্ট কখন কিভাবে হলেন, সেটা কি স্কুলজীবনেই?

না, তখন কেবল বাড়ি থেকে বাজারে যাওয়ার পারমিশন পেয়েছি। কারণ তখন তো আমাদের পারমিশন দেওয়া হতো না। আমাদের যৌথ পরিবার, বিরাট বাড়ি, এরা খাল পার হয়ে ওপারে যেতে পারবে শুধু। এই পর্যন্ত পারমিশন আছে। তখনো স্কুলে যাইনি। ওই সময় বাজারে গিয়ে দেখি, অনেকগুলো নৌকায় করে একটা বেদের বহর এসেছে। কী করে ওরা?—ম্যাজিক দেখায়, তা দেখার জন্য উদগ্রীব হয়ে গেলাম। আমি একজন বেদেকে সাহস করে আমাদের বাড়িতে নিয়ে এলাম। তখন এক সের চাল দিলে ম্যাজিক দেখায়। তো, তাঁকে নিয়ে এলাম, মাকে গিয়ে বললাম। মা বললেন, ঠিক আছে, বসা ভালো জায়গা দেখে, যেন সবাই দেখতে পায়। আমাদের উঠানে বসালাম। আমাদের বাড়ি ছিল অনেক বড়, অনেকগুলো ঘর, আমলকীগাছের নিচটা ওই ভদ্রলোক বেছে নিলেন।

 

কী ম্যাজিক দেখালেন উনি তখন?

উনি বাটি ও গুটির ম্যাজিক, মানে একটা কাঠের বাটির নিচে একটা কাপড়ের গুটি রেখে দিলেন, আবার ফাঁকা—এটার মধ্যে গুটিটা চলে গেল, আবার সেই গুটিটা খেয়ে ফেললেন, চোখ থেকে বের করলেন, কানে ঢোকালেন, বাঁ হাতে চলে গেল, একটা শালিক চিঁ চিঁ করছে, ঢাকা দিল—নাই হয়ে গেল। মানে এ রকম...ওই বয়সে এটা একটা সাংঘাতিক ঘটনা।

কবি হাসান হাফিজ ও জুয়েল আআচের কথোপকথন

কবি হাসান হাফিজ ও জুয়েল আআচের কথোপকথন

মানে অভিভূত হয়ে গেলেন?

অভিভূত হয়ে গেলাম। আমার মনে হলো, আমি যদি পারতাম...

 

তখন আপনার বয়স কত?

বয়স গুনে বলতে পারব না, কিন্তু স্কুলে যাওয়ার বয়স হয়নি। কেবল আমার বাড়ির বাইরে যাওয়ার পারমিশন হয়েছে, বাড়ির বাইরে যেতে গেলে একটা ছোট্ট সাঁকো, আমাদের বরিশালের ভাষায় চার বলত, গ্রামের ভাষায় হাক্কা বলত। ওই চার পার হওয়ার অধিকারটা হয়েছে, একটা হাতল ধরনের ছিল, ওই হাতল ধরে ধরে ভয়ে ভয়ে পার হতে হতো। ওই প্রথম দেখা, কিন্তু ভুলেও ভাবিনি আমি ম্যাজিশিয়ান হব। কারণ তখন ওই মানুষটির গেঞ্জিটা ছেঁড়া, তারপরে চূড়ান্ত মাত্রার দরিদ্র।

 

বোধ হয় তার নাম মনে নেই আপনার?

নাম জিজ্ঞেস করিনি। গরিব মানুষদের আমাদের সমাজ এখনো ব্যক্তি হিসেবে রিকগনাইজ করে না, মানে নাম জানতে আমরা চাই না। হয়তো সারা জীবন তার সার্ভিস নিয়ে আসছি, কিন্তু কোনো দিন জিজ্ঞেসও করা হয়নি তার নামটা কী, তার পরিচয়টা কী, এটা কিন্তু আমাদের এই ফিউডাল সোসাইটির একটা বৈশিষ্ট্য।

বিপাশাকে ইলেকট্রিক করাতে কেটে ফেলার জাদু

বিপাশাকে ইলেকট্রিক করাতে কেটে ফেলার জাদু

জাদুশিল্প চর্চা করতে গিয়ে আপনার কোনো ভয়াবহ অভিজ্ঞতা হয়েছে কি?

ভয়াবহ একবার না, অনেকবার হয়েছে। যেমন—প্রথম যখন একটি ইলেকট্রিক করাত দিয়ে রিহার্সাল করতে গেছি, গায়ে লেগে গেছে। আমি পাগল হয়ে গেছিলাম। বুঝতেই পারিনি আমার পরিস্থিতি কী? ছুটে গেলাম পিজিতে, তারপর বুঝলাম, তত বেশি কিছু ছিল না। তার পরে এই রকম ঘটনা অসংখ্য। বলে শেষ করা যাবে না।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে একবার আমার শো অর্গানাইজ করা হলো চার দিনের। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক গ্রুপ আছে।  যে গ্রুপটা আমাদের নিয়ে গেছে তাদের কাউন্টার গ্রুপটা...

 

বাধা দিতে চেয়েছে?

না, বাধা না। প্রথম শোর পরে ওরা যখন বুঝল, সাংঘাতিক জিনিস তো! দ্বিতীয় দিন ঠেসে লোক ঢুকেছে। তারপর ওরা এসে বলছে, আমাদের ঢুকতে দিতে হবে। কিন্তু এরা বলছে, যার যার টিকিট আছে, তারা ঢুকতে পারবে। আমাদের টিকিট সোল্ড আউট। তারপর তৃতীয় দিন আবার তারা এসেছে। বলে, টিকিট কই? ওরা বলে, আমাদের টিকিট লাগে না। এরা বলে, টিকিট না থাকলে আমরা ঢুকতে দিই না। দুই দলের সংঘর্ষ। ফোর্থ ডেতে ওরা টাকা নিয়ে গেছে। টিকেট কেনার জন্য তখন বিরাট লম্বা লাইন। কিন্তু ওদের সময় আসতে আসতে টিকিট শেষ। তখন ওরা ঢুকবেই, বলে—টাকা নাও আর ঢুকতে দাও। তখন এই বদমাইশরা রেডি হয়ে এসেছে, আর কথা বলতে বলতে পেটের মধ্যে চাকু ঢুকিয়ে দিয়েছে। যাকে ঢুকিয়ে দিয়েছে, সে এসেছিল এটা মিটমাট করতে। হি ওয়াজ দ্য লিডার। সে খুব পপুলার। সে নিচে পড়ে গেল। হলের ভেতরে আমরা এর কিছুই জানি না। সময়মতো আমরা শো শুরু করে দিয়েছি। ওমা! দেখি ওরা অডিটরিয়ামে আগুন লাগিয়ে দিল। পরে দেখি, শো যারা অর্গানাইজ করেছে, তারা যেসব হলে থাকে, সব হলে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে! তারা আগে থেকেই প্ল্যান করে এসেছিল, শুধু একটা ছুতা খুঁজে বের করল। ভয়াবহ একটা অভিজ্ঞতা।

 

এমন কি হয়েছে কখনো, শো করতে গিয়ে অডিয়েন্সের মধ্য দিয়ে স্মরণীয় কোনো ঘটনা, যেটা আপনাকে তাড়িয়ে বেড়ায়?

না, ও রকম নাই। কিন্তু আমি নিজে বিপদ ভেবেছিলাম, ঘটনা হয়েছিল বিপরীত। আমার একটা ম্যাজিক আছে, আমি দর্শকদের মধ্য থেকে কাউকে ডাকি। দেখা গেল, এক মোটা হুজুর থপথপ করে আসছে আর সমস্ত দর্শক হৈচৈ করে উঠেছে। আমি ভেবেছি, সেই হুজুর হয়তো বা সবার চেনা হবে। ম্যাজিকটা ছিল একটা ফ্লায়িং কার্পেটের। একটা কার্পেটের ওপর শুইয়ে দেওয়া হবে এবং সেটা দর্শককে নিয়ে শূন্যে ভাসবে। সেটা যে শূন্যে ভাসবে, এটা প্রমাণ করার জন্য একটা হুপ (বড় আকারের রিং) পাস করে দেওয়া হবে। দর্শককে ডেকে এনে শূন্যে ওড়ানো, এটা কিন্তু পৃথিবীতে এর আগে কেউ করেনি। আমি ভয় পেয়ে গেলাম, এই লোক যে ওপরে উঠছে, আমার হুপ তো এত বড় না। এ তো বিশাল ডাইনোসর। যা হোক, তাকে শোয়ানো হলো। সে হাতে তসবিহ নিয়ে কী যেন বিড়বিড় করে পড়তে থাকল। আমি যখন ফ্লায়িং কার্পেটে তাকে ওপরে ওঠানো শুরু করলাম, সে তখন যেটা আস্তে আস্তে পড়ছিল, সেটা জোরে জোরে পড়া শুরু করল। সে ভাবল, জোরে জোরে পড়ে শূন্যে ওড়ানো ঠেকিয়ে দেবে। সে আসছিল আমাকে ডাউন করার জন্য। সে যখন ওপরে ওঠা শুরু করল, তখন দর্শকরা এক ধরনের পাগলের মতো করতে থাকল। আমি এ রকম দেখেছি আমেরিকায়।

আমি আমেরিকার এমআইটিতে শো করতে গেছিলাম। সে আরেক কাহিনি। ঠিক যেন এমআইটিতে দর্শকের যেমন জোয়ার দেখেছি, বাংলাদেশেও সে রকম। এর মধ্যে ভেবেছি, ওকে আবার নামিয়ে দেব। রিং আর পাস করব না, কারণ এত বড় রিং নেই। আমাদের তো রুটিন করা থাকে। এক্সাক্ট মিউজিকের সঙ্গে পারফেক্ট রুটিন করা। আমাদের পারফেকশন খুব ইমপর্ট্যান্ট। যার রিং নিয়ে আসার কথা, সে ঠিক সময় রিং নিয়ে এসেছে, সে এসে রিং দেবে এবং আমি হাত পাতব আর রিং ধরব, ধরে দর্শকদের দেখিয়ে দেব। পায়ের দিক থেকে ঢুকিয়ে মাথার দিক দিয়ে বের করব। দর্শক আবার চিৎকার করবে। এখন হুপ তো দিয়েছে আমার হাতে, কিন্তু আমি কী করব। এটা হবে কি? তারপর তার পায়ের দিক থেকে ঢোকাচ্ছি, বাঁকা না হয়, কারণ বাঁকা হলে তো স্পেস কমে যাবে। আমি রিংটা বাঁকা না করে তার বডিটা হিসাব করছি—হিপ কোন বরাবর আছে, পেট কোন বরাবর আছে। ওই বরাবর আমি ঢেউ দিয়ে দিয়ে রিং নিয়ে আসছি আর মাথা থেকে পা দিয়ে রিংটা বের করে আনলাম। তারপর লোকজনের কী চিৎকার! আর আমিও খুশিতে আটখানা। ওদিকে ওই লোকও ভয় পেয়ে চিৎকার করতে থাকে। যত ওপরে ওঠে, তত জোরে চিৎকার করে। যখন নামালাম, তখন লোকটা নেমেই আমাকে জড়িয়ে ধরেছে। আমি ভাবলাম, জড়িয়ে ধরাটা কেন? সে আউট অফ রেসপেক্ট আমাকে জড়িয়ে ধরল। কী যেন বলল, কিন্তু এত মানুষের আওয়াজে তার কথা শুনিনি। সে তার গাল আমার গালের সঙ্গে মিশিয়ে দিয়ে তারপর নিচে চলে গেছে। কত যে বিচিত্র অভিজ্ঞতা!

 

আপনি তো একজন মুক্তিযোদ্ধা। যুদ্ধের অভিজ্ঞতা যদি বলতেন?

যুদ্ধের সিনেমা দেখে আর গল্প পড়ে, কবিতা পড়ে কিচ্ছু বোঝা যাবে না রিয়াল যুদ্ধ কত ভয়ানক জিনিস, মানে রাতে ঘুমানোর জায়গা নাই, নারকেলগাছের শিকড়ে...

 

খাওয়াদাওয়ার ঠিক নাই কোনো?

খাওয়াদাওয়া বলতে গেলে অনেক কিছু—পানি খেতে পারি না, কারণ খালের পানি। আমাদের ওই দিকে ঘোলা, তার মধ্য থেকে যেত পচা লাশ, শকুন নাড়িভুঁড়ি টেনে বের করত। তা থেকে দুর্গন্ধ চারদিকে ছড়িয়ে যেত। খাবারের মধ্যে বেশির ভাগ সময় ছিল এ রকম—কলাগাছের থোড়—ওই সময়ের জন্য পেটটা একটু ভরত। কিন্তু ওর মধ্যে তো অসুখবিসুখ লেগেই থাকত। আমার পায়ে গ্যাংগ্রিন হয়ে গেছিল, তাই নিয়ে কাদার মধ্যে ছুটতে হয়েছে। ওদের হাতে মেশিনগান আর আমার হাতে রাইফেল। আমার নেই কোনো ট্রেনিং, শুধু আছে অদম্য সাহস—করবই করব, আর না হয় মরব। শেষ পর্যন্ত লড়ে যাব—এটা ছিল আমাদের দুঃসাহসিক অঙ্গীকার। শেষ পর্যন্ত আমরা ছিলাম পেয়ারাবাগানে। তিনটা থানা নিয়ে পেয়ারাবাগান—      স্বরূপকাঠি, বানারীপাড়া আর ঝালকাঠি। এখানে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের কেন্দ্র ছিল বিরাট।

 

হ্যাঁ, পেয়ারাবাগান নিয়ে গানও হয়েছে অনেক...

হ্যাঁ, অনেক বইতেও লেখা হয়েছে। আমরা লঞ্চ ডুবিয়ে দিয়ে জ্যান্ত চারটা পাকিস্তানি আর্মি ধরে ফেলেছিলাম। তারপর আমাদের প্রতি গ্রামবাসীর এসে গেল বিশ্বাস, আর ওদের আমাদের প্রতি ক্রোধ আরো বাড়ল। শেষ পর্যন্ত আমরা ওখানে টিকতে পারলাম না। কারণ সেখানে ছিল ছারছীনার পীর ও পীরের মুরিদ, মাদরাসার ছাত্র এবং তাদের আত্মীয়-স্বজন। সবার হাতে দা দিয়ে পাঠিয়ে দিল পেয়ারাবাগান পরিষ্কার করার জন্য, পেছনে তো আর্মি আছে। আর্মির সঙ্গে চারদিকে ওই গানবোট আর কত রকম যে আলো—রাতের বেলা দিন বানিয়ে ফেলে এই রকম আলো...

 

ভয়াবহ! বাঁচলেন কিভাবে?

তখন আমার বাঁ পায়ে গ্যাংগ্রিন হয়ে গিয়েছিল। খোঁড়াতে খোঁড়াতে ওইখানে টিকতে পারলাম না।  চলে গেলাম আমাদের পাশের গ্রাম শেহাঙ্গলে—ওই গ্রামটা খুব সমৃদ্ধ এবং মানুষজন খুব ভালো। ওইখানে খলিল হাজরা নামে এক ভদ্রলোকের সঙ্গে আমার দেখা হলো, উনি কলকাতা গিয়েছিলেন। এনায়েত হোসেন খান ছিলেন এমএনএ, মেম্বার অব ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি। উনি তাঁর অ্যাসিস্ট্যান্ট। এনায়েত হোসেন খান সাহেবের বাড়ি হচ্ছে শেহাঙ্গল। উনি পাঠিয়েছেন—মুক্তিযুদ্ধে জয়েন করতে চায় যেসব ছেলেরা, তাদের নিয়ে এসো। প্রথম দিকে কিন্তু সবাই ভয় পেত। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে জোয়ারের মতো ছেলেরা যে জয়েন করল, সেটা অনেক পরে।

 

দ্বিধাও ছিল অনেক, সংশয় ছিল?

হ্যাঁ, অনেক সংশয় ছিল। আমি ওখানে গেলাম জঙ্গলের পথ ধরে নানাভাবে—হেঁটে হেঁটে এক পা খোঁড়াতে খোঁড়াতে। ওপরে বৃষ্টি, নিচে কাদা—এইভাবে করে অনিশ্চিত জীবন—থাকার ব্যবস্থা নেই, খাওয়ার ব্যবস্থা নেই। অমানুষিক একটা ব্যাপার। কারণ এত দিনে অলরেডি আমরা কুপোকাত হয়ে গেছি। মানে শরীরের হাড়হাড্ডি বেরিয়ে গেছে। হিসাব করে দেখেছি, সাড়ে তিন শ মাইল হেঁটে হেঁটে ঝালকাঠি পুরো জেলা—পিরোজপুর শহরের রাস্তা ধরে না গিয়ে দুর্গম পথ, জঙ্গল, কাদা, পানি, নদী—এগুলো পেরিয়ে বাগেরহাটের পরে খুলনা, সাতক্ষীরা পার হয়ে এক নদীর কাছাকাছি গেলাম। লোকদের কাছে জানলাম, থানাটার কাছে বাংকার করে আর্মি আছে। আমরা একটু দূর দিয়ে হেঁটে যাই, যাতে ওদের চোখে না পড়ি। নদীতে লাফ দিলাম ঠিকই, অনেক স্রোতের মধ্যে পানি খেতে খেতে প্রায় আধামরা অবস্থায় কোনোভাবে ওপারের কাছাকাছি যখন গেছি, তখন দেখি অনেকগুলো টর্চ আমাদের ওপর পড়ছে।

 

রাতের বেলা?

হ্যাঁ, রাতের বেলা। আমরা নিশ্চিত না, এটা কি বাংলাদেশ মানে পূর্ব পাকিস্তান, নাকি ওয়েস্ট বেঙ্গল। উনি আমাকে কথা বলতে নিষেধ করেছেন। উনি কথা বলে বুঝতে পারেন, ওরা ওই দিকের লোক, হিঙ্গলগঞ্জ জায়গাটার নাম। স্থানীয়রা বললেন, আপনারা চলে যান হাসনাবাদ। ওইখান থেকে হাসনাবাদ গেলাম। হাসনাবাদ গিয়ে লঞ্চে রইলাম দুই দিন। তারপর আমাদের রিক্রুট করতে এলো বিহার থেকে। আমার একটা পা ফোলা, আমি এক পায়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে অনেক লম্বা লাইনের যখন কাছাকাছি গেছি, তখন ওই আর্মির মধ্যে একজন সিনিয়র বললেন, তোমরা কি পাগল, না মাথা খারাপ? এই ছেলেটা এক পা দিয়ে খোঁড়াতে খোঁড়াতে যাবে ট্রেনিং করতে! ওকে যুদ্ধ পাঠাবে! তার এই পা-টা রাখতে হবে না, তাকে আগে সুস্থ হতে হবে। ওই ভদ্রলোক আমাকে কাছে ডাকলেন। ‘ওমা, ওর তো জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে, ওকে এখনই হসপিটালে পাঠিয়ে দাও।’ আর্মির একটা পুরনো জিপে করে পাঠিয়ে দিলেন হাসপাতালে। সেখানে আমার ওই পা-টা কেটে ফেলার ডিসিশন হলো। একজন ইয়াং ডক্টর আমাকে বাঁচিয়ে দিলেন। তিনি আমাকে ওই হসপিটাল থেকে বের করে এনে বললেন, আপনার এই পা কাটতে হবে না। এই ফার্মেসিটায় বসেন, আপনার জন্য যা যা লাগে আমি নিয়ে আসব। অ্যান্ড দ্যাট ইয়াং ডক্টর সেইভড মাই লাইফ। হ্যাঁ, খুব পাওয়ারফুল অ্যান্টিবায়োটিক আর কী কী ওষুধ দিয়ে আমাকে হাঁটার মতো অবস্থা করেছেন।

 

পরে আপনি ট্রেনিং নিলেন?

হ্যাঁ, তার পরে আবার যখন গেলাম, আমার কথাবার্তায় ওই ডাক্তার বললেন, আরে, আপনার ইন্টেলেকচুয়াল লেভেল তো ভালো, আপনি অনেক পড়াশোনা করেন, তাই না? আমি বলি, একটু পড়াশোনা তো করতেই হয়। তিনি বললেন, আপনি এই পা নিয়ে এখনই যুদ্ধের মাঠে যেতে পারবেন না। কারণ আপনার আপাতত পা-টা ঠিক আছে, কিন্তু আরো সময় লাগবে ভালো হতে। তিনি আমাকে পাঠিয়ে দিলেন বালিগঞ্জের একটা আমেরিকান ইনস্টিটিউটে। সেখানে তাঁরা স্কুল খুলেছেন বড় ক্যাম্পগুলোতে। ওখান থেকে বাহাদুরপুর ক্যাম্পে আমাকে শিক্ষক বানিয়ে পাঠিয়ে দিলেন। গিয়ে দেখি, যে বাচ্চাদের পড়াব তাদের গায়ে কাপড় নাই। এমন বাচ্চাও আছে, যার বাবা নাই, মা নাই, ভাই নাই, বোন নাই; মেরে শেষ করে দিয়েছে। ও কী পড়বে? তারপর অন্য টিচাররা বললেন, আপনি আসছেন, কিন্তু কাদের পড়াবেন? ওরা তো ডাকলেও আসে না। তখন আমি বললাম, আচ্ছা ঠিক আছে। আমি ওদের কয়েকজনকে ডেকে বললাম, ম্যাজিক দেখবে? আমি কিছু ম্যাজিক দেখালাম। ওই ম্যাজিক মন্ত্রের মতো কাজ করল। বললাম, কালকে তোমাদের বন্ধুদের ডেকে নিয়ে আসবে, আমি ম্যাজিক দেখাব এবং সবার আগে যে লাইনে থাকবে, তার জন্য কিছু লজেন্স নিয়ে আসব। চাইলে সে একা খেতে পারবে, আর যদি সে অন্যদের দিয়ে খেতে চায়, সেটা সবার আগে যে থাকবে সে তাদেরকে দেবে। ওই সময় আমার নিজেরই কিছু নাই, আমার পকেট ফুটো। ওইভাবে করে দ্বিতীয় দিন দেখি বিশাল লাইন, এত বাচ্চা...বসতে দেওয়ার মতো এত তাঁবু আমাদের ছিল না। পরে অবশ্য ওইটা দেখে আমাদের এক্সট্রা তাঁবুর ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। ওরা মাটিতেই বসত। আমি তো শিক্ষকতার নেশায়ই পড়ে, গিয়েছিলাম। যে বাচ্চাদের মুখের দিকে তাকানো যায় না, আমি তাদের স্টোরি শুনতাম, আবার প্রতিদিন ওদের ইন্সপায়ার করার জন্যই যেসব গল্প বলা দরকার, তা বলতাম। তখন ভিয়েতনাম সাত বছরের বেশি যুদ্ধ করছে, আমাদের কত বছর লাগবে, আমরা তা জানি না। আমরা ৯ মাস কিছুতেই আশা করিনি। এই ছেলেমেয়েগুলো তো ডিরেইলড হয়ে যেতে পারে। কারণ পেটে যদি কিছু না পড়ে, তাহলে কী করে তারা ভালো থাকবে? আমি ওদের নানাভাবে ইন্সপিরেশনাল গল্প বলি, ওই গল্প ওদের চাঙ্গা করত। ওই সময় এমন অবস্থা হয়ে গেল, হ্যামিলনের বংশীবাদকের মতো হয়ে গেলাম। বিকেলে লালগোলা লাইনের কয়লার ট্রেন যখন আসত, আমি তাতে উঠতাম এবং যতক্ষণ না ট্রেনটা ওদের দৃষ্টির বাইরে যেত, সে পর্যন্ত ওরা ওখানে দাঁড়িয়ে থাকত।

 

স্ট্রেঞ্জার দ্যান ফিকশন আসলে?

হ্যাঁ, আমি শিক্ষকতার এতে প্রেমে পড়ে গেলাম। আবার এদিকে নিজের সঙ্গে নিজের যুদ্ধ লাগে। রণাঙ্গনের যুদ্ধের তুলনায় এটা তো তুচ্ছ । আমি একি করছি! এটা তো অনেক অনেক ইজিয়ার। গল্প করছি, ফান করছি, নানা রকম কৌতুক করছি। আর যুদ্ধের মাঠ কী ভয়াবহ জিনিস—সশস্ত্র যুদ্ধ। তখন আমি আবার ওইখান থেকে টাকি ক্যাম্পে চলে গেলাম।

 

আনকনভেনশনাল টিচার আর কি?

অ্যাবসল্যুটলি। আমি শিক্ষকতার প্রেমে পড়ে গেলাম। পুরনো বইয়ের দোকান ছিল তখন সদরঘাটে বাংলাবাজারে ঢোকার পথে, এক লাইনে পুরো বইয়ের দোকান ছিল। আমি তখন ঢাকায় এসে ওইখান থেকে খুঁজে খুঁজে পুরনো বই, মানে টিচিংয়ের বিভিন্ন পদ্ধতি, এই বইগুলো জোগাড় করে করে ওখান থেকে নিজেকে তৈরি করলাম। টিচিংয়ের বিভিন্ন বই রাত জেগে জেগে পড়তাম। নোট করতাম।

 

সেলফ মেড ম্যান!

সেলফ মেড ম্যান। বইগুলো আমি রাত জেগে জেগে পড়তাম, সেইগুলোর ক্লাস নিতাম। কারণ আমি একটা জিনিস বুঝে গেছিলাম। যদি ক্লাসটা এন্টারটেইনিং না হয় তাহলে ছাত্ররা শিখবে না। ওই ৪৫ মিনিটের ক্লাসটা আমি ৪০ মিনিট হিসাব করে বের করলাম। আমার মনের ঘোর বলে দিত যে তোমার সময় কিন্তু শেষ। কারণ ওদের যে পাঁচটা মিনিট লেইজার দিতাম, এইটাও ওদের জন্য একটা গিফট হতো। আর আমি ক্লাসে গিয়েই তো হুমদুম একটা বেত হাতে নিয়ে, একদম না। বিশ্বাস করবেন না, আমি কাউকে কোনো দিন মারিনি, চড় দিইনি, গাল দিইনি। কিন্তু চোখের পলক ফেলত না স্টুডেন্টরা।

 

মানে আপনি জনপ্রিয় শিক্ষক ছিলেন?

আই ওয়াজ দ্য ইয়াঙ্গেস্ট টিচার। আমাকে কিছুদিনের মধ্যে অ্যাসিস্ট্যান্ট হেডমাস্টার হতে হলো। আচ্ছা, ঠিক আছে সে পর্যন্ত, ওমা! বছর না যেতে ম্যানেজিং কমিটি এসে বলল, স্যার, আপনাকে পুরো দায়িত্ব নিতে হবে। এটা সমুদয়কাঠি হাই স্কুল। ওইখানে বাধ্য হলাম হেড মাস্টারের দায়িত্ব নিতে।

 

কম বয়সেই তাহলে হেডমাস্টার হলেন?

খুব। আমার নিজের কাছেই খুব লজ্জা লাগত। কারণ আমার বয়সী শিক্ষক একজনও ছিল না। আর আমি এখানে হেডমাস্টার! সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, আমাদের বোর্ড ছিল যশোর বোর্ড। আমাদের ডিডিপিও বসতেন বরিশালে। ওই অফিসের সবাই আমাকে খুব সম্মান করত। মানে আমার কাজ সবার আগে। শুনতাম, টেবিলের নিচ দিয়ে পয়সা না দিলে ফাইল সরে না। আর আমি যেদিনেরটা সেদিন করে আসতে পারতাম। এটা আমার যশোর বোর্ডেও হয়েছে, বরিশালেও হয়েছে।

 

আপনি কেমন বাংলাদেশ দেখতে চান আসলে? মুক্তিযুদ্ধ করেছেন, অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছেন দেশের জন্য, হোয়াট ইজ ইওর ড্রিম? মানে স্বপ্নের বাংলাদেশটা আপনার কেমন?

খুব স্বাভাবিক। মানে সমস্ত মানুষের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, পড়াশোনার সুবিধা। এটা শুধু আমার একার থাকবে তা না, সবার থাকবে। কোনো মানুষ ক্ষুধার্ত থাকবে না। এটা আমার ড্রিম; এবং আমরা আরো ডিসিপ্লিনড হব, আরো শিক্ষিত হব, বিজ্ঞানমনস্ক হব। শিক্ষিত না হলে তো ডিসিপ্লিন শেখা যায় না। যে পর্যন্ত না আমি আমার জাতিকে ডিসিপ্লিনড করতে পারব, ততক্ষণ পর্যন্ত আমার মুক্তি নেই।

 

আপনার স্বপ্নের সঙ্গে বাস্তবতার ফারাকটা কতখানি?

অনেকখানি।

 

হাউ টু ওভারকাম?

আমার মতো এ রকম হাজার হাজার লাখ লাখ পাগল দরকার। অনেকে করছে হয়তো, তাদের নাম আমাদের সামনে আসছে না। কাজ চলছে না এমন না।

 

জীবনের সবচেয়ে বড় অর্জন কোনটা?

মানুষের নিখাদ ভালোবাসা। আমি যখন ইলেকট্রিক করাত দিয়ে মানুষ কাটার ম্যাজিকটা দেখাই, একরাতে শো-য়ের পরে এক ভদ্রমহিলা তাঁর পুরো ফ্যামিলি নিয়ে আসছেন, বলছেন—‘বাবা, এই ম্যাজিকটা আর করবেন না।’

 

করাত দিয়ে কাটার ম্যাজিকটা?

হ্যাঁ, তিনি আমার কাছ থেকে কথা আদায় করে নিলেন। তারপর আর দেখাই না। উনি আমাকে কনভিন্স করে ছাড়লেন। ওই সময় ঢাকা শহরে দুইটা কি তিনটা অডিটরিয়াম ছিল। একটা ছিল লালকুঠি মিলনায়তন। ওটা ছোট ছিল। আর দুইটা বড়। একটা ছিল ওয়াপদা অডিটরিয়াম, আরেকটা ছিল ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন।

 

নাটক হতো?

হ্যাঁ হ্যাঁ। ওইটা ছিল সবচেয়ে বড়, তখন মধুমিতা সিনেমা হল ছিল তার পাশেই। ওইটা যারা অর্গানাইজ করত, তারা এত দূরে আসতে চাইত না। এইটা শহর থেকে বেশ দূরে। ওইখানে একদিন শো-র পরে একজন সহকারী এসে বলল, আপনার সঙ্গে কথা বলা যাবে? একটা মেয়ে ওই পাশে দাঁড়িয়ে আছে। আমি বললাম, দাঁড়িয়ে থাকতে বলো, আমি একটু ফ্রেশ হয়ে আসি। তারপর ফ্রেশ হয়ে এলাম। ততক্ষণে অডিয়েন্স সব চলে গেছে। মেয়েটা তখনো ওখানে দাঁড়ানো। মেয়েটি আমাকে বলে, উনাকেও চলে যেতে বলেন। আমি বললাম, তুমি যাও। এবার মেয়েটি বলল, তিন দিন ধরে দেখছি আপনি একটি মেয়েকে ভ্যানিশ করে আবার ফেরত নিয়ে আসেন। আচ্ছা, এমন জাদু কি করা যায়, একজনকে আপনি ভ্যানিশ করে দেবেন, তারপর সে আর কোনো দিনও ফিরে আসতে পারবে না? আমি জিজ্ঞেস করলাম, কাকে ভ্যানিশ করতে হবে? সে গলাটা একটু লম্বা করে আমার দিকে কানে কানে বলল, ‘আমার শাশুড়িকে।’ হা হা হা। মানে চিন্তা করেন, ওই মেয়েটার জীবনটা ভাজা ভাজা করে ছেড়েছে!

 

এটা কত সালে করেছিলেন?

এটা ছিল বোধ হয় ১৯৮০ সাল।

 

এ রকম আবার নতুন করে শো করতে পারেন, সে রকম কোনো চিন্তা আছে কি?

গত বছর একটা টেলিভিশনে, আমার বন্ধুর টেলিভিশন, সে যখন রিকোয়েস্ট করল, আমি তখন গেলাম। আমি তো আমার পুরোটা দিয়ে করি। আমি যখন করি, তখন বিন্দুমাত্র কার্পণ্য করি না।

 

এগুলো তো প্রিজার্ভ করা দরকার। জেনারেশনের কাছে এগুলো ধরে রাখার জন্য, পৌঁছে দেওয়ার জন্য...এই পরম্পরা তো লাগবে।

গত ঈদের আগেই হলো। এই শিশু একাডেমিতে রেকর্ডিং হবে। সবার আগে গিয়ে আমি হাজির। তাদের বারবার বললাম, আর কিছু যদি না পারেন, তাহলে স্ট্রেইট সামনের ক্যামেরাটা দিয়ে ধরে রাখবেন, কাট করবেন না। দেখি, অনেকগুলো ক্যামেরা আছে। প্রোগ্রাম যখন করলাম, তখন দর্শক পাগল হয়ে গেল। তারপর শো শেষে যখন বের হলাম, তখন দু-তিনটা টেলিভিশনের ক্যামেরা। তারা ইন্টারভিউ নেওয়ার জন্য স্ট্যান্ডের ওপরে, ট্রাইপডের ওপরে ক্যামেরা নিয়ে বারান্দায় অপেক্ষা করতে লাগল। আমি যখন বের হলাম, সবাই আমাকে ঘিরে ধরল। বারান্দা ভর্তি মানুষ। আমি তাদের সঙ্গে কথা বললাম। এক ভদ্রমহিলা বোধ হয় কোনো ইউনিভার্সিটির শিক্ষক অথবা বড় কোনো লেখক-কবিও হতে পারেন। উনি আমার কাছে এলেন। যে ম্যাজিকটা করেছিলাম...মান্না দের একটা গান আছে, ‘স্বপন যদি মধুর এমন, হোক না মিছে কল্পনা। জাগিয়ো না আমায় জাগিয়ো না।’ ওই ভদ্রমহিলা বললেন, আমি সেই থেকে কেঁদে যাচ্ছি এখনো। ম্যাজিক দিয়ে যে এ রকম করা যায়, এটা আমি কখনো কল্পনা করিনি। বলতে বলতে টপটপ করে চোখ দিয়ে পানি বের হলো। যেহেতু ভদ্রমহিলা আমার পূর্বপরিচিত না, পূর্বপরিচিত হলে হয়তো আমি তাঁকে হাগ করতাম, পানিটা মুছে দিতাম। যা হোক, আমি তাঁকে থ্যাংক ইউ বলে চলে এলাম। আমি তো খুব খুশি যে এবার দর্শক খুব একটা ভালো জিনিস পাবে। কারণ ওই শো-র সময়ই স্ট্যান্ডিং ওভেশন। মানুষ বসে না। দাঁড়িয়েই স্ট্যান্ডিং ওভেশন চলতে লাগল। আমাদের এখানে তো আর্টিফিশিয়ালি হাততালি দিয়ে শেষে জুড়ে দেওয়া হয়।  প্রথম দিকে চিৎকার দিয়ে উঠেছে আর বসেছে। পরে দেখি, কেউ আর বসছে না। পরের দিন তাড়াতাড়ি গিয়ে এডিটিং রুমে এডিটর আসার আগে আমি গিয়ে বসে আছি। তারপর এডিটর এলেন, বললাম...আমাকে একটু দেখান। দেখি কী এসেছে!

দেখি কি! ঠিক যেখানে থাকা উচিত নয়, ক্যামেরাম্যান সেখানে ক্যামেরা ধরে আছে। আর মাঝে মাঝে এমন বিশ্রী অ্যাঙ্গল, যেখান থেকে কিছু বোঝা যায় না। চূড়ান্ত আনাড়ি। ম্যাজিকটা ছিল একটা গোলাপ ফুলের টব। আমি টেবিলের ওপরে রাখলাম। একটা ধারালো ছুরি নিলাম। পাশে একটা লাইট গোলাপ ফুলের ওপরে পড়ল। সেই শ্যাডোটা গিয়ে পড়ল লম্বা একটা শিট কাগজের ওপর। আমি ওই শিটের কাগজে ওই ফুলের ডাঁটার ছায়ার ওপর ছুরি দিয়ে যখন পোঁচ দিলাম, শ্যাডোর সঙ্গে সঙ্গে আসল ডাঁটাটা আস্তে করে কেটে টুক করে পড়ে গেল। দেখা গেল, ওইটা যে পড়ল, সঙ্গে সঙ্গে অরিজিনাল ডাঁটাটাও পড়ে গেল। এটা একটা অবিশ্বাস্য ব্যাপার। সঙ্গে মান্না দের গান চলছে।

তারপর দ্বিতীয়টাও কাটছি। সেটা আস্তে আস্তে কাটছি এবং ওটা একটু একটু করে রসিয়ে রসিয়ে ঝুলে, তারপর পড়ে গেল। আর লোকজন চিৎকার দিয়ে দাঁড়িয়ে গেল। পরে ফুলের ছায়ার পাপড়িগুলো একটা একটা করে কাটছি, পড়ছে পড়ছে পড়ছে এবং সব শেষে পুরোটা যখন হয়ে গেল, আমি খুশি হয়ে দর্শকদের দিকে তাকিয়েছি। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত, ওই ধারালো ছুরি আমার হাতে লেগে কেটে গেছে। তখন আমি হাত ঝাঁকি দিয়ে ধরে আছি। তারপর রক্তের শ্যাডোটাও গিয়ে পড়েছে ওই স্ক্রিনের গায়ে। এরপর আমি ওই রক্ত দিয়ে দুই টানে হার্ট আঁকলাম। পাশে লিখলাম ‘ট’। আর বাঁয়ে ‘ও’ লিখে রক্ত দিয়ে লিখে গেলাম ‘আই লাভ ইউ’। আমার হাতে তখন টকটকে লাল রক্ত।

 

আপনার নিজের উদ্ভাবিত ম্যাজিকের সংখ্যা কত?

তার কোনো কূল-কিনারা নেই। আমি যত ম্যাজিক করি, মেজর ম্যাজিকই আমার নিজের আবিষ্কার।

 

আপনার নিজের প্রিয় সবচেয়ে কোনটা?

আমার সবচেয়ে প্রিয় হয় যেটা দর্শক ভালোবাসেন। ‘ঝোড়ো আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ’, ‘পাতাঝরা শীতের শেষে বসন্তের হাসি’—এ রকম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত গিয়ে একটা ম্যাজিক আমার বেশি প্রিয়, সেটা হলো একটা মানুষ যখন শূন্যে ভাসে, তখন ওইটা আর ব্যাখ্যা করার কিছু থাকে না।

 

আপনার জীবনের অন্তিম আকাঙ্ক্ষা কী?

এটা তো গ্যারান্টেড যে আমরা মরে যাব। আমার একটা অন্তিম আকাঙ্ক্ষা বহুদিন আগে থেকে ছিল। সেটা হলো, আমরা প্রতিনিয়ত সকালে ঘুম থেকে উঠে দাঁত মাজি, খাই, কাপড় পরি। আবার রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগ পর্যন্ত যত মানুষের অবদান আছে এটার পেছনে—সে কে, কালো না সাদা আমরা জানি না! শুধু যারা আমার সামনে আসতে পারছে, তাদের আনন্দ দিয়ে আনন্দিত হলাম—তাতে তো আমার ঋণ শোধ হবে না। আমি আমার ইচ্ছাটা প্রকাশ করলাম ছায়ানটের সন্জীদা আপার কাছে। উনি বললেন, বেশ ভালো আইডিয়া তো! তখন আমরা একটা সংগঠন করলাম, ‘মরণোত্তর দেহদাতা সমিতি’। রেজিস্ট্রি করলাম নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে, যাতে আমরা মরে গেলে পরে আমাদের শরীরটা...

 

কতজনে সাড়া দিয়েছে?

অনেক সাড়া পেয়েছিলাম। কিন্তু পরে আপা বললেন, না, এই সোসাইটিতে ওই রকম লোক প্রচুর আছে। ফ্যামিলি অ্যালাউ করে না। পারমিশন দেয় না শেষ পর্যন্ত। আমি তো একজন তাজা মানুষ। আমার মনে হচ্ছে, আমি যদি এই অবস্থায় সব দিতে পারি, তাহলে এটা অনেক লোকের কাজে আসবে। আমি যখন মরে গেলাম, তখন কেটে ফেলে দেওয়া নখটা কাউকে দিয়ে দিলাম। এটা দান নয়।

 

আপনি জীবিত অবস্থায় দিতে চান?

আমি জীবিত অবস্থায় দিতে চাই।

 

খুব সুন্দর আইডিয়া এটা!

আমার এক বন্ধু ব্যারিস্টার। তার সঙ্গে আলাপ করলাম। সে বলল, না না, কোনো আইনে তুমি এটা পারবে না। তারপর আমি বাড়িতে এসে বললাম, যদি না দেয় তাহলে অন্য কোথাও দিয়ে আসব। আবার আমার মনে হলো, আরে! সবচেয়ে বেশি অবদান তো আমার এ দেশের মানুষের। সবচেয়ে ভালোবাসা, একদম তীব্র ভালোবাসা আমি এখান থেকে পেয়েছি। আমি যুদ্ধ করেছি এখানের জন্য। আমার এখানে দিতে হবে। ঋণটা এখানে। আমি মামলা করব ঠিক করলাম এই আইনের বিরুদ্ধে। কয়েকজন লইয়ারের সঙ্গে আলাপ করলাম। তারা সবাই আমার পক্ষে দাঁড়াবে। হঠাৎ আমার মনে হলো, এই সিদ্ধান্তের কথা আমার মেয়েকে এবং আমার স্ত্রীকে জানানো দরকার। শোনার পর তারা আমাকে মারতে বাকি রেখেছে। ওরা বলে, ওই শরীর কি তোমার একার?

 

আপনি তো একসময় বাঁশি বাজাতেন, শিক্ষকতাও করেছেন, এগুলোকে কি মিস করেন? কী মনে হয় মাঝেমধ্যে?

মিস করি মানে কি! বাঁশি তো আমার কাছেই থাকে, আমার মন যদি খারাপ হয়, আমি তো হাউমাউ করে কাঁদব না। বাঁশিটা নিয়ে একটা রাগ বাজাই। শিক্ষকতা! শিক্ষকতা মিস করি মানে কি? আমার এখনো মনে হয়, আমি এসেছিলাম কেন এত সিরিয়াসলি ম্যাজিকে জানেন? স্বাধীনতার পর প্রথম পাকিস্তানের হকি টিম যখন বাংলাদেশকে ১৭ গোলে হারিয়ে দিয়েছিল, ওটা আমাকে ভয়ংকর আঘাত করেছিল, যে পাকিস্তানিদের ওইভাবে আমরা আত্মসমর্পণ করালাম, তারা আমাদের ১৭ গোলে হারিয়ে দিল, আমরা কি এতই নিচু?

 

এক ক্ষেত্রে সেটার তো পরিবর্তন হয়েছে অনেকখানি। সেটা তো দেখতে পাচ্ছেন।

সাংঘাতিকভাবে, সব ক্ষেত্রে। আমি ‘প্রায়’ বলব না, সব ক্ষেত্রে।

 

আপনি তো একজন মহাতারকা, আপনি যখন রাস্তাঘাটে চলাচল করেন, তখন আপনার অভিজ্ঞতাটা কী হয়? খ্যাতির বিড়ম্বনা বলে আমরা একটা জিনিস জানি, আপনার অভিজ্ঞতাটা কী রকম হয় রাস্তাঘাটে চলতে-ফিরতে গেলে?

আমি এটাকে খ্যাতির বিড়ম্বনা মনে করি না। কারণ হচ্ছে, ভালোবাসলে তার প্রতিদান দিতেই হয়। এবং এই ভালোবাসাটা যে কী পর্যায়ের, একটা উদাহরণ দিই—রংপুরে আমাদের শো হবে, তখন প্লেন যেত সৈয়দপুর পর্যন্ত। আমার টিম পাঠিয়ে দিয়েছি আগে। কিছু কাজ বাকি ছিল, সেই কাজ সেরে আমি এসেছি এয়ারপোর্টে। একদল ছেলেমেয়ে আমাকে ছেঁকে ধরল, অটোগ্রাফ দিতে হবে। আমি বললাম, কার কার খাতা আছে? সবাই সামনে এগিয়ে দিল। আমি তাড়াতাড়ি সই দিয়ে রওনা দেব, আর সামনে থেকে যাদের খাতা নেই তারা আটকে ধরল। খাতা নেই, আমাদের জামায় দেন, কেউ বলে ওড়নায় দেন। আমি বললাম, প্লেন চলে যাবে, আমার এখন যেতে হবে। আমরা প্লেন টেনে ধরব, আপনাকে রেখে প্লেন কোথায় যাবে। শেষ পর্যন্ত সবার দাবি পূরণ হলো। যখন গিয়ে কাউন্টারে দাঁড়িয়েছি, আমার টিকিটটা দেখে বলল—একটু ভালো করে দেখেন, আপনার প্লেনটা ওই যে যাচ্ছে।

 

ভালোবাসার কাফফারা দিতে হলো।

হ্যাঁ, আমি একবারও এই বাচ্চাদের প্রতি রাগ হইনি।

 

আপনারা তো একটা দুঃসময়ে, কুসংস্কারাচ্ছন্ন সময়ে জাদুশিল্পের চর্চা শুরু করেছিলেন। কিন্তু এখন সেই সমস্যাটা অনেক কেটে গেছে। বর্তমান প্রজন্মের তরুণদের মধ্যে জাদুশিল্পের চর্চার বিষয়ে আগ্রহ কতখানি? মানে চিত্রটা আসলে কী রকম?

আগ্রহ ঠিকই আছে। কিন্তু একটি বিষয় আমাদের মাথায় রাখতে হবে, কাউকে দোষ দেওয়া যাবে না। সিনেমার গল্প লেখেন একজন, স্ক্রিপ্ট রাইটার আরেকজন। অতএব, গল্প যিনি লেখেন তিনিও লিখতে পারেন, বাট আরেকজন স্ক্রিপ্ট রাইটার থাকতে পারেন এবং ওই ক্যারেক্টারগুলো ফুটিয়ে তোলার জন্য এক্সপার্ট অ্যাক্টর-অ্যাক্ট্রেস বাহিনী থাকে। গান কেউ লেখেন, সুর দেন কেউ, যন্ত্রী থাকে। তারপর সেটা রেকর্ড করে একদল, সেটাকে এডিট করে, ডাবিং করে, সবকিছু করেটরে তারপর একটা জিনিস তৈরি হয়। কিন্তু ম্যাজিক এমন একটা কম্পোজিট আর্ট, যেটা কল্পনা করতে হবে নিজেকে। স্টোরিটা তারই তৈরি করতে হবে। দর্শকের সামনে তাকেই উপস্থাপন করতে হবে। সিনেমায় কাট কাট কাট বললে দশবার কাট বললেও কোনো অসুবিধা নাই। আর ম্যাজিশিয়ানের কোনো কাট নেই। লাইভ এবং শেষ পর্যন্ত সবগুলো পথ পেরিয়ে। সব থেকে বড় যে প্রবলেমটা হচ্ছে, ধরেন একটা গান হিট করল, আবার সবাই ওই গানটাই শুনতে চায়। ওয়ান মোর, ওয়ান মোর, ওয়ান মোর! ম্যাজিকে যে ম্যাজিকটি হিট করেছে, সেই ম্যাজিকটি আপনি আবার দর্শকের সামনে দেখাতে যাচ্ছেন। তখন দর্শকরা বলছে, এইতো দেখেছি। তারা প্রতিনিয়ত নতুন চাচ্ছে। এটাকে ফুলফিল করার ক্ষমতা অর্জন করা খুব মুশকিল। মানে আমি কাউকে দোষ দেব না।

 

আবার কথায়ও তাদের ইমপ্রেস করে রাখতে হবে। অ্যাট্রাক্ট করে রাখতে হবে, টেনে নিয়ে যেতে হবে, তাই না?

অফ কোর্স। লাইট কোন দিক থেকে আসবে, সেটাও তার জানতে হবে। সাউন্ড কী রকম যাবে, তা-ও তার জানতে হবে। সে কোথায় দাঁড়াবে, সে ছায়াটা কোন দিকে নেবে, আলোটা কোন দিকে নেবে—এভরিথিং শুড বি ডান বাই হিমসেলফ।

 

স্বপ্নকে অন্যের মধ্যে সঞ্চারিত করেন। অনেক অনেক ধন্যবাদ আপনাকে!

থ্যাংক ইউ। আর আপনি যে কষ্ট করে এলেন, অনেক ধন্যবাদ, অনেক কৃতজ্ঞতা।

মন্তব্য

সম্পর্কিত খবর

শীত বিকেল

    শরিফুল ইসলাম ভূঁইয়া
শেয়ার
শীত বিকেল
অঙ্কন : বিপ্লব চক্রবর্ত্তী

বাইরে কা কা করছে একটা কাক। নাজুকে শোনাতে পারলে খুশি হতো। সেদিন বলছিল, ‘ভোরে এখন আর কাকের ডাক শুনি না। কাক কি হারিয়ে যাচ্ছে? কাকের শহর ঢাকায় সাতসকালে একটা কাক ডাকবে না—এ কেমন কথা!’

কাক নিয়ে অবশ্য মাথাব্যথা নেই মাশুকের।

যে শহরে তার নিজেরই ঠিকানার ঠিক নেই, সেখানে আবার কাক!

মাশুকের ভাবনায় বাদ সাধে এক খদ্দের। দিনের প্রথম কাস্টমার।

‘অরিজিনাল লেদার শু আছে?’

প্রশ্নটা বিরক্তিকর! সমিতির মার্কেটে এসেছে লেদার শু কিনতে? মাশুক কুশলী জবাব দেয়, ‘পিওর লেদার পাবেন না, মিক্সড হবে। তবে এগুলা লেদারের চেয়ে কম না।

‘দেখান তো ভাই।’

র্যাক ভর্তি বিভিন্ন ধরনের জুতা সাজানো। এক দিকে আঙুল তুলে মাশুক বলল, ‘ওইখানে নতুন কিছু শু আছে। দেখেন কোনটা পছন্দ হয়।

লোকটা এগিয়ে গেল র্যাকের দিকে। মাশুক এই জুতার দোকানে ক্যাশ আগলায়। জুতা দেখানো বা খদ্দেরের পায়ে গলিয়ে মাপ ঠিক করা তার কাজ নয়। অল্পবয়সী দুই তরুণ কাজটা করে। কিন্তু সকাল সাড়ে দশটায়ও কারো আসার নাম নেই।

দুজনই মোবাইল নিয়ে রাতভর পড়ে থাকে। ফেসবুক, টিকটক—আরো কত কী দেখে! ফাঁক পেলেই এসব নিয়ে কথা বলে দুজন। ফেসবুক অবশ্য মাশুকও দেখে। রাতে ঘুম না এলে ফেসবুকের ভিডিওগুলো দেখে।

অঙ্কন : বিপ্লব চক্রবর্ত্তী

‘ভাই, এই জোড়া নামান। নিয়া আসেন, দেখি।’

নরম কুশনের টুলে গিয়ে বসল ক্রেতা। ছোকরা দুটো আসছে না কেন? মাশুকের মাঝেমধ্যে এমন রাগ হয়, দুজনের নামে মালিকের কাছে নালিশ দিতে ইচ্ছা করে। কিন্তু দমে যায়। ওরা দুজনই ছেলের বয়সী। মায়া লাগে।

মাশুক বাধ্য হয়ে লেগে গেল খুবই অপ্রিয় একটা কাজে। লোকটা ধুলোমলিন পুরনো জুতা থেকে পা দুটি বের করতেই ছুটে পালাতে ইচ্ছা করল তার। মোজায় এমন গন্ধ, কেনার পর চিজ দুখানায় কখনো পানি পড়েছে কি না সন্দেহ!

লোকটা নতুন জুতা পায়ে গলিয়ে মচমচ করে কয়েক কদম হেঁটে দেখল। তারপর মুখ বাঁকা করে বলল, ‘নাহ, জুত নাই। রাইখ্যা দেন।’

লোকটার ধুলোমলিন পুরনো জুতা ডাকঘরের সিলমোহরের মতো একটা ছাপ রেখে যায় মাশুকের মনে। পরিবার থেকে দলছুট এই দেহটা এখনো বয়ে বেড়ানো যাচ্ছে। যখন আরো বয়স হবে, কর্মক্ষম থাকবে না, ঠিক ওই ধুলোমলিন জুতা বনে যাবে সে। হায় জীবন!

তাড়াহুড়া করে আসায় সকালের নাশতাটাও সারা হয়নি আজ। পেটে সারিন্দা বাজাচ্ছে ক্ষুধা। কিছু মুখে দেওয়া দরকার। কিন্তু ওরা না এলে বাইরে যাবে কী করে?

পরিষ্কার থাকার একটু বাতিক আছে মাশুকের। লোকটার নোংরা মোজা হাতড়ে গা ঘিনঘিন করছে। হাত না ধুলেই নয়। এ সময় সুরেলা আওয়াজ তোলে মোবাইলের রিংটোন। কল দিয়েছে নাবিলা। হাত ধোয়ার কথা ভুলে কল রিসিভ করে মাশুক।

‘কী করছ, বাবা?’

‘এইতো—দোকানে বসছি।’

‘আজ দুপুরে আসতে পারবা?’

‘কেন?’

‘তোমার এই একটা বিশ্রী স্বভাব, একটা প্রশ্ন করলে জবাব না দিয়া পাল্টা প্রশ্ন করো। আসতে পারবা কি না?’

‘খুব দরকার?’

‘উহু রে, আবার প্রশ্ন! আইসো।’

‘দেখি।’

‘দেখি আবার কী? দেখার কী আছে? আসবা, ব্যস।’

লাইন কেটে দেয় নাবিলা। মাশুকের হৃদয়গভীরে একটা কুলুকুলু স্রোত বয়ে যায়। ওদের কাছে যাওয়ার সুযোগ হলে এমন অনুভূতি হয়। আজব এক পরিস্থিতি। পরিবার নিজের, কিন্তু বাসা ওদের।

মাস কয়েক আগে মিরপুরের রুফটপ ওই ফ্ল্যাটে উঠেছে ওরা। নাজু, নাবিলা আর নাহিদ। বড় একটা রুম দুই ভাগ করে দুটি বানানো হয়েছে। একটায় রান্নাবান্না চলে। সেখানেই এক কোণে খাট পেতে থাকে নাজু আর নাবিলা। বাথরুম একটাই। সেটা ছাদের আরেক প্রান্তে। আরেকটা রুম নাহিদের। সেখানে জায়গা হয়নি মাশুকের। মা-মেয়ে যত স্বচ্ছন্দে একসঙ্গে থাকা যায়, বাপ-ছেলের এক রুমে থাকাটা সহজ নয়। বিশেষ করে ছেলে যদি তরুণ হয় আর মুখের ওপর বলে, ‘কী করলা জীবনে? মায়ের জীবন তো তামা করছই, আমাদের জন্যও তো কিছু করতে পারলা না!’

বাধ্য হয়ে মেসে উঠেছে মাশুক।

এর মধ্যে দোকানের ছেলে দুটি এসেছে। সমিতির মার্কেটের দোকানগুলোতে ক্রেতার ভিড় জমছে। এখানে বেশির ভাগই নিম্নমধ্যবিত্ত। তারা দেখে বেশি, কেনে কম। কিনলেও দোনামনা থাকে—ঠকলাম কি না। এর পরও জুতার দোকানে বিক্রি মন্দ না। দিনে সাত-আট জোড়া বিক্রি করতে পারলে ভালো লাভ থাকে।

দুপুরের দিকে ফোনে মালিকের কাছ থেকে ঘণ্টা তিনেকের জন্য ছুটি নেয় মাশুক। বলে, বাসায় জরুরি কাজ। ছেলে দুটির ওপর দোকানের ভার বুঝিয়ে দিয়ে মিরপুরের বাস ধরে সে। মাথায় এলোমেলো চিন্তা। হঠাৎ এই জরুরি তলব কেন? টাকার দরকার, না অন্য কোনো সমস্যা? নাজু আজকাল নিজে ফোন করে না, মেয়েকে দিয়ে করায়। এখন মাসের তৃতীয় সপ্তাহ চলছে। এই মুহূর্তে টাকা দেওয়া সম্ভব না, যা দেওয়ার তা তো দিয়েছেই।

মিরপুর-১০ গোলচত্বরে বাস থেকে নেমে যায় মাশুক। এখান থেকে বাসায় যেতে রিকশায় ৫০ টাকার মতো লাগে। মাশুক হেঁটেই যায়। গলির মাথায় সবজির ভ্যান। বাসায় কিছু সবজি নেওয়া যায়। খুশি হবে ওরা। কিন্তু দাম শুনে দমে যায় মাশুক। নতুন আলু ৭০ টাকা, করলা ৮০ টাকা, বেগুন ১০০ টাকা। সবজির দামের কাছে জীবনের দাম পানি। সস্তার সবজি অবশ্য আছে। মুলা। বিশ টাকা কেজি। মাশুক নেয় কেজিখানেক।

এ বাসায় লিফট নেই। সিঁড়ি ভেঙে ছয়তলায় ওঠা কষ্ট। প্রবল ইচ্ছাশক্তি মাশুককে টেনে তোলে। টুকটুক করে মৃদু টোকা দেয়। নাজু দরজা খোলে।

‘তুমি!’

যেন তিরিশ বছরের জীবনসঙ্গীকে চিনতে অনেক কষ্ট। মাশুক গা করে না। সয়ে গেছে। তবে নাজুর জন্য মাশুকের এখনো অনেক মায়া।

মাশুক বিরস মুখে বলে, ‘নাবু ফোন দিয়া আসতে বলল। ভাবলাম জরুরি।’

‘আসো।’

দরজা থেকে সরে জায়গা করে দেয় নাজু। পেছনে নাবিলা এসে দাঁড়িয়েছে। মাকে তীক্ষ কণ্ঠে বলে, ‘বাবাকে দেইখা চমকানোর কী আছে, মা? নয় দিন পর আসল বেচারা!’

নাজু বলে, ‘আমাকে তো বললি না?’

‘তোমাকে বইলা কী হইব? তিতা কথা ছাড়া কিছু জানো?’

‘তিতা কথা তো এমনিই বাইর হয় না। তোর বাপের চুল পাইকা সাদা হইয়া যাইতেছে, তবু আক্কেল-বুদ্ধি পাকল না! দেখ, মুলা নিয়া আসছে! এইসব বলে কোনো বাসায় নেওয়ার জিনিস!’

‘মাসের কয় তারিখ আইজ? তুমি আমার পকেটের অবস্থা দেখবা না?’

‘টাকা না থাকলে আনবা না। তাই বইলা গ্যাসের ফ্যাক্টরি নিয়া আসবা?’

নাবিলা ফিক করে হেসে ফেলে। নাজুও যোগ দেয়।

মাশুক বিরক্ত হয়ে বলে, ‘এই জন্যই তোদের কাছে আসতে ইচ্ছা করে না। ভালো কিছু করলেও মরণ! মুলা দিয়া পাতা শুঁটকির চচ্চড়ি তুমি পছন্দ করো না? এই জন্যই তো...। এখন বলো কী হইছে?’

নাবিলা বলে, ‘কিছু হয় নাই, বাবা। বাসায় আজ ভালো কিছু রান্না হইছে। আমরা পোলাও-মাংস খাব, আর তুমি বাদ থাকবা, সেইটা কি হয়?’

মাশুক এতক্ষণে খেয়াল করে, রান্নাঘর প্লাস থাকার ঘরটায় দারুণ সুবাস! কয়েক দিনের না-খাওয়া অভাগার মতো হাসি ফোটে তার। বলে ফেলে, ‘পোলাওয়ের সঙ্গে কী করছ তোমরা? গরু, না মুরগি?’

নাবিলাও হাসে, ‘দুইটাই।’

‘কী উপলক্ষে এত কিছু?’

নাজু বলে, ‘আরে, নাহিদ ওর এক বন্ধুরে খাওয়াইব। সেও রাইড শেয়ার করে।’

এখন দুপুর দুইটা। এত বেলা পর্যন্ত না-খাওয়া মাশুকের আর তর সয় না। বলে, ‘কী দিবা দাও। খুব ক্ষুধা লাগছে।’

নাজু ভেতরে ভেতরে টেনশনে অস্থির। আজকের দাওয়াতের বিশেষ উদ্দেশ্য আছে। নাহিদ যে বন্ধুকে নিয়ে আসবে, সেও পড়াশোনা ছেড়ে রাইড শেয়ার করে। নাহিদ বলেছে, ওর জানা মতে ছেলেটির বাজে কোনো নেশা নেই। কোনো মেয়ের সঙ্গেও নেই, তবে খুঁজছে। পছন্দমতো পেলে বিয়ে করবে। নাবিলাকে দেখে সে রকম আগ্রহ দেখালে বিয়ের কথা পাড়বে নাহিদ।

নাবিলা দেখতে-শুনতে মন্দ না। মেধাবীও। এসএসসিতে সায়েন্স থেকে জিপিএ ফাইভ পেয়েছে। মেডিক্যালে পড়ার ইচ্ছা। না হলে পাবলিক ভার্সিটি। কিন্তু নাহিদ বলে, বাবার যে অবস্থা, কলেজে থাকতে থাকতে নাবিলাকে পার করতে হবে। আইবুড়ো হলে তখন ছেলে পাওয়া মুশকিল।

নাজু একটু আপত্তি তুলেছিল, অমনি রেগে গেল ছেলেটা। বলল, ‘আমি এত বিয়ার করতে পারব না, মা। বোঝা হালকা করতে হইব। আমারও তো ভবিষ্যৎ আছে। বি প্র্যাকটিক্যাল!’

নাজু আর কিছু বলেনি। টাকা-পয়সা না থাকলে এ বয়সে অনেক অধিকার বেদখল হয়ে যায়। নাহিদ পইপই করে বলেছে, ‘বাবা যেন কিছুতেই জানতে না পারে। পরে জানাইলেই হইব।’

এ জন্যই নাজু কিছু জানায়নি মাশুককে। নাবিলাও জানে না এই দাওয়াতের আসল কারণ। মেয়েটা হুট করে বাবাকে নিয়ে আসায় এখন ভারি বিপদ হয়েছে। কখন যে ওরা এসে পড়ে! বাবাকে দেখলে নাহিদ এখন হয়তো কিছু বলবে না, পরে ঠিকই ঝাল ওঠাবে।

নাজু বলে, ‘তাড়াতাড়ি খাইয়া চইলা যাও। দেরি করলে দোকানের মালিক আবার কী বলে!’

হাতমুখ ধুয়ে বিছানায় বসে পড়ে মাশুক। নাবিলা ঘরে রাখা  মোটা কাগজের একটা শপিং ব্যাগ ছিঁড়ে বিছিয়ে দেয় বাবার সামনে। বলে, ‘সকালে কী দিয়ে নাশতা করছ, বাবা?’

মাশুক এড়িয়ে যায়, ‘সকালের কথা এখন জানার দরকার আছে?’

‘রোজ সকালে নাশতা করার সময় তোমার কথা মনে পড়ে, বাবা। মা দুধ-চা দিত, তুমি তেল ছাড়া পরোটা ভিজাইয়া খাইতা। মা বলে আর কাঁদে।’

‘তুইও এখন কাঁদবি নাকি?’

নাবিলা ওদিক ফিরে মুখ আড়াল করে। মাশুকের বুকের গভীর থেকে দীর্ঘশ্বাস উঠে আসে। করোনার আগে ভালোই ছিল ওরা। তখন এত লোয়ার লেভেলে না, বেশ ভালো একটা আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানে হিসাব বিভাগে ছিল। দুই কামরার একটা ছিমছাম বাসায় ছিল। আলাদা কিচেন, দুটি বাথরুম। নাহিদ তখন ঢাকা কলেজে অনার্সে পড়ে। নাবিলা স্কুলে। হুট করে করোনা এলো, ভোজবাজির মতো উধাও হলো চাকরিটা। তারপর কয়েকটা মাস একদম বেহদ্দ বেকার। করোনা গেলে ব্যাংকে যা ছিল, তা দিয়ে শেষরক্ষা হিসেবে একটা ফাস্ট ফুডের দোকান দিয়েছিল। জমল না। পুরো ১০ লাখ টাকা গচ্চা। নাহিদের পড়াশোনা ওখানেই শেষ। তবু ভাগ্যিস, ধারদেনা করে ওকে একটা মোটরবাইক কিনে দিতে পেরেছে। চারটা বছর ছোট-বড় নানা ঢেউ সামলে শেষে এই জুতার দোকানে ঢুকেছে মাশুক। বেতন যা পায়, তা দিয়ে কোনোমতে টেকা যায়, কিন্তু সোজা হয়ে দাঁড়ানো যায় না।

বাবাকে পোলাও-মাংস বেড়ে দেয় নাবিলা। অনেক দিন এমন ভালো খাবার খায় না মাশুক। রাজ্যের ক্ষুধা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে।

সব শেষে দই খেয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তোলে মাশুক। নাবিলা বলে, ‘তোমার বেতন কি আর বাড়বে না, বাবা?’

‘বাড়বে কিভাবে? বাড়ানোর কথা বলারই তো সাহস হয় না।’

‘তোমার সাহস নাই দেইখাই তো আমাদের এই অবস্থা। ভাইয়া ঠিকই বলে। মালিককে বলবা যে জিনিসপত্রের দাম বেশি, চলা যায় না।’

মাশুক কিছু বলে না। হালকা নিঃশ্বাস ছাড়ে। নাজুর ফোনে রিংটোন। কল দিচ্ছে নাহিদ। বুকটা ধড়াস করে ওঠে। এসে গেছে নিশ্চয়ই! ভয়ে ভয়ে ফোন ধরে। কিন্তু না, জরুরি কি একটা কাজ পড়েছে। এখন না, রাতে আসবে ওরা। হাঁপ ছাড়ে নাজু। যাক, এ যাত্রা বাঁচা গেছে!

নাজু এবার বলে, ‘খেয়ে একটু আরাম করেই যাও। একদিন একটু লেট হইলে কী আর বলবে?’

মাশুকেরও ভরপেট খেয়ে নড়তে ইচ্ছা করে না। ওই বিছানায়ই চিত হয়ে শুয়ে পড়ে। নাবিলা মাথার কাছে বসে। বাবার মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলে, ‘আর কয়েকটা মাস কষ্ট করো, বাবা। আমি এইচএসসি দিয়া টিউশনি করব। তোমাকে আর মেসে থাকবে হইব না। তখন আরেকটা ভালো বাসায় উঠব।’

নাবিলা বলেই চলে, ‘আর যদি ভার্সিটিতে ভর্তি হই, হলে উঠতে পারি...’

নাবিলার সব কথা কানে যায় না মাশুকের। আবেশে চোখ বুজে আসে। ঘোরলাগা চোখে স্বপ্ন দেখে সে। সবাই একসঙ্গে নতুন একটা বাসায় উঠেছে। বারান্দায় আসা নরম রোদে গা পেতে বসে আছে সে। ভেতরে চায়ের কাপে টুং টাং। এখনই আসবে ভাপ ওঠা চা। কিন্তু শীত বিকেলটা বড্ড ক্ষণস্থায়ী। কখন যে মিষ্টি বিকেল অস্তাচলে বিলীন হয়, টের পায় না মাশুক।

 

 

 

 

 

 

প্রাসঙ্গিক
মন্তব্য

একটি পুরনো গল্প

    ইউসুফ শরীফ
শেয়ার
একটি পুরনো গল্প
অঙ্কন : শতাব্দী জাহিদ

পুরনো হলেও এখনো চাপা রিনঝিন হাসি ঢেউ খেলে যায় ছ’ফুটি এই গলিতে—বাঁ দিকে সালেহা মঞ্জিলের উঁচু দেয়াল, ডান দিকে আম-কাঁঠালগাছের নিরিবিলি ছায়ায় পর পর দুটি টিনশেড বাংলোবাড়ি। সামনে গলি গিয়ে পড়েছে দু’পায়া পথে আর পেছনে এল সাইজ টিনশেড এই এলাকার থেকে যাওয়া একমাত্র মেস—ইঞ্জিনিয়ার্স মেস। যে ইঞ্জিনিয়াররা গাছপালায় ছাওয়া শান্ত পরিবেশে এই মেসবাড়িটার প্রথম বাসিন্দা ছিলেন, এখন নিশ্চিত কোনো না কোনো অভিজাত পাড়ায় তাঁরা বিলাসবহুল জীবন যাপন করছেন।

ইলিয়াস ঢুকতে গিয়ে পুরনো ভাঙাপ্রায় টিনের গেটের সামনে দাঁড়িয়ে যায়।

বেশ ক’দিন ধরে এই রিনঝিন চাপা সুবাস ছড়ানো হাসির ঢেউ ঠিক এখানে পৌঁছার সঙ্গে সঙ্গেই তার ওপর আছড়ে পড়ে।

সুবাসটা চেনা চেনা, অথচ মোটেই চেনা নয়। হাসিটাও এই রকম—পুরনো হাসির ধরন, যা চেনা যায় যায় না। চকিতে মনে পড়ে ইলিয়াসের মানুষকে চেনার আগেই বোধ হয় তার হাসি চেনা যায়।

হাসি মানবীয় সম্পর্কের এক আদি নির্ভরযোগ্য সেতু। এটা আদৌ যদি তত্ত্বকথা হয়, তাহলে ভাবতে পেরে ইলিয়াস মুচকি হাসল—অতৃপ্ত মানুষের তৃপ্তির হাসি।

স্কুলে হেডমাস্টার সাব আজ বলে দিয়েছেন—আমি দুঃখিত ইলিয়াস সাব, আপনার জন্য বোধ হয় কিছু করতে পারলাম না। কিভাবে করব বলুন, একজন মন্ত্রী যদি সামান্য একটা স্কুল শিক্ষকের চাকরির জন্য রিকমেন্ড পাঠিয়ে আবার টেলিফোনে রিকোয়েস্ট করেন, তাহলে কী করা যাবে! আপনি সাময়িক নিযুক্তি নিয়ে কাজ করেছেন—আপনার একটা দাবি আছে, কিন্তু আমার করার নেই কিছুই।

তবে আমি কথা দিচ্ছি, দু-একটা ভালো টিউশনি আপনাকে জোগাড় করে দেওয়ার চেষ্টা করব।

অঙ্কন : শতাব্দী জাহিদ

মন্ত্রীদের হাত কত দীর্ঘ! একটা মানুষের হাত কত দীর্ঘ হতে পারে? কোনো কোনো বংশের লোকদের হাত নাকি তুলনামূলকভাবে দীর্ঘ হয়—এ রকম কথা বলা হয়ে থাকে। সেটাও তো আর শরীর ছাড়িয়ে যায় না। তবে মন্ত্রীর হাত শরীরের তোয়াক্কাই করে না, অশ্বখুরের দাগের পরিমাণ ফাঁকফোকরে ননি-মাখনের খানিকটা আভাসও জিহ্বাগত হওয়ার বাইরে থাকে না!

হাত নিয়ে ভাবতে ভাবতে ইলিয়াস মেসে ঢুকছিল। টিনের ভাঙা গেটে হাত রাখার সঙ্গে সঙ্গে ওই হাসি আজও দুরন্ত তরঙ্গের মতো আছড়ে পড়ল।

তার হাত যদি তেমন হতো তাহলে হয়তো এই হাসির খনিকটা উপড়ে নিয়ে আসতে পারত! তবু হাসিটাকে সে ঠিক চিনে ফেলেছে—এই হাসি অদৃশ্য হাতের আঙুল হয়ে হৃদয়ের গোপন দরজায় টুকটুক করে কড়া নাড়ে।

গোপন কড়া নাড়ার এই শব্দ ঝরনার মতো বইছে এখন তার বুকের ভেতর। অবাক কাণ্ড, দীর্ঘ হাতের ছোবল যে ক্ষত তৈরি করেছে, তার ওপর ঝরনার পানি পড়তেই বেদনা ধোঁয়ার মতো উড়তে থাকল—আসলে উড়তে থাকল কী! পুরনো অভ্যাস তো থাকে!

মুচকি হাসিটা ধরে রেখেই রুমে ঢুকল। রুমমেট পানি উন্নয়ন বোর্ডের ডেপুটি অ্যাকাউন্টস অফিসার রফিক মাড়ির গোড়ায় গুল ঠেসে দিয়ে পুরনো অভ্যাসে অস্বাভাবিক জোরে হাত ঝাড়ছিল।

ইলিয়াস ঢোকামাত্র তার মুখে দৃষ্টি স্থির করে হাতঝাড়া ভুলে উৎসাহিত হয়ে উঠল, কী কাম হইয়া গ্যাচে! হবে না ভাই, আপনের কপাল ভালো। কইছিলাম না—চিন্তা কইরেন না। আরে ভাই—আপনে আপনের কপাল দেখতে না পাইলে কী হইব—আমরা তো দেখতে পাই। আপনের কপালের গড়ন আলাদা—এই রকম গড়নপদের কপাল দেখলেই চিনবার পারি—হেই ইস্ট পাকিস্তান ওয়াপদার আমলে ক্লার্ক হইয়া ঢুকছি—কত কপাল দেখছি। অহন একনজর দেখলেই কইয়া দিতে পারি কী আছে কপালে। না, কপালতত্ত্ব নিয়া পড়াশোনা করি নাই, এইডা অভিজ্ঞতা। বুঝলেন ভাই, অভিজ্ঞতার কোনো বিকল্প নাই।

রফিক গুলের ক্রিয়ায় মুখে জমে ওঠা পানি দরজা দিয়ে বাইরে পিক করে ছুড়ে দিয়ে আত্মতৃপ্তির হাসিতে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল।

ইলিয়াসের হাসি মিলিয়ে গেছে—জামার বোতাম খুলতে খুলতে বলল, কাম হয় নাই, রফিক ভাই!

রফিক বিছানা থেকে উঠে ইলিয়াসের সামনে এসে দাঁড়াল, কন কী, হয় নাই! হয় নাই ক্যান? আপনে তিন মাস কাজ করছেন—অহন আপনে, ডিপার্টমেন্টাল ক্যান্ডিডেট রুলে আছে আপনের প্রিফারেন্স।

ইলিয়াস বলল, কলোনিতে পাঁচ বছর আগে আপনার নামে বাসা অ্যালট হয়েছে—তার পরও বাসায় উঠতে পারছেন না কেন?

রফিক হতাশ হয়ে বিছানায় বসে পড়ে বলল, আরে ভাই, এই কিচ্ছা না কত দিন কইছি। গত পাঁচ বছরে আমি যত কথা কইছি—তার বেশি অর্ধেক খরচ হইছে এই কিচ্ছা কইতেই। তো আর কওয়া যাইব না, পরশু দিন অফিসে হুমকি দিয়া গ্যাছে।

ইলিয়াস বলল, কন কী! হুমকি দেওয়ার জন্য অফিসে গুণ্ডা লেলিয়ে দিয়েছে?

রফিক হাত-পা ছেড়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল, আরে ভাই, গুণ্ডা হইলে বুঝতাম—গুণ্ডায় হুমকি দিব না তো কী করব, হুমকি দিয়া গ্যাছে ওই মেয়েটা। কই নাই যারা জবরদখল কইর্যা রাখছে বাসা ওদের ওই মেয়েটা। কয় গান গায়—শিল্পী। এ যে কোন শিল্প সে কি আর বুঝি না! জানেন, ছোটবেলায় গেরামে দেহতত্ত্বের গান শুনছি, আর অহন এই সময়ে ঢাকার শহরে দেখছি দেহশিল্পের দাপট!

ইলিয়াস বলল, গোটা দেশটাই এখন মাসলম্যানদের হাতে জিম্মি—এদের হাত থেকে উদ্ধার না পেলে দেশ চলবে না!

রফিক বলল, আরে দূর সাব, আপনে কী কন! এই যে মেয়েটা আমারে রীতিমতো হুমকি দিয়া গ্যাল—সে কি মাসলম্যান? এ হলো সফট মাসল ওম্যান। এখন এদের যুগ, এদের হাতে জিম্মি এখন সমাজ। হার্ডওয়্যারের যুগ শেষ, এখন সফটওয়্যারের যুগ!

ইলিয়াস বিছানায় বসে পড়ে বলল, বুঝলাম না ভাই কী কইলেন সাংকেতিক ভাষায়।

রফিক বলল, আরে ভাই, আপনেরে আর কত বুঝাইবাম। সাংকেতিক ভাষা হইল এই যুগের ভাষা। আপনে তো ম্যালা নভেলটভেল পড়েন। দেখেন না আজকাল মডার্ন জনপ্রিয় লেখকরা কেমন শর্টহ্যান্ডের মতো সংকেত দিয়া দিয়া তরতর কইর্যা লেইখ্যা যায়। মনে হয় চিন্তা নাই ভাবনা নাই—কাগজ-কলম নিয়া বসে আর ফরফরায়্যা লেখা শেষ কইর্যা ফালায়। এই কথা কইছে এক মহাজনপ্রিয় লেখক এক সাপ্তাহিকে সাক্ষাৎকারে। কথা বেঠিক না—চিন্তা-ভাবনা যদি কিছু করতে হয় তো করব পাঠকরা।

ইলিয়াস বলল, এটা আপনার অন্যায়, রফিক ভাই—আপনি জানেন সারা বিশ্বের সাহিত্যে পরিবর্তন এসেছে। আমাদের লেখকরাও—

রফিক তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, রাত কয়টা দেখছেন? অহন হাতমুখ ধুইয়া খাইতে বসেন।

লোকটার মেজাজ এই বাসা নিয়ে ইদানীং খিটখিটে হয়ে উঠেছে। তবে সময়মতো খাওয়া আর ঘুমানোর ব্যাপারে ইলিয়াসকে প্রতিদিন তাগিদ দিতে ভোলে না।

খাওয়াদাওয়া সেরে বিছানায় শুয়ে বাতি নিভিয়ে দিল ইলিয়াস। অন্ধকারের সঙ্গে সঙ্গে সেই রিনঝিন হাসিটা তার মশারির ভেতর ঢুকে পড়ল—সে এখন থইথই হাসির ঢেউয়ে নিমজ্জিত। এমন তো হতে পারে, কাল খুব ভোরে এই গলির বাসিন্দারা জেগে ওঠার আগে ভাঙা গেট দিয়ে বের হতেই দেখবে—কী দেখবে! কোনো ছবি স্পষ্ট হয় না। সাদা কাগজের মতো একটা ভোর ওত পেতে রয়েছে—এ রকম সাদার মুখোমুখি হতে ভয় পায় সে, দম আটকে আসে তার।

ইলিয়াস উঠে বসে বিছানায়। মশারি গুটিয়ে টেবিলের ওপর থেকে হাতড়ে পানির গ্লাসটা তুলে নেয়—ঢকঢক করে খানিকটা পানি পান করে।

তারপর ডাকে, রফিক ভাই ঘুমিয়েছেন?

রফিক জিজ্ঞেস করল, ঘুম আসছে না? ঘুমান, ঘুম হইল শরীরের বিশ্রাম। চিন্তা কইর্যা কিছু হয় না—যা হওয়ার এমনিই হয়। ঢাকার শহরটা একটা সমুদ্র—এইখানে রুই-কাতলার পাশাপাশি মলা-পুঁটিও থাকে। তবে থাকার একটা ফরম্যাট আছে—আয়ত্ত না হওয়া পর্যন্ত অস্থির অস্থির লাগে, হইয়্যা গ্যালে দেখবেন একেবারে নিশ্চিন্ত পানির মতো জীবন। নেন ঘুমান।

ইলিয়াস বলল, আপনি সজাগ ছিলেন—ঘুমান নাই?

রফিক বলল, আরে কইয়েন না, হঠাৎ আপনের ভাবিরে দেখলাম—

ইলিয়াসের কণ্ঠে বিস্ময়, ভাবিরে দেখলেন! কী স্বপ্ন দেখছেন?

রফিক হেসে ওঠে, আরে না—ঘুমাই নাই তো স্বপ্ন দেখব ক্যামনে!

ইলিয়াস বলল, তাহলে ভাবিরে দেখলেন কেমনে?

রফিক বলল, মশারির পাশে আইস্যা দাঁড়াইল। আপনে যখন পানি খাইলেন তখন কইল—যাইগা, ইলিয়াস ভাইয়ে দেখলে কী কইব? শত হউক এইডা মেস তো!

ইলিয়াস থ—লোকটা বলে কী—মাথায় গোলমাল দেখা দেয়নি তো! সে চুপ হয়ে যায়—মুখ থেকে কোনো শব্দ বের করে না।

অনেকক্ষণ পর রফিক কথা বলে ওঠে—কী, ঘুমাইলেন?

ইলিয়াস সাড়া দেয়, না।

রফিক বলল, ইলিয়াস সাব, আপনে আমার ছোট ভাইয়ের মতন, কী কই আপনেরে। জানেন, বিয়া করলাম—দু’টা ছেয়েমেয়েও হইল, কিন্তু সংসার করতে পারলাম না। একজন ব্রাহ্মণবাড়িয়া আর একজন ঢাকায়। সংসার বলতে যা বোঝায়, প্রতিদিনের সংসার, তা হয়!

রফিকের দীর্ঘশ্বাস ঘরের বাতাস ভারী করে তোলে—এত ভারী যে শ্বাস নিতে কষ্ট হয়।

ইলিয়াস জিজ্ঞেস করল, রফিক ভাই, আমি যখন এলাম, তখন বাইরে কোনো হাসির শব্দ শুনেছিলেন?

রফিকের কণ্ঠে বিস্ময়, হাসি! কার হাসি?

ইলিয়াস বলল, এই—এই কোনো মহিলার!

রফিক আপন মনে আওড়াল—মেয়েমানুষের হাসি! না তো—কন কী! শুনছেন আপনে?

ইলিয়াস বলল, হ্যাঁ। গত কয় দিন যাবৎই শুনি—ভাঙা গেটটায় হাত রাখতেই রিনঝিন হাসি...

রফিক হেসে ওঠে, দূর কী কন! আপনে শোনেন আর আমি শুনি না, কেউ শুনে না—এইটা হয় নাকি? এইটা আপনের ভেতরে লুকাইয়া আছে—ফাঁক পাইলেই বাইর হয়!

ইলিয়াস বলল, এটা কী কন রফিক ভাই? আমি স্পষ্ট শুনেছি, একদিন-দুইদিন না, গত এক সপ্তাহ ধরে শুনছি—মিষ্টি সুরেলা হাসি, ঠিক ঝরনা থেকে পানি গড়ায় যেমন শব্দ করে!

রফিক ওকে থামিয়ে দেয়—ব্যস, হইয়া গ্যাছে, আর কইতে হইব না। এই যে আপনের ভাবি আইস্যা দাঁড়াইল—এইটা ক্যামনে? আরে ভাই, ভেতরে লুকাইয়া থাকলে ফাঁক পাইলেই বাইর হইয়া আসে। ভেতরটা যখন অসহ্য হইয়া ওঠে, তখনই বাইর হয়।

ইলিয়াসের গা ছমছম করে ওঠে—সে বুকে হাত দেয়—অনুভব করার চেষ্টা করে সত্যই রিনঝিন হাসিটা ভেতরে আছে কি না! 

 

 

প্রাসঙ্গিক
মন্তব্য

ঈদে অভিজাত সাজ

    ঈদে গরম থাকবে, তাই স্টাইলের সঙ্গে সাজে আরামের দিকটাও খেয়াল রাখুন। ঈদের সাজ নিয়ে পরামর্শ দিয়েছেন রেড বিউটি স্যালনের রূপ বিশেষজ্ঞ আফরোজা পারভীন। লিখেছেন মোনালিসা মেহরিন
শেয়ার
ঈদে অভিজাত সাজ

ঈদের দিনের অনুভূতিই অন্য রকম। এদিন সাজে সুন্দর ও সাবলীল থাকা চাই। ঈদ সকালটা শুরু হয় কাজের ব্যস্ততা দিয়ে। দুপুরে অতিথি আপ্যায়নে সময় কাটে।

বিকেল আর রাতে নিজের জন্য একটু বেশি সময় পাওয়া যায়। প্রিয়জনকে সঙ্গে নিয়ে ঘোরাঘুরি, আড্ডা কিংবা দাওয়াতে যাওয়া হয়। এ জন্য তিন বেলায় চাই তিন রকম সাজ।

সকালে হালকা সাজ

সকালে হালকা ও আরামদায়ক পোশাক পরা উচিত কারণ এসময় ছিমছাম, স্নিগ্ধ সাজই সুন্দর লাগে।

সকালে যেহেতু কাজের ব্যস্ততা থাকে তাই সাজ-পোশাক আরামদায়ক হওয়া চাই। শোভন মেকওভারের স্বত্বাধিকারী শোভন সাহা বললেন, ‘ঈদের দিন ব্যস্ততায় তিনবার লুক বদলানো বেশ ঝামেলার কাজ। সকালের সাজ দিয়েই দুপুর ও রাতের সাজটা সেরে ফেলতে পারেন। সকালে হালকা ফাউন্ডেশন দিন।
ঠোঁটে এ সময় ন্যুড রঙের লিপস্টিক দিতে পারেন। চোখ সাজাতে হালকা আইশ্যাডো দিলে সুন্দর লাগবে।’

সকালের পরিবেশে হালকা যেকোনো কিছুই ভালো মানায়। মেকআপ, কনট্যুরিং, ব্লাশ ও মাশাকারায় হালকা ভাব ধরে রাখতে পারেন। সকালে চুলের সাজে পনিটেল করে নিন।

কম বয়সীরা কপালের দুই পাশে একটু স্টাইলিশ বেণি করে নিলে সুন্দর দেখাবে।

 

ঈদে অভিজাত সাজ

দুপুরে চাই আরাম

গরম আবহাওয়া এখন। রেড বিউটি স্যালনের স্বত্বাধিকারী ও রূপ বিশেষজ্ঞ আফরোজা পারভীন বললেন, ‘ঈদের দিন দুপুরে ভারী মেকআপ না করাই ভালো। বেইস মেকআপ ম্যাট রাখুন। গরমে ত্বক বেশি ঘামলে বা তেলতেলে হলে ভালো করে মুখ ধুয়ে টোনার লাগিয়ে নিন। চেষ্টা করুন মেকআপের সব উপাদান যেন ম্যাট হয়। এতে গরমে ঘামলেও মেকআপ নষ্ট হবে না। চোখে ঘন মাশকারা ও আইলাইনার দিতে পারেন। চোখের সাজে স্মোকি ভাবও এই সময় সুন্দর লাগবে। পোশাকের রঙের সঙ্গে মিলিয়ে লিপস্টিক দিন ঠোঁটে। ন্যুড কালার লিপস্টিকও রাখতে পারেন। কানে দুল আর গলায় হালকা লকেট বেছে নিতে পারেন। দুপুরের সাজে চুল বেঁধে রাখাই বেশি আরামদায়ক হবে।’

 

ঈদে অভিজাত সাজ

রাতে জমকালো

রাতের বেইস মেকআপ মানায় ভালো। সাজও জমকালো হয়। রাতে জমকালো কাজ করা পোশাকের সঙ্গে ভারী মেকআপ, ভারী গয়না, চোখের সাজে রঙের বাহার, ঠোঁটে গাঢ় লিপস্টিক রাতে আরো বেশি সৌন্দর্য ফুটিয়ে তুলবে। বিন্দিয়া এক্সক্লুসিভ কেয়ারের স্বত্বাধিকারী শারমিন কচি বললেন, ‘রাতের সাজে মানানসই হাইলাইটার ব্যবহার করুন। গাঢ় ব্লাশ অন বেছে নিন। ঠোঁটেও থাকবে উজ্জ্বল রং। চোখে রঙিন সাজ বা স্মোকি আই রাতে ভালো দেখাবে। চুলের সাজে লম্বা বেণি সুন্দর মানাবে। চাইলে চুল ছেড়েও রাখতে পারেন।’

যখন যেমনই সাজুন, সবার আগে নিজের ব্যক্তিত্ব ও আরামদের দিকটা প্রাধান্য দিন। গরমে সাজবেন তো অবশ্যই, তবে তা যেন নিজের সৌন্দর্য আর সুস্থতায় কোনো ব্যাঘাত না ঘটায়। মনে রাখবেন, সবার আগে নিজেকে সুস্থ রাখা সবচেয়ে জরুরি। তবেই তো ঈদের আনন্দ সবার সঙ্গে মিলেমিশে উপভোগ করবেন।

 

 

 

প্রাসঙ্গিক
মন্তব্য
ফ্যাশন

ঈদের ফ্যাশনেবল পাঞ্জাবি

    ঈদের দিন পাঞ্জাবি না পরলে ছেলেদের ফ্যাশন যেন অপূর্ণ থেকে যায়। প্রতিবছর নতুন নকশা, থিম ও প্যাটার্নের পাঞ্জাবি নিয়ে আসে ফ্যাশন হাউসগুলো। ডিজাইনারদের সঙ্গে কথা বলে এবারকার ঈদের পাঞ্জাবির খোঁজ জানাচ্ছেন আতিফ আতাউর
শেয়ার
ঈদের ফ্যাশনেবল পাঞ্জাবি

পাঞ্জাবি পরতে ভালোবাসেন না এমন পুরুষ কমই। ঈদের দিন তো নতুন পাঞ্জাবি ছাড়া জমেই না। এ জন্য ঈদ ঘিরে নতুন নতুন পাঞ্জাবির পসরা সাজিয়ে বসে ফ্যাশন হাউসগুলো। ফ্যাশন হাউস কে ক্রাফটে এসেছে বর্ণিল নকশার পাঞ্জাবি।

লাল, নীল, সাদা, কালো, খয়েরিসহ বিভিন্ন রঙের সংমিশ্রণ ঘটেছে পাঞ্জাবিতে। গলা ও হাতায় রয়েছে আলাদা নকশা ও কাজ। ঐতিহ্যবাহী কাঁথা স্টিচ, মোগল শৈলী, উইভিং মোটিফের অনুপ্রেরণা ছাড়াও গুজরাটি, ইক্কত, কলকা আর্ট, জামদানি, ফ্লোরাল, ট্র্যাডিশনাল, টার্কিশ আর্ট ও ইসলামিক মোটিফ ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। রয়েছে আরামদায়ক কাপড়ের ব্যবহার।
প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার খালিদ মাহমুদ খান বলেন, ‘পাঞ্জাবির গলা, বুক ও হাতার পাশাপাশি কাঁধেও নতুন নকশা করা হয়েছে। কটন, ডিজাইন কটন, হ্যান্ডলুম কটন, লিনেন, জর্জেট, সিল্ক, হাফসিল্ক, টিস্যু ও সাটিনের মতো আরামদায়ক কাপড় বেছে নেওয়া হয়েছে। যেন গরমে স্বস্তি পাওয়া যায়। হাতের কাজ, এমব্রয়ডারি, স্ক্রিন ও ব্লক প্রিন্ট, কারচুপি ও টাইডাইয়ের সাহায্যে পাঞ্জাবির নকশা ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।

বিশ্বরঙের শোরুমে ম্যানিকুইনগুলোর বেশির ভাগই ঈদের পাঞ্জাবি পরা। প্রতিষ্ঠানটির স্বত্বাধিকারী ডিজাইনার বিপ্লব সাহা বলেন, ‘এবার নকশা ও থিমের চেয়ে আরামই বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে পাঞ্জাবির কাপড়ে। কারণ গরমের মধ্যে। সে জন্যই আরামকে বেছে নেওয়া। সুতি, কটন, সেমিকটন, লিনেন ও পাতলা তাঁতের কাপড়ে তৈরি হয়েছে এবারকার ঈদ পোশাক।

একই সঙ্গে মোটিফেও থাকছে ইসলামিক, ফ্লোরাল, ফুল, লতাপাতা ও মোগল কারুকার্য।’

 

ঈদের ফ্যাশনেবল পাঞ্জাবি

প্রিন্টে পরিপাটি

প্রিন্টের পাঞ্জাবির প্রতি ছেলেদের আকর্ষণ সব সময়ই। এবারও প্রিন্টের পাঞ্জাবির জয়জয়কার। ফ্যাশন হাউস ওটু, জেন্টল পার্ক, লা রিভ, টুয়েলভ, অঞ্জন’স, লুবনান, রিচম্যান থেকে শুরু করে ছোট-বড় সব প্রতিষ্ঠান ঈদ উপলক্ষে প্রিন্টের নতুন পাঞ্জাবি এনেছে। লালচে সুতি পাঞ্জাবিতে কালো প্রিন্টের নকশা, হাতায় কালো রঙের পাইপিংয়ের প্রিন্ট যেমন দারুণ সাড়া ফেলেছে, তেমনি গাঢ় সবুজ শেডের জমিনে হালকা সবুজ প্রিন্ট, তার সঙ্গে এমব্রয়ডারির নকশা যুক্ত করে অভিজাত ভাব আনা হয়েছে। এসব পাঞ্জাবির বোতামের আলাদা নকশা ও ম্যাটেরিয়ালেও পাওয়া যাবে ভিন্নতা। এ ছাড়া ফুল, ফল, পাখি, লতাপাতা ও প্রকৃতির নানা মোটিফ যুক্ত হয়েছে এবারকার প্রিন্টের পাঞ্জাবিতে।

 

কাটছাঁটে নতুন কী

গলা, বুক, হাতা ও কাঁধের কাটছাঁটে রয়েছে আলাদা বৈচিত্র্য। সারা লাইফস্টাইলের ডিজাইনার শামীম রহমান বলেন, ‘কম বয়সীদের জন্য জমকালো ও ভিন্ন ধাঁচের প্যাটার্নের পাঞ্জাবি এনেছি। আলাদা কাপড় জুড়ে দেওয়া, বোতামের পরিবর্তন, বুকের কাটে ভিন্নতা, এমব্রয়ডারি ও সুই-সুতার কাজের সাহায্যে নতুনত্ব যোগ করা হয়েছে। কখনো বুকের এক পাশ খালি রেখে আরেক পাশে নকশা, কখনো কাঁধের কাছে ভিন্ন কাপড় জুড়ে দিয়ে ভিন্নতা আনা হয়েছে।’

একেকজনের একেক রকম চাহিদার কথা মাথায় রেখে পাওয়া যাবে তিন ধরনের পাঞ্জাবি—রেগুলার ফিট, স্লিম ফিট ও স্লিম শর্ট। এখনকার ট্রেন্ড লম্বা কাটের লুজ ফিট পাঞ্জাবি। অভিজাত লুকেরও পাঞ্জাবি পাওয়া যাবে বিভিন্ন ফ্যাশন হাউসে। সিল্ক, মসলিনের মতো দামি কাপড়ে তৈরি এসব পাঞ্জাবিতে অভিজাত ভাব তুলে ধরতে অতিরিক্ত ভ্যালু অ্যাড করতে ব্যবহার করা হয়েছে নানা রকম ম্যাটেরিয়ালের অলংকার।

 

কখন কেমন পাঞ্জাবি

ঈদের সকালে হালকা রঙের পাঞ্জাবি বেশি মানানসই। ঈদের জামাতে বেশি উজ্জ্বল রং বেমানান মনে হবে। হালকা রঙের পাঞ্জাবি সকালের আবহে স্নিগ্ধ ভাব এনে দেবে। ঈদ বিকেলে ও রাতে উজ্জ্বল রঙের পাঞ্জাবি বেছে নিন। কমলা, হালকা সোনালি, হলুদ ও গাঢ় নীল রঙের পাঞ্জাবি পরা যাবে। বিকেলের সূর্যের সোনালি রং কিংবা রাতের আলো-আঁধারি পরিবেশে দারুণ মানিয়ে যাবে এমন পাঞ্জাবি। বেছে নিতে পারেন ম্যাচিং পাঞ্জাবিও। কয়েক বছর ধরেই ট্রেন্ডে রয়েছে ম্যাচিং পোশাক। সব বয়সী সদস্যদের জন্য পাওয়া যাবে একই নকশার পাঞ্জাবি।

 

কোথায় পাবেন, কেমন দাম

বসুন্ধরা সিটি শপিং মল, যমুনা ফিউচার পার্ক, সুবাস্তু আর্কেড, রাপা প্লাজা, পুলিশ প্লাজার মতো বড় বড় মার্কেটের বিভিন্ন ব্র্যান্ডের শোরুমগুলোতে পাওয়া যাবে ঈদের নতুন পাঞ্জাবি। একটু কম দামে ভালো মানের পাঞ্জাবি পাওয়া যাবে নিউমার্কেট, আজিজ সুপার মার্কেট, বেইলি রোড, মিরপুর শাহ আলী মার্কেটসহ ছোট-বড় মার্কেটগুলোতে। মিরপুর, নিউমার্কেট, গুলিস্তান, বায়তুল মোকাররম, বঙ্গবাজারে আলাদা পাঞ্জাবির মার্কেট রয়েছে। ব্র্যান্ডের পাঞ্জাবি পাবেন এক হাজার ৩০০ টাকা থেকে পাঁচ হাজার ৫০০ টাকার মধ্যে। ব্র্যান্ডের বাইরের পাঞ্জাবির দাম পড়বে ৩০০ থেকে এক হাজার টাকার মধ্যে।

 

 

মন্তব্য

সর্বশেষ সংবাদ