আপনি কিভাবে বিতর্কের জগতে প্রবেশ করলেন? এখনো কিভাবে বিতর্কের মাঝেই নিজেকে উজ্জীবিত রেখেছেন?
স্কুল-কলেজ জীবন থেকেই আমার বিতর্কচর্চার লড়াই শুরু। তবে সেই লড়াইটা সমৃদ্ধি লাভ করে নব্বইয়ের দশকে। আশির দশকে ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন ভর্তি হই রাষ্ট্রক্ষমতায় তখন সামরিক সরকার হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। সারা দেশে সামরিক সরকারবিরোধী আন্দোলনের ঢেউ।
বিতর্ক নিয়ে এরশাদবিরোধী আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ি আমি নিজেও। গড়ে তুলি ঢাকা ইউনিভার্সিটি ডিবেটিং সোসাইটি। সাধারণ সম্পাদক হিসেবে নেতৃত্বে থাকি। একঝাঁক তরুণকে সঙ্গে নিয়ে বিতর্কের লড়াইটা ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হই।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিতর্কের ধারা এবং শৈলী কিভাবে পরিবর্তিত হয়েছে? কিভাবে এই পরিবর্তনগুলোর সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিয়েছেন?
বিতর্ক একটা চলমান বিষয়। বিতর্ককে আকর্ষণীয় করতে নতুন নতুন ফর্ম ব্যবহার করা হয়। এখানে ব্যক্তির প্রাপ্তির চেয়ে সামাজিক দায়বদ্ধতার বিষয়টিকে বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয়। এখানে মূল লক্ষ হলো—তরুণদের একমুখী চিন্তার বিপরীতে বহুমুখী চিন্তার বহিঃপ্রকাশ ঘটানো।
এ কারণেই নব্বইয়ের দশকের শেষে বেসরকারি টেলিভিশনে বিতর্কের সূচনা ঘটে আমার হাত ধরেই। নব্বইয়ের দশকের শেষলগ্নে প্রথম বেসরকারি টেলিভিশন এটিএন বাংলায় আমার পরিকল্পনা, উপস্থাপনা ও নির্দেশনায় শুরু করি বিতর্ক প্রতিযোগিতা। প্রথম প্রথম বিষয়ভিত্তিক বিতর্ক নিয়ে কাজ করি। এরপর রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তনের কথা ভেবে সংসদীয় ধারায় শুরু করি ছায়া সংসদের আদলে বিতর্ক প্রতিযোগিতা, যা এখনো চলমান আছে।
বিতর্ককে আপনি কিভাবে একটি শৈল্পিক অভিব্যক্তি হিসেবে দেখেন? বিতর্কের মাধ্যমে কিভাবে সাহিত্যিক মূল্যবোধ প্রকাশ করা যায়?
বিতর্ক চর্চা, অনুশীলন হলো সমাজের আয়না।
সমাজে যেকোনো বিষয় নিয়ে যত বেশি বিতর্ক হয় তাতে সমাজ, রাষ্ট্রই বেশি লাভবান হয়। সমাজের সব ক্ষেত্রে এক ধরনের জবাবদিহি উত্তরোত্তর বাড়ে। প্রথাগত চিন্তা-ভাবনা থেকে তরুণ প্রজন্মের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হয়। তরুণ প্রজন্মের মাঝে মূল্যবোধ, দেশপ্রেম, সদিচ্ছা তৈরি হয়। আসলে সমাজে-রাষ্ট্রে কী হচ্ছে, কেন হচ্ছে তা জানা ও বিশ্লেষণের অন্যতম মাধ্যম হলো বিতর্ক। যেখানে নানা মতের সম্মিলন ঘটে। যেখানে শুধুই যুক্তি দিয়ে বিষয়গুলো তুলে ধরা হয়। যেখানে আবেগের চেয়ে বাস্তবতার আলোকে বিষয়গুলো প্রাধান্য পায়। বিষয়গুলোকে শুধুই তথ্য-উপাত্ত দিয়ে গভীরভাবে তুলে ধরতে হয়। এ সব মিলিয়েই বিতর্কের শৈল্পিক রূপটি ফুটে ওঠে। এখানে যুক্তি, পাল্টা যুক্তি, তথ্য, উপস্থাপন সব একসঙ্গে তুলে ধরতে হয়। সাহিত্যের মাধ্যমে মানুষের মূল্যবোধ গড়ে ওঠে এবং তা বিকশিত হয়। সাহিত্যের মাধ্যমে মানুষের ভালো চরিত্রের গুণাবলি বিকশিত হয় এবং মানবিক মূল্যবোধের উন্নয়ন ঘটে।
বিতর্কচর্চার সঙ্গে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সম্পর্কটা কিভাবে দেখেন?
বিতর্কচর্চার প্রসার বৃদ্ধিতে, বিতার্কিক তৈরিতে আমরা অনেক দিন ধরে নিরলসভাবে কাজ করছি। আমরা চাই বিতর্কচর্চাটা শিক্ষার মূল শ্রোতধারায় অন্তর্ভুক্ত হোক। এখন পর্যন্ত সেটা কিন্তু হয়নি। আগেও বলেছি কো-কারিকুলার হিসেবে বিতর্কটাকে পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করা হোক। আমরা লক্ষ করছি, এ বছর পরিমার্জিত বা সংশোধিত পাঠ্যপুস্তকে ব্যাবহারিক ও উন্নয়নমূলক অনেক ধরনের শিক্ষা যুক্ত করা হয়েছে। অথচ ব্যাবহারিক শিক্ষার চেয়ে জরুরি বিষয় শিক্ষার্থীর ভেতরের বিকাশ। এখানে বিতর্ক শিক্ষা একজন শিক্ষার্থীর মেধা-মনন বিকাশে বড় ভূমিকা রাখতে পারে।
বিতর্ক প্রতিযোগিতায় নতুন প্রজন্ম সম্পৃক্ততাকে কতটা গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন?
বিতর্ক প্রতিযোগিতা বরাবরই তথ্য-তত্ত্ব, চিন্তার এবং দৃষ্টিভঙ্গির এক অপূর্ব উপস্থাপন, যা জ্ঞান ও চিন্তাকে বিকশিত করে। ভাবনার জগেক বড় বেশি প্রসারিত করে। বিতর্কচর্চার প্রাণ হলো নতুন প্রজন্ম। এটিই সত্য, বিতর্কচর্চার মধ্য দিয়ে নতুন প্রজন্ম যেমন প্রতিনিয়ত যুক্তিশীল হয়ে ওঠে, তেমনি তাদের মাঝে একটি চমৎকার ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে ওঠে। এটি সত্য যে এ দেশটাকে সুন্দরভাবে গড়তে হলে দায়িত্ববান যুক্তিশীল নতুন প্রজন্ম দরকার। দেশপ্রেমিক নতুন প্রজন্ম দরকার। যে নতুন প্রজন্ম বদলে দেবে আগামীদিন, আনবে নতুন সুপ্রভাত।
একটি দুর্দান্ত বিতর্ক আয়োজন উপহার দিতে গিয়ে সংগঠক হিসেবে আপনাকে কী ধরনের দায়িত্ব পালন করতে হয়।
সংগঠক হিসেবে আসলে অনেক দায়িত্ব রয়েছে। প্রোগ্রাম কনসেপ্ট তৈরি থেকে উপস্থাপন, অতিথি নির্বাচন—সব কিছুই করতে হয়। তবে সংগঠক হিসেবে অনেক দায়িত্ব পালন করলেও আমি বিতর্কের থিমেটিক বিষয়গুলোকে বেশি প্রায়োরিটি দিই। বিশেষ করে টপিক সিলেকশনে আমি সমসাময়িক প্রেক্ষাপটের ভিত্তিতে করে থাকি। বিতর্কচর্চাকে আমি সব সময় সমাজ-রাষ্ট্র-রাজনীতির আয়না হিসেবে দেখতে চাই। সমসাময়িক বিষয়ের ওপর প্রতিযোগিতা আয়োজন করতে গিয়ে বিগত শাসনামলে ফ্যাসিস্ট সরকারের রোষানলে পড়ারও ঘটনা ঘটেছে। তবে এখন সেই ঝুঁকি নেই। তাই প্রেক্ষাপট বিবেচনায় যেকোনো বিষয়ের ওপর ছায়া সংসদটি আয়োজন করতে পারছি।
গণতান্ত্রিক সমাজ বিনির্মাণে বিতর্ক কতটা প্রভাব রাখতে পারে বলে আপনি মনে করেন?
বিতর্কের প্রভাব বিশাল। বিতর্ক হলো যুক্তি উপস্থাপন ও শোনার একটি বিকল্প জায়গা। যেখানে মতপ্রকাশের পূর্ণ স্বাধীনতা রয়েছে। যে কেউ স্বাধীনভাবে এখানে মতামত এবং নিজের কথাগুলো বলতে পারে। এই মতামতের মধ্য দিয়েই সমাজের ভালো-মন্দ চুলচেরা বিশ্লেষণ করা যায়। দেখুন, দেশের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আমরা প্রতিনিয়ত রাজনীতিবিদ এবং নীতিনির্ধারক এবং পর্যবেক্ষকদের কথা শুনছি। গণমাধ্যমগুলোও বিভিন্ন বিষয়ে মত প্রকাশ করছে, সংবাদ বিশ্লেষণ করছে। কিন্তু ‘বিতর্কের চর্চামূলক অনুষ্ঠানে আমরা রাজনৈতিক পরিচয়ের বাইরের নতুন প্রজন্মোর প্রতিনিধিদের চিন্তা-ভাবনার কথা বিশেষভাবে শুনতে পাচ্ছি। গণতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণে এটির প্রভাব বিশাল।
আপনি অনেক দিন ধরে ডিবেট ফর ডেমোক্রেসি নামের একটি সংগঠনের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। এ সংগঠন নিয়ে আপনার ভবিষ্যৎ ভাবনার কথা জানতে চাই।
আমি আসলে স্বপ্নবাদী মানুষ। আমি স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসি। বিতর্ক নিয়ে আমার স্বপ্ন অনেক বড়। আমি বিশ্বাস করি বিতর্কচর্চা একটি গণতান্ত্রিক, বুদ্ধিবৃত্তিক সমাজ নির্মাণের প্রধানতম হাতিয়ার। বিতর্কের ব্যাপ্তি বাড়লে রাষ্ট্রসমাজ উপকৃত হয়। কিন্তু আমাদের দেশে এই শিল্পের এখন পর্যন্ত কোনো প্রাতিষ্ঠানিক রূপ গড়ে ওঠেনি। প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার জন্য আমরা অনেক আগেই একটি জাতীয় বিতর্কশালা বা একাডেমি নির্মাণের আহ্বান জানিয়েছে। এটি আমাদের প্রাণের দাবি। আমরা মনে করি, বিতর্কচর্চার প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে সরকার যদি এগিয়ে না আসে. তাহলে ডিবেট ফর ডেমোক্রেসি জনগণের সহায়তায় নিজেই উদ্যোগ গ্রহণ করবে। কেননা দেশে অনেক প্রতিষ্ঠান এভাবেই মানুষের সহায়তায় গড়ে উঠার নজির রয়েছে।