চাঁদ দেখার দিন বিকেলের পর থেকেই আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকা এক ধরনের রীতি হয়ে গেছে। অনেকে বাড়ির ছাদে, উঠানে বা খোলা জায়গায় পরিবারের সবাইকে নিয়ে চাঁদ দেখার চেষ্টা করে। শিশুদের মধ্যে চাঁদ দেখার ব্যাপারে বাড়তি কৌতূহল থাকে, তারা প্রথম চাঁদ দেখার প্রতিযোগিতায় মেতে ওঠে।
রাষ্ট্রীয়ভাবে ধর্মমন্ত্রীর সভাপতিত্বে ২৯ শাবান রমজানের চাঁদ দেখার জন্য বৈঠক হয়। চাঁদ দেখা গেলেই তা দ্রুত প্রচারের ব্যবস্থা করা হয়। পত্রপত্রিকা ও টেলিভিশন চ্যানেলগুলো চাঁদ দেখার খবর প্রচার করে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে।
তারাবি নামাজ ও বাঙালি মুসলিম সমাজ
বাঙালি মুসলিম সমাজে তারাবি নামাজ একটি সামাজিক ঐতিহ্য হয়ে উঠেছে। রমজানের চাঁদ উঠতেই পাড়া-মহল্লা ও শহরে নেমে আসে রমজানের পবিত্র আমেজ। জায়নামাজ হাতে মুসলমানরা মসজিদে ছুটে চলে তারাবি নামাজ আদায়ের জন্য। মসজিদগুলোয় নেমে আসে মুসল্লিদের ঢল। ধনী-গরিব, শিক্ষিত-অশিক্ষিত সবাই তারাবি নামাজে দাঁড়িয়ে যায় এককাতারে। বাবার সঙ্গে শিশুদের মসজিদে যাওয়াও বাংলার এক অনন্য সংস্কৃতি। অনেক মসজিদে তারাবি নামাজের জন্য হাফেজ ইমাম রাখা হয়, যাঁদের সুললিত তিলাওয়াতে ছড়িয়ে পড়ে মুগ্ধতা।
তারাবি শেষ হলে মানুষের দল বেঁধে বাসায় ফেরা ঈদের দিনের মতো রাস্তাঘাটে শুধু টুপি, পাঞ্জাবিতে এক আলাদা ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যের পরিবেশ ফুটে ওঠে। বাসায় বাসায় মহিলারা ছোট শিশুদের নিয়ে নামাজে দাঁড়িয়ে যান।
সাহরিতে বাঙালি সংস্কৃতি
বাংলাদেশে রমজান মাসে শেষ রাতে সাহরির সময় অন্য রকম এক আবহ তৈরি হয়। মহল্লার অলিগলিতে চলে রোজাদার মুসল্লিদের জাগানোর মহড়া। মসজিদের মিনার থেকে ইমাম-মুয়াজ্জিনের দরদি কণ্ঠে ভেসে আসে সাহরির আহ্বান। একসময় পুরান ঢাকায় কিশোররা দল বেঁধে বাংলা-উর্দু মিশ্রিত ভাষায় সুর তুলে রোজাদারদের জাগিয়ে তুলত। বাংলাদেশে সাহরিতে ‘কাসিদা’ গেয়ে ডাকাডাকির এ রেওয়াজ দীর্ঘদিনের।
আজ থেকে তিন-চার দশক আগে থানা-উপজেলা পর্যায়ে কোনো মসজিদ বা প্রতিষ্ঠান থেকে তীব্র আওয়াজের হুইসেল বাজানো হতো। এ আওয়াজ পেয়ে কয়েক গ্রামের মানুষ সাহরির জন্য ঘুম থেকে জাগত। এ ছাড়া মফস্বল অঞ্চলে মুড়ির টিনখ্যাত টিনের পাত্রে কাঠির আঘাতে শব্দ করে বলত, ‘রোজাদার উঠুন। সাহরির সময় হয়েছে।’
প্রযুক্তির উন্নতির আগে এভাবে সাহরিতে জাগানো হলেও বর্তমানে দল বেঁধে ডাকা ও কাসিদা গাওয়া অনেকাংশে কমে এসেছে। মাইকের আহ্বান এখনো প্রচলিত আছে। কিছু সময় পরপর ছোট্ট শব্দে সাহরির সময় মনে করিয়ে দিতে থাকেন ইমাম, মুয়াজ্জিন সাহেবরা। আধুনিক বিভিন্ন হামদ-নাত ও রমজানের বিশেষ নাশিদ বাজিয়েও রোজাদারদের সাহরির জন্য ঘুম থেকে জাগানো হয়।
সাহরির ডাকে নারীরা প্রথমে জেগে ওঠে, আহারের প্রাথমিক প্রস্তুতি শেষে সবাইকে জাগিয়ে তোলে। সাহরিতে একসময় দুধ, চিনি, নারকেল খাওয়া হতো, বাংলাদেশের প্রায় সব প্রান্তেই তা প্রসিদ্ধ ছিল।
ইফতারে বাঙালি সংস্কৃতি
বাঙালি মুসলিমদের ইফতার সংস্কৃতি ধর্মীয় অনুশীলন, ঐতিহ্য ও সামাজিক রীতিনীতির এক অনন্য মিশ্রণ। বাঙালির ইফতার মানেই ঐতিহ্যবাহী কিছু বিশেষ খাবারের সমাহার। যদিও ইসলামে সহজ ইফতার ও সংযমের তাগিদ দেওয়া হয়েছে, তবু বাঙালির ইফতার টেবিল সাধারণত বেশ বৈচিত্র্যময় হয়।
উনিশ শতকে ইফতার করাকে বলা হতো ‘রোজা খোলা’, অর্থাৎ খাবার গ্রহণের মাধ্যমে রোজা ভাঙা। সে সময় গ্রামগঞ্জে চাল, চালভাজা, ভাত, খই-চিড়ার মাধ্যমে ইফতার করার রেওয়াজ ছিল। সেসবের জায়গায় মাখানো ছোলামুড়ি এখন বাঙালি মুসলমানের ইফতারির মূল উপকরণ। শহর কী গ্রাম, ধনী অথবা গরিব সবার ইফতার তালিকায় স্থায়ী পত্তনি করে যাচ্ছে ছোলামুড়ি, পেঁয়াজু। বাঙালির ইফতারিতে শরবত খুবই জনপ্রিয়, বিশেষ করে বেলের শরবত, লেবুর শরবত, দুধ-লাচ্ছি এবং বাজারে প্রচলিত স্ন্যাকস ড্রিংক খাওয়া হয়।
বাংলার হাটবাজারে বাহারি ধরনের ইফতারের পসরা সাজিয়ে দোকানিরা বসেন। তবে পুরান ঢাকার ইফতার বহুল প্রচারিত ও প্রসিদ্ধ ইফতার। আরব-পারসিয়ান, মোগল ও ভারতীয় ভোজের সমন্বয়ে বাঙালির ইফতার সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে।
বেশির ভাগ পরিবারে সবাই একসঙ্গে বসে ইফতার করার সংস্কৃতি রয়েছে। আত্মীয়-স্বজন বা পাড়া-প্রতিবেশীদের মধ্যে ইফতার ভাগাভাগি করার রেওয়াজ আছে। গ্রামাঞ্চলে সাধারণত মসজিদে একত্র হয়ে ইফতার করার প্রবণতা বেশি দেখা যায়। সাধারণত নিজ থেকেই মহল্লাবাসী কে কবে ইফতারের আয়োজন করবে, তা মসজিদ কমিটি বা ইমাম সাহেবকে জানিয়ে রাখা হয়।
অনেকে প্রান্তিক ও অসহায় গোষ্ঠীর মধ্যে ইফতার বিতরণ করেন। এভাবেই ধর্মীয় অনুপ্রেরণা ও মানবতার মিশ্রণে বাঙালির ইফতার হয়ে উঠেছে জাতিগত সংস্কৃতি ও মানবতার প্রতিবিম্ব।
ইফতার মাহফিল
বাংলাদেশে রমজান মাসজুড়ে ইফতার পার্টি আয়োজনের সামাজিক প্রচলন রয়েছে, যেখানে আত্মীয়, বন্ধুবান্ধব, সহকর্মী বা ব্যাবসায়িক পার্টনারদের আমন্ত্রণ জানানো হয়, বিশেষ করে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ইফতার মাহফিল ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। ইফতার ও রোজার আবেদনকে কেন্দ্র করে আয়োজিত এই ইফতার মাহফিলগুলোতে সরকারি দল, বিরোধী দল ও ভিন্নমতের নানা সংগঠন দেশের চলমান বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে গঠনমূলক কথা বলে। রাষ্ট্রীয় উন্নতি-অবনতি, সামাজিক অবক্ষয়, দুর্নীতিসহ রাষ্ট্রের বিভিন্ন সংগতি-অসংগতির আলোচনা-সমালোচনা এবং সমাজসেবামূলক কোনো উদ্যোগ বাস্তবায়নের জন্য প্রেরণা জোগাতে সাধারণত এজাতীয় ইফতার মাহফিলগুলো অনুষ্ঠিত হয়। এ ধরনের ইফতার মাহফিলে সাধারণত বিভিন্ন শ্রেণির নেতারা, সংবাদকর্মী ও ধর্মীয় নেতারা উপস্থিত থাকেন। অনুষ্ঠান শেষে দেশ, জাতি, ধর্ম ও মানবতার কল্যাণ কামনা করে দোয়া-মোনাজাত করা হয়।
শবেকদরের সংস্কৃতি
বাঙালি মুসলিম সমাজে রমজান উদযাপনের অন্যতম উপলক্ষ হলো শবেকদর। মহিমান্বিত এ রাতের সন্ধানে রমজানের শেষ দশকের বিজোড় রাতগুলোতে বিশেষ ইবাদতের আয়োজন করা হয়। সাতাশতম রাতকে শবেকদর হিসেবে ধরে নেওয়ার প্রবণতা বেশি দেখা যায়, যদিও ইসলামে কোনো নির্দিষ্ট দিন বলা হয়নি। এ রাতে মসজিদ, ঘর ও বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান সুন্দর করে সাজানো হয়। রাতভর নফল নামাজ, তিলাওয়াত, দোয়া ও জিকির করা হয়। প্রায় মসজিদগুলোতে বিশেষ ওয়াজ-মাহফিলের আয়োজন হয়। অতঃপর মধ্য রাতে মোনাজাতে জীবনের গুনাহ মাফ, আত্মীয়-স্বজনের কল্যাণ, দুনিয়া ও আখিরাতের শান্তি কামনা করা হয়। অনেকে শবেকদরের বরকত লাভের জন্য শেষ ১০ দিন মসজিদে ইতিকাফে বসেন।