সাতক্ষীরার আশাশুনিতে খোলপেটুয়া নদীর বাঁধ দুই দিন পেরিয়ে গেলেও সেটি মেরামত করা সম্ভব হয়নি। ইতিমধ্যে বাঁধ ভেঙে আটটি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। ফলে ১৫ হাজার মানুষ পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছে। দেখা দিয়েছে সুপেয় পানির তীব্র সংকট।
সরজমিনে মঙ্গলবার স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মৎস্যঘেরে লবণ পানি প্রবাহের জন্য পাইপলাইন স্থাপন করায় বেড়িবাঁধের নিচের মাটি দুর্বল হয়ে পড়েছিল। ফলে এই ভাঙনের সৃষ্টি হয়।
আরো পড়ুন
ফেসবুকে ভাইরাল ঘিবলি স্টাইল, কী কেন কিভাবে
ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচির (সিপিপি) আশাশুনি উপজেলার টিম লিডার আবদুল জলিল বলেন, ‘আমরা যখন ঈদের নামাজে ছিলাম তখন শুনি বাঁধ ভেঙে গেছে। মোনাজাত না করেই ছুটে যাই।
গ্রামবাসী মিলে অস্থায়ীভাবে বাঁধ রক্ষা করতে চেষ্টা করেছিল। কিন্তু দুপুরের জোয়ারের পর সেই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। মূল যে পয়েন্টটি ভেঙেছে, সেটাতে একটি পাইপলাইন ও গেট সিস্টেম ছিল। যতগুলো ভাঙন পয়েন্ট রয়েছে, সবগুলোই পাইপলাইনের কারণে হয়েছে। এখন যদি আমরা এই পাইপলাইন বসানো বন্ধ না করি, তাহলে ভবিষ্যতে আরো বড় বিপর্যয় ঘটবে।’
তিনি বলেন, ‘পানিবন্দি মানুষ এখন খাবার সংকটে পড়েছে। অনেক পরিবার উঁচু জায়গায় আশ্রয় নিয়েছে। স্থানীয় প্রশাসন ও স্বেচ্ছাসেবীরা কাজ শুরু করলেও এখনো পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসেনি।’
সোমবার সকালে আনুলিয়া ইউনিয়নের বিছট গ্রামে প্রায় দেড়শ ফুট দৈর্ঘ্যের বেড়িবাঁধ নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায়।
এতে আনুলিয়া ইউনিয়নের বিছট, বল্লভপুর, আনুলিয়া, নয়াখালী, চেঁচুয়া, কাকবসিয়া, পারবিছুট ও বাসুদেবপুর গ্রামের বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়।
আনুলিয়া ইউনিয়ন পরিষদ সূত্রে জানা গেছে, বাঁধ ভেঙে প্রবল জোয়ারের পানি গ্রামগুলোর ৪ হাজার বিঘা জমির ধান ও ২০০ বিঘার অধিক চিংড়ি ঘের তলিয়ে গেছে। প্রায় ৭০০ থেকে ৮০০ বাড়িঘর পানির নিচে ডুবে গেছে। ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলোর মানুষ এখন দুর্বিষহ পরিস্থিতির মধ্যে দিন কাটাচ্ছে। ভাঙনের পরপরই গ্রামবাসীরা স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে বিকল্প রিংবাঁধ তৈরির চেষ্টা করলেও, প্রবল জোয়ারের তোড়ে সেই বাঁধও ধসে পড়ে। ফলে নতুন করে আরো বেশি এলাকায় পানি ঢুকে পড়ে।’
আনুলিয়া ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান রুহুল কুদ্দুস বলেন, ‘আমরা গভীরভাবে উপলব্ধি করছি, সামনে আমাদের জন্য কঠিন সময় অপেক্ষা করছে। কারণ মাত্র একদিনের ব্যবধানে পরিস্থিতি আরো খারাপ হয়েছে। দুপুর ও রাতের জোয়ারের কারণে ভাঙন আরো গভীর হয়েছে। বিচ্ছিন্ন এলাকা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। জরুরি ভিত্তিতে বেড়িবাঁধ সংস্কার করা প্রয়োজন। ইতোমধ্যে পানি উন্নয়ন বোর্ড, জেলা প্রশাসন, ইউএনও, সেনাবাহিনীর কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়েছেন। কিন্তু শুধুমাত্র উপস্থিত থাকলেই হবে না, দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে।’
তিনি আরো বলেন, ‘আমাদের এখানে বাল্কহেড (বালু ও মাটি বহনের নৌকা) প্রয়োজন। একটি বাল্কহেড এসেছে, তবে এটি দিয়ে কতক্ষণ কাজ চালানো সম্ভব? আমরা আশা করছি, রাতারাতি আরও চারটি বাল্কহেড আসবে, তারপর পুরোপুরি কাজ শুরু হবে। তবে এই ধরনের ভাঙন রোধ করতে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার জরুরি।’
আরো পড়ুন
জলঢাকায় বিএনপির দুই পক্ষের পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি, ১৪৪ ধারা জারি
সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক মোস্তাক আহমেদ বলেন, ‘আশাশুনি উপজেলার আনুলিয়া ইউনিয়নের বিছট গ্রামে খোলপেটুয়া নদীর পাশে পানি উন্নয়ন বোর্ডের বেড়িবাঁধ ছিল। কিন্তু গতকাল সেটার ১০০ মিটার অংশ ভেঙে গেছে। এতে ৮ থেকে ১০টি গ্রামে পানি ঢুকেছে। আমি খবর পাওয়ার পরপরই পানি উন্নয়ন বোর্ডকে জরুরি নির্দেশনা দিয়েছি। তবে ঈদের কারণে শ্রমিক সংকট ও বালু বোর্ড আনতে দেরি হওয়ায় কাজ শুরু করতে বিলম্ব হয়েছে। আমি সকালেই ঘটনাস্থলে এসে দেখেছি, পরিস্থিতি ভয়াবহ। আমরা যদি দ্রুত ব্যবস্থা নিতে না পারি, তাহলে পরবর্তী জোয়ারে আরো প্রায় আধা কিলোমিটার বাঁধ ভেঙে যেতে পারে। ইতোমধ্যে সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ডের দুটি বিভাগকে একত্রে কাজ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। স্থানীয়রা আমাদের সহযোগিতা করছেন, আমরা যত দ্রুত সম্ভব এই বাঁধ মেরামতের চেষ্টা করছি।’
স্থানীয়দের অভিযোগ, বাঁধ দুর্বল হয়ে পড়ার পেছনে অবৈধ পাইপলাইন ও গেট সিস্টেম অন্যতম কারণ। তারা অবিলম্বে এই পদ্ধতি বন্ধের দাবি জানিয়েছেন। প্রশাসনের কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকলেও স্থানীয়রা দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য জোরালো দাবি তুলেছেন। ভাঙন প্রতিরোধে অবিলম্বে জরুরি উদ্যোগ নেওয়া না হলে সাতক্ষীরার এই অঞ্চলে দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।