জয়পুরহাটের কালাই উপজেলার আলুচাষিরা এবছর চরম দুশ্চিন্তার মধ্যে পড়েছেন। জমি থেকে আলু তোলার উপযুক্ত সময় হলেও তারা হিমাগারে সংরক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় স্লিপ পাচ্ছেন না। ফলে বাধ্য হয়ে অনেকেই কম দামে আলু বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন, যা তাদের জন্য বড় ধরনের লোকসানের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
কৃষকদের অভিযোগ, হিমাগার মালিকরা মজুতদার ও ব্যবসায়ীদের কাছে আগেভাগেই স্লিপ বিক্রি করে দিচ্ছেন,যার ফলে প্রকৃত চাষিরা স্লিপ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
চলতি মৌসুমে কালাই উপজেলায় ১২ হাজার ৫০০ হেক্টরের বেশি জমিতে আলুর আবাদ হয়েছে, যা নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও বেশি। উপজেলা কৃষি বিভাগের তথ্যানুযায়ী, এ বছর প্রায় ৩ লাখ ১২ হাজার ২৭৫ টন আলু উৎপাদনের সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু পুরো উপজেলায় মাত্র ১১টি হিমাগার থাকায় সংরক্ষণ সুযোগ সীমিত হয়ে পড়েছে।
এই হিমাগারগুলোর মোট ধারণক্ষমতা মাত্র ৭০ হাজার টন, যা মোট উৎপাদনের মাত্র ২২.৪১ শতাংশ।
ফলে অধিকাংশ আলু হিমাগারে সংরক্ষণ করা সম্ভব হচ্ছে না। এতে কৃষকরা বাধ্য হয়ে বাজারে কম দামে আলু বিক্রি করছেন, যার ফলে বাজারেও আলুর দরপতন ঘটছে এবং কৃষকদের ব্যাপক আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে।
নর্থপোল কোল্ড স্টোরেজে আলু রাখতে না পেরে কাদিরপুর গ্রামের কৃষক মিরাজ আলি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, "হিমাগার মালিকেরা মজুতদারদের কাছে আগেভাগেই স্লিপ বিক্রি করে দিয়েছেন। ফলে প্রকৃত কৃষকরা স্লিপ পাচ্ছে না।
বাধ্য হয়ে কম দামে আলু বিক্রি করতে হচ্ছে, যা আমাদের জন্য বড় ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে।"
শিয়ালমারী গ্রামের কৃষক মুকাব্বের হোসেন ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, 'পল্লী কোল্ড স্টোরেজে স্লিপ নেই!তাহলে এত আলু কোথায় যাবে! যদি সংরক্ষণ করতে না পারি, তাহলে তো লস হবেই। মাথা ঠিক রাখতে পারছি না!'
সাঁতার গ্রামের আলুচাষি সাজ্জাদ হোসেন ক্ষোভ জানিয়ে বলেন, ''আলু এখনো ক্ষেতেই আছে, অথচ সাউথপোল কোল্ড স্টোরেজে জায়গা নেই! এটা কেমন নিয়ম? সবই হিমাগারের মালিকদের কারসাজি। এখন তাহলে আলু কম দামে বিক্রি করতে হবে।"
হিমাগারে আলু সংরক্ষণের জন্য সাধারণত দুই ধরনের বুকিং পদ্ধতি চালু রয়েছে,
১. লুজ বুকিং: কৃষক আলু বিক্রির পর হিমাগারের ভাড়া পরিশোধ করেন।
এবছর ৫০ কেজির এক বস্তার সংরক্ষণ খরচ ৪০০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।
২. পেইড বুকিং: সংরক্ষণের আগেই পুরো টাকা পরিশোধ করতে হয়, তবে কালাই উপজেলায় কোনো হিমাগার এই পদ্ধতি অনুসরণ করে না। কৃষকদের অভিযোগ, হিমাগার মালিকরা আগেভাগেই মজুতদার ও ব্যবসায়ীদের কাছে স্লিপ বিক্রি করে দিয়েছেন। ফলে প্রকৃত কৃষকরা স্লিপ পাচ্ছেন না।
নর্থপোল কোল্ড স্টোরেজের ম্যানেজার মোনোয়ার হোসেন এ বিষয়ে বলেন, "হিমাগারের ধারণক্ষমতা অনুযায়ী ৩৫% ব্যবসায়ী ও মজুতদারদের জন্য রেখে বাকি ৬৫% আলুচাষীদের জন্য উন্মুক্ত রাখা হয়েছে। যারা আগে এসে স্লিপ নিয়েছেন, তারাই কেবল আলু সংরক্ষণের সুযোগ পাচ্ছেন। এখন যেসব আলুচাষী স্লিপ সংগ্রহ না করে ক্ষোভ প্রকাশ করছেন, তাদের জন্য কিছুই করার নেই। আমাদের ধারণক্ষমতার বাইরে তো আলু সংরক্ষণ করতে পারি না!"
পল্লী কোল্ড স্টোরেজের ম্যানেজার মো. সাব্বির হোসেন বলেন, "প্রত্যেক আলুচাষীর জন্য ৫০ বস্তা করে স্লিপ বুকিং চলছে। আমরা আগাম স্লিপ দিইনি। যে আগে আসবে, সে-ই আলু সংরক্ষণের সুযোগ পাবে।" তবে কৃষকদের প্রশ্ন, "যদি আগাম স্লিপ দেওয়া না হয়ে থাকে, তাহলে আগেই সব শেষ হয়ে গেল কীভাবে?"
কালাই উপজেলার কৃষি অফিসার অরুণ চন্দ্র রায় আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, "আলু সংরক্ষণের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না থাকলে কৃষকরা ভবিষ্যতে আবাদ কমিয়ে দেবেন। বিশেষ করে বীজ আলু সংরক্ষণের ব্যবস্থা না থাকলে পরবর্তী মৌসুমে আলুর উৎপাদনও কমে যেতে পারে।"
উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) শামিমা আক্তার জাহান জানান, "যদি কোনো হিমাগার কর্তৃপক্ষ স্লিপ বিতরণে অনিয়ম করে থাকে বা মজুতদারদের সুবিধা দিয়ে কৃষকদের বঞ্চিত করে, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ বিষয়ে কঠোর নজরদারি রাখা হচ্ছে।"