<p>রাত সাড়ে ১১টা। কারওয়ান বাজারের সিগনালে ধাক্কাধাক্কি করে ৮ নম্বর লোকাল বাসে উঠেছি। সিট খালি নেই। একেবারে শেষের ৫ সিটের একটি ফাঁকা। হুড়াহুড়ি করে গেলাম শূন্যস্থান পূরণ করতে। বসতে গিয়ে একটু ইতস্ততবোধ করলাম। পাশের লোকটাকে খুব চেনা চেনা মনে হচ্ছে। দেখতে হুবহু প্রবীর মিত্রের মতো! কী সব ভাবছি? তাঁর মতো পর্দাকাঁপানো ‘নবাব’ ৮ নম্বর লোকাস বাসে আসবেন কোত্থেকে! তাও এই মধ্যরাতে।</p> <p>আগবাড়িয়ে জিজ্ঞেস করারও সাহস হলো না। আমার মতো বহু মানুষের কৌতূহলী চোখ দেখে তিনি অভ্যস্ত। হয়তো এ কারণেই চোখে-মুখে একটা চোরা হাসি জিইয়ে রাখলেন। তাতে কৌতূহলটা আরো বাড়ল। তাঁর গায়ে যেন আমার গা না লাগে, সাধ্যমতো চেষ্টা করলাম। বিষয়টা তিনি লক্ষ্য করলেন, ভরাট গলায় বললেন, ‘আরেকটু চেপে বসেন, সমস্যা নেই।’</p> <div class="d-flex justify-content-center"> <div class="col-12 col-md-10 position-relative"><strong>আরো পড়ুন</strong> <div class="card"> <div class="row"> <div class="col-4 col-md-3"><img alt="প্রাণ গেল ২ ভক্তের, আল্লুর পর এবার কাঠগড়ায় রাম চরণ" height="66" src="https://asset.kalerkantho.com/public/news_images/2025/01/07/1736223936-0c7ffb2cdb828a849261fbb547da5d52.png" width="100" /></div> <div class="col-8 col-md-9"> <p>প্রাণ গেল ২ ভক্তের, আল্লুর পর এবার কাঠগড়ায় রাম চরণ</p> </div> </div> </div> <a class="stretched-link" href="https://www.kalerkantho.com/online/entertainment/2025/01/07/1465964" target="_blank"> </a></div> </div> <p>গলার স্বরও হুবহু প্রবীর মিত্রের মতো। সিনেমার মতোই ভাবনায় এলো, এমনও হতে পারে তিনি প্রবীর মিত্রের জমজ ভাই। ঠিক তখনই বাসের হেলপার এসে বাজখাই গলায় ভাড়া চাইল, দিলাম। তিনিও পকেট থেকে টাকা বের করলেন; কিন্তু হেলপার কিছুতেই তাঁর কাছ থেকে ভাড়া নেবেন না। ‘টেকা দিয়া আপনের সিনেমা দেখছি। এখন সামনাসামনি দেখলাম, মনে করেন এইটা আপনেরে সামনাসামনি দেখনের টিকেটের টেকা’, বলেই ছেলেটা খিল খিল করে হাসতে লাগল। ততক্ষণে নিশ্চিত হলাম, এতক্ষণ আমি প্রবীর মিত্রের সঙ্গে বাস জার্নি করছি। টাকাটা হেলপারের পকেটে গুঁজে দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন প্রবীর মিত্র। তাঁর নামার সময় হলো। প্রেস ক্লাবের সামনে নেমে গেলেন। জানালা দিয়ে দেখার চেষ্টা করলাম, কোনদিকে যাচ্ছেন তিনি। কিন্তু না, কোনো হদিস পাইনি।</p> <p>২০১০ সালে তাঁর সেগুনবাগিচার ফ্ল্যাটে সামনাসামনি বসে ঘটনাটা বললাম। ৮-৯ বছর আগের ঘটনা শুনে তিনি মুচকি হাসেন। বলেন, ‘আমি প্রায়ই লোকাল বাসে চড়ি। ভালো লাগে। মানুষের কৌতূহলী চোখ আমার ভালো লাগে। মানুষের সঙ্গে মিশলে নিজেকে শেকড়ে বাঁধা মনে হয়। সিনেমার মানুষ হয়েছি বলে বাসে, হাটে-বাজারে সাধারণ মানুষের সঙ্গে বসা যাবে না, আমার মধ্যে এমন কোনো ইগো কাজ করে না।’</p> <div class="d-flex justify-content-center"> <div class="col-12 col-md-10 position-relative"><strong>আরো পড়ুন</strong> <div class="card"> <div class="row"> <div class="col-4 col-md-3"><img alt="প্রবীর মিত্রের মৃত্যুতে যা বলছেন সহকর্মীরা" height="66" src="https://asset.kalerkantho.com/public/news_images/2025/01/06/1736161851-e07e50f5ab6b503e9985fd043a16751a.jpg" width="100" /></div> <div class="col-8 col-md-9"> <p>প্রবীর মিত্রের মৃত্যুতে যা বলছেন সহকর্মীরা</p> </div> </div> </div> <a class="stretched-link" href="https://www.kalerkantho.com/online/entertainment/2025/01/06/1465666" target="_blank"> </a></div> </div> <p>বন্ধুদের আড্ডায় আমরা আনোয়ার হোসেনকে বলতাম ‘কিং অব হার্ট অ্যাটাক’। গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকের সিনেমার পর্দায় তিনি এলেই একটি হঠাৎ মৃত্যুদৃশ্যের জন্য মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে রাখত দর্শক। আনোয়ার হোসেনের পর সেই স্থান পাকাপাকিভাবে দখল করেন প্রবীর মিত্র। দুজনই পর্দার ‘নবাব সিরাজদ্দৌলা’, প্রথমজন সাদাকালো নবাব, দ্বিতীয়জন রঙিন। দুই ‘নবাব’-এরই অভিনয়জীবনের শেষটাকে প্রায় অপ্রয়োজনীয় ও গুরুত্বহীন চরিত্রের করে তুলেছিলেন ঢাকাই ছবির নির্মাতারা। এই প্রসঙ্গ উঠতেই সেদিন প্রবীর মিত্র লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেলেছিলেন। পরশু রাতে যখন তাঁর মৃত্যুর খবর পেলাম, সেই দীর্ঘশ্বাসটা গায়ে কাঁটার মতো এসে বিঁধল। দীর্ঘশ্বাস ফেলে সেদিন যে কথাটা বলেছিলেন, পরে সেটা ছাপতে মানাও করলেন। তাতে তাঁর কাজ পেতে সমস্যা হতো। কথাটা এখন বলাই যায়। কারণ এখন তিনি কাজ পাওয়া না-পাওয়ার ঊর্ধ্বে পৌঁছে গেছেন। বলেছিলেন, ‘ঢাকাই ছবির শুরু থেকে এখন পর্যন্ত ডিরেক্টররা শুধু ছবি হিট করানোর ফর্মুলা কপি করে গেছেন। কোনো ছবি হিট করলে, সে গল্পটাকে এদিক-সেদিক করে গোটা দশেক ছবি করে গেছেন। কেউ ভালো ছবি বা নতুন কিছু করেছেন, কিন্তু সেটা হিট হয়নি; সেদিকে পা মাড়াত না কেউ। এই করে করে শিল্পটা মরে গেছে। অভিনয়শিল্পীদের নিয়ে পর্দায় খেল দেখানোর কথা তাদের মাথায়ই আসেনি। আমার কথা বাদই দেন, আনোয়ার হোসেন-খলিল ভাইয়ের মতো অভিনেতাদের কত কিছু দেওয়ার ছিল। কিছুই হলো না।’</p> <div class="d-flex justify-content-center"> <div class="col-12 col-md-10 position-relative"><strong>আরো পড়ুন</strong> <div class="card"> <div class="row"> <div class="col-4 col-md-3"><img alt="চিরচেনা এফডিসিতে নিথর দেহে প্রবীর মিত্র" height="66" src="https://asset.kalerkantho.com/public/news_images/2025/01/06/1736158361-e07e50f5ab6b503e9985fd043a16751a.jpg" width="100" /></div> <div class="col-8 col-md-9"> <p>চিরচেনা এফডিসিতে নিথর দেহে প্রবীর মিত্র</p> </div> </div> </div> <a class="stretched-link" href="https://www.kalerkantho.com/online/entertainment/2025/01/06/1465646" target="_blank"> </a></div> </div> <p>এই প্রজন্মের অনেকেই ‘তিতাস একটি নদীর নাম’, ‘চরিত্রহীন’, ‘রাজলক্ষ্মী শ্রীকান্ত’, ‘পরিণীতা’, ‘দহন’ বা ‘বড় ভালো লোক ছিল’-এর প্রবীর মিত্রকে দেখেনি। দেখেছে সদা মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত গোটা পঞ্চাশেক ছবির পার্শ্বচরিত্রের অভিনেতাকে। যে কারণে তাঁর মৃত্যুর পর ‘বড় ভালো লোক ছিল’ বলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তেমন আবেগি শোকগাথা দেখা যায়নি।</p> <p>ঢাকাই ছবির ইতিহাসে তবু তিনি থাকবেন অমলিন। পর্দার অগণিত মৃত্যু যাঁকে পরাজিত করতে পারেনি, বাস্তব জীবনের শুধু একটি মৃত্যু কি তাঁকে ভুলিয়ে দেবে? অসম্ভব।</p>