হোয়াইট হাউসে ট্রাম্প ও জেলেনস্কির নজিরবিহীন বাদানুবাদ ও বৈঠক ভেস্তে যাওয়া নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন ইউরোপের নেতারা। মার্কিন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে ইইউ নেতাদের ভবিষ্যৎ সম্পর্ক কেমন হবে তা নিয়ে চলছে আলোচনা।
শুক্রবার হোয়াইট হাউসে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভোলোদিমির জেলেনস্কি সঙ্গে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ভাইস প্রেসিডেন্ট জে ডি ভ্যান্সের প্রকাশ্য বাদানুবাদের ঘটনা ঘটে। মূল্যবান খনিজ নিয়ে চুক্তি ও ভবিষ্যৎ রুশ হামলা ঠেকাতে ট্রাম্পের কাছ থেকে নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি আদায়ের লক্ষ্য নিয়ে ওয়াশিংটন সফরে গিয়েছিলেন জেলেনস্কি।
কিন্তু রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধ ও মার্কিন সহায়তা নিয়ে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়ের পর কোনো চুক্তি ছাড়াই আকস্মিকভাবে বৈঠকটি শেষ হয়। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি জেলেনস্কি অসম্মান প্রদর্শন করেছেন বলে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন ট্রাম্প ও ভ্যান্স।
পরবর্তীতে ট্রাম্প তার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বলেছেন, জেলেনস্কি শান্তির জন্য প্রস্তুত নন।
ক্ষমা চাইতে বললেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী রুবিও
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও এই ঘটনার জন্য জেলেনস্কিকে ক্ষমা চাইতে বলেছেন।
সংবাদমাধ্যম সিএনএনকে তিনি বলেন, ‘এভাবে বৈঠক শেষ করে আমাদের সময় নষ্ট করার জন্য (ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টের) ক্ষমা চাওয়া উচিত।’
জেলেনস্কি সত্যিই শান্তি চান কি না, তা নিয়েও সন্দেহ প্রকাশ করেছেন রুবিও। শান্তি প্রচেষ্টাকে অবমূল্যায়ন করার মাধ্যমে জেলেনস্কি এর সঙ্গে জড়িত সবাইকে নিরাশ করেছেন বলেও উল্লেখ করেছেন তিনি।
তবে এই ঘটনায় এখনো ক্ষমা চাননি জেলেনস্কি।
ট্রাম্প ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত ফক্স নিউজকে তিনি বলেছেন, ‘খারাপ কিছু করেছি—এমনটা আমি নিশ্চিত নই।’ তবে সাংবাদিকদের সামনে এমন বাদানুবাদ তার প্রত্যাশিত ছিল না বলেও জানান।
যুক্তরাষ্ট্রকে নিয়ে মিত্রদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন
এদিকে আটলান্টিক কাউন্সিলের ইউরোপ সেন্টারের সিনিয়র ফেলো রেচেল রিৎজো মনে করেন, মিত্র হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভবিষ্যৎ কেমন হবে এই বৈঠকের পর ইউরোপীয় নেতাদের তা ভাবাবে।
রেচেল বলেন, ‘বিশেষ করে কয়েক সপ্তাহ ধরে ট্রাম্প প্রশাসনের উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধিদের ইউরোপ সফরের পর, আমি মনে করি মার্কিন মিত্র ও অংশীদাররা, সত্যিই প্রশ্ন তুলছে, যুক্তরাষ্ট্র তাদের কেমন অংশীদার।’
তার মতে, এর ফলে এমন এক পরিস্থিতি তৈরি হবে, যার ফলে মিত্র ও অংশীদাররা যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে তাকাতে শুরু করবে।
এতে বৈশ্বিক স্তরে যুক্তরাষ্ট্র দুর্বল হবে বলেও তিনি অভিমত দেন।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক প্রধান কায়া কালাস তার প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, ‘আজকে এটা পরিষ্কার হয়ে গেছে, মুক্ত বিশ্বের একজন নতুন নেতার প্রয়োজন। এই চ্যালেঞ্জ নেওয়াটা আমাদের ইউরোপের ওপর বর্তায়।’
তিনি আরো বলেন, ‘আমরা ইউক্রেনের প্রতি আমাদের সমর্থন বৃদ্ধি করব, যাতে তারা হামলাকারীদের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যেতে পারে।’
ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাখোঁ এক্সে দেওয়া এক পোস্টে লিখেছেন, ‘একটি আক্রমণকারী : রাশিয়া। আক্রমণের মুখে থাকা একটি জাতি : ইউক্রেন।’
তিনি আরো লিখেছেন, ‘যারা শুরু থেকে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে তাদের প্রতি সম্মান জানান। কারণ তারা তাদের মর্যাদা, স্বাধীনতা, সন্তান ও ইউরোপের নিরাপত্তার জন্য লড়ছেন।’
ইউক্রেন ও জেলেনস্কির প্রতি সমর্থনের এই দলে আরো যোগ দিয়েছেন ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডার লিয়েন, ইউরোপীয় কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট আন্তোনিও কস্তা, জার্মানির বিদায়ি চ্যান্সেলর ওলাফ শোলজ, নির্বাচনে জয়ী চ্যান্সেলর ফ্রেডরিখ মেৎস, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার, পোলিশ প্রধানমন্ত্রী ডোনাল্ড টুস্ক ও স্প্যানিশ প্রধানমন্ত্রী পেদ্রো সানচেজ।
ট্রাম্পের সঙ্গে যেভাবে আচরণ করতে হবে
ওভাল অফিসে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়ের ঘটনার পর ট্রাম্প ও জেলেনস্কি—দুজনের সঙ্গেই স্টারমার ফোনে কথা বলেছেন। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর একজন মুখপাত্র বলেছেন, প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কিসহ আন্তর্জাতিক নেতাদের নিয়ে রবিবারের সম্মেলনের অপেক্ষায় আছেন স্টারমার।
গত সপ্তাহে স্টারমার হোয়াইট হাউসে ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। এর আগে ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠক করেছেন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ম্যাখোঁ।
বিশ্লেষক রেচেল রিৎজো মনে করেন, স্টারমার ও ম্যাখোঁর মতো গর্ব ঝেড়ে ফেলাই জেলেস্কির জন্য এখন সবচেয়ে ভালো বিকল্প। তিনি বলেন, ‘ইমানুয়েল ম্যাখোঁ ও কিয়ার স্টারমার তাদের অহংকার এক পাশে রাখতে সক্ষম হয়েছেন।’
ট্রাম্পের সঙ্গে কিভাবে আচরণ করতে হবে, তা ব্যাখ্যা করে রেচেল আরো বলেন, ‘হোয়াইট হাউসে উপস্থিত হয়ে একরকম করণীয় অনুযায়ী ট্রাম্পের প্রশংসা করুন, ব্যাপারটা যদিও অনেকটা ছোট বাচ্চাদের সামলানোর মতো।’
তিনি মনে করেন, জেলেনস্কির তা করতে পারা উচিত, যদিও যুদ্ধের মধ্যে থাকা ‘ইউক্রেনের গৌরববোধ’ বোধগম্য বলে উল্লেখ করেন তিনি।
সম্মেলনের ডাক মেলোনির
এদিকে ইতালির প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনি এত দিন ইউক্রেনকে সমর্থন দিয়ে গেলেও কট্টর ডানপন্থী রাজনীতিবিদ হিসেবে ট্রাম্পের সঙ্গে তার ভালো সম্পর্ক। তিনি ইউক্রেনসহ বর্তমান বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ নিয়ে পশ্চিমা দেশগুলোর আলোচনার ডাক দিয়েছেন।
মেলোনি বলেন, ‘পশ্চিমাদের প্রতিটি বিভাজন আমাদের সবাইকে দুর্বল করবে এবং যারা আমাদের সভ্যতার পতন দেখতে চায় তাদের সুবিধা দেবে।’
তবে ট্রাম্প ও জেলেনস্কির দূরত্বের কারণে ভবিষ্যতে যুদ্ধ বন্ধে যেকোনো চুক্তিতে পৌঁছনো কঠিন হবে বলে মনে করেন রিৎজোও। এমনকি সমঝোতা প্রক্রিয়ায় ইউরোপ বাদ পড়তে পারে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি। বলেন, ‘ট্রাম্প জেলেনস্কিকে উদ্ধত ও শান্তির জন্য প্রস্তুত নন বলে মনে করেন, তাই তিনি বাদ পড়বেন। যা ঘটেছে তা সহজে কাটিয়ে ওঠা যাবে—এটা আমার প্রত্যাশা, কিন্তু আমার মনে হয় তা কঠিন হবে।’
ট্রাম্পের পাশে হাঙ্গেরির অরবান
ইউরোপীয় ইউনিয়নের বেশির ভাগ দেশই হোয়াইট হাউসের ঘটনায় জেলেনস্কির পাশে দাঁড়িয়েছেন। তবে হাঙ্গেরির জাতীয়তাবাদী প্রধানমন্ত্রী ভিক্টর অরবান মার্কিন প্রেসিডেন্টের পক্ষ নিয়েছেন। রাশিয়া ঘনিষ্ঠ অরবান আগে থেকেই ট্রাম্পের মিত্র হিসেবে পরিচিত।
হোয়াইট হাউসে ট্রাম্প-জেলেনস্কির বিতণ্ডার পর অরবান এক্সে লিখেছেন, ‘প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আজ সাহসের সঙ্গে শান্তির পক্ষে দাঁড়িয়েছেন। যদিও তা অনেকের পক্ষে হজম করা কঠিন। ধন্যবাদ প্রেসিডেন্ট।’
ট্রাম্পের প্রতি অরবানের সমর্থনের কারণে ইউরোপীয় ইউনিয়নের পক্ষ থেকে ইউক্রেনকে ভবিষ্যতে কিছু সহায়তা দেওয়া নিয়ে সমস্যা তৈরি হতে পারে, বিশেষ করে যেসব ক্ষেত্রে ২৭ দেশের জোটটির সব সদস্যের অনুমোদনের প্রয়োজন পড়ে।