নতুন-পুরনো মিলে বর্তমানে দেশে হাজারের বেশি শীর্ষ মাদক কারবারি রয়েছে। এদের মধ্যে রয়েছে শতাধিক তরুণ। সরকার পরিবর্তনের পর এরা ইন্টারনেট ব্যবহার করে ছড়িয়ে দিচ্ছে ভয়ংকর সব মাদক। শহর থেকে প্রত্যন্ত গ্রাম পর্যন্ত রয়েছে এদের অগনন মাঠকর্মী, যারা নানাভাবে মাদকসেবীদের কাছে পৌঁছে দিচ্ছে এসব মাদক।
শতাধিক তরুণ তালিকার শীর্ষে
রেজোয়ান বিশ্বাস

ডিএনসির প্রতিবেদন বলছে, ২০২২ থেকে ২০২৩-এর জুলাই পর্যন্ত পাঁচ বছরে মাদকাসক্ত হয়ে মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে (রিহ্যাব) চিকিৎসা নিয়েছে প্রায় ৫৫ হাজার মাদকসেবী। এই সময় রিহ্যাবে চিকিৎসা নেওয়া নারী মাদকাসক্তের সংখ্যা বেড়েছে পাঁচ গুণ। আর ১৫ বছর ও তার কম বয়সী মাদকাসক্ত বেড়েছে তিন গুণ, সংখ্যায় যা ৪৭ হাজার ৩৭৬ জন।
সূত্র মতে, গত দেড় দশকে দেশে শনাক্ত ৩০ ধরনের মাদকের মধ্যে শুধু সাত ধরনের যে পরিমাণ মাদক উদ্ধার করা হয়েছে, তার অর্থমূল্য অন্তত ১৯ হাজার কোটি টাকা। সংশ্লিষ্টরা বলছে, উদ্ধার হওয়া এসব মাদক দেশে ছড়িয়ে পড়া মোট মাদকের মাত্র ২০ থেকে ২৫ শতাংশ।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিপ্তর সূত্র জানায়, বর্তমান পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে শীর্ষ মাদক কারবারিদের নতুন তালিকা করা হয়েছে। এদের মধ্যে ২৯২ জনকে চিহ্নিত করা হয়েছে। এরা সবাই শীর্ষ মাদক কারবারি। এদের অনেকে ২০ থেকে ৩০ বছর ধরে মাদক কারবারে যুক্ত। দেশজুড়ে মাদকের বড় নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছে তারা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দেশের বিভিন্ন এলাকায় শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী হিসেবে যারা পরিচিত, তাদের বেশির ভাগ এখনো ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। সরকার পরিবর্তনের পর এদের অনেকে গাঢাকা দিয়েছে। অনেকে আবার রাজনৈতিক পরিচয় পরিবর্তন করে নতুন আঙ্গিকে শুরু করেছে মাদক কারবার।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরকে মাদকের গডফাদারদের গ্রেপ্তারে নির্দেশ দিয়েছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। সম্প্রতি রাজধানীর সেগুনবাগিচায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে মতবিনিময়সভায় তিনি এ নির্দেশ দেন।
জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, মাদক ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে ধ্বংসের মাধ্যমে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য ভয়াবহ পরিণতি বয়ে আনে। তাই মাদক নির্মূলে অধিদপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মানসিকতার পরিবর্তন করে আন্তরিকভাবে কাজ করতে হবে।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর, পুলিশ, বিজিবি, র্যাব ও বাংলাদেশ কোস্ট গার্ডের ২০০৯ থেকে ২০২৪ সালের অক্টোবর পর্যন্ত করা মামলা, উল্লেখযোগ্য আসামি ও মাদকদ্রব্যের বিবরণী থেকে জানা যায়, এই সময়ে মোট অভিযান পরিচালিত হয়েছে আট লাখ ৫৩ হাজার ২৫৮টি, মামলা হয়েছে দুই লাখ ২৮ হাজার ৭০৯টি, আসামি করা হয়েছে দুই লাখ ৪৪ হাজার ৮৯৪ জনকে।
সাম্প্রতিক সময়ে গ্রেপ্তার অন্তত শতাধিক মাদক কারবারিকে জিজ্ঞাসাবাদ করে ডিএনসিসহ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী জানতে পেরেছে, আন্তর্জাতিক মাদক কারবারিচক্র বর্তমানে বাংলাদেশকে কোকেন ও হেরোইন পাচারের রুট হিসেবে ব্যবহার করছে।
দেশের ১৩টি কেন্দ্রীয় কারাগার ও ৫৫টি জেলা কারাগারে যেসব বন্দি রয়েছে, তাদের মধ্যে অন্তত ৩০ শতাংশ মাদকের অভিযোগে বন্দি।
অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, মাদক তরুণসমাজকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। এর ফলে দেশে যেমন মাদকাসক্ত বাড়ছে, তেমনি মাদকের প্রভাবে অপরাধ বাড়ছে।
উল্লেখযোগ্য মাদক কারবারি
উল্লেখযোগ্য মাদক কারবারিদের বিষয়ে ডিএনসি সূত্র বলছে, রাজধানীতে সবচেয়ে বেশি শতাধিক শীর্ষ মাদক কারবারি রয়েছে। এদের মধ্যে তরুণ কারবারি অন্তত ৪৫ জন। পাশাপাশি চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে শীর্ষ মাদক কারবারি বেশি। রাজধানীর শীর্ষ মাদক কারবারিদের মধ্যে আছে মোহাম্মদপুর বিহারি ক্যাম্পের কলিম জাম্বো, চুয়া সেলিম, হিরণ, বুন্দিয়া সোহেল, ইশতিয়াক। এদের পৃষ্ঠপোষক পতিত সরকারের বেশ কজন ওয়ার্ড কাউন্সিলর। এ ছাড়া রামপুরার তানিমসহ নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর মিলে তালিকায় শীর্ষ ৯০ জন কারবারির নাম রয়েছে।
শীর্ষ মাদক কারবারিদের বিষয়ে ডিএনসির তথ্যে বলা হয়েছে, সাইফুল করিম নামে এক ব্যবসায়ী নিজেকে আমদানি-রপ্তানিকারক পরিচয় দিলেও মাদক ব্যবসায় রয়েছে তার বড় বিনিয়োগ। সে মূলত ঢাকা ও চট্টগ্রামে অবস্থান করে ইয়াবা ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করে। এ ছাড়া ফেনীর ইসমাইল হোসেনের নাম রয়েছে শীর্ষ মাদক কারবারির তালিকায়।
সূত্র বলছে, বর্তমানে চট্টগ্রাম বিভাগে রয়েছে ৭২ জন শীর্ষ মাদক কারবারি। চট্টগ্রাম বিভাগের তালিকায় রয়েছে কক্সবাজার সদর, টেকনাফ ও উখিয়ার সাবেক এমপি, উপজেলা, ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এবং আত্মীয়-স্বজন মিলিয়ে অন্তত ২০ জনের নাম। এর বাইরে রাজশাহী বিভাগের তালিকায় ২১ জন শীর্ষ হেরোইন কারবারিসহ ৩৫ জনের নাম রয়েছে। এই বিভাগে শীর্ষ কারবারি, পাইকারি কারবারি ও বহনকারী মিলিয়ে এক হাজার ৩৯২ জনের নাম তালিকায় রয়েছে।
খুলনা বিভাগে শীর্ষ মাদক কারবারির তালিকায় রয়েছে ২০ জনের নাম, বরিশাল বিভাগে ১৫ জন, সিলেট বিভাগে ২০ জন, রংপুর বিভাগে ২৫ জন এবং ময়মনসিংহ বিভাগে রয়েছে ২০ জনের নাম।
ডিএনসি সূত্র জানায়, আগে ইয়াবা চোরাচালানের রুট ছিল মায়ানমারের টেকনাফ সীমান্ত। বর্তমানে এই রুটে বিজিবির কড়া টহল থাকায় মাদক কারবারিরা রুট পরিবর্তন করেছে। পাশের অন্য দেশ থেকেও আসছে ইয়াবা। সাগরপথে উপকূলীয় এলাকা দিয়ে দেশে ঢুকছে এসব ইয়াবা। এ ছাড়া যশোরের বেনাপোল, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, সাতক্ষীরা, লালমনিরহাট, চুয়াডাঙ্গা ও জয়পুরহাট সীমান্ত এলাকা দিয়ে ঢুকছে ইয়াবা।
ডিএনসি সূত্র বলছে, মাদক নিয়ন্ত্রণে তালিকাভুক্ত শীর্ষ মাদক কারবারি, পাইকারি কারবারি ও বহনকারী—এ তিন ক্যাটাগরিতে মোট ১০ হাজার জনের তালিকা করে মাঠে নেমেছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর (ডিএনসি)। শীর্ষ কারবারিদের কেউ কেউ গ্রেপ্তার হলেও অধিকাংশ চলে গেছে আত্মগোপনে। গত ৪ সেপ্টেম্বর অস্ত্র ও মাদক উদ্ধারে যৌথ অভিযানের ঘোষণা দিলে আত্মগোপনে চলে যায় এসব মাদক কারবারিরা।
সূত্র বলছে, তালিকাভুক্ত এসব শীর্ষ কারবারির মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রভাবশালী নেতা, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর বেশ কজন সাবেক কর্মকর্তা, সরকারি কর্মকর্তা। তবে সরকার পরিবর্তনের পর শতাধিক তরুণ শীর্ষ মাদক কারবারির তথ্য পাওয়া গেছে। অনলাইনে এরা দেশ-বিদেশের মাদক কারবার নিয়ন্ত্রণ করছে।
মাদকের শীর্ষ কারবারি বদি সম্পর্কে সূত্র বলছে, মায়ানমার সীমান্তে তার কয়েক শ মাদক সন্ত্রাসী রয়েছে। তারা নিয়মিত মায়ানমার থেকে মাদকের চালান দেশে আনত। বাংলাদেশের অন্তর্জাতিক মাদক রুট নিয়ন্ত্রণ করে সে। এ ছাড়া মাদকের তালিকায় বদির সঙ্গে তার পাঁচ ভাই মৌলবি মুজিবুর রহমান, আবদুস শুক্কুর, মো. সফিক, আবদুল আমিন ও মো. ফয়সালের নামও রয়েছে। এরা সবাই শীর্ষ মাদক কারবারি।
ডিএনসির পরিচালক (অপারেশনস অ্যান্ড গোয়েন্দা) তানভীর মমতাজ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘৫ আগস্ট-পরবর্তী দেশে মাদকের কারবার কিছুটা বেড়েছে। তবে আমরা মাদক কারবারিদের তালিকা করে অভিযান অব্যাহত রেখেছি। দেশের যেসব সীমান্ত এলাকা দিয়ে মাদক বেশি ঢুকছে, সেসব এলাকায় আগের চেয়ে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে।’
ইন্টারনেটে শীর্ষ কারবারি
মাদক নিয়ন্ত্রণকারীদের সাম্প্রতিক অভিযানে তিন তরুণ গ্রেপ্তার হলে জিজ্ঞাসাবাদে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছে তারা। ইন্টারনেটে তারা মাদক বিস্তারে মূল ভূমিকা পালন করছিল। গত ৪ ডিসেম্বর নিত্যনতুন মাদকসহ উচ্চবিত্ত পরিবারের এই তিন তরুণকে গ্রেপ্তার করে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। রাজধানীর গুলশান ও পল্টন এলাকায় মাদকবিরোধী অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের কাছ থেকে নতুন মাদক ট্রেট্রাহাইড্রো ক্যানাবিনলযুক্ত কুশ, ক্যানাবিনলযুক্ত কান্ডি, তরল ক্যানাবিনয়েড, ম্যাজিক মাশরুম জব্দ করা হয়। গ্রেপ্তাররা হলো কাজী মারুফুল ইসলাম ওরফে রাজ (২৬), মো. ইসমাইল বেপারী (৩০) ও সাকিব নঈম।
নতুন রুটে দেশে ঢুকছে হেরোইন-কোকেন
জানা গেছে, বেনাপোলের পুটখালী, শিকারপুর, রঘুনাথপুর, অভ্রভুলাট ও দৌলতপুর সীমান্ত দিয়ে নিয়মিত দেশে মাদক ঢুকছে ।
ডিএনসির পরিচালক (অপারেশন ও গোয়েন্দা) তানভীর মমতাজ বলেন, কোকেন-হেরোইনের চালান দেশে ঢুকছে। গত এক বছরে দেশে চোরাপথে এক হাজার কোটি টাকার বেশি কোকেন ও হেরোইন জব্দ করার তথ্য দিয়েছে ডিএনসি।
সম্পর্কিত খবর

সচিবালয় এলাকায় শ্রমিক-পুলিশ সংঘর্ষ আহত অর্ধশতাধিক
নিজস্ব প্রতিবেদক

রাজধানীতে বকেয়া বেতন-বোনাসের দাবিতে আন্দোলনকারী শ্রমিকদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে জাতীয় প্রেস ক্লাব ও সচিবালয়ের লিংক রোডের সামনে এই ঘটনা ঘটে।
সংঘর্ষের সময় উভয় পক্ষের অর্ধশতাধিক ব্যক্তি আহত হয়েছেন। এর মধ্যে অন্তত ৪০ জন শ্রমিক এবং ১১ জন পুলিশ সদস্য রয়েছেন।
পুলিশের দাবি, সংঘর্ষ চলাকালে বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা পুলিশের একটি গাড়ি ভাঙচুর করেন। আর আন্দোলনকারী শ্রমিকরা বলছেন, পুলিশ বিনা উসকানিতে তাঁদের ওপর সাউন্ড গ্রেনেড ও টিয়ার শেল নিক্ষেপ করলে আতঙ্কে তাঁরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যান। এ সময় শ্রমিকদের মারধর করা হয় বলেও তাঁরা অভিযোগ করেন।
ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকা ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) শাহবাগ থানার পরিদর্শক সরদার বুলবুল আহমেদ বলেন, সড়ক অবরোধ করে শ্রমিকরা বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করার চেষ্টা করেন।
গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক রাজু আহমেদ বলেন, সচিবালয়ের সামনে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে তাঁদের ৩০ থেকে ৩৫ জন শ্রমিক আহত হয়েছেন।
জানা গেছে, টানা তিন দিন ধরে শ্রম মন্ত্রণালয়ের সামনে অবস্থান কর্মসূচি চালিয়ে আসছিলেন গার্মেন্টস শ্রমিকরা। পূর্বঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী গতকাল সকাল ১০টার দিকে নয়াপল্টন থেকে বিজয়নগরের দিকে অগ্রসর হতে শুরু করেন তাঁরা। এ সময় পুলিশ তাঁদের প্রথমে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করলেও সেই বাধা উপেক্ষা করে তাঁরা সামনে এগিয়ে যান। পরে পল্টন পার হয়ে তোপখানা রোডে প্রবেশ করতে গেলে পুলিশ আবারও তাঁদের বাধা দেয়, যা পরে সংঘর্ষে রূপ নেয়।
সংঘর্ষের এক পর্যায়ে শ্রম ভবনের সামনে অবস্থান নিয়ে বাংলাদেশ গার্মেন্টস ও সোয়েটার্স শ্রমিক ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক রুহুল আমিন বলেন, দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন অব্যাহত থাকবে। বেতন-বোনাস না পেলে ঈদের দিন প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় ঘেরাও করা হবে।
শাহবাগ থানার পরিদর্শক মো. আসাদুজ্জামান বলেন, সচিবালয় সড়কে ঢুকতে চাইলে নিয়ম অনুযায়ী শ্রমিকদের বাধা দেওয়া হয়। এ সময় তাঁরা পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছুড়লে পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে টিয়ার শেল ছুড়ে তাঁদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়।
শাহবাগ থানার ওসি মো. খালিদ মনসুর বলেন, ‘পুলিশের ব্যারিকেড থেকে দূরে থাকতেই শ্রমিকরা পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছোড়েন। এতে আমাদের কয়েকজন সদস্য আহত হয়েছেন। অল্প সময়ের মধ্যে আমরা তাঁদের ছত্রভঙ্গ করে দিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসি। পরে শ্রমিকরা যে যাঁর মতো চলে গেছেন।

১০% কারখানা নিয়ে আশঙ্কা
নিজস্ব প্রতিবেদক

তৈরি পোশাকশিল্পের নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও অধিকাংশ মালিক শ্রমিকদের বেতন ও ঈদ বোনাস পরিশোধ করেছেন। কিছু কারখানা, যেগুলো নিয়ে আশঙ্কা রয়েছে সেগুলো নিয়েও মালিক-শ্রমিক ও সরকার তৎপর। আশা করা হচ্ছে দু-এক দিনের মধ্যে এ সংকটও কেটে যাবে। গতকাল মঙ্গলবার সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, কয়েক হাজার কারখানার মধ্যে দু-চার-দশটি কারখানায় প্রতিবছরই সংকট দেখা দেয়। তবে সবশেষে খুশিমনে শ্রমিকরা ঈদ করতে বাড়ি ফিরতে পারেন।
এদিকে ১৪টি কারখানার বকেয়া বেতন ও ঈদ বোনাস নিয়ে গতকাল আশঙ্কার কথা জানিয়েছে বিজিএমইএ। তবে এ নিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কাজ করছে বলেও জানিয়েছে তৈরি পোশাক খাতের শীর্ষ সংগঠনটি।
জানতে চাইলে বিজিএমইএর সাবেক পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল কালের কণ্ঠকে বলেন, আশা করছি প্রতিবারের মতো এবারও শ্রমিকরা তাঁদের ঈদ বোনাস ও বকেয়া বেতন নিয়ে বাড়ি ফিরবেন। এর জন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও ব্যাংকগুলোকে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য আহ্বান জানানো হয়েছে। কারণ এসব ব্যাংক তৈরি পোশাক খাতের উদ্যোক্তাদেরই অংশীদার। তাই যেসব মালিক ব্যাংকঋণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, তাঁদের সহযোগিতায় হাত বাড়িয়ে দিতে হবে।
তিনি বলেন, শ্রমিক ভাইদের প্রতি অনুরোধ, ভাঙচুর চালিয়ে এই শিল্পকে ক্ষতিগ্রস্ত করবেন না। এতে কর্মসংস্থানসহ দেশের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কোনো পক্ষই উপকৃত হবে না।
এদিকে শ্রমিকদের বকেয়া বেতন এবং ঈদ বোনাস নিয়ে গতকালও রাজধানীতে কিছু অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছে।
গতকাল দুপুরে জাতীয় প্রেস ক্লাব ও সচিবালয়ের লিংক রোডে পুলিশের সঙ্গে শ্রমিকদের এই অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে। এতে উভয় পক্ষের অর্ধশতাধিক ব্যক্তি আহত হয়েছে।
১২ পোশাক কারখানার মালিকের বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা
সরকারের বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যে শ্রমিকদের বকেয়া বেতন ও ঈদ বোনাস পরিশোধ না করায় ১২টি কারখানার মালিকের বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে সরকার। এসব কারখানার মালিকরা শ্রমিকদের বেতন-বোনাস পরিশোধ না করা পর্যন্ত বিদেশ যেতে পারবেন না।
গতকাল মঙ্গলবার সচিবালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে নৌ পরিবহন এবং শ্রম ও কর্মসংস্থান উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন এ তথ্য জানান।
শ্রম উপদেষ্টা বলেন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে ইমিগ্রেশনে তাঁদের বিষয়ে তথ্য জানানো হয়েছে। আজ (গতকাল) থেকেই এ নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হয়েছে।
তিনি বলেন, ২৭ মার্চের মধ্যে পোশাক কারখানার শ্রমিকদের বেতন-ভাতা পরিশোধ করার কথা। কিন্তু ১২টি কারখানা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে বেতন-ভাতা পরিশোধ করতে পারছে না বলে জানিয়েছে। এর মধ্যে পাঁচটি কারখানায় অসন্তোষ চলছে।
নির্ধারিত সময়ের মধ্যে যাঁরা বেতন-ভাতা পরিশোধ করতে পারছেন না, তাঁদের বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। আমরা শ্রম আইন অনুযায়ী এঁদের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ ব্যবস্থা নেব—বলেন উপদেষ্টা এম সাখাওয়াত হোসেন।
কোনো কোনো কারখানার মালিকদের বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। সাংবাদিকরা প্রশ্ন করলে কারখানাগুলোর নাম বলা যাবে না বলে জানান উপদেষ্টা।
১২ কারখানার বাইরে অন্য কারখানা শ্রমিকদের বেতন-বোনাস পরিশোধ না করলে তাঁদের বিষয়ে কী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে প্রশ্ন করলে উপদেষ্টা এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ২৭ মার্চের মধ্যে সব কারখানার শ্রমিকদের বেতন-বোনাস পরিশোধ করতে হবে। ২৭ মার্চের পর আমরা বিষয়টি পর্যালোচনা করব। যদি আরো কোনো প্রতিষ্ঠান শ্রমিকদের বেতন-বোনাস পরিশোধ করতে না পারে তাদের বিরুদ্ধেও সর্বোচ্চ আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
কালিয়াকৈরে বকেয়া বেতন না দিয়ে গেটে তালা ঝুলিয়ে পলাতক কর্তৃপক্ষ
কালিয়াকৈর (গাজীপুর) প্রতিনিধি জানান, গাজীপুরের কালিয়াকৈরে তিন মাসের বকেয়া বেতন ও ঈদ বোনাস না দিয়ে কারখানার গেটে তালা ঝুলিয়ে পালিয়ে গেছে কর্তৃপক্ষ। মঙ্গলবার সকালে মৌচাকের কামরাঙ্গীচালা এলাকার ‘হ্যাগ নিট ওয়্যার’ নামের একটি নিট কারখানার শ্রমিকরা বেতনের জন্য কারখানায় এসে তালা দেখে বিক্ষোভে ফেটে পড়েন। পরে বকেয়া বেতন ও ঈদ বোনাসের দাবিতে সকাল সাড়ে ৭টা থেকে সাড়ে ৮টা পর্যন্ত ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন শ্রমিকরা। এতে ওই মহাসড়কে চলাচলকারীরা বিপাকে পড়ে।
কারখানার শ্রমিকরা অভিযোগ করেন, চলতি মাসসহ তিন মাস ধরে তাঁদের কোনো বেতন দেয় না মালিক পক্ষ। আশপাশের সব কারখানায় বেতন ও ঈদের বোনাস দেওয়া হয়েছে। পরিবার-পরিজন নিয়ে কিভাবে এখন তাঁরা ঈদ করবেন।
কালিয়াকৈর থানার ওসি রিয়াদ মাহমুদ বলেন, মৌচাকের একটি কারখানা কর্তৃপকক্ষ শ্রমিকদের বেতন ও ঈদ বোনাস না দিয়ে গেটে তালা ঝুলিয়ে রেখেছে। তাদের পাওয়া যাচ্ছে না। বেতনের দাবিতে শ্রমিকরা মহাসড়ক অবরোধ করেছেন। খবর পেয়ে পুলিশ ও সেনাবাহিনী ঘটনাস্থলে গিয়ে শ্রমিকদের বুঝিয়ে সড়ক থেকে সরিয়ে দিলে যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক হতে থাকে। পরে শ্রমিকরা কারখানার সামনে গিয়ে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করছেন।
সাভারে ঈদের ছুটি বৃদ্ধি, বন্ধ কারখানা চালুর দাবিতে শ্রমিকদের সড়ক অবরোধ
সাভার (ঢাকা) প্রতিনিধি, জানান সাভারে ঈদের ছুটি বৃদ্ধি, বন্ধ কারখানা খুলে দিয়ে শ্রমিকদের ওভারটাইম পরিশোধ এবং দাবি আদায়ে আন্দোলনের ঘটনায় আটক ছয় শ্রমিকের নিঃশর্ত মুক্তির দাবিতে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছেন তৈরি পোশাক শ্রমিকরা। এ সময় কারখানা বন্ধের প্রতিবাদ জানিয়ে বহিরাগত সন্ত্রাসী দিয়ে শ্রমিকদের ওপর হামলা-মামলার প্রতিবাদ জানিয়ে কর্তৃপক্ষের অপসারণ দাবি করে বিক্ষোভ মিছিল করেছেন তাঁরা। গতকাল সকালে সাভারের হেমায়েতপুর-সিংগাইর-মানিকগঞ্জ সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছেন স্থানীয় জিন্স ম্যানুফ্যাকচারিং কম্পানি লিমিটেড কারখানার দুই হাজার শ্রমিক।

ব্যাঙ্ককে ইউনূস-মোদি বৈঠকের জন্য প্রস্তুত ঢাকা দিল্লির সম্মতির অপেক্ষা
নিজস্ব প্রতিবেদক

আগামী সপ্তাহে ব্যাঙ্ককে বিমসটেক শীর্ষ সম্মেলনের ফাঁকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বৈঠকের জন্য ঢাকা প্রস্তুত। এ বৈঠকের জন্য নয়াদিল্লির ইতিবাচক উত্তরের অপেক্ষায় আছে ঢাকা।
গতকাল মঙ্গলবার ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এক ব্রিফিংয়ে পররাষ্ট্রসচিব মো. জসীম উদ্দিন এ কথা জানান। ড. ইউনূস-নরেন্দ্র মোদির বৈঠকের সম্ভাবনা নিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্রসচিব বলেন, ‘যেকোনো দেশের সঙ্গে শীর্ষ পর্যায়ের যে বৈঠক, সেই বৈঠক আমরা গুরুত্বপূর্ণ মনে করি।
পররাষ্ট্রসচিব বলেন, ‘আমাদের দিক থেকে বলতে পারি, আমরা এই বৈঠকের জন্য প্রস্তুত আছি। ভারতের দিক থেকে আমরা একটা ইতিবাচক উত্তরের অপেক্ষায় আছি।’
বৈঠকের জন্য দিল্লি কি প্রস্তুত নয়—এই প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্রসচিব বলেন, ‘দিল্লি প্রস্তুত কি না, সেটা দিল্লি বলবে।
ব্রিফিংয়ে পররাষ্ট্রসচিব বলেন, আগামী ৪ এপ্রিল থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাঙ্ককে ষষ্ঠ বিমসটেক শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এ শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিতে প্রধান উপদেষ্টা আগামী ৩ এপ্রিল ব্যাঙ্ককে পৌঁছবেন।
পররাষ্ট্রসচিব বলেন, তিনি আগামী ২ এপ্রিল বিমসটেকের সচিব পর্যায়ের সভায় অংশ নেবেন।
পররাষ্ট্রসচিব বলেন, এবারের বিমসটেক শীর্ষ সম্মেলনের আগে আগামী ৩ এপ্রিল প্রধান উপদেষ্টা ‘বিমসটেক ইয়াং জেনারেশন ফোরাম : হয়্যার দ্য ফিউচার মিটস’ শীর্ষক ফোরামে মূল বক্তা হিসেবে বক্তব্য দেবেন।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, ষষ্ঠ বিমসটেক শীর্ষ সম্মেলনে বাংলাদেশ আগামী ২ বছরের জন্য বিমসটেকের সভাপতিত্ব গ্রহণ করবে। এ কারণে এবারের বিমসটেক শীর্ষ সম্মেলন বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, বিমসটেকের ষষ্ঠ শীর্ষ সম্মেলনে বিমসটেকের সদস্য রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে ‘মেরিটাইম ট্রান্সপোর্ট কো-অপারেশন’ সংক্রান্ত একটি চুক্তি স্বাক্ষরের সম্ভাবনা রয়েছে। এ চুক্তি বাণিজ্যিক শিপিং ও সামুদ্রিক পরিবহন শক্তিশালীকরণের মাধ্যমে আঞ্চলিক অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক বৃদ্ধিতে সহায়তা করবে বলে বাংলাদেশ আশা করছে।

সংবিধান সংস্কার কমিশনের সুপারিশ
জরুরি অবস্থা ঘোষণায় দ্বিমত বিএনপির
হাসান শিপলু

জাতীয় সাংবিধানিক কমিশনের (এনসিসি) সিদ্ধান্তক্রমে রাষ্ট্রপতি জরুরি অবস্থা ঘোষণা করতে পারবেন—সংবিধান সংস্কার কমিশনের এমন সুপারিশের সঙ্গে একমত হয়নি বিএনপি। দলটি বলেছে, জরুরি অবস্থা জারির সঙ্গে সরকারের নির্বাহী কর্তৃত্বের বিষয়টি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত হওয়ায় এসংক্রান্ত ক্ষমতা সরকার ও সংসদের বাইরে অন্য কোনো কর্তৃপক্ষের কাছে থাকা সংগত নয়।
সংস্কার কমিশনের সুপারিশে আরো বলা হয়, জরুরি অবস্থার সময় নাগরিকদের কোনো অধিকার রদ বা স্থগিত করা যাবে না এবং আদালতে যাওয়ার অধিকার বন্ধ বা স্থগিত করা যাবে না। তাই অনুচ্ছেদ ১৪১(খ) ও অনুচ্ছেদ ১৪১(গ) বাতিল হবে।
গত রবিবার জাতীয় ঐকমত্য কমিশনে জমা দেওয়া সংবিধান সংস্কার কমিশনের সুপারিশের ওপর বিএনপি এই মতামত তুলে ধরেছে।
বিএনপির দেওয়া মতামত পর্যালোচনায় এ তথ্য জানা গেছে।
সংস্কার কমিশনগুলোর সুপারিশের ওপর দেওয়া মতামতে বিএনপি জাতীয় সংসদের মেয়াদ পাঁচ বছর বহাল রাখার পক্ষে মত দিয়েছে। সংস্কার কমিশনের চার বছর মেয়াদের সুপারিশের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে দলটি এই মত দেয়।
প্রধানমন্ত্রী কোনো রাজনৈতিক দলের প্রধান কিংবা সংসদ নেতা হিসেবে থাকতে পারবেন না বলে সংবিধান সংস্কার কমিশন যে সুপারিশ করেছে সে বিষয়ে বিএনপির বক্তব্য হলো প্রধানমন্ত্রী দলের প্রধান অথবা সংসদ নেতা পদে কোনো এক বা একাধিক ব্যক্তি অধিষ্ঠিত হবেন কি না, তা একান্তই সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দলের সিদ্ধান্ত হওয়া উচিত। এ ক্ষেত্রে সাংবিধানিকভাবে কোনো বিধি-নিষেধ আরোপ সংসদীয় গণতন্ত্রের মূল চেতনার পরিপন্থী।
অবশ্য সংবিধান সংস্কার কমিশনের সুপারিশে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মেয়াদ তিন মাসের কথা বলা হলেও নির্বাচন কমিশন সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মেয়াদ চার মাস করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এই সময়ে জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকারের সব নির্বাচন অনুষ্ঠানের সুপারিশ করা হয়।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় কালের কণ্ঠকে বলেন, দলের পক্ষ থেকে সুপারিশ জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের কাছে দেওয়া হয়েছে। এখন সরকার অতি প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে সংসদ নির্বাচনের ব্যবস্থা করবে—এটাই সবার প্রত্যাশা। তিনি বলেন, সংবিধান সংশোধনের দায়িত্ব নির্বাচিত সরকারের। সে জন্য সংবিধানসংক্রান্ত কোনো সংশোধন করতে হলে আগে নির্বাচন দিতে হবে। নির্বাচিত সরকার সংসদে সেই সংশোধন আনবে।
সংবিধান সংস্কার কমিশনের সুপারিশের ওপর বিএনপির মতামত পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার ন্যূনতম বয়স ২১ বছর চায় না দলটি। আইনসভার নিম্নকক্ষের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের সমর্থনে প্রধানমন্ত্রী মনোনীত হওয়ার বিধানের সঙ্গেও একমত নয়। তবে সংসদের দুজন ডেপুটি স্পিকারের মধ্যে একজন বিরোধী দল থেকে মনোনীত করায় দলটি একমত। একই সঙ্গে উচ্চকক্ষের একমাত্র ডেপুটি স্পিকার সরকারি দলের বাইরে থেকে নির্বাচিত হোক, সেটাও চায় বিএনপি।
বিএনপির দেওয়া মতামত পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট একটি আইনসভার বিষয়ে নীতিগতভাবে তারা একমত। তবে উভয় কক্ষের (উচ্চকক্ষ ও নিম্নকক্ষ) মেয়াদ চার বছর করার যে সুপারিশ করা হয়েছে, সেখানে বিএনপি বলেছে, মেয়াদ পাঁচ বছর হওয়া সমীচীন হবে।
প্রস্তাবের সংবিধান সংশোধনী অংশে সংবিধানের যেকোনো সংশোধনী উভয় কক্ষের দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় অনুমোদন এবং গণভোটে করার কথা বলা হয়েছে। বিএনপি এর সঙ্গে একমত নয়। দলটি বলেছে, সংবিধানের সব সংশোধনী গণভোটে উপস্থাপন বাস্তবসম্মত নয়। এ ক্ষেত্রে অনুচ্ছেদ ১৪২-কে পঞ্চদশ সংশোধনীপূর্ব অবস্থায় ফিরিয়ে নেওয়াই যথেষ্ট। নিম্নকক্ষে পাস হওয়া বিল উচ্চকক্ষ সুপারিশসহ কিংবা সুপারিশ ব্যতিরেকে পুনর্বিবেচনার জন্য নিম্নকক্ষে ফেরত পাঠাতে পারবে—এরূপ বিধান করা যেতে পারে।
রাষ্ট্রপতি অংশে বলা আছে, রাষ্ট্রপতির মেয়াদ হবে চার বছর। রাষ্ট্রপতি সর্বোচ্চ দুইবারের বেশি অধিষ্ঠিত থাকবেন না। এই প্রস্তাবের সঙ্গে একমত না হয়ে বিএনপি তাদের মতামতে বলেছে, রাষ্ট্রপতির মেয়াদ পাঁচ বছর হওয়া সমীচীন হবে। বিদ্যমান সংবিধানে সর্বোচ্চ দুইবারের বেশি রাষ্ট্রপতি পদে অধিষ্ঠিত না থাকার বিধান [অনুচ্ছেদ ৫০(২)] থাকায় এতত্সংক্রান্ত সুপারিশ অপ্রয়োজনীয়।
প্রস্তাবে প্রধানমন্ত্রী অংশে বলা হয়েছে, আইনসভার নিম্নকক্ষের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের সমর্থনে প্রধানমন্ত্রী মনোনীত হবে। এর সঙ্গে একমত নয় বিএনপি।
প্রধানমন্ত্রী অংশে আরো বলা হয়েছে, আইনসভার মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার আগে যদি কখনো প্রধানমন্ত্রী স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেন বা আস্থা ভোটে হেরে যান কিংবা অন্য কোনো কারণে রাষ্ট্রপতিকে আইনসভা ভেঙে দেওয়ার পরামর্শ দেন, সে ক্ষেত্রে যদি রাষ্ট্রপতির কাছে এটা প্রতীয়মান হয় যে নিম্নকক্ষের অন্য কোনো সদস্য সরকার গঠনে প্রয়োজনীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ সমর্থন অর্জনে ব্যর্থ হচ্ছে, তবেই রাষ্ট্রপতি আইনসভার উভয় কক্ষ ভেঙে দেবেন। সংবিধান সংস্কার কমিশনের এই সুপারিশের সঙ্গে একমত নয় বিএনপি।
বলা হয়েছে, একজন ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সর্বোচ্চ দুইবার দায়িত্ব পালন করতে পারবেন। তিনি একাদিক্রমে অথবা অন্য যেকোনো উপায়ে দুইবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী পদে আসীন হতে পারবেন না। সুপাশিরকৃত এই বিধানের সঙ্গে একমত পোষণ না করে বিএনপি বলেছে, প্রধানমন্ত্রী পদের মেয়াদসংক্রান্ত বিষয়ে ‘কোনো ব্যক্তি একাদিক্রমে তৃতীয়বার প্রধানমন্ত্রী পদে নিয়োগ লাভের যোগ্য বলিয়া বিবেচিত হইবেন না’—এরূপ বিধান করাই যথেষ্ট।
প্রস্তাবে আরো বলা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রী থাকা অবস্থায় তিনি কোনো রাজনৈতিক দলের প্রধান এবং সংসদ নেতা হিসেবে অধিষ্ঠিত থাকতে পারবেন না। এর সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে বিএনপি বলেছে, প্রধানমন্ত্রী দলের প্রধান অথবা সংসদ নেতা পদে কোনো এক বা একাধিক ব্যক্তি অধিষ্ঠিত হবেন কি না, তা একান্তই সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দলের সিদ্ধান্ত হওয়া উচিত। এ ক্ষেত্রে সাংবিধানিকভাবে কোনো বিধি-নিষেধ আরোপ সংসদীয় গণতন্ত্রের মূল চেতনার পরিপন্থী।
সংবিধান সংস্কার কমিশনের বিচার বিভাগের সুপ্রিম কোর্ট অংশে দেশের সব বিভাগে হাইকোর্ট বিভাগের সমান এখতিয়ারসম্পন্ন হাইকোর্টের স্থায়ী আসন প্রবর্তনের সুপারিশ করা হয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের আসন রাজধানীতেই থাকবে। সব বিভাগে হাইকোর্টের স্থায়ী আসন প্রবর্তনের বিষয়ে একমত নয় বিএনপি। দলটি বলেছে, দেশের সব বিভাগে হাইকোর্ট বিভাগের স্থায়ী আসন সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর সঙ্গে সাংঘর্ষিক হওয়ায় এটি করার সুযোগ নেই। বিকল্প হিসেবে ঢাকার বাইরে অনুচ্ছেদ ১০০-এর অধীনে হাইকোর্ট বিভাগের সার্কিট বেঞ্চ স্থাপন করা যেতে পারে।
প্রস্তাবে আপিল বিভাগের বিচারকদের মধ্য থেকে সর্বোচ্চ জ্যেষ্ঠ বিচারককে প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ প্রদানকে প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের একটি বিধান সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করার কথা বলা হয়েছে। বিএনপি এই প্রস্তাবের সঙ্গে আংশিকভাবে একমত। দলটি তাদের মতামতে বলেছে, ‘ডকট্রিন অব নেসেসিটি’ বিবেচনায় রেখে প্রবীণতম তিনজন বিচারকের মধ্য থেকে প্রধান বিচারপতি নিয়োগের বাধ্যবাধকতা আরোপ করা যেতে পারে।
স্থায়ী অ্যাটর্নি সার্ভিস অংশে সংবিধানের অধীন একটি স্থায়ী অ্যাটর্নি সার্ভিস প্রতিষ্ঠা করার সুপারিশ করা হয়েছে। এর সঙ্গে একমত নয় বিএনপি। দলটি বলেছে, স্থায়ী প্রসিকিউশন সার্ভিসের প্রয়োজনীয়তা থাকলেও তা আইনের মাধ্যমে ও পর্যায়ক্রমে হওয়া সমীচীন।
প্রস্তাবে সংবিধানের মূলনীতি অংশে বলা হয়েছে, কমিশন নিম্নোক্ত বিধান অন্তর্ভুক্তির সুপারিশ করছে। ‘বাংলাদেশ একটি বহুত্ববাদী, বহুজাতি, বহুধর্মী, বহুভাষী ও বহু-সংস্কৃতির দেশ, যেখানে সব সম্প্রদায়ের সহাবস্থান ও যথাযথ মর্যাদা নিশ্চিত করা হবে।’
অন্যদিকে রাষ্ট্রের মূলনীতি অংশে সংবিধানের মূলনীতি ও রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি হিসেবে ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র ও জাতীয়তাবাদ এবং এসংশ্লিষ্ট সংবিধানের ৮, ৯, ১০ ও ১২ অনুচ্ছেদ বাদ দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। উভয় ক্ষেত্রে একমত নয় বিএনপি। দলটি দুই ক্ষেত্রেই বলেছে, অনুচ্ছেদ ৮, ৯, ১০ ও ১২-কে পঞ্চদশ সংশোধনীর আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নেওয়াই অধিকতর যুক্তিযুক্ত।