<p>৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মাধ্যমে শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়। গঠিত হয় অন্তর্বর্তী সরকার। এই সরকারের হাত ধরেই পরিবর্তন আসতে শুরু করেছে আর্থিক খাতে। আর্থিক খাত ঢেলে সাজাতে বাংলাদেশ ব্যাংক পায় একজন নতুন গভর্নর। এরপর বিধ্বস্ত ব্যাংক ও আর্থিক খাত ঢেলে সাজাতে সাহসী পদক্ষেপ নিতে শুরু করে বাংলাদেশ ব্যাংক।</p> <p>ব্যাংকের পর্ষদ পুনর্গঠন, আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার, কঠোর নজরদারির মাধ্যমে বাণিজ্যভিত্তিক অর্থপাচার রোধ, মূল্যস্ফীতি কমাতে নীতি সুদহার বৃদ্ধিসহ আরো কিছু কঠিন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে গত দুই মাসে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সিদ্ধান্তগুলো পুরোপুরি বাস্তবায়িত হলে খুব শিগগির আরো ইতিবাচক ফল আসবে বলে আশাবাদী গভর্নর।</p> <p>খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, কয়েক বছর ধরেই নানামুখী সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশের ব্যাংক খাত। গত দুই বছরে এই সংকট আরো গভীর হয়েছে। একটি বিশেষ গোষ্ঠীর মাধ্যমে ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ, ঋণের নামে ব্যাংক লুটপাট ও বিদেশে অর্থপাচার, লাগামহীন খেলাপি ঋণ, ব্যাংকে তীব্র তারল্য সংকট, ডলার ও রিজার্ভ সংকটে ব্যাংক খাতের ক্ষত আরো গভীর হয়েছে।</p> <p>নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের যে ভূমিকা রাখার কথা ছিল, সেটি পালন করেননি ওই সময়ের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার। এতে ব্যাংকের প্রতি গ্রাহকের আস্থাহীনতা বাড়ে। নতুন সরকারের নিয়োগ দেওয়া গভর্নর আমানতকারীদের আশ্বস্ত করলে আবারও ব্যাংকে ফিরতে শুরু করেছে টাকা।</p> <p>বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, বর্তমানে নোটস ইন সার্কুলেশন বা প্রচলনে থাকা টাকার পরিমাণ কমে তিন লাখ ১০ হাজার কোটিতে নেমেছে। গত ১৫ আগস্ট তা ছিল তিন লাখ ২২ হাজার ৬১ কোটি। ছাত্র আন্দোলনকে কেন্দ্র করে টাকা উত্তোলনের চাপ বেড়েছিল ব্যাংকে। তাই ওই সময় মানুষের হাতে টাকার পরিমাণ বেড়েছিল। সে টাকা আবারও ব্যাংকিং চ্যানেলে ফেরত আসতে শুরু করেছে। সাধারণত নোটস ইন সার্কুলেশন বা মানুষের হাতে প্রচলিত টাকার পরিমাণ থাকে দুই লাখ ৮০ থেকে ৯০ হাজার কোটি। ব্যাংকের ওপর আস্থা ধীরে ধীরে বাড়লে টাকা আরো ফেরত আসবে বলে জানিয়েছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা।</p> <p>নতুন সরকার আসার পর ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে রেমিট্যান্স বা প্রবাস আয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম চার মাসে রেমিট্যান্স এসেছে ৮৯৩ কোটি ৫০ লাখ বা প্রায় ৯ বিলিয়ন ডলার। গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরের একই সময়ে এসেছিল ৬৮৮ কোটি বা ৬.৮০ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে রেমিট্যান্সের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২০৫ কোটি ডলার বা ৩০ শতাংশ। এই রেমিট্যান্সের ওপর ভর করে বর্তমানে প্রায় ১৯ বিলিয়ন ডলারে অবস্থান করছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ।</p> <p>ব্যাংকিং খাতের সৃষ্ট সমস্যা সমাধানে এরই মধ্যে তিনটি টাস্কফোর্স গঠন করেছে সরকার। এর মধ্যে একটির কাজ হবে ব্যাংক খাতের সুশাসন ফিরিয়ে আনাসহ ঋণ আদায় প্রক্রিয়া নিরূপণ এবং অন্যটির কাজ বিদেশে পাচার হওয়া টাকা ফেরত নিয়ে আসা। পাচার হওয়া অর্থ ফেরাতে এরই মধ্যে দেড় হাজার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ ও তলব করা হয়েছে। পাশাপাশি বিদেশ থেকে অর্থ ফেরাতে আন্তর্জাতিক আইনি সংস্থা নিয়োগের প্রস্তুতি নিচ্ছে আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা বাংলাদেশ ফিন্যানশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)।</p> <p>জানা গেছে, দুর্নীতিসহ বিভিন্ন উপায়ে অর্জিত অর্থ নানা উপায়ে অনেকেই ঘরে রেখেছিলেন। তবে সরকার পরিবর্তনের পর তাদের বেশির ভাগই পলাতক। ঘরে টাকা রেখে তাদের কেউ কেউ এখন বিপদে আছেন। নিরাপদ বোধ না করায় বিভিন্ন উপায়ে তারা ভালো ব্যাংকে টাকা জমা রাখছেন।</p> <p>আবার সরকার পতনের পর থেকে বড় অঙ্কের নগদ টাকা তুলতে পারছে না মানুষ। এর কারণ সরকার পতনের প্রথম সপ্তাহে দিনে সর্বোচ্চ এক লাখ, দ্বিতীয় সপ্তাহে দুই লাখ এবং তৃতীয় সপ্তাহে তিন লাখ টাকা নগদ উত্তোলনের সীমা বেঁধে দেওয়া হয়। এখন সেই সীমা তুলে দেওয়া হয়েছে। এর পরও সমস্যাগ্রস্ত ব্যাংক থেকে অনেকেই বড় অঙ্কের আমানত তুলতে পারছেন না। নামে-বেনামে ব্যাংকগুলো থেকে বিপুল অঙ্কের ঋণ নিয়ে পাচারের অভিযোগ খতিয়ে দেখছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।</p> <p>বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা জানান, অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে যেসব ব্যাংক দুর্বল হয়ে পড়েছে, সেগুলোকে বাংলাদেশ ব্যাংক বিশেষ ব্যবস্থায় তারল্য সহায়তা দিচ্ছে। এরই মধ্যে এসব ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ পরিবর্তন করা হয়েছে। তবে তারল্য সংকটের কারণে ক্ষুদ্র আমানতকারীরা আতঙ্কিত হয়ে টাকার জন্য ব্যাংকগুলোতে যাচ্ছেন। টাকা না পাওয়ায় অনেক অপ্রীতিকর ঘটনাও ঘটেছে। এমন পরিস্থিতি বিবেচনায় ব্যাংকগুলোকে তারল্য সহায়তা দেওয়ার উদ্যোগ নেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। পরে এসব ব্যাংক পুনর্গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হবে। কোনো ব্যাংকের ঘুরে দাঁড়ানোর পথ না দেখলে সেটিকে একীভূত করার উদ্যোগ নেওয়া হবে।</p> <p>গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর তৎকালীন গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার আত্মগোপনে চলে যান। এরপর গভর্নর হিসেবে নিয়োগ পান অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুর। তিনি যোগ দিয়েই ব্যাংক খাতের সংস্কারে মনোযোগ দেন।</p>