প্রয়োজনীয় ও অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প যাচাই-বাছাইয়ের ডামাডোলে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে বড় ধাক্কা চলতি অর্থবছরে। চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাস জুলাই-ডিসেম্বরে গত ৭ অর্থবছরের মধ্যে সর্বনিম্ন অর্থছাড় হয়েছে। গত এক যুগের মধ্যে সর্বনিম্ন এডিপি বাস্তবায়ন হয়েছে। চলতি অর্থবছরের এডিপি থেকে সরকার রেকর্ড পরিমাণ কাঠছাঁট করতে যাচ্ছে।
যদিও কাটছাঁটের প্রভাব পড়েনি বড় বরাদ্দ পাওয়া এলজিইডি ও বিদ্যুতে। বরাবরের মতোই উন্নয়নে পিছিয়ে রয়েছে জনগুরুত্বপূর্ণ স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাত।
গতকাল জুলাই-ডিসেম্বর পর্যন্ত ছয় মাসের এডিপি বাস্তবায়নের তথ্য ওয়েবসাইটে প্রকাশ করেছে পরিকল্পনা কমিশনের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি)। তাতে দেখা যায়, ছয় মাসে এডিপি বাস্তবায়ন হয়েছে ১৭.৯৭ শতাংশ।
এর চেয়ে কম এডিপি বাস্তবায়নের তথ্য সংস্থাটির ওয়েবসাইটে নেই। সেই আলোকে গত এক যুগে এত কম এডিপি বাস্তবায়নের হার সর্বনিম্ন। এদিকে ছয় মাসে ৫০ হাজার দুই কোটি টাকা অর্থছাড় হয়েছে, যা ২০১৮-১৯ অর্থবছরের পর সর্বনিম্ন। গত অর্থবছরে ৬১ হাজার ৭৩৯ কোটি টাকা ছাড় হয়েছিল এই সময়ে। শুধু গত ডিসেম্বর মাসে অর্থছাড় বেশি হয়েছে, যা টাকার অঙ্কে ১৫ হাজার ৭৮৭ কোটি টাকা।
পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে জানা গেছে, চলতি অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) থেকে ৪৯ হাজার কোটি টাকা কাটছাঁট হচ্ছে। এর মধ্যে সরকারের অংশ থেকে ৩০ হাজার কোটি টাকা ও বৈদেশিক বরাদ্দ থেকে ১৯ হাজার কোটি টাকা। এর আগে কোনো অর্থবছরে এত বেশি পরিমাণ অর্থ এডিপি থেকে কাটছাঁট করা হয়নি। শুধু সড়ক ও মহাসড়ক বিভাগ থেকেই ১১ হাজার ১৮৬ কোটি টাকা কাটছাঁটের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
চলতি অর্থবছরের এডিপির আকার ধরা হয় দুই লাখ ৭৮ হাজার ২৮৮ কোটি টাকা।
আইএমইডি সূত্র জানায়, গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরের এডিপির তুলনায়, সংশোধিত এডিপির (আরএডিপি) আকার কমেছিল ১৮ হাজার কোটি টাকা। ২০২২-২৩ অর্থবছরে এডিপি থেকে বরাদ্দ কমেছিল ১৮ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। ২০২১-২২ অর্থবছরে কমেছিল ১৫ হাজার ৩৪৭ কোটি টাকা।
পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তারা জানান, আগের সরকারের সময়ে নেওয়া চলমান সব প্রকল্পই সরকার পর্যালোচনা করেছে। কম গুত্বপূর্ণ ও রাজনৈতিক বিবেচনায় নেওয়া অনেক প্রকল্প বা স্কিম বাদ যাচ্ছে। এতে অর্থ ব্যয়ের চাহিদা কমেছে। আবার জুলাই অভ্যুত্থানের পরে অনেক উন্নয়ন প্রকল্পের পরিচালক চলে গেছেন। অনেক প্রকল্প পরিচালকের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। ফলে এডিপি বাস্তবায়ন হারও কমে গেছে। অনেক দেশীয় ঠিকাদারও প্রকল্প এলাকায় এখনো ফিরে আসেননি। একইভাবে বৈদেশিক অর্থায়নের অনেক প্রকল্পে বিদেশি ঠিকাদার অনুপস্থিত রয়েছেন। এই বাস্তবতায় এডিপিতে বরাদ্দ কমানো হয়েছে বলে জানান তাঁরা।
পরিকল্পনা কমিশনের কার্যক্রম বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, বাস্তবায়ন গতি কম থাকায় সরকারি তহবিলের চাহিদাও অনেক কমেছে। সাধারণত অন্যান্য অর্থবছরের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সরকারি তহবিল থেকে চাহিদা অনেক বেশি থাকে। কিন্ত চলতি অর্থবছরে এডিপিতে যে পরিমাণ সিলিং বেঁধে দেওয়া হয়েছে, চাহিদা তার চেয়ে কম রয়েছে। তবে সরকারি বিনিয়োগ বাড়াতে চলতি অর্থবছরে চাহিদার চেয়ে বেশি বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো বৈদেশিক ঋণ ও অনুদান থেকে ৭০-৭৫ হাজার কোটি টাকা চাহিদা দিয়েছিল। কিন্তু সরকার বৈদেশিক অর্থায়ন ব্যবহারের গুরুত্ব দেওয়ায় বরাদ্দ বাড়িয়ে ৮১ হাজার কোটি টাকার সিলিং দেওয়া হয়।
আইএমইডির সাবেক সচিব আবুল কাশেম মো. মহিউদ্দিন কালের কণ্ঠকে বলেন, উন্নয়ন প্রকল্পে অর্থছাড় কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। কোন প্রকল্পটি বেশি প্রয়োজনীয়, কোনটির প্রয়োজনীয়তা কম তা যাচাই-বাছাই চলছে। প্রকল্পগুলো পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, দেশের অর্থনীতি সংকটের মধ্যে আছে। রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি হচ্ছে। ফলে সরকারকে ব্যয় কমাতে হবে। চলতি অর্থবছরের বাজেটে অপচয়মূলক ব্যয় কমানোর অনেক সুযোগ রয়েছে। এ ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকারের সামনে খরচ কমানোর বড় জায়গা হচ্ছে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি)। পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তারা বলছেন, বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির বাস্তবায়ন বর্তমানে শুরুর পর্যায়ে রয়েছে। এ ক্ষেত্রে অপ্রয়োজনীয় ব্যয় বাদ দিয়ে এডিপি বড় ধরনের কাটছাঁট করলে তেমন কোনো অর্থের অপচয় হবে না। চলতি অর্থবছরে এডিপির আওতায় এক হাজার ৩২৬টি প্রকল্প আছে। বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, রাজনৈতিক বা প্রশ্নবিদ্ধ প্রকল্পগুলো পুনরায় বিবেচনা করা উচিত। কারণ সরকার আর্থিকসংকটে আছে, রাজস্ব আদায়েও ঘাটতি রয়েছে। সরকারকে ব্যয় কমাতে হবে। ব্যয় কমানোর বড় জায়গা এডিপি। প্রকল্পের গুরুত্ব বিবেচনায় বরাদ্দ দিতে হবে। চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে সবচেয়ে বেশি ১০ হাজার ৩০৯ কোটি টাকা অর্থ খরচ করেছে বিদ্যুৎ বিভাগ।