<p>মানুষের মন অত্যন্ত সংবেদনশীল। অন্যের কথা, কাজ, আচার-আচরণ, পরিবেশ ও প্রতিবেশ দ্বারা প্রভাবিত হয়। ভালো আচরণে মানুষের মন যেমন উত্ফুল্ল হয়, তেমনি মন্দ আচরণে তা আহত হয়, ব্যথিত হয়। শারীরিক ব্যথা ও ক্ষতের চেয়ে যে ব্যথা ও ক্ষত অনেক গভীর ও বেদনাদায়ক। কবি ইয়াকুব হামদুনি বলেছেন, ‘তরবারির ক্ষতের (শারীরিক) আরোগ্য আছে, কিন্তু জিবের দ্বারা সৃষ্ট ক্ষতের (মানসিক) আরোগ্য নেই।’ (তাজুল উরুস, পৃষ্ঠা ৩৭৩)</p> <p>ইসলাম মানব মনের সংবেদনশীলতার প্রতি অত্যন্ত সতর্ক ও সচেতন। ঈমান থেকে শুরু করে ইসলামী শরিয়তের দৈনন্দিন বিধি-বিধানে তার স্পষ্ট প্রতিফলন রয়েছে। মানুষের মনের অবস্থা বিবেচনা করে ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ বিধানেও তারতম্যের কথা বলা হয়েছে। যেমন—সফর মানব মনে বিষাদ ও ক্লেশ সৃষ্টি করে। তাই ইসলাম সফরের সময় ফরজ নামাজকে কসর বা সংক্ষিপ্ত করার অনুমতি দিয়েছে। একইভাবে তাকে রমজানের রোজা ও জুমার জামাতের ব্যাপারে অবকাশ দিয়েছে। অসুস্থ ও প্রাকৃতিক দুর্যোগে আক্রান্ত ব্যক্তির ক্ষেত্রেও এমন অবকাশ রয়েছে। শুধু ফিকহি বিধি-বিধান নয়; বরং দৈনন্দিন জীবনের আচার-আচরণেও ইসলাম মানব মনের সংবেদনশীলতার প্রতি লক্ষ রাখার নির্দেশ দিয়েছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বিষয়টিকে মানুষের ঈমান ও ইসলামের সঙ্গে সম্পৃক্ত করে বলেছেন, ‘যার জিব ও হাত থেকে মানুষ নিরাপদ, সে-ই প্রকৃত মুসলিম।’ (সুনানে নাসায়ি, হাদিস : ৪৯৯৫)</p> <p>আল্লাহর প্রেরিত পুরুষদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো, তাঁরা মানব মনের সংবেদনশীলতার প্রতি যত্নবান ছিলেন। ফলে দ্বিনের পথে তাঁদের আহ্বান ছিল অধিক ফলপ্রদ। পবিত্র কোরআনে রাসুলুল্লাহ (সা.) সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘আল্লাহর অনুগ্রহে আপনি তাদের প্রতি কোমল হৃদয় হয়েছেন। যদি আপনি তাদের প্রতি রূঢ় ও কঠোরচিত্ত হতেন, তবে তারা আপনার পাশ থেকে সরে যেত।...’ (সুরা : আলে ইমরান, আয়াত : ১৫৯)</p> <p>অন্য আয়াতে আল্লাহ মুসা (আ.) ও হারুন (আ.)-কে নির্দেশ দিয়েছেন, ‘তোমরা দুইজন তার সঙ্গে নরম ভাষায় কথা বলো। হয়তো সে শিক্ষা গ্রহণ করবে অথবা ভয় পাবে।’ (সুরা : ত্বহা, আয়াত : ৪৪)</p> <p>ইসলাম প্রাত্যহিক জীবনে মানুষকে সংযত ও সতর্ক হওয়ার নির্দেশ দিয়েছে। এমনকি কারো সঙ্গে তর্ক-বিতর্কে লিপ্ত হলেও তার সঙ্গে উত্তম আচরণ করতে বলেছে। নতুবা সংবেদনশীল মানব মন সত্যবিমুখ হওয়ার ভয় থেকে যায়। ইরশাদ হয়েছে, ‘আপনি আপনার প্রভুর পথে প্রজ্ঞা ও উত্তম উপদেশের মাধ্যমে আহ্বান করুন। আর তাদের সঙ্গে বিতর্ক করুন সর্বোত্তম পন্থায়।’ (সুরা : নাহল, আয়াত : ১২৫)</p> <p>মানুষ বিপদগ্রস্ত হলে, অভাব-অনটনে পড়লে তার মন আরো বেশি সংবেদনশীল হয়ে ওঠে। এ সময় সামান্য আঘাতও তার কাছে জীবননাশী ব্যথায় পরিণত হয়। কোরআনে বিপদগ্রস্ত মানুষের সঙ্গে সদাচরণের পৃথক নির্দেশনা এসেছে। বলা হয়েছে, ‘সুতরাং তুমি এতিমের প্রতি কঠোর হয়ো না এবং যারা চায় তাদের ভর্ত্সনা কোরো না। তুমি তোমার প্রতিপালকের অনুগ্রহের কথা জানিয়ে দাও।’ (সুরা : দুহা, আয়াত : ৯-১১)</p> <p>কোরআনে অসংখ্য আয়াতে পরস্পরের সঙ্গে সংযত ও মানবিক আচরণের নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও এতিম ও অভাবগ্রস্ত মানুষের সঙ্গে কোমল আচরণের কথা বলার কারণ হলো, এসব মানুষের হৃদয় আরো বেশি ‘সংবেদনশীল’ হয়। অন্য আয়াতে বলা হয়েছে, ‘সম্পত্তি বণ্টনের সময় আত্মীয়, এতিম, অভাবগ্রস্ত লোক উপস্থিত থাকলে তাদেরও তা থেকে কিছু দেবে এবং তাদের সঙ্গে সদালাপ করবে।’ (সুরা : নিসা, আয়াত : ৮)</p> <p>এই আয়াতে উত্তরাধিকারী নয় এমন আত্মীয় ও ব্যক্তিদের ব্যাপারে সহৃদয় হওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে।</p> <p>আত্মসম্মানবোধ মানবজীবনের একটি স্পর্শকাতর দিক। আত্মসম্মানে আঘাত পেলে মানুষ তুলনামূলক বেশি আহত বোধ করে। রাসুলুল্লাহ (সা.) অপরাধীর সম্মানবোধকেও খাটো করে দেখতেন না। আয়েশা (রা.) বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে যখন তাঁর কোনো সাহাবির ব্যাপারে কোনো অভিযোগ পৌঁছাত, তখন তিনি বলতেন না অমুকের কী হলো; বরং তিনি বলতেন, মানুষের কী হলো তারা এমন কাজ করে!’ (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস : ৪৭৮৮)</p> <p>একই কারণে ইউসুফ (আ.) স্মৃতিচারণার সময় তাঁর ভাইদের অপরাধ ও অপকর্মের কথা এড়িয়ে গিয়ে বিষয়টি এমনভাবে উপস্থাপন করেন, যেন তারা আত্মগ্লানির শিকার না হয়। তিনি বলেন, ‘তিনি আমাকে কারাগার থেকে মুক্ত করে এবং শয়তান আমার ও আমার ভাইদের মধ্যকার সম্পর্ক নষ্ট করার পরও আপনাদের মরু অঞ্চল থেকে এখানে এনে আমার প্রতি অনুগ্রহ করেছেন।’ (সুরা : ইউসুফ, আয়াত : ১০০)</p> <p>রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, “তোমাদের কেউ যেন আমার ‘দাস’ ও আমার ‘দাসী’ না বলে। তোমরা সবাই আল্লাহর বান্দা এবং তোমাদের নারীরা আল্লাহর বান্দি। কিন্তু তোমরা বলবে আমার ‘বালক’ ও আমার ‘বালিকা’, আমার ‘যুবক’ ও আমার ‘যুবতী’।” (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ২২৪৯)</p> <p>মানব মন ও অনুভূতিকে আক্রান্ত করে এবং তার সংবেদনশীলতা নষ্ট হয় এমন কাজ ইসলামের দৃষ্টিতে অপরাধ। হিংসা, বিদ্বেষ, লোভ, নির্লজ্জতা, পরশ্রীকাতরতা, আত্মমুগ্ধতা ইত্যাদি বৈশিষ্ট্যকে ইসলাম পরিহারযোগ্য পাপ ঘোষণা করেছে। কারণ তা মানব মনের সুস্থতা ও সংবেদনশীলতা নষ্ট করে। এসব ব্যাধি থেকে মুক্তিকে সাফল্য হিসেবে ঘোষণা করেছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘সেই সফল যে নিজেকে পবিত্র করেছে এবং সেই ব্যর্থ যে নিজেকে কলুষিত করেছে।’ (সুরা : শামস, আয়াত : ৯-১০)</p> <p>অন্যদিকে দান করে খোঁটা দেওয়া, কারো দুর্বলতা নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করা নিষিদ্ধ করেছে, কারণ তা অন্যের মনকে আহত করে। আল্লাহ বলেন, ‘হে মুমিনরা! তোমরা তোমাদের দানকে খোঁটা ও কষ্ট দিয়ে নষ্ট কোরো না।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ২৬৪)</p> <p>ইসলাম মানব মনের সংবেদনশীলতাকে গুরুত্ব দিলেও তার ‘ক্ষতিকর’ প্রবণতাকে প্রশ্রয় দিতে নিষেধ করেছে। অতি আবেগ, সন্দেহ, সংশয়, দ্বিধা, হীনম্মন্যতা ইসলামের দৃষ্টিকে বর্জনীয়। মনের এসব প্রবণতাকে ইসলামের পরিভাষায় ‘ওয়াসওয়াসা’ বা প্রবঞ্চনা বলা হয়। কোরআন ও হাদিসের ভাষ্য মতে, ‘ওয়াসওয়াসা’ শয়তানের কাজ। শয়তানের প্রবঞ্চনার ব্যাপারে সতর্ক করে আল্লাহ বলেছেন, ‘অবশেষে যখন সে আমার কাছে আসবে, তখন শয়তানের উদ্দেশে বলবে, হায়! তোমার ও আমার মাঝে যদি পূর্ব-পশ্চিমের দূরত্ব থাকত। কতই না নিকৃষ্ট সঙ্গী সে।’ (সুরা : জুখরুফ, আয়াত : ৩৮)</p> <p>তবে ইসলাম এসব প্রবণতায় আক্রান্ত ব্যক্তিকে মানবিক দৃষ্টিতে দেখার আহ্বান জানিয়েছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ আমার উম্মতের মনে যা উদিত হয় তা ক্ষমা করে দিয়েছেন, যতক্ষণ না তারা তা বলে বা করে।’ (সহিহ বুখারি, আয়াত : ৬৬৬৪)</p> <p>মহান আল্লাহ আমাদের জবানের হেফাজত করার তাওফিক দান করুন। আমিন।</p> <p>khosrurahman@gmail.com</p> <p> </p>