মা-বাবা হত্যাকাণ্ডের তদন্ত ও বিচারে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরওয়ার ও মেহেরুন রুনির একমাত্র সন্তান মাহির সরওয়ার মেঘ। বলেছেন, ‘আশা করা যাচ্ছে, পজিটিভ (ইতিবাচক) কিছু একটা শুনতে পাব।’
১৩ বছর আগে ২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি সাগর সরওয়ার ও মেহেরুন রুনি রাজধানীর পশ্চিম রাজাবাজারে ভাড়া বাসায় খুন হওয়ার সময় মেঘ ছিলেন পাঁচ বছরের শিশু। এখন তাঁর বয়স ১৮ বছর।
গতকাল মঙ্গলবার আলোচিত এই হত্যাকাণ্ডের ১৩তম বার্ষিকীতে মামা নওশের আলম রোমানের সঙ্গে সুপ্রিম কোর্টের অ্যানেক্স ভবনের সামনে এসেছিলেন মেঘ। তাঁদের সঙ্গে ছিলেন আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির। সেখানে মামলাটির তদন্ত ও বিচার নিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে তিনজনই কথা বলেন।
মামলাটির তদন্তপ্রক্রিয়া নিয়ে আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির বলেন, ‘গত ১৩ বছরেও এই মামলার তদন্ত শেষ করে রহস্য উন্মোচন করতে পারেনি।
আমরা মনে করি, এটি রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে একটি বড় ধরনের ব্যর্থতা। এই সরকার আসার পর হাইকোর্ট বিভাগের আদেশে একটি উচ্চতর টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে। এই টাস্কফোর্স ৪ এপ্রিলের মধ্যে হাইকোর্টে তদন্তের সারবত্তা পেশ করবে।’
তদন্তের অগ্রগতি জানিয়ে শিশির মনির বলেন, ‘তদন্ত কর্মকর্তা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন, আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন, পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন।
বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি এবং কৌশল প্রয়োগ করে প্রমাণাদি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছেন। যেটুকু আমরা জানতে পেরেছি, বেশ কিছু ডেভেলপমেন্ট (উন্নতি) হাতে এসেছে। এই ডেভেলপমেন্টগুলো নিয়ে হাইকোর্টে একটি তদন্ত প্রতিবেদন সাবমিট করা হবে।’
বিগত সময়ে মামলাটির তদন্তকাজ সঠিকভাবে পরিচালনা করতে দেওয়া হয়নি দাবি করে আইনজীবী শিশির মনির বলেন, ‘অতীতে এই ইনভেস্টিগেশন (তদন্ত) সিস্টেমকে (প্রক্রিয়াকে) অবস্ট্রাকশন (বাধাগ্রস্ত) করা হয়েছে। ইনভেস্টিগেশন আইনি পদ্ধতিতে চলতে দেওয়া হয়নি।
এই মর্মেও তদন্তে তথ্য-উপাত্ত উঠে এসেছে।’
তিনি বলেন, ‘গত ১৩ বছরে অনেক সাক্ষ্য-প্রমাণই ডিসঅ্যাপিয়ার (গায়েব) হয়ে গেছে, হারিয়ে গেছে। সব কিছুর পরও এখন একটি আশার আলো দেখা যাচ্ছে। আমরা আশা করি, স্বল্পতম সময়ের মধ্যেই তদন্ত কর্মকর্তা একটি গ্রহণযোগ্য এবং সত্যিকার অর্থেই একটি বিচার পরিচালনা করার মতো উপযুক্ত তদন্ত রিপোর্ট আদালতে দাখিল করবেন। এটিই আমরা প্রত্যাশা করি।’
এক প্রশের জবাবে শিশির মনির বলেন, ‘তদন্তের বিষয়টির সঙ্গে একটু সেনসেটিভিটি (স্পর্শকাতরতা) আছে। তদন্তের বিষয়টির সঙ্গে এক ধরনের সিক্রেসি (গোপনীয়তা) আছে। তার পরও এতটুকু জানাচ্ছি, অন্য মামলায় জেলে আছেন এ রকম ব্যক্তিদের সঙ্গেও তদন্ত কর্মকর্তা আলাপ-আলোচনা করেছেন। যাঁরা কি না কিছুটা স্টেটমেন্ট দিয়েছেন, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের ব্যাপারে তাঁরা মুখও খুলেছেন।’
উচ্চ পর্যায়ের ব্যক্তিরা রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব কি না, জানতে চাইলে এই আইনজীবী বলেন, ‘সব ধরনের ব্যক্তিই আছেন বলে বোঝা যাচ্ছে।’
আশা করি পজিটিভ কিছু শুনতে পাব : মেঘ
রুনির ভাই ও মামলার বাদী নওশের আলম রোমান সাংবাদিকদের বলেন, ‘১৩ বছর পরও তদন্তের যে অগ্রগতি, তা ২০১২ সালেই রয়ে গেছে। তার পরও আমরা কিছুটা আশার আলো দেখতে পাচ্ছি। যেহেতু আগের সরকার এখন নেই। আগের সরকারকে আমরা মনে করতাম, সরকারের সংশ্লিষ্ট কেউ বা সরকার স্বয়ং এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী (শেখ হাসিনা) বলেছিলেন, কারো বেডরুম পাহারা দেওয়ার দায়িত্ব তাঁর না। এই শব্দটা থেকেই আমরা আসলে মনে করি, তৎকালীন সরকার বা তাদের সংশ্লিষ্ট কেউ এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত।’
রোমান বলেন, ‘এখন যেহেতু সব কিছুই পরিবর্তন হয়েছে, কিছুটা আশার আলো আমরা দেখতে পাচ্ছি। তবে এতবার আশাভঙ্গ হয়েছে যে আশাবাদী হতে পারছি না, যতক্ষণ পর্যন্ত তদন্ত রিপোর্ট কী আসছে সেটা জানতে পারছি।’
এরপর সাংবাদিকরা মেঘের বক্তব্য জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আগে তো কিছু হইত না। এখন তো দেখতেছি ওরা (পিবিআই টাস্কফোর্স) কাজ করতেছে। তো একটু হইলেও আমরা হোপফুল (আশাবাদী)। আশা করা যাচ্ছে, পজিটিভ কিছু একটা শুনতে পারব।’
২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর পশ্চিম রাজাবাজারে ভাড়া বাসায় খুন হন বেসরকারি টিভি চ্যানেল মাছরাঙার বার্তা সম্পাদক সাগর সরওয়ার ও তাঁর স্ত্রী এটিএন বাংলার জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক মেহেরুন রুনি। তখন রুনির ভাই নওশের আলম রোমান বাদী হয়ে রাজধানীর শেরেবাংলানগর থানায় মামলা করেন। প্রথমে এই মামলা তদন্ত করছিল শেরেবাংলানগর থানার পুলিশ। চার দিন পর মামলার তদন্তভার ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) কাছে হস্তান্তর করা হয়। এই দম্পতির একমাত্র সন্তান মেঘকে উদ্ধৃত করে পুলিশ তখন জানিয়েছিল, খুনি ছিল দুজন।
সাগর-রুনির বাসার দুই নিরাপত্তারক্ষীকে জিজ্ঞাসাবাদ করবে টাস্কফোর্স
সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরওয়ার ও মেহেরুন রুনি পশ্চিম রাজাবাজারের যে বাসায় ভাড়া থাকতেন, সেই বাসার নিরাপত্তারক্ষী এনামুল ও পলাশ রুদ্র পালকে জিজ্ঞাসাবাদ করবে চার সদস্যের টাস্কফোর্স। মামলার তদন্তপ্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত পিবিআইয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এ তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করেন।
পিবিআইয়ের এই কর্মকর্তা বলেন, সাগর-রুনি যে বাসায় ভাড়া থাকতেন, সেই বাসার একজন নারী গৃহকর্মীকেও খুঁজছে পিবিআই। এই হত্যাকাণ্ড নিয়ে তাঁকেও জিজ্ঞাসাবাদ করবে পুলিশ।
সাগর-রুনি খুনের মামলায় এখন পর্যন্ত সব মিলিয়ে মোট আটজন সন্দেহভাজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।