<p>করোনা থেকে উত্তরণ ও নতুন স্বাভাবিকতা অর্জনের জন্য বিশ্বের সব দেশকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। কিছু আবশ্যিক বিষয় বাস্তবায়ন করতে হবে। যখন দেখা যাবে করোনা ও অন্যান্য ভাইরাসজনিত ফুসফুসের রোগে সম্মিলিত মৃত্যুহার মহামারিপূর্ব সময়ে ইনফ্লুয়েঞ্জা ও অন্যান্য ফুসফুসের রোগজনিত মৃত্যুহারের চেয়ে বেশি নয়, তখন ধরে নিতে হবে লক্ষ্য অর্জিত হয়েছে। এই লক্ষ্য অর্জন এবং তা ধরে রাখতে প্রয়োজন ভ্যাকসিন ও চিকিৎসাব্যবস্থার দ্রুত উন্নয়ন এবং বিশ্বব্যাপী এর সমবণ্টন। করোনা ভ্যাকসিন প্রাপ্যতায় অনেক এগিয়ে আছে। এখন প্রয়োজন চিকিৎসার লক্ষ্য নির্ধারণ এবং ভাইরাস প্রতিরোধী মুখে খাওয়ার কার্যকর ওষুধ বেশি করে উৎপাদন করা। গুরুতর অসুস্থদের জন্য মনোক্লোনাল অ্যান্টিবডির উৎপাদন ও বিশ্বব্যাপী বণ্টন, যাতে এগুলো সব রোগীর আওতায় আসে।</p> <p>ভ্যাকসিন : বিশ্বের সব মানুষ যাতে ভ্যাকসিন পায় সেই লক্ষ্যে কাজ করে যেতেই হবে। এটা পর্যবেক্ষণ করা গেছে যে যেসব এলাকায় বেশি লোক ভ্যাকসিন পেয়েছে, সেসব এলাকায় হাসপাতালে করোনা রোগীর ভর্তির সংখ্যা ও মৃত্যুহার কমেছে। কোনো কোনো পরিসংখ্যান অনুযায়ী, স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার জন্য জনগোষ্ঠীর ৯০ শতাংশের বেশি মানুষের শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা থাকতে হবে। অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সহযোগিতাভিত্তিক দেশগুলোর ১০টি সংগঠনের ৯টিতে সম্পূর্ণ ভ্যাকসিনপ্রাপ্তির হার ওই দেশগুলোর জনসংখ্যার ৭৫ শতাংশের বেশি, সেখানে করোনাজনিত মৃত্যু এক লাখ আক্রান্ত মানুষের মধ্যে একজন।</p> <p>বিশ্বে বর্তমানে করোনা ভ্যাকসিনগুলোর মধ্যে রয়েছে Pfizer/BioNTech, Moderna, Oxford/AstraZeneca, Johnson & Johnson, SputnikV, Sinovac, Sinopharm/Beijing। ভ্যাকসিনের শুরুতে দুই ডোজ এবং ছয় মাস পর তৃতীয় ডোজ বা বুস্টার ডোজ নিতে হবে। প্রাথমিক অনুসন্ধান থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে, ওমিক্রন ভেরিয়েন্ট নিয়ন্ত্রণে বুস্টার ডোজ কার্যকর। আরো জানা গেছে, শরীরে করোনা অসুখজনিত সৃষ্ট প্রতিরোধ এবং প্রাথমিক দুই ডোজ ভ্যাকসিন ওমিক্রন প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে যথেষ্ট নয়।</p> <p>যদি করোনাভাইরাসের সংক্রামক শক্তি যথেষ্ট পরিমাণে কমে না যায় তাহলে এই ভ্যাকসিন নিয়মিত, বছরে একবার দেওয়ার প্রয়োজন হবে। এটা এখনো অনিশ্চিত যে ভ্যাকসিন কত দিন অত্যন্ত জটিল ধরনের রোগ প্রতিরোধ করতে সক্ষম হবে। ধারণা করা হচ্ছে, নতুন কোনো ভেরিয়েন্ট ছড়ালে তা প্রতিরোধ করতে বার্ষিক ইনফ্লুয়েঞ্জা ভ্যাকসিনের মতো করোনা ভ্যাকসিনও প্রতিবছর পরিবর্তন করতে হবে।</p> <p><img alt="" src="https://asset.kalerkantho.com/public/news_images/ckfinder/innerfiles/images/Print Version Online/print /2022/02.February/03-02-2022/121/9.gif" style="float:left; height:270px; margin:12px; width:332px" />জনগণের ৯০ শতাংশকে ভ্যাকসিন দিতে হবে। যারা সন্দেহযুক্ত, যাদের ভ্যাকসিনে অনীহা রয়েছে এবং যাদের কাছে ভ্যাকসিন সুলভ নয় তাদের জন্য বোধ হয় সরকারি প্রজ্ঞাপন প্রয়োজন। সব সরকারি কর্মচারী ও ঠিকাদার, স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মচারী, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের কর্মচারী, সব হাসপাতাল ও নার্সিং হোমের কর্মচারী, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মচারী ও শিক্ষার্থীদের ভ্যাকসিন দিতে পারলে ৯০ শতাংশ লক্ষ্য অর্জন অসম্ভব নয়। এ ছাড়া গণপরিবহনের সব যাত্রী এবং ঘরোয়া ও সামাজিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারীদের ভ্যাকসিন বাধ্যতামূলক করতে হবে। যারা ভ্যাকসিন পায়নি তাদের প্রতি সপ্তাহে করোনা পরীক্ষা করিয়ে দেখতে হবে যে তারা অসুখ ছড়াচ্ছে কি না।</p> <p>বর্তমানে যেসব ভ্যাকসিন পাওয়া যাচ্ছে এগুলোকেও উন্নত করতে হবে, যাতে সব ভেরিয়েন্টের বিরুদ্ধে এগুলো কার্যকর হয়। এ জন্য সব ভেরিয়েন্টের জিন জরিপ তথ্য প্রয়োজন। এসব জিনতথ্য ভ্যাকসিন প্রস্তুতকারী কম্পানিগুলোকে দ্রুত জানানো দরকার, যাতে তারা ভেরিয়েন্ট-নির্দিষ্ট ভ্যাকসিন তৈরি করতে পারে।</p> <p>বর্তমানে অনেক ভ্যাকসিন রয়েছে। কিন্তু যদি একই ভ্যাকসিন সব সময় সুলভ না হয়, তখন তিন ডোজ দেওয়ার জন্য কোন কোন ভ্যাকসিন সন্নিবেশন সর্বোত্কৃষ্ট এবং রোগ প্রতিরোধের জন্য সর্বাপেক্ষা ভালো হবে—এমন তথ্য এখন পর্যন্ত অসম্পূর্ণ রয়েছে। মেসেঞ্জার-আরএনএ ভ্যাকসিনের সঙ্গে প্রোটিন ভ্যাকসিন অথবা ভাইরাস-ভেক্টর ভ্যাকসিনের সম্মেলন ঘটালে কোন সম্মেলন বেশি প্রতিরোধ সৃষ্টি করবে তা জানা প্রয়োজন। এ জন্য সুনির্দিষ্ট গবেষণা চালিয়ে যেতে হবে। সব ভেরিয়েন্টের বিপক্ষে কাজ করবে এবং সংক্রমণ রোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে—এমন একটা সর্বজনীন ভ্যাকসিন তৈরি করা সম্ভব হলে সেটা বিশ্বব্যাপী সুলভ করে তোলার লক্ষ্যে সব দেশের সরকারকে সম্মিলিত উদ্যোগ ও অবদান রাখতে হবে। ভ্যাকসিনপ্রাপ্তদের তালিকা এবং তাদের মধ্যে কতজন রোগাক্রান্ত হয়েছে তার তালিকা ডিজিটাল ব্যবস্থায় সংরক্ষণ করতে হবে। এসব তথ্যের একটা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক তালিকা থাকা জরুরি।</p> <p>চিকিৎসা : করোনা চিকিৎসার জন্য কয়েকটি কার্যকর ওষুধ রয়েছে। যেমন রেমডেসিভির, ডেক্সামেথাসন এবং মনোক্লোনাল অ্যান্টিবডি। কিন্তু সব রোগীর চাহিদা মেটানোর জন্য এগুলোর সরবরাহ পর্যাপ্ত নয়। বেশি সমস্যা হচ্ছে, নতুন ভেরিয়েন্ট চিকিৎসার জন্য নতুন মনোক্লোনাল অ্যান্টিবডির প্রয়োজন হচ্ছে। কারণ আগেরগুলো কার্যকর হচ্ছে না। রোগীর শরীরে সাইটোকাইন (আইএল-৬) উদ্ভূত প্রদাহ কমাতে বিশেষ ধরনের ওষুধ প্রয়োজন, সেটার সরবরাহও অপর্যাপ্ত।</p> <p>যথেষ্ট পরিমাণ ভাইরাস নিধনকারী খাওয়ার ওষুধ প্রয়োজন। বর্তমানে পাওয়া যাচ্ছে, এমন খাওয়ার ওষুধগুলোর মধ্যে প্যাক্সলোভিড ও মলনিউপিরাভিরের কার্যক্ষমতা ভিন্ন। মলনিউপিরাভিরের কার্যক্ষমতা কম এবং এর গুরুতর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া রয়েছে, যেমন জন্মত্রুটি ও জেনেটিক পরিবর্তন। প্যাক্সলোভিড বেশি কার্যকর এবং কম পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াসম্পন্ন। বাড়িতে ও বহির্বিভাগে ব্যবহারযোগ্য ওষুধ কম খরচে সুলভ করা প্রয়োজন।</p> <p>প্রত্যেক অসুস্থ ব্যক্তি রোগ নির্ণয়ের সঙ্গে সঙ্গে যাতে যথাযথ চিকিৎসা পেতে পারে সে ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম এবং যাদের শরীরে ভ্যাকসিন কার্যকর হয়নি, তাদের অসুখ হওয়ার আগেই মনোক্লোনাল অ্যান্টিবডি ইঞ্জেকশন দিতে হবে।</p> <p>করোনা জীবনের নতুন স্বাভাবিকতা অর্জনে প্রয়োজন সব ভেরিয়েন্ট নিয়ন্ত্রণযোগ্য ভ্যাকসিন এবং বিশ্বব্যাপী তার সমবণ্টন। কার্যকর চিকিৎসা সুলভ করতে হবে। অন্যান্য ভাইরাসজনিত ফুসফুসের রোগ নিয়ন্ত্রণে ভ্যাকসিন ও চিকিৎসা নিশ্চিত করতে হবে। এসব বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন লাগাতার গবেষণা, উন্নতমানের পরীক্ষাগার এবং ওষুধ প্রস্তুত কম্পানিগুলোর সহযোগিতা। দরকার প্রচুর অর্থ, আর সে জন্য বিশ্বের ধনী দেশগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে।</p> <p>করোনা নিয়ন্ত্রণে বিশ্বব্যাপী ভ্যাকসিন ও চিকিৎসার সমবণ্টন করা না গেলে রোগটি আরো দীর্ঘায়িত হবে। ব্যাহত হবে নতুন স্বাভাবিকতা অর্জন।</p> <p> </p> <p>লেখক : মেডিক্যাল ডিরেক্টর, সংক্রামক ব্যাধি বিভাগ, সুমা হেলথ সিস্টেম, বারবারটন, ওহাইও, যুক্তরাষ্ট্র। ফেলো, আমেরিকান কলেজ অব ফিজিসিয়ানস ও সংক্রামক ব্যাধি বিশেষজ্ঞ সমিতি</p>