<p>আমরা জানি মাদরাসা শিক্ষা একটি প্রাচীন ধারার শিক্ষাব্যবস্থা। এই অঞ্চলে প্রথম ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খলজি ১২০৪ সালে বাংলার রাজধানী গৌড়ে একটি মাদরাসা নির্মাণ করেন। তার পর থেকে বহু ভাগে বিভক্ত হয়ে বাংলাদেশে নানা রকম মাদরাসা শিক্ষা চলে আসছে। মূলধারা অবশ্য দুটি—আলিয়া ও কওমি। এ ছাড়া অন্যান্য ধারার মধ্যে আছে—নুরানি, ফোরকানিয়া, কারিয়ানা, হাফেজি ইত্যাদি। এই নিবন্ধে যখন সাধারণ শিক্ষার সঙ্গে মাদরাসা শিক্ষার তুলনা করা হবে তখন আলিয়া মাদরাসার সঙ্গেই তুলনা করা হবে। কারণ দুই ধারায়ই অন্তত ইংরেজি, বাংলা ও অঙ্কের ক্ষেত্রে একই সিলেবাস, একই পাঠ্য বই, একই মূল্যায়ন পদ্ধতি এবং একই শিখন-শেখানো কৌশল ব্যবহার করা হয়। এই তিনটি বিষয় উল্লেখ করলাম এ জন্য যে এই বিষয়গুলোর ওপর ভিত্তি করেই আমরা এই দুই ধারার শিক্ষার্থীদের তুলনা করব।</p> <p>যদিও এখন মাদরাসা থেকে পাস করা অনেক শিক্ষার্থী ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে, তবু মনে করা হয়, মাদরাসা শিক্ষার্থীরা পিছিয়ে আছে। তবে তারা আসলেই পিছিয়ে আছে কি না কিংবা পিছিয়ে থাকলে কতটা পিছিয়ে আছে তা নিয়ে সে রকম কোনো গবেষণা হয়নি। আমি মাউশির মহাপরিচালক থাকার সময় এবং আমার আগেও মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের শিক্ষার মান মূল্যায়ন করার জন্য ২০১৫, ২০১৭ ও ২০১৯ সালে মোট তিনটি গবেষণা হয়। এর মধ্যে ২০১৫ সালের রিপোর্টটি এখনকার জন্য এত প্রাসঙ্গিক নয় বলে আমরা শেষ দুটি নিয়ে আলোচনা করব। এর ভেতর একটি হচ্ছে ‘লার্নিং অ্যাসেসমেন্ট অব সেকেন্ডারি ইনস্টিটিউশনস (লাসি) ২০১৭’ এবং আরেকটি হচ্ছে ‘ন্যাশনাল অ্যাসেসমেন্ট অব সেকেন্ডারি স্টুডেন্টস-২০১৯ (ন্যাস-১৯)’। দুটি গবেষণাই নমুনায়ন, উপাত্ত সংগ্রহ, উপাত্ত বিশ্লেষণ এবং পদ্ধতির ক্ষেত্রে প্রায় একই রকম বলে এদের ফলাফল পরস্পরের সঙ্গে তুলনীয়। দুটি গবেষণাই সারা দেশ থেকে নমুনায়নের ভিত্তিতে ষষ্ঠ, অষ্টম ও দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের ওপর পরিচালিত হয়েছে এবং এই শিক্ষার্থীদের মধ্যে সাধারণ শিক্ষার শিক্ষার্থী যেমন আছে, তেমনি আলিয়া মাদরাসার শিক্ষার্থীরাও আছে। ফলে খুব সহজেই এই দুই ধারার শিক্ষার্থীদের নিয়ে একটা তুলনামূলক আলোচনা করা যাবে।</p> <p>আগেই বলেছি, গবেষণাটি হয় তিনটি বিষয় নিয়ে। এর মধ্যে দুটি হচ্ছে ভাষা। বাংলা ও ইংরেজি এবং অন্যটি অঙ্ক। আমরা প্রথমে লাসি-১৭-তে কী আছে দেখি। লাসি-২০১৭-এর ফলাফল আমাদের ধারণার সঙ্গে মিলে যায়। ষষ্ঠ শ্রেণিতে এই দুই ধারার শিক্ষার্থীদের ফলাফল প্রায় এক হলেও সাধারণ শিক্ষার ছেলেমেয়েরা মাদরাসার ছেলেমেয়েদের চেয়ে সামান্য ভালো করেছে। তবে একটা বিষয়ে তাদের মিল আছে। সেটা হচ্ছে উভয় ধারার শিক্ষার্থীরাই যত ওপরের ক্লাসে উঠেছে তত ভালো করেছে, যেমন—ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণিতে এবং অষ্টম থেকে দশম শ্রেণিতে তারা ক্রমান্বয়ে ভালো করেছে। সাধারণ শিক্ষার ছেলেমেয়েদের ভালো করার হার মাদরাসা শিক্ষার্থীদের চেয়ে বেশি। ফলে তারা যত ওপরের ক্লাসে উঠেছে এই দুই ধারার মধ্যে পার্থক্য তত বেড়েছে। যেমন—ষষ্ঠ শ্রেণিতে বাংলায় সাধারণ শিক্ষার ছেলেমেয়েদের গড় নম্বর মাদরাসা শিক্ষার্থীদের চেয়ে মাত্র ছয় বেশি (সাধারণের গড় ৩৭৯ এবং মাদরাসার গড় ৩৭৬); অষ্টম শ্রেণিতে সেটা বেড়ে ১৯ হয়েছে (সাধারণ ৪২১ এবং মাদরাসা ৪০২); আর দশম শ্রেণিতে সেই পার্থক্যটা আরো দুই বেড়ে ২১-এ দাঁড়িয়েছে (সাধারণ ৪৪৬ এবং মাদরাসা ৪২৫)।</p> <p>লাসি-১৭-র বাংলার মতো ইংরেজি ও গণিতেও একই রকম উপাত্ত পাওয়া গেছে। এখানেও ষষ্ঠ শ্রেণিতে এই দুই ধারার শিক্ষার্থীদের ফল প্রায় এক এবং সার্বিকভাবে সাধারণ শিক্ষার ছেলেমেয়েরা মাদরাসার ছেলেমেয়েদের চেয়ে ভালো করেছে। এই দুই ধারার মধ্যে যে মিল ছিল এখানেও তা আছে, উভয় ধারার শিক্ষার্থীরাই যত ওপরের ক্লাসে উঠেছে তত ভালো করেছে। সাধারণ শিক্ষার ছেলেমেয়েদের ভালো করার হার মাদরাসা শিক্ষার্থীদের চেয়ে বেশি। ফলে আগের মতোই তারা যত ওপরের ক্লাসে উঠেছে তাদের মধ্যে পার্থক্য উত্তরোত্তর তত বেড়েছে।</p> <p>এবার আমরা আসি ন্যাস-১৯-এর বাংলায়। এখানে লাসি-১৭-র চেয়ে কিছুটা ভিন্নতা আছে। লাসি-১৭-তে যেমন ষষ্ঠ শ্রেণিতে এই দুই ধারার শিক্ষার্থীরা খুব কাছাকাছি ছিল, এখানে তা নয়। এখানে ষষ্ঠ, অষ্টম ও দশম—এই তিন শ্রেণিতেই এদের ভেতর পার্থক্য অনেক। ইংরেজিতে লাসি-১৭-র সঙ্গে ন্যাস-১৯-এর মিল আছে। এখানেও ষষ্ঠ শ্রেণিতে এই দুই ধারার শিক্ষার্থীদের ফলাফল প্রায় এক এবং সাধারণ শিক্ষার ছেলেমেয়েরা মাদরাসার ছেলেমেয়েদের চেয়ে সামান্য ভালো করেছে। এই দুই ধারার মধ্যে যে মিল ছিল এখানেও তা আছে। উভয় ধারার শিক্ষার্থীরাই যত ওপরের ক্লাসে উঠেছে ক্রমাগত ততই ভালো করেছে। গণিতেও ষষ্ঠ শ্রেণিতে এই দুই ধারার শিক্ষার্থীদের ফলাফল প্রায় এক এবং সার্বিকভাবে সাধারণ শিক্ষার ছেলেমেয়েদের ফল মাদরাসার ছেলেমেয়েদের চেয়ে ভালো। গণিতের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে, অষ্টম শ্রেণিতে এই পার্থক্যটা অনেক বেড়ে দশম শ্রেণিতে এসে তা আবার অনেক কমে গেছে। অর্থাৎ দশম শ্রেণিতে এসে মাদরাসা শিক্ষার্থীদের উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে।</p> <p>এখানে একটা বিষয় লক্ষণীয়, ন্যাস-১৯-এর বাংলা ছাড়া অন্যান্য বিষয়ে সাধারণ শিক্ষা ও মাদরাসা শিক্ষায় মাধ্যমিক পর্যায়ের শুরুতে এই দুই ধারার শিক্ষার্থীদের মধ্যে তেমন কোনো পার্থক্য নেই। তাদের ফলাফলে পার্থক্য কম থাকার অর্থ হচ্ছে ইবতেদায়ি ও প্রাইমারি পর্যায়ে মাদরাসা ও স্কুলগুলোর মধ্যে শিখন-শেখানো কার্যক্রমের এক ধরনের সমতা আছে। এখানে আর যে বিষয়টা নজর কাড়ে সেটা হচ্ছে মাদরাসাছাত্রদের ভাষার ক্ষেত্রে দুর্বলতা একটু বেশি। ন্যাস-১৯-এ গণিতের ক্ষেত্রে যেমন দেখা গেল দশম শ্রেণিতে গিয়ে, সম্ভবত দাখিল পরীক্ষায় ভালো করার মোটিভেশন থাকার কারণে মাদরাসা ছাত্ররা সাধারণ শিক্ষার শিক্ষার্থীদের কাছাকাছি চলে আসতে পারল, ওই একই মোটিভেশন থাকার পরও বাংলা ও ইংরেজির ক্ষেত্রে কিন্তু সে রকম দেখা যায়নি। বাংলা ও ইংরেজির ক্ষেত্রে তাদের মধ্যকার পার্থক্য ক্রমাগত বেড়েছে, সেটা ন্যাস-১৯ হোক কিংবা লাসি-১৭।</p> <p>মাদরাসা শিক্ষার এই পিছিয়ে থাকার বিষয়টি নিয়ে কথা বললে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা প্রথমেই যে কথাটা বলেন সেটা হচ্ছে মাদরাসা শিক্ষার্থীদের অনেক বেশি বিষয় পড়তে হয়। তারা যেমন একদিকে আরবি, কোরআন, হাদিস ও ইসলামী আইন নিয়ে পড়াশোনা করে, অন্যদিকে সাধারণ শিক্ষার বিষয়গুলোও পড়ে। ফলে বাংলা, ইংরেজি ও গণিতের দিকে তারা সাধারণ শিক্ষার শিক্ষার্থীদের মতো নজর দিতে পারে না। কথাটা বিবেচনার দাবি রাখে। এ ব্যাপারে কারিকুলাম বিশেষজ্ঞরা নিশ্চয়ই আরো গভীরভাবে চিন্তা করবেন। এ ছাড়া মাদরাসা শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের দিকেও আরো বেশি নজর দিতে হবে।</p> <p>সরকার নিশ্চয়ই এটা অনুধাবন করবে যে মাদরাসা শিক্ষার্থীরা যদি পিছিয়ে থাকে, তাহলে টেকসই উন্নয়নের প্রধান উপাদান ‘গুণগত শিক্ষা’ বাস্তবায়ন করা যাবে না। কারণ আমরা জানি, শিক্ষায় সমতা হচ্ছে শিক্ষায় গুণগত মান অর্জনের অন্যতম প্রধান পূর্বশর্ত। আর মাদরাসা শিক্ষার্থীদের বাইরে রেখে কখনোই এই সমতা আনা যাবে না।</p> <p> লেখক : মাউশির সাবেক মহাপরিচালক, অধ্যাপক</p> <p>ও ফলিত ভাষাতত্ত্ববিদ</p> <p> </p>