<p style="text-align:justify"><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">কয়েক দিন ধরেই টাইগার বুঝতে পারছিল কিছু একটা ঘটছে বা ঘটতে যাচ্ছে। যে রাতে ভীষণ শব্দ হলো, আগুন জ্বলল, বাতাসে রক্ত আর অদ্ভুত একটা পোড়া গন্ধের মিশেলে নাক ওর ভারী হয়ে গেল, সে রাতের পর থেকেই বদলে গেছে সব কিছু। </span></span></span></span></p> <p style="text-align:justify"><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">টাইগারের জন্ম ঢাকার ওয়ারীর একটা গলিতে। ওরা তিন ভাই-বোন একসঙ্গে জন্মেছিল। পরে মা আর ভাই-বোনরা কোথায় যেন ছিটকে গেল। সেসব কথা টাইগার জানে না। কারণ তখনো ওর চোখ ফোটেনি। অন্ধভাবে শুধু বুঝত মায়ের ঘ্রাণ। একদিন সেই ঘ্রাণও হারিয়ে গেল। </span></span></span></span></p> <p style="text-align:justify"><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">তারপর আরেক মায়ের কোল খুঁজে পেল সে। সাদা একতলা একটা বাড়ি। এই বাড়ির গেটের কাছে সে অসহায়ভাবে পড়ে ছিল। তখন মা ওকে কুড়িয়ে আনেন ঘরের ভেতরে। তত দিনে ওর চোখ ফুটেছে। সে দেখল এক প্রশান্ত মুখ, মিষ্টি হাসি। সেদিন থেকে এই নতুন মা হয়ে উঠলেন ওর নিশ্চিত আশ্রয়। শুধু মা নন, বাড়ির অন্যরাও ওকে খুব ভালোবাসত। খেলার ইচ্ছা হলেই ও ঘুরত সবার পায়ে পায়ে। কখনো লাফিয়ে-ঝাঁপিয়ে বড় ভাইয়া আর ছোট ভাইয়ার সঙ্গে বল খেলা। কখনো আপার হারমোনিয়ামের ওপর গড়িয়ে পড়া। ওর সবচেয়ে বন্ধুত্ব ছিল শুভর সঙ্গে। শুভ ওর লেজ ধরে টানত, কান মলে দিত আবার কোলে নিয়ে আদরও করত অনেক। শুভ যখন ওর সঙ্গে দৌড়ে পাল্লা দিত, তখন টাইগারের এত আনন্দ হতো যে ও ঘেউঘেউ করে ডেকে উঠত গলা ছেড়ে। </span></span></span></span></p> <p style="text-align:justify"><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">জন্মের এক বছরের মধ্যেই টাইগার বেশ বড়সড় হয়ে উঠল। এখন আর দুধ নয়, মাংস খায় ও। গায়ের জোর বাড়ার পাশাপাশি খুব সাহসীও হয়ে উঠল। বাবা একদিন ওর আকার দেখে বললেন, </span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">‘</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">টাইগার নামটা সার্থক হয়েছে। একদম চিতাবাঘের মতোই হয়ে উঠেছে আমাদের বেটা। ও বোধ হয় সরাইল হাউন্ডের বংশধর।</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">’</span></span></span></span></p> <p style="text-align:justify"><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">টাইগার জানত না সরাইল হাউন্ড কাকে বলে, বাবার কথা শুনে বুঝতে পারছিল সেটা বড় কোনো বংশ হবে। টাইগার যেমন বেড়ে উঠছিল, তেমনি চারপাশের পরিবেশও বদলে যাচ্ছিল। বড় ভাইয়া আজকাল প্রায়ই বাড়ি ফিরছে রাত করে। ছোট ভাইয়াও। বাড়িতে থাকলেও কাগজের ওপর বড় বড় করে কীসব লেখে। ওদের কথা শুনে টাইগার বোঝে ওগুলো পোস্টার। </span></span></span></span></p> <p style="text-align:justify"><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">উনসত্তর সাল। বাংলাদেশে তখন গণ-আন্দোলন চলছে। বড় ভাইয়া, ছোট ভাইয়া আর বাবা তিনজনেই মুক্তিকামী। মিছিল-মিটিং সারা ঢাকা শহরে তখন দাপটের সঙ্গে চলছে। সেই সঙ্গে চলছে পুলিশি গ্রেপ্তার। রাজনীতিকদের পাশাপাশি সংস্কৃতিকর্মীরাও বসে ছিলেন না। তারাও দেশের মুক্তি আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েছিলেন। আপা প্রায়ই যেতেন এসব প্রতিবাদী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে। বাড়িতে হারমোনিয়াম বাজিয়ে গাইতেন, </span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">‘</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">মুক্তির মন্দির সোপান তলে কত প্রাণ হলো বলিদান লেখা আছে অশ্রুজলে।</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">’</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"> টাইগারের ভীষণ ভালো লাগত গানটা। আর আপার কণ্ঠ তার কাছে মনে হতো সবার সেরা। </span></span></span></span></p> <p style="text-align:justify"><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">সারা দিন বাড়িতে তখন সে আর শুভ। কত আর খেলা ভালো লাগে। শুভর কাছ থেকে ও শুনত ওদের স্কুলের ওপরের ক্লাসের ছেলেরাও কিভাবে দেশের জন্য আন্দোলন করছে সেসব কথা।</span></span></span></span></p> <p style="text-align:justify"><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">তারপর এলো সেই দিন, ২৫ মার্চ। সে রাতটা ছিল যেন নরক থেকে উঠে আসা এক বিভীষিকা। চারদিক থেকে কান ফাটানো গুলির আওয়াজ। টাইগারের তীক্ষ্ম ঘ্রাণশক্তিতে ধরা পড়ছিল দূর থেকে ভেসে আসা মানুষের রক্তের গন্ধ। সারা রাত বাড়ির সবার সঙ্গে মায়ের বড় ঘরটায় জেগে বসে ছিল ও। কান খাড়া করে শুনছিল সব কিছু। ওর স্নায়ুতন্ত্র টান টান হয়ে উঠছিল অজানা আশঙ্কায়। </span></span></span></span></p> <p style="text-align:justify"><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">পরদিন থেকেই সব কিছু কেমন যেন বদলে গেল। মা-বাবাসহ সবার মুখ গম্ভীর। কপালে চিন্তার ভাঁজ। এমনকি শুভর মতো ছোট ছেলেও পরিস্থিতির ভয়াবহতায় থমকে গেছে। এর মাত্র ১০ দিন পরেই এক গভীর রাতে বাড়ির সব কিছু গোছগাছ করতে শুরু করলেন মা-বাবা। অন্যরাও। ছোট কয়েকটি ব্যাগে অল্প কিছু কাপড়চোপড় আর জরুরি কিছু জিনিস গুছিয়ে নিয়ে যাত্রার জন্য প্রস্তুত হলো সবাই। টাইগার বোবা দৃষ্টি মেলে সবার দিকে তাকাচ্ছিল। মা ওকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে ফেললেন। তারপর বেশ কয়েকটা বিস্কুটের প্যাকেট রেখে দিলেন ঘরের কোণে। </span></span></span></span></p> <p style="text-align:justify"><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">সকালবেলা একটা গাড়িতে করে বাড়ির সবাই চলে গেল। শুধু রয়ে গেল টাইগার। ও অনেক দূর গাড়ির পেছন পেছন দৌড়ে গিয়েছিল। মায়ের কান্নাভেজা মুখটা দেখতে পেয়েছিল। তারপর ক্লান্ত হয়ে ফিরে এসেছিল শূন্য বাড়িতে। </span></span></span></span></p> <p style="text-align:justify"><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">পরের দিনগুলো ফাঁকা, একঘেয়ে, ভয়ের আর কষ্টের। গলির বেশির ভাগ বাড়িই বন্ধ। তবু কোনোভাবে এদিক-ওদিক থেকে খাবার জোটানোর চেষ্টা নিরন্তর। </span></span></span></span></p> <p style="text-align:justify"><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">সবচেয়ে ভয়াবহ সেই শেষের দিনটা, যেদিন কয়েকজন পাকিস্তানি মিলিটারি এই বাড়িতে ঢোকে। সব কিছু ভেঙেচুরে তছনছ করছিল লোকগুলো। টাইগার কিছুতেই ওদের মায়ের ঘরে ঢুকতে দিতে চায়নি। চিতাবাঘের মতো গর্জে উঠে পা কামড়ে ধরেছিল একজনের। ওরাও সোজা গুলি করেছিল টাইগারের মাথায়। টাইগারের দেহ পড়ে ছিল উঠানে। অনেক দিন। </span></span></span></span></p> <p style="text-align:justify"><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">তারপর একদিন হিমেল ভোরে নতুন রঙের একটা সূর্য উঠল। সেটা ছিল ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর। </span></span></span></span></p> <p style="text-align:justify"><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">বাড়ির লোকজন একদিন ফিরে এলো। কিন্তু টাইগার ওদের দেখেনি। বেঁচে থাকলে টাইগার দেখত ওরা বিজয় নিয়ে এসেছে। বাবা ও বড় ভাইয়া ফিরতে পারেনি। তারা মিশে গেছে পতাকার লাল সূর্যে। কিন্তু মা, ছোট ভাইয়া, আপা ও শুভ ফিরেছে। ওরা বিজয় নিয়ে ফিরেছে। টাইগার বিজয় দেখেনি। ও শুধু শুনে গেছে বিজয়ের সোনালি পদধ্বনি।</span></span></span></span></p>