<p>মরণ নেশা মাদকের ছোবল ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে দেশের সীমান্তবর্তী জেলা ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। গত ছয় মাসের এক হিসেব থেকে দেখা গেছে, মাদকসংক্রান্ত বিষয়কে কেন্দ্র করে খুন হয়েছেন ১০ জন। এসব হত্যাকাণ্ডের ঘটনার বেশিরভাগই পরিবারকেন্দ্রিক। এ ছাড়া মাদক ব্যবসা সংক্রান্ত বিরোধের জের ধরেও একাধিক হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের বেশিরভাগই যুব বয়সি মাদকাসক্ত।</p> <p>বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, মাদকাসক্ত ছেলের প্রতি অতিষ্ঠ হয়ে খুন করেছেন বাবা। মাদকের টাকা না দেওয়ায় স্বামী খুন করেছেন স্ত্রীকে। স্ত্রী ও সন্তানকে বিষ খাইয়ে হত্যার অভিযোগ উঠেছে স্বামীর বিরুদ্ধে। কোলে পিঠে করে মানুষ করা এক নারীকে গলা কেটে হত্যার পর পুড়িয়েছেন মাদকাসক্ত যুবক। গত ২৪ ডিসেম্বরের এ ঘটনা সারা দেশে বেশ আলোচনার জন্ম দেয়।</p> <p>সংশ্লিষ্টজনসহ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মাদকাসক্তরা এক সময় নিজের হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। কোনটা ভালো কোনটা মন্দ সেই জ্ঞান থাকে না তাদের। তাদেরকে গিয়ে যেকোনো অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড করানো যায়। যে কারণে খুনের মতো ঘটনা ঘটাতেও তারা কুণ্ঠাবোধ করে না। পারিবারিকভাবে এ বিষয়ে সচেতনতা জরুরি বলছেন তারা। পাশাপাশি মাদক পাচার, ব্যবসা নির্মূলে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণের দাবি তাদের।</p> <div class="d-flex justify-content-center"> <div class="col-12 col-md-10 position-relative"><strong>আরো পড়ুন</strong> <div class="card"> <div class="row"> <div class="col-4 col-md-3"><img alt="আনিসুল হক ও সালমানকে রক্ষার চেষ্টা! ফের আলোচনায় সানজিদা" height="66" src="https://asset.kalerkantho.com/public/news_images/2024/12/30/1735534108-e06d061a77a7bde916b8a91163029d41.jpg" width="100" /></div> <div class="col-8 col-md-9"> <p>আনিসুল হক ও সালমানকে রক্ষার চেষ্টা! ফের আলোচনায় সানজিদা</p> </div> </div> </div> <a class="stretched-link" href="https://www.kalerkantho.com/online/national/2024/12/30/1462964" target="_blank"> </a></div> </div> <p><strong>বাড়িতে ডেকে নিয়ে খুন</strong><br /> এ বছরের ১৩ জুন আশুগঞ্জ উপজেলার যাত্রাপুর গ্রামে বাড়িতে ডেকে নিয়ে হৃদয় (২৫) নামের এক যুবককে খুন করা হয়। নিহত হৃদয় যাত্রাপুর গ্রামের মো. জসিম উদ্দিনের ছেলে। একই এলাকার বাসিন্দা, একাধিক মাদক মামলার আসামি রুবেল (৪০) এ ঘটনা ঘটান। ঘটনার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই পাশের বাড়ি থেকে পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে। <br /> ঘাতক রুবেলের মা লালু বেগম ওই সময় পুলিশ ও সাংবাদিকদের কাছে অভিযোগ করেন, তার ছেলে মাদকাসক্ত। তার অত্যাচারে পরিবার ধ্বংস হয়ে গেছে। রুবেলের অত্যাচারে তার বাবাও উচ্চ রক্তচাপজনিত কারণে মারা যান। তিনি ছেলের বিচার দাবি করে।</p> <p>হৃদয়ের বাবা মো. জসিম উদ্দিন জানান, হৃদয়কে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে যায় রুবেল। কিছুক্ষণ পরে মেয়ের জামাইয়ের মাধ্যমে জানতে পারেন হৃদয়ের লাশ রক্তাক্ত অবস্থায় হাসপাতালে পড়ে আছে। এটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড বলে তিনি দাবি করেন। </p> <p><strong>মাদক পরিবহনকারীকে খুন</strong><br /> গত ২ জুলাই কসবা উপজেলার বায়েক ইউনিয়নের কাশিরামপুরে পাহাড়ের ঢালে বাঁশ ঝাড়ের ভেতর থেকে মাথাবিহীন অর্ধগলিত অবস্থায় রাবেয়া আক্তার রাবু (৩৩) নামে এক নারীর মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। এ ঘটনায় বায়েক ইউনিয়নের কাশিরামপুর গ্রামের প্রয়াত সোনা মিয়ার ছেলে সামসুল ইসলাম প্রকাশ মিন্টু (৪৮), একই ইউনিয়নের রঘুরামপুর দক্ষিণপাড়ার মৃত সিরাজ মিয়ার ছেলে মো. আব্দুল আলীম (৪২) ও একই গ্রামের মৃত সামসু মিয়ার ছেলে মো. কুডু মিয়া (৩৮)-কে আটকের পর পুলিশ জানতে পারে ১২ কেজি গাঁজা পরিবহনের পর ওই নারী টাকা দেননি। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে তারা ২৫ জুন ওই নারীকে ডেকে নিয়ে খুন করেন।</p> <p><strong>মাদকের টাকা না দেওয়ায় স্ত্রীকে খুন</strong><br /> ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌর এলাকার পুনিয়াউটে মাদক সেবনের টাকা না দেওয়ায় তানিয়া আক্তার (৩৬) নামে এক নারী স্বামীর হাতে খুন হন। নিহত তানিয়া (৩৬) নাসিরনগর উপজেলার চাতলপাড় ইউনিয়নের কাঁঠালকান্দি গ্রামের মো. রফিতুল ইসলাম ছোটন মিয়ার মেয়ে। ঘাতক স্বামী মো. ফারুক কসবা উপজেলার খাড়েরা গ্রামের শাহ আলম মিয়ার ছেলে। ২৬ জুলাই তানিয়াকে হত্যার পর মরদেহ বাথরুমে রেখে পালিয়ে যান ফারুক। বিয়ের এক বছরের মাথায় তানিয়া হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। ফারুক ও তানিয়া ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ভাড়া বাসায় থাকতেন।</p> <p><strong>মাদকাসক্ত ছেলেকে হত্যা</strong><br /> মাদকাসক্ত ছেলের যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ হয়ে এনায়েত উল্লাহ (২০) নামে এক যুবককে হত্যা করেছেন তার বাবা। ১ সেপ্টেম্বর রাতে বিজয়নগর উপজেলার বিষ্ণুপুর ইউনিয়নের মহেশপুর (স্কুলপাড়া) এলাকার এ ঘটনায় পুলিশ এনায়েতের পিতা জয়নাল আবেদীনকে তাৎক্ষণিকভাবে গ্রেপ্তার করে।</p> <p>পুলিশ ও এলাকাবাসী জানায়, এনায়েত উল্লাহ সৌদি প্রবাসী ছিলেন। বিদেশে ভালো কিছু করতে না পেরে দেশে ফেরেন। দেশে এসে হতাশা থেকে মাদকাসক্ত হয়ে পড়েন। এ সময় তিনি পারিবারিক বিভিন্ন বিষয়াদি নিয়ে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কলহে জড়িয়ে পড়েন। মাদকের টাকার জন্য প্রায়শই বাবার সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণ করতেন। ঘটনার কিছু দিন আগে অটোরিকশা কেনার কথা বলে টাকা দিতে তার বাবাকে চাপ দেন। এ নিয়ে বিতণ্ডার এক পর্যায়ে জয়নাল আবেদীন লোহার রড দিয়ে ছেলেকে মাথায় আঘাত করলে তার মৃত্যু হয়।</p> <p><strong>স্ত্রী-সন্তানকে বিষ খাইয়ে মারার অভিযোগ</strong><br /> সদর উপজেলার ঘাটুরায় দুই সন্তানসহ স্ত্রীকে বিষ খাইয়ে হত্যার অভিযোগ পাওয়া গেছে। ১৩ নভেম্বর পুলিশ শারমিন আক্তার (২৪) এবং তার দুই মেয়ে রোজা আক্তার (৬) ও নোহা আক্তারের (৩) মরদেহ উদ্ধার করে ময়নাতদন্ত করায় পুলিশ।</p> <p>শারমিনের বাবার বাড়ির লোকজনের অভিযোগ, এক নারীর সঙ্গে পরকীয়া, যৌতুকের জন্য নির্যাতনসহ নানা বিষয় নিয়ে প্রতিবাদ করায় দুই মেয়েসহ শারমিনকে স্বামীসহ শ্বশুরবাড়ির লোকজন বিষ খাইয়ে হত্যা করেছেন। আশরাফ জুয়া খেলতেন ও মাদকাসক্ত ছিলেন বলে তাদের অভিযোগ। এসব নিয়ে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কলহ ছিল।</p> <p><strong>বন্ধুর হাতে খুন</strong><br /> গত ১৫ নভেম্বর সন্ধ্যায় আখাউড়া উপজেলার আজমপুরে স্বাধীন মিয়া (২৫) নামে এক যুবককে ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয়। স্বপন নামে এক বন্ধু দলবল নিয়ে এ হত্যাকাণ্ড ঘটায়। স্বপন ও স্বাধীন দুজনই মাদকসেবী। তাদের বিরুদ্ধে থানায় একাধিক ছিনতাই মামলা আছে। </p> <p><strong>মাদকাসক্তের হাতে খুন</strong><br /> ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা উপজেলায় টাকা নিয়ে মোবাইল বিক্রি না করায় মাদকাসক্ত এক যুবকের হাতে মো. মহসীন নামে অটোরিকশাচালক খুন হয়েছেন। হত্যাকাণ্ডের ১১ দিন পর ২৬ ডিসেম্বর পুলিশ তার মরদেহ উদ্ধার করে। ঘাতক রাসেল অটোরিকশা চালকের বন্ধু ছিলেন।</p> <p>পুলিশ জানায়, উপজেলার রানিয়ারা গ্রামের মহসীনের কাছ থেকে একটি মোবাইল ফোন কেনেন রাসেল। তবে মহসীন ওই ফোন দিতে টালবাহানা করেন। এরই মধ্যে মহসীন ওই ফোন ছয় হাজার টাকায় বিক্রি করলে ক্ষুব্ধ হন রাসেল। পরিকল্পনা মাফিক মহসীনকে হত্যা করে মরদেহটি পরিত্যক্ত ঘরে ফেলে রাখা হয়।</p> <p><strong>মাদকাসক্ত যুবক গলাকেটে পুড়িয়ে দিল নারীকে</strong><br /> ব্রাহ্মণবাড়িয়া আখাউড়া উপজেলার দক্ষিণ ইউনিয়নের গাজীর বাজারে ঘটে যাওয়া একটি হত্যাকাণ্ড যেন সব পৈশাচিকতাকে হার মানিয়েছে। গত ২৪ ডিসেম্বর (মঙ্গলবার) পুলিশ সেখানকার একটি পরিত্যক্ত ঘর থেকে ৪৭ বছর বয়সি শারমীন বেগম নামে নারীর পুড়া মরদেহ (কয়লা) উদ্ধার করে। ওই নারীর দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করা মাথা উদ্ধার করা হয় পাশের একটি পুকুরের কাছের জমি থেকে। মাথাটিও গর্তে পুঁতে রাখা হয়েছিল। ঘাতকের দেওয়া স্বীকারোক্তি মতে উদ্ধার করা হয় হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত ছুরি।</p> <p>হত্যাকাণ্ডের শিকার ওই নারী উপজেলার হীরাপুর গ্রামের কলোনি এলাকার মো. নুরুল ইসলাম বেপারীর স্ত্রী। ভোরে ওই নারীকে ডেকে নিজবাড়িতে নিয়ে যান ঘাতক যুবক ফারহান ভূঁইয়া রনি। উপজেলার দক্ষিণ ইউনিয়ন যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক শাহনেওয়াজ ভূঁইয়ার ছেলে ফারহান এলাকায় চিহ্নিত মাদকসেবী হিসেবে পরিচিত। ফারহানের বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগও দিয়েছিলেন তার বাবা শাহনেওয়াজ ভূঁইয়া।</p> <p><strong>সচেতনতার তাগিদ</strong><br /> এসব বিষয়ে কথা হলে খেলাঘর ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক নীহার রঞ্জন সরকার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ব্রাহ্মণবাড়িয়া মাদক পরিবহনের ট্রানজিট পয়েন্ট হওয়ায় এটা একেবারে নির্মূল করা হয়ত সম্ভব না। কিন্তু নিয়ন্ত্রণে আনতে সংশ্লিষ্টদের আরো তৎপরতা বাড়াতে হবে। পাশাপাশি পারিবারিকভাবেও আমাদেরকে আরো সচেতন হতে হবে।’</p> <p>সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক) ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সভাপতি অ্যাডভোকেট আবদুন নূর এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘মাদকাসক্তরা এক সময় নিজের স্বাভাবিকতা হারিয়ে ফেলে। ভালো-মন্দের বালাই থাকে না তাদের কাছে। এ ক্ষেত্রে পরিবারকে সন্তানদের বিষয়ে অনেক বেশি সচেতন হতে হবে।’ সম্প্রতি ঘটা কিছু ঘটনায় উদ্বেগ জানিয়ে মাদক নির্মূলে সংশ্লিষ্টদের জোরালো ভূমিকা পালন করার দাবি করেন তিনি। </p> <p>ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সাবেক সিভিল সার্জন ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. শাহ আলম বলেন, ‘এখন মূলত ইয়াবার কারণে সমস্যা বেশি হচ্ছে। এ ধরনের মাদক যারা সেবন করেন তাদেরকে দিয়ে যেকোনো ভয়ঙ্কর কাজ করানো যায়। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে পরিবার থেকে সচেতনতাটা বেশি জরুরি। কেউ মাদকাসক্ত হয়ে গেলে ছয় মাস থেকে এক বছরের চিকিৎসায় স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা সম্ভব।’</p>