ঢাকা, মঙ্গলবার ০১ এপ্রিল ২০২৫
১৮ চৈত্র ১৪৩১, ০১ শাওয়াল ১৪৪৬

ঢাকা, মঙ্গলবার ০১ এপ্রিল ২০২৫
১৮ চৈত্র ১৪৩১, ০১ শাওয়াল ১৪৪৬

শেখ ফজলুল হক মনির ৩৫ বছর জীবনের বর্ণাঢ্য ইতিহাস

  • স্বাধীনতার অকাট্য প্রামাণিক দলিল
সৈয়দ মিজানুর রহমান
সৈয়দ মিজানুর রহমান
শেয়ার
শেখ ফজলুল হক মনির ৩৫ বছর জীবনের বর্ণাঢ্য ইতিহাস
শেখ ফজলুল হক মনি

৪ ডিসেম্বর, ২০২১ শহীদ শেখ ফজলুল হক মনির ৮২তম জন্মদিন। বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতাসংগ্রামের অন্যমত এই সংগঠক জনশ্রুতিতে চৌকস রাজনৈতিক পরিচয়ে বিশ্ব সমাদৃত তো বটেই! এ ছাড়া দেশের ইতিহাস তাঁকে ধারণ করেছে একজন প্রজ্ঞাবান সাংবাদিক ও সুলেখক হিসেবে। আপদমস্তক দেশপ্রেমে গড়ে ওঠা এই মানুষটি বাংলার স্বাধীনতাসংগ্রামে কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের কারণে বিপ্লবী বীর খেতাব পরিচিতি পান মাত্র ৩৫ বছর বয়সেই।

শেখ ফজলুল হক মনির পিতা তদানীন্তন ফরিদপুর মহকুমার জমিদার কুদরত উল্লাহ শেখের (কুদ শেখ) পুত্র নূরুল হক।

তিনি উচ্চশিক্ষা সম্পন্ন করে ব্রিটিশ সরকারের (এজিবির) উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন এবং শেখ মনির মাতা আছিয়া বেগম ছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বড় বোন।

শৈশব থেকেই আপন মামা এবং বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদরে-অনুকরণে বেড়ে উঠেছেন শেখ ফজলুল হক মনি। সে সময় থেকেই পাকিস্তানি শাসন-শোষণ বঞ্চনার দাহ্য শেখ মনির রাজনৈতিক দ্রোহে প্রকাশিত হতে থাকে। ছাত্র অবস্থায়ই প্রত্যক্ষ রাজনীতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন তিনি।

তারুণ্যের উত্তাপে মুজিব আদর্শে বলীয়ান শেখ মনি ১৯৬২ থেকে ১৯৬৩ সাল মেয়াদে তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন এবং দীর্ঘ সময় ছাত্রসমাজের নেতৃত্ব দেন।

১৯৬২ সাল ছিল আন্দোলনমুখর এক অগ্নিগর্ভের বছর। এ সময়ে হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশন রিপোর্টের বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন সংগঠিত হয়। তত্কালীন পাকিস্তান সরকার শিক্ষাকার্যক্রম এলিট শ্রেণির জন্য সংরক্ষিত করে এক রিপোর্ট পেশ করে।

শিক্ষা খাতে ব্যয় বৃদ্ধিসহ শিক্ষা থেকে লাভজনক মুনাফা আদায়ের উদ্দেশ্যে অবৈতনিক শিক্ষা অবাস্তব ঘোষণা করলে শিক্ষার মৌলিক অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে আন্দোলন সংগঠিত হতে থাকে। আন্দোলনের এক পর্যায়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনির্দিষ্টকালের জন্য ধর্মঘট কর্মসূচি পালনের পরিপ্রেক্ষিতে গ্রেপ্তার হন শেখ মুজিবুর রহমান, তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়াসহ অনেকে। ধারাবাহিকভাবে হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট বাতিলের দাবিতে ওই আন্দোলনের নেতৃত্ব দেওয়ার অভিযোগে গ্রেপ্তার হন তত্কালীন ছাত্রনেতা শেখ ফজলুল হক মনি। এ সময় তাঁকেও ছয় মাস কারাভোগ করতে হয়।

শিক্ষা কমিশনের বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলনের মুখে পিছু হটে পাকিস্তানের তত্কালীন স্বৈরশাসক ‘ফিল্ড মার্শাল’ আইয়ুব খান।

১৯৬২ সালের ৮ জুন পাকিস্তানের দীর্ঘ সামরিক আইনও প্রত্যাহার করতে বাধ্য করা হয় তাঁকে। সেই থেকে শেখ ফজলুল হক মনি বাংলার স্বাধিকার আন্দোলন-সংগ্রামের শক্তি-সাহস হয়ে ওঠেন।

১৯৬২ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের এক ঐতিহাসিক গৌরবোজ্জ্বল দিবস। এবারে জাতির শিক্ষার অধিকার আদায়ে আত্মদানের ইতিহাস ঐতিহ্য ছাত্রলীগকে করেছে মহিমান্বিত। শিক্ষা কমিশন আন্দোলনের বীরত্ব গাথা ইতিহাসে ১৭ সেপ্টেম্বর তারিখে বাংলার ছাত্রসমাজ ‘শিক্ষা দিবস’ হিসেবে পালন করে আসছে।

শেখ ফজলুল হক মনির দেশপ্রেম, সংগ্রাম ও অধিকার আদায়ে ইতিহাসের অকাট্য দলিলসমগ্র তরুণ প্রজন্মের পড়া ও জানা দরকার। বিশেষ করে ছাত্রলীগের বন্ধুদের অত্যাবশ্যকীয়ভাবে এই ইতিহাস জানা বাঞ্ছনীয়। 

১৯৫৩ সালের সামরিক শাসনামলে পূর্ব বাংলায় সব ধরনের রাজনৈতিক তত্পরতা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। দীর্ঘ পটপরিক্রমায় ১৯৬২ সালে শিক্ষা কমিশন আন্দোলনের ফলে স্বৈরাচার আইয়ুব সরকার মার্শল ল প্রত্যাহার করে মৌলিক গণতন্ত্র ঘোষণা করতে বাধ্য হয়।

এ সময় ছাত্রলীগের তত্কালীন সাধারণ সম্পাদক শেখ ফজলুল হক মনি আবার সাংগঠনিক কার্যক্রম জোরদারের পাশাপাশি আধুনিক চিন্তাধারার সংগ্রাম ও অধিকার আদায়ের প্রতিবাদী কৌশল অবলম্বন করে ছাত্রলীগের দলীয় মনোগ্রাম এবং পতাকা তৈরির সিদ্ধান্ত নেন। যে কারণে ছাত্রলীগের দলীয় মনোগ্রাম ও পতাকা তৈরির ইতিহাসে শেখ ফজলুল হক মনির আকণ্ঠ দেশপ্রেম ও বাঙালির ন্যায্য অধিকার আদায়ের প্রতিবাদী কল্পকাহিনি গচ্ছিত রয়েছে।

১৯৬৩ সালে ছাত্রলীগের জাতীয় কাউন্সিল আহ্বান করে নতুনভাবে ছাত্র রাজনৈতিক তত্পতরা বৃদ্ধির পাশাপাশি ছাত্রলীগের দলীয় পতাকা এবং মনোগ্রাম প্রকাশের মাধ্যমে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বাংলার অর্থ-সম্পদ, ন্যায্যতা লুণ্ঠনের প্রতিবাদে সংগ্রামের প্রতীকী বার্তা দেন শেখ ফজলুল হক মনি।

তাঁর অনুরোধেই দেশের প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী জয়নুল আবেদিন ছাত্রলীগের দলীয় মনোগ্রাম ও পতাকার মৌলিক ধারণা প্রণয়ন করেন। এ কাজে সহযোগী হিসেবে যুক্তি-পরামর্শদানের জন্য বিখ্যাত বাংলা লৌকসাহিত্য শিল্পী অধ্যাপক মনসুর উদ্দিন সাহেবের প্রতি শ্রদ্ধা জানাই।
শেখ ফজলুল হক মনির দেশপ্রেমে সংগ্রাম ও প্রতিবাদের কৌশলগত রূপরেখায় চিত্রশিল্পী জয়নুল আবেদিন আওয়ামী লীগের দলীয় প্রতীক ও চিরায়িত বাংলার ঐতিহ্য নৌকাকে চলমান, প্রগতিশীল বিবেচনায় ছাত্রলীগের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চলমান ও প্রগতিশীলতার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ছাত্রসংগঠনের মনোগ্রামের মধ্যাংশে নৌকার আকৃতি ব্যবহার করেন এবং তত্কালীন পূর্ব বাংলার সোনালি আঁশ ছিল ‘পাট’। যেহেতু পূর্ব বাংলার কৃষি খাতের স্বর্ণালি ফসল পাটের রপ্তানীকৃত লাভজনক অর্থের বেশির ভাগই পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকরা অন্যায্যভাবে নিয়ে যেত; সেই প্রতিবাদে ছাত্রলীগের মনোগ্রামের দুই পাশে পাট পাতা আকৃতির ব্যবহার করা হয়েছে এবং শিক্ষা, শান্তি ও প্রগতির উদ্দেশ্য সামনে রেখে তিন তারকা চিহ্ন এবং স্পষ্ট বাংলা অক্ষরে ওপরে পূর্ব বাংলা ও নিচে ছাত্রলীগ লিখে চিরায়িত বাংলার ঐতিহ্য গাঢ় সবুজ রঙের পটভূমি ব্যবহারে করে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের দলীয় মনোগ্রাম প্রস্তুত করা হয়েছিল।

একই চিন্তাধারায় শেখ ফজলুল হক মনির পরামর্শক্রমে দেশের স্বাধীনতাসংগ্রামের পরিপ্রেক্ষিতে শান্তির রং সাদা পটভূমিতে সংগ্রামের প্রতীক হিসেবে তিনটি অগ্নিশিখা চিহ্নের ওপর শিক্ষা, শান্তি ও প্রগতির মন্ত্রে লাল রঙের তিন তারকা চিহ্নের রূপ দিয়ে ছাত্রলীগের দলীয় পতাকার আকৃতি নিরূপণ করেছিলেন বিখ্যাত চিত্রশিল্পী জয়নুল আবেদিন।

অবশ্য শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের এই রূপকল্প অনুযায়ী ছাত্রলীগের দলীয় মনোগ্রাম ও পতাকা তৈরির শিল্পকর্মে শেখ ফজলুল হক মনির সংগ্রাম ও অধিকার আদায়ের প্রতিবাদী বার্তায় বাঙালির ন্যায্য অধিকার লুণ্ঠনের চিত্রকর্ম চমত্কারভাবে ফুটিয়ে তুললেন তাঁরই ছাত্র তখনকার নামকরা চিত্রশিল্পী হাশেম খান। যা আজও বাংলাদেশ ছাত্রলীগের দলীয় মনোগ্রাম ও পতাকা হিসেবে ব্যবহার হয়ে আসছে। এভাবেই বাঙালি জাতির বৃহত্তর স্বার্থে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সংগ্রামী পথচলায় ছায়াসঙ্গী হয়ে স্বাধীনতাসংগ্রামের বীজ বপনে ধারাবাহিকভাবে অবদান রাখেন শেখ ফজলুল হক মনি।

১৯৬৪ সালের ২২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর মোনেম খাঁর আগমনের বিরুদ্ধে শেখ ফজলুল হক মনির নেতৃত্বে ছাত্রনেতারা সুদৃঢ় প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। বিক্ষোভ প্রতিবাদের কারণে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিয়ে পাকিস্তানি জান্তা শেখ ফজলুল হক মনির এমএ ডিগ্রি বাতিল করে। অবশ্য পরবর্তী সময়ে মামলায় জয়লাভ করে আলোচ্য ডিগ্রি ফিরে পান তিনি।

১৯৬৫ সালে পাকিস্তান নিরাপত্তা আইনে গ্রেপ্তার হয়ে দেড় বছর কারাভোগ করেন। ১৯৬৬ সালের ছয় দফা থেকে ১৯৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থানের সংগঠক শেখ ফজলুল হক মনি আন্দোলন-সংগ্রামের থিংকট্যাংক হিসেবে ভূমিকা রেখেছিলেন। ১৯৬৬ সালের ৭ জুন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও আটক অন্যান্য জাতীয় নেতার মুক্তির দাবিতে দেশব্যাপী শ্রমিক ধর্মঘট পালনের অগ্রভাগে নেতৃত্ব দেন শেখ মনি। ওই ধর্মঘটে পুলিশের গুলিতে তেজগাঁও শিল্প এলাকায় শ্রমিক নেতা মনু মিয়াসহ সারা দেশে ১১ জন নিহত হন। এবারেও তাঁকে গ্রেপ্তার করে দীর্ঘ দুই বছর আট মাস কারান্তরীণ রাখা হয়।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে কারারুদ্ধ থাকা অবস্থায় ১৯৬৯ সালে বাঙালির গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে মুক্তিলাভ করেন তিনি। প্রকৃতপক্ষে ষাটের দশকজুড়েই বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ বাস্তবায়নে শেখ ফজলুল হক মনি নিযুক্ত ছিলেন বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনে উপযুক্ত কর্মীদল ও সংগঠন গড়ার কাজে। ১৯৭০ সালে আওয়ামী লীগের ঐতিহাসিক নির্বাচনী ইশতেহারের অন্যতম প্রণেতাও শেখ ফজলুল হক মনি।

ধারাবাহিক আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে গড়ে তোলা নেতাকর্মীদের সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধায় পরিণত করে ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সম্মুখ সমরে বীরত্ব গাথা নেতৃত্বের অর্জনই আজকের স্বাধীন বাংলাদেশ। শেখ ফজলুল হক মনির ধমনিতে বঙ্গবন্ধুর বজ্রকণ্ঠে নিসৃত ৭ই মার্চের সেই গর্জন— ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ পরিপূর্ণভাবে কার্যকারিতা লাভ করে।

আন্দোলন-সংগ্রামের সতীর্থ সহচর সিরাজুল আলম খান, অনুজপ্রতিম আব্দুর রাজ্জাক ও তোফায়েল আহমেদকে সহসঙ্গী করে শেখ ফজলুল হক মনি গড়ে তোলেন বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স (বিএলএফ), যা মুজিববাহিনী নামে সর্বাধিক বিখ্যাত। স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের জন্য শেখ ফজলুল হক মনিকে বাংলার ইতিহাস চির অমর করে রাখবে। 

স্বাধীনতা লাভের পর যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশকে পুনর্গঠনের সংগ্রামে শেখ ফজলুল হক মনির ওপর আবারও আস্থা রাখলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধুর প্রত্যক্ষ নির্দেশে ১৯৭২ সালের ১১ নভেম্বর উপমহাদেশের বৃহত্ যুব সংগঠন বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ প্রতিষ্ঠা করলেন দূরদর্শীসম্পন্ন জননেতা শেখ ফজলুল হক মনি। যুব রাজনীতির পদযাত্রায় আওয়ামী যুবলীগের প্রতিষ্ঠাকালীন চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালনের মধ্য দিয়ে দেশমাতৃকার অবকাঠামো উন্নয়ন সমৃদ্ধির কাজে আত্মনিয়োগ করেন বাংলার যুবশক্তিকে মানবসম্পদে পরিণত করার মধ্য দিয়ে। গড়ে তোলেন দেশপ্রেমিক আধুনিক যুবসমাজ।

দেশের অবকাঠামো উন্নয়ন ও রাজনৈতিক ব্যস্ততার মধ্যেও শেখ ফজলুল হক মনির জ্ঞান আহরণের অভিলাষ বর্তমান প্রজন্মের জন্য নিদারুণ শিক্ষা হতে পারে। তাঁর ব্যক্তিগত সংগ্রহশালায় বিশ্বের ঐতিহাসিক তথ্যবহুল বইসমগ্র যে কাউকে বিস্মিত করত।

১৯৬৩ সালেই দৈনিক ইত্তেফাকের সম্পাদক তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার তত্ত্বাবধানে সাংবাদিকতা পেশায় নিয়োজিত হন শেখ ফজলুল হক মনি। ১৯৬৯ সালে তাঁর রচিত গল্পের সংকলন বৃত্ত প্রথম প্রকাশিত হয়। সাবলীল লেখালেখিতে জনপ্রিয়তার কারণে পরবর্তী সময়ে এটি গীতারায় নামে দ্বিতীয় সংস্করণে প্রকাশিত হয়। যা বাংলাদেশের গণহত্যা সম্পর্কিত তাঁর সর্বাধিক আলোচিত ও ঐতিহাসিক সম্পাদনামূলক গ্রন্থ।

এরপর ১৯৭০ সালে নিজেই প্রকাশ করেছিলেন সাপ্তাহিক বাংলার বাণী ম্যাগাজিন, যা স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে দৈনিক বাংলার বাণী পত্রিকায় রূপান্তর করা হয়। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন সদ্যঃস্বাধীন বাংলাদেশকে বিশ্ব দরবারে তুলে ধরতে দেশের তরুণ যুবসমাজে শিক্ষা, সংস্কৃতি ও সাংবাদিকতার বিকাশ ঘটাতে হবে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৭৩ সালে প্রকাশ করেন বিনোদনমূলক ম্যাগাজিন ‘সাপ্তাহিক সিনেমা’। ১৯৭৪ সালে তাঁর সম্পাদনায় ইংরেজি দৈনিক দি বাংলাদেশ টাইমস প্রকাশিত হয়। ‘দৈনিক বাংলার বাণী ও দি বাংলাদেশ টাইমস’ পত্রিকায় একই সঙ্গে ইংরেজি ও বাংলা উভয় ভাষায়ই সম্পাদকীয় লিখতেন তিনি। এভাবেই পাকিস্তানিদের বর্বরতা, ধর্ষণ, গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞের সার্বিক ফিরিস্তি তুলে ধরে বিশ্ব নজরে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশকে উপস্থাপন করতেন দেশপ্রেমিক লেখক শেখ ফজলুল হক মনি।

কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শ্রাবণ মেঘেঢাকা রাতের শেষভাগে বাংলার আকাশ-বাতাস নিস্তেজ হয়ে পড়ে শেখ পরিবারের নির্মম হত্যাকাণ্ডে। ঘাতকের নীল দংশনে মুহূর্তেই বিষাক্ত হয়ে যায় স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতির রক্তে রঞ্জিত মাটি। একই সঙ্গে স্বাধীনতা-সংগ্রামের দূরদর্শীসম্পন্ন প্রতিবিপ্লবী শেখ ফজলুল হক মনি ও তাঁর সন্তানসম্ভাবনা স্ত্রী আরজু মনির বুকের তাজা রক্তেও অভিশপ্ত হয় সবুজ-শ্যামল বাংলার মাটি। 

আগস্টের সেই নির্মম হত্যাকাণ্ডের ঘটনা বিবরণীর স্মৃতিকথায় শেখ ফজলুল হক মনি ও আরজু মনির জ্যেষ্ঠপুত্র বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগের বর্তমান চেয়ারম্যান অধ্যাপক শেখ ফজলে সামস পরশ তাঁর লেখা ‘নির্বাসনের দিনগুলি’ শিরোনামে এক প্রবন্ধে ঘটনার লোমহর্ষক বর্ণনায় উল্লেখ করেন—‘‘আমার মা মনে হয় বাবাকে অনেক বেশি ভালোবাসতেন। তাই প্রবৃত্তির বশবর্তী হয়েই মা বাবার সামনে মানবঢাল হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েন। সেই মুহূর্তে তিনি আমাদের কথাও ভাবেন নাই। মা স্বামীর প্রতি নিঃস্বার্থ ভালোবাসার উদাহরণ রেখে গেছেন। হয়তো বা গুলি লাগার পরে তাঁর আমাদের দুই ভাইয়ের কথা মনে হয়েছে। কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। ফিরে আসার আর উপায় ছিল না। তখনই মা চাচিকে বললেন, ‘ফাতু আমাকে বাঁচাও। আমার পরশ-তাপস! ওদেরকে তুমি দেইখো।’ ওটাই বোধ হয় মার শেষ কথা।”

অবুঝ দুই শিশুপুত্র শেখ ফজলে শামস পরশ ও শেখ ফজলে নূর তাপসকে রেখে বাংলার স্বাধীনতা-সংগ্রামের বিপ্লবী বীর শেখ ফজলুল হক মনি ও তাঁর সহধর্মিণী শামসুন্নেসা আরজু মনি ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট আন্তর্জাতিক মদদপুষ্ট দেশীয় কিছু সেনা ঘাতকের নির্দয় বুলেট বিদ্ধ হয়ে মৃত্যু আলিঙ্গন করে ইহকাল ত্যাগ করেন।

শেখ ফজলুল হক মনি ১৯৩৯ সালের ৪ ডিসেম্বর গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়া গ্রামের ঐতিহ্যবাহী শেখ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পূর্বপুরুষরা ছিলেন দরবেশ শেখ আউয়ালের বংশধর, যাঁরা উপমহাদেশের প্রখ্যাত ইসলাম সাধক হজরত বায়েজীদ বোস্তামী (রা.)-এর ধর্ম প্রচারে সহচর ছিলেন।

মধুমতী নদীর তীরভূমি টুঙ্গিপাড়ার সবুজ-শ্যামল গ্রামে শৈশব স্মৃতির মোহমায়া ছেড়ে শেখ ফজলুল হক মনি লেখাপড়ার সুবাদে ঢাকায় আসেন একবুক স্বপ্ন নিয়ে। অধ্যয়ন শুরু করেন নবকুমার ইনস্টিটিউটে। এই প্রতিষ্ঠান থেকে ১৯৫৬ সালে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়ে ভর্তি হন জগন্নাথ কলেজে এবং ১৯৫৮ সালে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন। ১৯৬০ সালে বরিশাল ব্রজমোহন কলেজে ভর্তি হয়ে এই শিক্ষপ্রতিষ্ঠান থেকেই বিএ ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে ভর্তি হয়ে ১৯৬২ সালে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন। এ সময় তিনি স্যার সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের আবাসিক ছাত্র ছিলেন। এ ছাড়া কারাবন্দি থাকা অবস্থায় ১৯৬৭ সালে আইনশাস্ত্রে এলএলবি ডিগ্রি সম্পন্ন করেন বাংলার এই সূর্যসন্তান।

স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক, যুব রাজনীতির মহাপ্রাণ দূরদর্শীসম্পন্ন রাজনৈতিক, লেখক-সাংবাদিক, বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ শেখ ফজলুল হক মনি বাংলার ইতিহাসে সংগ্রাম ও সাফল্যের অসংখ্য অকাট্য দলিল রচনা করে গেলেন মাত্র ৩৫ বছরের বর্ণাঢ্য জীবনে। ৮২তম জন্মবার্ষিকীতে তাঁর অমর কৃর্তির প্রতি বিশ্ব যুবসম্প্রদায়ের বিনম্র শ্রদ্ধা।

লেখক : সাবেক সভাপতি, ঢাকা মহানগর ছাত্রলীগ (উত্তর) ও যুবনেতা, ঢাকা মহানগর যুবলীগ উত্তর

মন্তব্য

দুধ দিয়ে গোসল করলে কি কলঙ্ক মোছে?

অনলাইন ডেস্ক
অনলাইন ডেস্ক
শেয়ার
দুধ দিয়ে গোসল করলে কি কলঙ্ক মোছে?

দুধ দিয়ে গোসল করে রাজনীতি ছাড়ার হিড়িক পড়েছে দেশে। এই নেতা দুধ দিয়ে গোসল করে আওয়ামী লীগ ছাড়ছেন, তো আরেক নেতা নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ ছাড়ছেন। সকালে যুবলীগ ছাড়ছেন আরেকজন। কিন্তু দুধ দিয়ে গোসল কেন? বিশেষ দুধ দিয়ে গোসল করে আলোচনায় নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের অনেক নেতাকর্মী।

দুধ দিয়ে গোসল করলে কী হয়?
বিগত কয়েক বছরে এমন অনেক নেতা দুধ দিয়ে গোসল করে হয় রাজনীতি ছেড়েছেন, নয়তো দল পরিবর্তন করেছেন। কিন্তু এই খবরগুলোর আকর্ষণের জায়গা ছিলো দুধ দিয়ে গোসল। নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন জানান, রাজনীতির কলঙ্ক মুছতেই তারা গোসলে দুধের ব্যবহার করে পাক-পবিত্র হওয়ার চেষ্টা করেছেন।
 
আসলেই কি দুধ কলঙ্ক মোছে?
ভারতীয় উপমহাদেশে দুধ দিয়ে গোসলের মাধ্যমে পবিত্র হওয়ার ধারণা প্রাচীনকাল থেকে চলে এলেও আধুনিক বিজ্ঞানে যা ভিত্তিহীন।

দুধ দিয়ে গোসলের মাধ্যমে কলঙ্কমুক্ত হওয়ার কোনো তথ্য ধর্মীয়ভাবেও শোনা যায় না। তবে দুধ মিশ্রিত পানি দিয়ে গোসল করলে পাওয়া যায় কিছু স্বাস্থ্যগত উপকারিতা।

চিকিৎসাবিজ্ঞানে দুধ দিয়ে গোসলে কয়েকটি উপকারিতা পাওয়া যায়। তন্মধ্যে শুষ্ক ত্বকে আর্দ্রতা আনা, একজিমা দূর করা, চুলকানি দূর হওয়াসহ নানা উপকারের উল্লেখ রয়েছে।

প্রাসঙ্গিক
মন্তব্য

মেডুসা, গ্রিক পুরাণের এক অভিশপ্ত রূপসী

শেয়ার
মেডুসা, গ্রিক পুরাণের এক অভিশপ্ত রূপসী
সংগৃহীত ছবি

গ্রিক পুরাণের এক রহস্যময় চরিত্র মেডুসা। তার সৌন্দর্য একসময় দেবতাদের পর্যন্ত মুগ্ধ করেছিল। কিন্তু এক ভয়ংকর অভিশাপের কারণে তিনি পরিণত হন এক দানবীতে। যার চোখে তাকালেই মানুষ পাথরে পরিণত হয়।

মেডুসা মূলত একজন অসাধারণ সুন্দরী মানবী ছিলেন। তার সৌন্দর্যে বিমোহিত হন সমুদ্রের দেবতা পসেইডন। কিছু কাহিনিতে বলা হয়, পসেইডন তাকে এথেনার মন্দিরে শারীরিকভাবে হেনস্তা করেন। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে দেবী এথেনা এতে রুষ্ট হয়ে মেডুসাকে শাস্তি দেন।

মেডুসার সুন্দর চুল পরিণত হয় ভয়ংকর সাপের ঝাঁকে। তাঁর দৃষ্টিতে কেউ তাকালে সে পাথরে পরিণত হয়।

গ্রিক পুরাণে মেডুসার ভূমিকা
মেডুসার গল্প শুধু অভিশাপের নয়, প্রতিশোধ ও ক্ষমতারও। বহু বীর মেডুসাকে পরাজিত করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন।

কিন্তু পারসিয়াস, অলিম্পাসের দেবতাদের সহায়তা নিয়ে অবশেষে মেডুসাকে বধ করেন।
পারসিয়াস মেডুসার মাথা কেটে ফেলে এবং সেটি একটি থলেতে করে নিয়ে যান। এই মাথা পরবর্তীতে বিভিন্ন যুদ্ধে ব্যবহার করা হয়, কারণ এটি তখনো পাথরে পরিণত করার ক্ষমতা ধরে রেখেছিল।

মেডুসার প্রতীকী গুরুত্ব
আজকের সমাজে মেডুসার গল্প নারীদের শক্তি, অবমাননার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ও পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রতীকি প্রতিবাদের প্রতিচ্ছবি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। একসময় তাকে শুধু ভয়ংকর দানবী হিসেবে দেখা হলেও এখন অনেকেই মেডুসাকে এক নির্যাতিত নারীর প্রতিচ্ছবি হিসেবে দেখেন।

যিনি সমাজের অন্যায়ের শিকার হয়েছিলেন।

সংস্কৃতিতে মেডুসা
শিল্পকলা ও ভাস্কর্যে মেডুসার মুখ দেখা যায়, বিশেষ করে রেনেসাঁ যুগের চিত্রকলায়। ফ্যাশন ডিজাইনাররা মেডুসার প্রতীক ব্যবহার করেছেন। বিখ্যাত ব্র্যান্ড ভার্সাচির লোগোতে মেডুসার মাথা রয়েছে। অনেক সাহিত্য, সিনেমা ও ভিডিও গেমে মেডুসা চরিত্রটি এসেছে, যেখানে তাকে ভয়ংকর দানবী বা শক্তিশালী নারীর প্রতীক হিসেবে দেখানো হয়েছে।

সূত্র : ব্রিটানিকা

মন্তব্য

‘মেহেন্দি বাই মিমির’ আয়োজনে হতে যাচ্ছে ঈদ মেহেদী ফেস্ট

অনলাইন ডেস্ক
অনলাইন ডেস্ক
শেয়ার
‘মেহেন্দি বাই মিমির’ আয়োজনে হতে যাচ্ছে ঈদ মেহেদী ফেস্ট
ছবি: কালের কণ্ঠ

ঈদুল ফিতরের আনন্দে সবাইকে রাঙাতে রাজধানী ঢাকায় আয়োজন হচ্ছে দেশের সবচেয়ে বড় মেহেদী উৎসব ‘ঈদ মেহেদী ফেস্ট ২০২৫’।  ‘মেহেন্দি বাই মিমি’ আয়োজনে এই উৎসবে  থাকছে তাদের সকল পণ্য কেনা, লাইভ মেহেদি পরিয়ে নেওয়ার সুযোগ। এই মেহেদী ডিজাইনগুলো একেবারেই নতুন এবং ভিন্ন মাত্রার।

আয়োজকরা জানান, এই আয়োজনের কেন্দ্রবিন্দু হলো অভিজ্ঞ কারিগরদের তৈরি অর্গানিক মেহেদি দিয়ে নকশা করা কারুকাজ নিজের হাতে নেওয়া।

এই ফেস্টিভ্যালটি অনুষ্ঠিত হবে ঢাকার ক্যান্টনমেন্ট ইসিবি চত্তরের ব্লুমুন টাওয়ারের ১৩ তলায়, যেখানে দেশের শীর্ষস্থানীয় মেহেদী শিল্পীরা উপস্থিত থাকবেন এবং তাদের সৃজনশীল ডিজাইন ক্লায়েন্টের পছন্দ অনুযায়ী হাতে তুলে দেবেন।  ‘মেহেন্দি বাই মিমি’-এর প্রতিষ্ঠাতা প্রখ্যাত মেহেদী ডিজাইনার তানজিলা আক্তার মিমি নিজেই এই আয়োজনে নেতৃত্ব দেবেন।

‘ঈদ মেহেদী ফেস্ট ২০২৫’ মেহেদী প্রেমীদের জন্য একটি অসাধারণ সুযোগ, যেখানে তারা উপভোগ করতে পারবেন আধুনিক ও ঐতিহ্যবাহী মেহেদী ডিজাইনের এক চমকপ্রদ সমন্বয়। ফেস্টে অংশগ্রহণকারীরা পাবেন বিশেষ ঈদ স্পেশাল মেহেদী ডিজাইন, যা আপনাদের ঈদ উৎসবকে নতুন মাত্রায় নিয়ে যাবে।

উৎসবটি আগামী ২৯ ও ৩০ মার্চ সকাল ১০টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত রাজধানীর ক্যান্টনমেন্ট ইসিবি চত্ত্বরের ব্লুমুন টাওয়ারে অনুষ্ঠিত হবে। যোগাযোগ করতে পারেন- ফোন: 09647000112, ইমেইল: mehendibymimi@gmail.com এবং  ওয়েবসাইট: www.mehendibymimi.com।

প্রাসঙ্গিক
মন্তব্য
স্বরণ

স্থপতি ফজলুর রহমান খানের মৃত্যুবার্ষিকী আজ

অনলাইন ডেস্ক
অনলাইন ডেস্ক
শেয়ার
স্থপতি ফজলুর রহমান খানের মৃত্যুবার্ষিকী আজ
সংগৃহীত ছবি

স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এর অন্যতম পথিকৃৎ বিশ্ব বিখ্যাত পুরকৌশলী ফজলুর রহমান খানের মৃত্যুবার্ষিকী আজ। ১৯৮২ সালের ২৭ মার্চ (আজকের দিনে) তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তিনি পৃথিবীর অন্যতম উচ্চ ভবন শিকাগোর সিয়ার্স টাওয়ার (বর্তমানে উইলিস টাওয়ার)-এর নকশা প্রণয়ন করেন। তাকে বিংশ শতকের শ্রেষ্ঠ প্রকৌশলীদের মধ‍্যে অন‍্যতম বলা হয়।

ফজলুর রহমান খান ১৯২৯ খ্রিষ্টাব্দের ৩ এপ্রিল তৎকালীন বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির ঢাকায় একটি বাঙালি মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা খান বাহাদুর আবদুর রহমান খাঁ ছিলেন একজন শিক্ষাবিদ। তার দাদার নাম আসলত রহমান খাঁন এবং তাদের আদিবাড়ি ছিল মাদারীপুর জেলার শিবচর উপজেলার ভাণ্ডারিকান্দি গ্রামে।

আরো পড়ুন

ময়মনসিংহে কথা কাটাকাটির জেরে যুবককে হত্যার অভিযোগ

ময়মনসিংহে কথা কাটাকাটির জেরে যুবককে হত্যার অভিযোগ

 

তার মা খাদিজা খাতুন ছিলেন পাবনা জেলার দুলাই ও পার্শ্ববর্তী এলাকার জমিদার আব্দুল বাসিত চৌধুরীর মেয়ে এবং তাদের পূর্বপুরুষ শরফুদ্দীন সরকার তুর্কেস্তানের সমরখন্দ শহর থেকে বাংলায় এসে দুলাই গাঁওয়ে বসতি স্থাপন করেছিলেন।

ফজলুর রহমান খানের ভাই হলেন ডা. জিল্লুর রহমান খান এবং তার বোন মাসুদা খান লীনা হলেন সাবেক মন্ত্রী এনায়েতুল্লাহ্ খানের স্ত্রী।

ফজলুর রহমান ১৯৪৪ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকার আরমানিটোলা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিক বা মাধ্যমিক পরীক্ষায় এবং ১৯৪৬ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে কলকাতার শিবপুর বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে (বর্তমানে বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড সায়েন্স ইউনিভার্সিটি, শিবপুর) ভর্তি হন। 

আরো পড়ুন

শুভ জন্মদিন কোয়েন্টিন ট্যারান্টিনো

শুভ জন্মদিন কোয়েন্টিন ট্যারান্টিনো

 

চূড়ান্ত পরীক্ষা চলাকালে পঞ্চাশের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার কারণে তিনি ঢাকায় ফিরে এলে তৎকালীন আহসানউলাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ (বর্তমানে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়) থেকে বাকি পরীক্ষা সমাপ্ত করেন। কলকাতার শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে অনুষ্ঠিত পরীক্ষার এবং আহসানউলাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের পরীক্ষার উভয় ফলের ভিত্তিতে তাকে বিশেষ বিবেচনায় ব্যাচেলর অব ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রি অর্থাৎ প্রকৌশলে স্নাতক উপাধি প্রদান করা হয়।

এ মূল্যায়নে তিনি প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করেন।

ফজলুর রহমান খান ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দে যুগপৎ সরকারি বৃত্তি ও ফুলব্রাইট বৃত্তি নিয়ে পিএইচডি করতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যান। সেখানে ১৯৫৩ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ইউনিভার্সিটি অব ইলিনয় অ্যাট আর্বানা-শ্যাম্পেইন থেকে অবকাঠামো প্রকৌশল (স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারিং) ক্ষেত্রে সনদ এবং ১৯৫৫ খ্রিষ্টাব্দে তত্ত্বীয় ও ফলিত বলবিজ্ঞান ক্ষেত্রে বিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর (মাস্টার অব সায়েন্স) উপাধি লাভ করেন।

আরো পড়ুন

‘র’-এর ওপর নিষেধাজ্ঞার সুপারিশে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ভারতের

‘র’-এর ওপর নিষেধাজ্ঞার সুপারিশে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ভারতের

 

স্নাতক উপাধি অর্জনের পরপরই ফজলুর রহমান খান আহসানউলাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে অধ্যাপকের পদে নিযুক্তি লাভ করেন। ১৯৫৫ খ্রিষ্টাব্দে তিনি শিকাগো শহরের স্কিডমোর, ওউইং ও মেরিল নামের প্রকৌশল প্রতিষ্ঠানে প্রকল্প প্রকৌশলী হিসেবে যোগদান দেন।

ডক্টরেট উপাধি অর্জনের পর ১৯৫৬ খ্রিষ্টাব্দে দেশে ফিরে আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে পূর্ব পদে যোগদান করেন। 

পরবর্তীতে আমেরিকার স্থাপত্য প্রতিষ্ঠান স্কিড মোর-এর আমন্ত্রণে যুক্তরাষ্ট্র গিয়ে এ কম্পানির শিকাগো অফিসের পরিচালক হিসেবে যোগদান করেন। পাশাপাশি তিনি আমেরিকার ইন্টারন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজি-এর স্থাপত্য বিভাগে অধ্যাপক পদে অধিষ্ঠিত হন। সেখানে পরে তিনি প্রফেসর এমিরিটাস হয়েছিলেন।

তিনি ১৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দে যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল একাডেমি অব ইঞ্জিনিয়ারিং এর সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দে আমেরিকার ‘নিউজ উইক’ ম্যাগাজিন শিল্প ও স্থাপত্যের ওপর প্রচ্ছদ কাহিনিতে তাকে মার্কিন স্থাপত্যের শীর্ষে অবস্থানকারী ব্যক্তি হিসেবে বর্ণনা করে। স্থপতি ড. এফ.আর.খান আন্তর্জাতিক গগনচুম্বী ও নগরায়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন। 

তার অন্যান্য অবদানের মধ্যে রয়েছে শিকাগোর জন হ্যানকক সেন্টার, বাদশাহ আব্দুলআজিজ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের হজ্ব টার্মিনাল এবং বাদশাহ আব্দুল আজিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য মডেল অঙ্কন।

এফ.আর.খান মুসলিম স্থাপত্য বিষয়ের ওপর নানা ধরনের গবেষণা করেছেন। তিনি Tube in Tube নামে স্থাপত্য শিল্পের এক নতুন পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছিলেন যার মাধ্যমে অতি উচ্চ (কমপক্ষে একশত তলা) ভবন স্বল্প খরচে নির্মাণ সম্ভব। গগনচুম্বী ভবনের ওপর সাত খণ্ডে প্রকাশিত একটি পুস্তকের তিনি সম্পাদনা করেন।

তিনি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে প্রবাসে গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা পালন করেন। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে তার অবদান স্মরণীয় হয়ে আছে। মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে আমেরিকা প্রবাসী বাংলাদেশিদের আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন তিনি। তার নেতৃত্বে প্রবাসীদের নিয়ে গঠিত হয় দুটি সংগঠন: ‘বাংলাদেশ ইমার্জেন্সি ওয়েলফেয়ার আপিল’, যার উদ্দেশ্য ছিল মুক্তিবাহিনীর সমর্থনে প্রচার-প্রচারণা এবং রিলিফ সংগ্রহ এবং ‘বাংলাদেশ ডিফেন্স লীগ’, এই সংগঠনটি কূটনৈতিকভাবে মুক্তিযুদ্ধকে বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরেছিল। মূলত এই সংগঠনের তৎপরতায় যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানে সৈন্য পাঠাতে অপারগতা প্রকাশ করে।

বিশ্ব বিখ্যাত এই স্থপতি ১৯৮২ খ্রিষ্টাব্দের ২৭ মার্চ জেদ্দায় মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর পর তার দেহ আমেরিকায় নিয়ে যাওয়া হয় এবং তাকে শিকাগোতে সমাহিত করা হয়।

মন্তব্য

সর্বশেষ সংবাদ