<p style="text-align:justify">আমি বিথী। আমার বাবা ছিলেন একজন এতিম মানুষ। অন্যের বাড়িতে থেকে কিছুটা পড়াশোনা করেছে। এরপর আর তার ভাগ্য এগোয় নি, হয়তো দাসত্ব কপালে ছিলো। কিন্তু তার খুব শখ আমাদের পড়াশোনা করানোর। আমি এবং আমার ভাই, আমাদের  দুজনকেই এলাকার সব থেকে সেরা স্কুলটাতে ভর্তি করান তিনি। কথায় আছে না! শখের তোলা আশি টাকা। </p> <p style="text-align:justify">খুব মনে আছে, বাবা শীতের সকালে পিঠে করে নালা পার করে, সাইকেলে করে স্কুলে রেখে আসতেন আমাদের। ট্রাকের আধা পচা ফল আনতেন রাতে। আর সেই রাতেই ডেকে খাওয়াতেন আর বলতেন ‘সিজোনাল ফল, খেয়ে নে!’ আমরাও খুশি হতাম। একটা বড়সড় ড্রেস কিনে দিয়ে বলতেন আগামী বছর পর্যন্ত চালিয়ে নিস। আমরাও সত্যিই তাই করতাম। তখন ছোট ছিলাম অভাব কী বুঝতাম না। বাবা মায়ের কাছে শখের যা চাইতাম, তাই দিতো। কিন্তু খেয়াল করি নাই কীভাবে দিতো।  এখন বুঝি। ২০২৪ সালে এসেও মাকে দেখি একই জামা শুকিয়ে ওই জামাটাই পরছেন। বাবাকে দেখি শার্ট ছিঁড়ে গেলেও স্ট্যাপ্লার মেরে পরছেন। তাদের দেখলে আমার হতাশ লাগে। পরিশ্রম আর বয়সের ভারে নুয়ে পড়েছে কিন্তু তারা লেগে আছে আমাদের জন্য, যেন আমরা দেশ ও দশের সেবা করতে পারি। আমি শুধু দেখি আর আফসোস করি আমার কিছু করার থাকে না। হতাশ লাগে আর হাসি। ভাগ্যিস হাসতে পারতাম, নয়তো এত দুঃখ কিভাবে লুকাতাম!</p> <p style="text-align:justify">বাবা-মায়ের কষ্ট সহ্য করতে না পেরে নিজের খরচ নিজে চালানোর চেষ্টা শুরু করি। টিউশন শুরু করি দুইটা। টিউশনের বাসায় রোজ রোজ একই জামা পরে যেতাম। এজন্য আমার  স্টুডেন্ট বলতো একই ড্রেস প্রতিদিন ব্যবহার করি কেনো? বডি সেমিং করতো, ফলে টিউশনির প্রতি একটা বিতৃষ্ণা চলে আসে। এরপর নীলক্ষেতে ব্যবহারিক খাতা লেখা শুরু করি। মাঝেমাঝে অন্যজনের টিউশনিতে প্রক্সি দিতাম অথবা ইভেন্টে কাজ করতাম। ইভেন্টেও আমাকে বডি সেমিং আর ড্রেস নিয়ে ফেস করতে হয় অনেক কথা। এরপরও সব কিছু উপেক্ষা করে যখন যা কাজ পেতাম নিজের খরচ চালানোর পাশাপাশি ছোট ভাইয়ের খরচ চালাতাম। জীবনে যে সব জিনিসের আমি পূর্ণতা পাইনি, চেষ্টা করতাম ওরটা পূরণ হোক। কখনো এমন হতো ছাতু খেতাম বাড়ি থেকে টাকা যেন না নেয়া লাগে, ওই টাকাটা যেন ছোট ভাইকে দিতে পারি। আমি কোন অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতাম না কারণ আমার তো ছেঁড়া আর চামড়া উঠা জুতা, রং জ্বলে যাওয়া জামা, হাড্ডিসার চেহারা।  হয়তো আমার পোশাক পরিচ্ছদের কোন এক কোনায় ছেড়া দেখেই মানুষ বিরূপ মন্তব্য করবে। আমার থার্ড ইয়ার প্রায় শেষ। আমি পরিবারের বড় তাও আবার মেয়ে। পরিবার, পড়াশোনা, অভাব, বাস্তবতা প্রত্যেকটা শব্দের সাথে রোজ রোজ যুদ্ধ করা লাগতো। আমি চাইতাম নিজেকে গুছিয়ে চাকরির পড়াশোনা শুরু করতে।</p> <p style="text-align:justify">এরপর দেবদূত হিসেবে ‘বসুন্ধরা শুভসংঘ’ আমার জীবনে এলো। আমার এবং আমার ভাইয়ের দুজনের পড়াশোনার খরচ বসুন্ধরা শুভসংঘ বহন করার আশ্বাস দিলো। আমরা কখনোই বাড়ি যেতাম না ঈদ ছাড়া। বাড়ি যেতে যে খরচটা হতো তা দিয়ে  দুজনের এক মাস ভালো মত চলা যেতো। তারপর বসুন্ধরা শুভসংঘের প্রধান নন্দিত কথাসাহিত্যিক  জনাব ইমদাদুল হক মিলন স্যার আমাকে পোশাক কিনে দিয়ে আমাকে বাড়ি যাওয়ার সকল বন্দোবস্ত করে দিলেন। ঈদ ছাড়াও আমি বাড়িতে যেতে পারছি ভেবেই আনন্দে চোখ ভিজে উঠলো। মনে হচ্ছে, মায়ের জন্য বড়বড় চিংড়ি নিয়ে যাই, সবসময় নিয়ে যেতে বলে। আবার মনে হচ্ছে, ছোট ভাই এর ফর্মফিলাপের টাকাটা দেই। ধুর নাহ! বাড়িতে যাই ভাইবোনের চার জোড়া চোখ দিয়ে পুরো দুনিয়া দেখে আসি। এখন আমি দুনিয়া দেখতে যাচ্ছি।</p> <p style="text-align:justify">‘বসুন্ধরা শুভসংঘ’ আমাকে অনেক অনেক কিছু শিখিয়েছে। সন্তানের মতো লালনপালন করার দায়িত্ব নিয়ে আমাদের পড়াশোনা সহজ করেছে। আমাকে একটা নতুন পরিবার দিয়েছে তারা। বসুন্ধরা শুভসংঘের কাছে আজীবন কৃতজ্ঞ থাকবো আমি।</p> <p style="text-align:justify"> </p> <p style="text-align:justify">বিপাশা আক্তার বিথী<br /> শিশু বিকাশ ও সামাজিক সম্পর্ক বিভাগ, <br /> গভমেন্ট কলেজ অফ অ্যাপ্লাইড হিউম্যান সাইন্স।</p>