<p style="text-align:left"><span style="font-size:10pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">দরিদ্র কৃষক শাহ আলম। চোখে মুখে রাজ্যের হতাশা। ধান কাটার কাঁচি হাতে উসখুস করছেন! ধান কাটবেন কি কাটবেন না, ভেবে পাচ্ছেন না। কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করতেই বললেন, </span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">‘</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">ধান কিতা কাটতাম কন, এইবার তো সব মাইর। ধান অইছে না। হুদা খাটনি দিয়া কাইট্টা নিয়া কিতা লাব অইব বুঝি না। গরুর খেড় অইব কিছু। আর কোনো লাব নাই।</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">’</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"> কুমিল্লা জেলার বুড়িচং উপজেলার ইছাপুরা গ্রামের সাত সদস্যের পরিবারের সহজ-সরল কৃষক শাহ আলমের যত উদ্বেগ-দুশ্চিন্তা সামনের দিনে পরিবারের ভরণ-পোষণ নিয়ে। গত আগস্টের বন্যার পর ৩০ শতক জমিতে ধান লাগিয়েছিলেন। ধানগাছ ঠিকই হয়েছে, তবে ফলন না হওয়ায় বড় লোকসানে আছেন।</span></span></span></span></span></p> <p style="text-align:left"><span style="font-size:10pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">পাশেই কথা হয় আরেক কিষানির সঙ্গে। তিনি কেটে আনা ধান মেশিনে ছড়াচ্ছেন। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত ফলন না হওয়ায় হতাশ। গোছায় তো ধান নেই, তাহলে ছড়াচ্ছেন কেন? জানালেন, ধান তেমন পাওয়া যাচ্ছে না ঠিক। তবে যেটুকু আছে, সেটুকুই সংগ্রহের চেষ্টা করছেন। তা ছাড়া খড়গুলো গরুর খাবার ও জ্বালানির কাজে লাগবে। </span></span></span></span></span></p> <p style="text-align:left"><span style="font-size:10pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">গত বৃহস্পতিবার শাহ আলম ছাড়াও হুমায়ুন মিয়া, মোহাম্মদ মোস্তফা, আশিক হোসেনসহ স্থানীয় আরো বেশ কয়েকজন কৃষককের সঙ্গে কালের কণ্ঠের প্রতিবেদকের কথা হয়। বন্যা-পরবর্তী ধানের ফলন নিয়ে তাঁরা প্রায় সবাই হতাশ। ফলন ভালো না হওয়ায় এবার তাঁদের ঘরে নবান্নের পিঠা-পুলির আয়োজনও নেই। সামনে বোরো মৌসুমের ফলন ওঠার আগ পর্যন্ত পরিবারের খাবারের চালের সংস্থান নিয়ে শঙ্কিত তাঁরা।</span></span></span></span></span></p> <p style="text-align:left"><span style="font-size:10pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">জানা যায়, গত বছরের আগস্ট মাসে আকস্মিক অতিবৃষ্টি এবং ভারতের পাহাড়ি ঢলের প্রভাবে কুমিল্লা, ফেনী, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর জেলায় বড় ধরনের বন্যা হয়। ফেনী, নোয়াখালীর লক্ষ্মীপুরেও ধানের কাঙ্ক্ষিত ফলন হয়নি। স্থানীয় প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন, ত্রুটিযুক্ত বীজের কারণে ওই সব জেলার কোনো কোনো উপজেলায় কাঙ্ক্ষিত ফলন হয়নি। কোথাও কোথাও বীজের মধ্যে ভুসির মিশ্রণ ছিল বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। কিছু জায়গায় মোটামুটি হলেও সন্তোষজনক নয়। সব মিলিয়ে কৃষকরা ফলন নিয়ে হতাশ বলে কালের কণ্ঠের স্থানীয় প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন।</span></span></span></span></span></p> <p style="text-align:left"><span style="font-size:10pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">তবে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত জেলা হিসেবে ফলনের দিক থেকে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন কুমিল্লার গোমতী নদীকেন্দ্রিক অঞ্চলের কৃষকরা। বিশেষ করে গোমতী নদীর বাঁধ ভেঙে যাওয়ায় বুড়িচং ও ব্রাহ্মপাড়া উপজেলার প্রায় সব কটি গ্রামই বড় ধরনের বন্যার কবলে পড়ে। বন্যার আগে আগে বেশির ভাগ কৃষকই জমিতে আমনের আবাদ করেছিলেন। আকস্মিক বন্যা আসায় আমনের ক্ষেত ও বীজতলা তলিয়ে যায়। কৃষকরা জানান, বন্যার পরে পানি নেমে গেলে, সরকারি উদ্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের কাউকে কাউকে ফ্রিতে ধানের বীজ দেওয়া হয়। তবে বেশির ভাগ কৃষক সরকারের কৃষি অফিস থেকে বীজ কিনে জমিতে রোপণ করেন। সবারই আশা ছিল, বন্যার যে ক্ষতি তাঁরা এই ফলনের পর কিছুটা হলেও পুষিয়ে নিতে পারবেন। কিন্তু সম্প্রতি ফলন তোলার সময় দেখা যায়, বেশির ভাগ জমিতেই কাঙ্ক্ষিত ফলন হয়নি। মাঠের পর মাঠে ধান কাটা হচ্ছে ঠিকই; তাতে ফলনের মাত্রা নগণ্য। কৃষকরা জানান, সর্বোচ্চ ৫ থেকে ১০ শতাংশ ফলন হয়েছে। এতে তাঁরা বড় ধরনের লোকসানে পড়েছেন। একদিকে আর্থিক ক্ষতি, অন্যদিকে ফলন না হওয়ায় সামনে খাবারের চাল কিনে খেতে হবে তাঁদের।</span></span></span></span></span></p> <p style="text-align:left"><span style="font-size:10pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">এ ব্যাপারে কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. জাহাঙ্গীর আলম কালের কণ্ঠকে বলেন, </span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">‘</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">পরীক্ষিত বীজ না হলে এটা হতে পারে। এতে কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হন। বিদেশে বীজ থেকে কাঙ্ক্ষিত ফলন না হলে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার বিধান রয়েছে। বাংলাদেশেও আছে। তবে তা কার্যকর নয়। কুমিল্লায় ভুল বা ভেজাল বীজের কারণে কৃষক যদি ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকেন, তাহলে যেসব কম্পানির বীজ নেওয়া হয়েছে তাদের কাছ থেকে অথবা সরকার দিয়ে থাকলে সরকারের উচিত হবে কৃষককে ক্ষতিপূরণ দেওয়া।</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">’</span></span></span></span></span></p> <p style="text-align:left"><span style="font-size:10pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অফিস সূত্র জানায়, বন্যার সময় জেলায় আমন ধান আবাদ করা জমির পরিমাণ ছিল এক লাখ ৩৫ হাজার ২৩৮ হেক্টর। যার মধ্যে ৪৯ হাজার ৬০৮ হেক্টর জমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যার আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণ করা হয় ৭৫০ কোটি টাকা। এর মধ্যে চার লাখ ৩৫ হাজার ৬৯৪ জন কৃষক রয়েছেন। বন্যা-পরবর্তী সময়ে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের মাঝে প্রণোদনা হিসেবে ধানবীজ বিআর-৭৫, বিআর-২২ ধানের চারা এবং সার প্রদান করা হয়। সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থাও তাঁদের মাঝে ধানের চারা বিতরণ করেছে। </span></span></span></span></span></p> <p style="text-align:left"><span style="font-size:10pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">বন্যাকবলিত উপজেলাগুলো সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, প্রান্তিক কৃষকদের বেশির ভাগ জমিতে শুধু আগাছা জন্মেছে। কিছু জমিতে ধানগাছ দেখা গেলেও তাতে ধানের পরিমাণ সামান্য। </span></span></span></span></span></p> <p style="text-align:left"><span style="font-size:10pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বন্যা-পরবর্তী সরকারিভাবে কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে যে জাতের ধান বীজ দেওয়া হয় এটি সঠিকভাবে নির্বাচন করা হয়নি। আমন ধান দেরিতে লাগালে বিআর-২২ অর্থাৎ নাবি জাতের ধান লাগাতে হয়। কিন্তু সেখানে কৃষি বিভাগ বিতরণ করেছে বিআর-৭৫ জাতের ধান। এটি নাবি জাতের ধান নয়। এই জাতের ধান আগস্ট কিংবা আরো আগে লাগালে ভালো ফলন পাওয়া যায়। এ সময় বিতরণের দরকার ছিল বিআর-২২ জাতের ধানের বীজ। তাহলে কৃষকরা লাভবান হতেন। যার করণে বেশির ভাগ কৃষক বন্যা-পরবর্তী বিআর-৭৫ জাতের ধান আবাদ করে ফল থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। </span></span></span></span></span></p> <p style="text-align:left"><span style="font-size:10pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">বুড়িচং উপজেলার বুড়বুড়িয়া গ্রামের কৃষক মজিদ মিয়া বলেন, </span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">‘</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">বন্যার পরে ২০ শতক জমিতে ধানের আবাদ করেছি। লাভ তো দূরের কথা, জমি চাষের টাকাও ওঠেনি। ২০ শতকে মাত্র দেড় মণ ধান পেয়েছি। সামনের দিকে ছেলেমেয়ে নিয়ে কী খেয়ে বাঁচব জানি না।</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">’</span></span>  </span></span></span></p> <p style="text-align:left"><span style="font-size:10pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">একই উপজেলার শিবরামপুর গ্রামের বাসিন্দা মো. গোলাম কিবরিয়া বলেন, </span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">‘</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">কী বলব ভাই। আমাদের এলাকায় অনেক কৃষক এবার কাঁচি নিয়ে জমিতে যেতে পারবেন না। জমিতে শুধু ধানের গাছ আছে, ধান নেই। যাঁরা সরকারি বিআর-৭৫ ধান আবাদ করেছেন তাঁদের অবস্থা খারাপ।</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">’</span></span></span></span></span></p> <p style="text-align:left"><span style="font-size:10pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">পূর্বহুড়া গ্রামের জামাল উদ্দিন বলেন, </span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">‘</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">বন্যা-পরবর্তী ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে ৪০ শতক জমিতে ধান করেছি। সফল পেয়েছি মাত্র দুই মণ। কৃষি বিভাগ যদি সঠিকভাবে তদারকি করত কৃষকরা হয়তো কিছুটা হলেও লাভবান হতেন।</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">’</span></span>    </span></span></span></p> <p style="text-align:left"><span style="font-size:10pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম উপজেলার কনকাপৈত ইউনিয়নের মাসকরা গ্রামের কৃষক আব্দুর রশিদ বলেন, </span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">‘</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">পাঁচ হাজার টাকা খরচ করে অন্যের জমিতে বীজতলা তৈরি করি। কিন্তু বন্যার পানি নামতে দেরি করায় চারা রোপণে সময় লেগেছে। রোপণকৃত চারা থেকে কোনো ফলন পাইনি। গরুর খাওয়ানোর মতো খড়ও বাড়ি আনতে পারিনি।</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">’</span></span> </span></span></span></p> <p style="text-align:left"><span style="font-size:10pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">কৃষি সমপ্রসারণ অধিদপ্তর কুমিল্লার উপপরিচালক আইউব মাহমুদ কালের কণ্ঠকে বলেন, </span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">‘</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">বন্যা-পরবর্তী তালিকা করে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের মাঝে প্রণোদনা হিসেবে বিআর-৭৫, বিআর-২২ ও ২৩ ধানের বীজ, চারা ও সার বিতরণ করা হয়। এ সময় পর্যাপ্ত পরিমাণ নাবি জাতের ধান বীজ বিআর-২২ ও ২৩ না থাকায় অনেক কৃষককে বিআর-৭৫ দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে যাঁরা দ্রুত সময়ে রোপণ করতে পারেননি তাঁরা ভালো ফলন থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। আর যাঁরা কৃষি বিভাগের নির্দেশনা মেনে রোপণ করেছেন তাঁরা ভালো ফলন পেয়েছেন।</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">’</span></span></span></span></span></p> <p style="text-align:left"> </p> <p style="text-align:left"><span style="font-size:10pt"><span style="font-family:Kantho"><span style="color:black"><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">[প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন কুমিল্লা প্রতিনিধি জাহিদ পাটোয়ারী]</span></span></span></span></span></p>