‘পুরনো সংবিধান ও শাসনকাঠামো রেখে একটি নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণ সম্ভব নয়। কেবল সরকার পরিবর্তন করেই জনগণের কল্যাণ ও প্রকৃত গণতন্ত্র বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। এ জন্য আমরা বলছি, চব্বিশে যে গণ-অভ্যুত্থান হয়েছে, ছাত্র-জনতা রক্ত দিয়েছে, তাতে কেবল সরকার পরিবর্তন নয়, বরং শাসনকাঠামো ও সাংবিধানিক পরিবর্তন করে নতুন একটি বাংলাদেশের যাত্রা শুরু করতে চাই, যেখানে প্রকৃত গণতন্ত্র, ইনসাফ ও সাম্য নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।’ গতকাল মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ৮টার দিকে সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এসব কথা বলেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম।
রাজনৈতিক দল হিসেবে প্রতিষ্ঠার পর প্রথম কর্মসূচির অংশ হিসেবে তাঁরা মহান মুক্তিযুদ্ধের বীর শহীদ ও জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান।
শ্রদ্ধা জানানো শেষে নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘১৯৪৭ থেকে ২০২৪-এর সব লড়াইয়ের আকাঙ্ক্ষাকে ধারণ করে আমরা নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণ করব এবং সেই লক্ষ্যে এনসিপি কাজ করে যাচ্ছে। আমরা বলেছি, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমরা একটি স্বাধীন রাষ্ট্র পেলেও আমাদের সার্বভৌমত্ব বারবার হুমকির মুখে পড়েছে। আমাদের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো বারবার ভেঙে পড়েছে।
আমরা একটি গণতান্ত্রিক সংবিধান গড়ে তুলতে পারিনি। একটি একদলীয় সংবিধানের মাধ্যমে ফ্যাসিজম এবং একদলীয় স্বৈরতন্ত্রের বীজ বপন করা হয়েছিল।’
তিনি বলেন, ‘আমরা বলেছি, একটি নতুন প্রজাতন্ত্র আমাদের করতে হবে। তার জন্য প্রয়োজন একটি নতুন সংবিধান ও গণপরিষদ।
সেই জায়গা থেকে আমরা সেকেন্ড রিপাবলিকের কথা বলেছি এবং আমরা সেই লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছি। জাতীয় নাগরিক পার্টির এ মুহূর্তে প্রথম লক্ষ্য হচ্ছে সাংগঠনিকভাবে কার্যক্রম বিস্তৃত করা। নিবন্ধন নিতে যে ধরনের শর্তাবলি পূরণ করা প্রয়োজন, সে শর্তাবলি আমরা দ্রুত সময়ের মধ্যে পূরণ করে নিবন্ধনের দিকে আগাব। এ মাসের মধ্যেই আমাদের গঠনতন্ত্র তৈরির কাজ শুরু করব।’
অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে গণ-অভ্যুত্থান এবং গত ১৫ বছরে হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের বিচারের আহ্বান জানিয়ে নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘গণ-অভ্যুত্থানে সংঘটিত গণহত্যার বিচার দ্রুত সময়ের মধ্যে কার্যকর দেখতে চাই।
বিচারিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক ফয়সালা এই বাংলার মাটিতে করতে হবে। গণ-অভ্যুত্থানে আমাদের প্রতিশ্রুতি ছিল যে যারা এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত এবং ১৫ বছর ধরে নানা ধরনের জুলুম করেছে তাদের বিচার এই বাংলার মাটিতে হতে হবে। এই বিচার বাংলাদেশের মানুষ দেখতে চায়। বিচারের পর সংস্কার কার্যক্রম করে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে দ্রুত জাতীয় সংলাপে গিয়ে আমাদের জুলাই সনদ ও জুলাই ঘোষণাপত্র বাস্তবায়ন আমরা দেখতে চাই।’
দেশবাসীর কাছে দোয়া প্রার্থনা করে দলটির সদস্যসচিব আখতার হোসেন বলেন, ‘১৯৭১ সালে লাখ লাখ শহীদের জীবনের বিনিময়ে যে স্বাধীনতা এসেছে, সে স্বাধীনতার মূলমন্ত্র ছিল সাম্য ও সামাজিক সুবিচারের বাংলাদেশ। গত ৫৪ বছরে তা অধরা থেকে গেছে। আমরা এনসিপির নেতাকর্মীরা অঙ্গীকারবদ্ধ, সেই বাংলাদেশ নির্মাণে কাজ করে যাব।’
তিনি আরো বলেন, ‘সারা বাংলাদেশে আমাদের অনেক প্রস্তাবের জায়গা রয়েছে। তার মধ্যে অন্যতম হলো, বাংলাদেশ পুরো বিশ্বে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে। ঢাকা শহরকে গ্লোবাল সাউথের প্রধান হিসেবে দেখা। এমন অনেক স্বপ্ন নিয়ে আমরা এগোচ্ছি। বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে আমরা বিশ্বাস করি, নতুন একটি সংবিধানের বাস্তবতা রয়েছে। এর ভিত্তিতে আমরা গণপরিষদ নির্বাচনের কথা বলেছি। একই সঙ্গে সে গণপরিষদ নির্বাচনে যাঁরা জয়ী হবেন, তাঁরা সংসদ সদস্য হিসেবে ভূমিকা পালন করবেন—এমন প্রস্তাবও আমাদের আছে। অল্প সময়ের মধ্যে সারা দেশে জেলা ও উপজেলায় জাতীয় নাগরিক পার্টি কার্যক্রম বিস্তৃত করবে।’
হাসিনার ফাঁসির আগে নির্বাচন নিয়ে কথা নয় : সারজিস আলম
ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনার বিচার না হওয়া পর্যন্ত নির্বাচন নিয়ে কথা না বলতে সবার প্রতি অনুরোধ জানিয়েছেন জাতীয় নাগরিক পার্টির উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম। গতকাল সকাল ১০টার দিকে রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে শহীদদের কবর জিয়ারতের পর তিনি এই মন্তব্য করেন।
এ সময় তিনি বলেন, ‘স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা ও আইন উপদেষ্টা যদি খুনি হাসিনার দৃশ্যমান বিচার এই অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে করে যেতে না পারেন তাহলে এই সরকারের সবচেয়ে বড় দায়বদ্ধতা এবং সবচেয়ে বড় লেজিটিমেসি তাঁরা হারাবেন এবং সারা জীবন এটা তাঁদেরই দায় বহন করে যেতে হবে। কিন্তু আমরা স্পষ্ট করে একটা কথা বলি, দায় বহন করে যাওয়ার মধ্যে সব শেষ নয়। এই বিচার এই অন্তর্বর্তী সরকারের সময় করতে হবে এবং যে সময়টুকু এই সরকারের আছে, নির্বাচনের আগেই খুনি হাসিনাকে বাংলাদেশে নিয়ে এসে ফাঁসির মঞ্চে নিতে হবে। যত দিন না আমরা খুনি হাসিনাকে ওই ফাঁসির মঞ্চে না দেখছি, এই বাংলাদেশে কেউ যেন ভুলক্রমেও নির্বাচনের কথা না বলে।’
এক শহীদের মায়ের পাশে দাঁড়িয়ে সারজিস বলেন, ‘আমাদের একজন শহীদ ভাইয়ের মায়ের এই আহাজারিকে সামনে রেখে আপনাদের শুধু একটা কথাই বলি, এই খুনি হাসিনা যখন শুধু ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য আমার এমন হাজার ভাইকে খুন করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেনি, আমার এমন অনেক ভাই রয়েছে, যাদের লাশ এখন পর্যন্ত খুনি হাসিনা হত্যার পরে কোথায় নিয়ে গেছে, এটা খুঁজে পাওয়া যায়নি।’
তিনি আরো বলেন, ‘আজ আমার মা তাঁর সন্তানের লাশের জন্য, শেষবার একবার দেখার জন্য, এখন সেই আহাজারি করছে; এই মাকে আমরা বায়তুল মোকাররমের সামনে সেদিন দেখেছি, প্রতিটি জায়গায় এই মা এভাবে আহাজারি করে ছুটে বেড়িয়েছেন; তো সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, আমরা হয়তো আমাদের জায়গায় সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে পারি, আমাদের ভাইয়ের লাশটা খোঁজার জন্য। কিন্তু এটা বলতে পারি না যে কখনো পাব কি পাব না। কিন্তু যেই ভাইয়ের লাশের জন্য আমার একজন মা এভাবে আহাজারি করেন, যেই খুনির নির্দেশে আমার এই ভাইগুলোকে হত্যা করা হলো, সেই খুনির বিচার না দেখা পর্যন্ত কিভাবে এই বাংলাদেশে আমরা অন্য কিছুর চিন্তা করি?’
আরেক মুখ্য সংগঠক (দক্ষিণাঞ্চল) হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, ‘সরকার ছাত্র-জনতার রক্তের ওপর এসেছে। তাদের মনে রাখতে হবে, বিচার নিশ্চিত করতে না পারলে পুরো প্রক্রিয়া প্রশ্নবিদ্ধ হবে। দ্রুততম সময়ে বিচার নিশ্চিত করতে হবে। প্রয়োজনে বিশেষভাবে ট্রাইব্যুনালের সংখ্যা বাড়িয়ে বিচার নিশ্চিত করতে হবে।’