জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান উচ্চশিক্ষার বিভিন্ন দিক চিন্তা করে চারটি বিশ্ববিদ্যালয়কে ১৯৭৩ সালের অধ্যাদেশ অনুযায়ী স্বায়ত্তশাসন দিয়েছেন এবং পরবর্তী সময়ে প্রতিষ্ঠিত বাকি সব বিশ্ববিদ্যালয় নিজ নিজ আইন দ্বারা স্বায়ত্তশাসিতভাবে পরিচালিত হয়। ইউজিসির ওয়েবসাইট অনুযায়ী বর্তমানে বাংলাদেশে ৪৫টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এবং ১০৩টি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় উচ্চশিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করছে। সাম্প্রতিককালে বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগ বাণিজ্য ও অনিয়ম, উপাচার্যের পদত্যাগের জন্য শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ, বুয়েটে আবরার হত্যার প্রতিবাদে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন, ক্যাম্পাসে ছাত্র-শিক্ষক লেজুড়বৃত্তিক অপরাজনীতি এবং ক্যাম্পাসে উপাচার্যের প্রশাসনিক ব্যর্থতা নিয়ে বিভিন্ন সংবাদপত্রের শিরোনামে খবর প্রকাশিত হয়েছে, যা নিয়ে সরকার বিব্রত এবং শিক্ষা সেক্টরের জন্য খুবই দুঃখজনক ও কালো অধ্যায় বলে মনে করেন শিক্ষাবিদরা। এ প্রসঙ্গে কয়েক সপ্তাহ আগে ইউজিসির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. কাজী এম শহীদুল্লাহ একটি সংবাদপত্রকে বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োগের ক্ষেত্রে কোনো ছাড় দেওয়া উচিত না।
আমলাতান্ত্রিক উপাচার্য ও প্রভাষক নিয়োগ প্রক্রিয়ার সংস্কার
- কামরুল হাসান মামুন, আবু জাফর আহমেদ মুকুল, মোহাম্মদ ফখরুল ইসলাম, মো. মনিরুল ইসলাম, সুব্রত ব্যানার্জী
অন্যান্য

সুতরাং পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উপাচার্যদের যোগ্যতা হওয়া উচিত সর্বোচ্চ শিক্ষা এবং বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় প্রশাসনিক দক্ষতা।
অনেকেই ভাবতে পারেন আমাদের দেশ তো উন্নয়নশীল, আমরা কেন উন্নত দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে নিজেদের তুলনা করতে যাব? বাংলাদেশ সরকারের পরিকল্পনা অনুযায়ী আগামী ২০৪১ সালে বাংলাদেশ উন্নত দেশ হিসেবে রূপান্তরিত হবে। তাই বর্তমান সরকারের মানসম্মত শিক্ষার ইশতেহার বাস্তবায়নের জন্য উন্নত দেশের শিক্ষাব্যবস্থার মডেলের সঙ্গে তুলনা বা চর্চার বিকল্প নেই। উন্নত বিশ্বে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উপাচার্য নিয়োগের ক্ষেত্রে নানা পদ্ধতি থাকে, সেখানে সরকার, মন্ত্রণালয় কিংবা আমলাদের কোনো হাত নেই। আমরা উপাচার্য নিয়োগ দিই আমলা আর গোয়েন্দা রিপোর্ট দেখে—এর চেয়ে হাস্যকর ব্যবস্থা পৃথিবীতে আর নেই বললেই চলে। সুতরাং উপাচার্যদের একক দোষ দিয়ে কোনো লাভ নেই; উপাচার্যরা অনেক ক্ষেত্রে পরিস্থিতির স্বীকার। দায়টি আমাদের আমলাতান্ত্রিক উপাচার্য নিয়োগ পদ্ধতির। তাই এখন সময় এসেছে উপাচার্য নিয়োগ পদ্ধতির সংস্কার করে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ন্যূনতম যোগ্যতা নির্ধারণ করা, যা বর্তমান সরকারের নীতিনির্ধারকরা চিন্তা করতে পারেন, যার মাধ্যমে উচ্চশিক্ষাব্যবস্থার গুণগত পরিবর্তন হবে।
স্বয়ং মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন দুর্নীতির বিষয়ে জিরো টলারেন্স হিসেবে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন এবং নিজ দল থেকে শুদ্ধি অভিযান পরিচালনা করেছেন, যা বাংলাদেশের জনগণ স্বাগত জানিয়েছে। একটি সংবাদপত্রের প্রকাশিত সংবাদের মাধ্যমে জানতে পেরেছি যে বিশ্ববিদ্যালয়ে সবচেয়ে বেশি অনিয়ম হয় নবনিযুক্ত প্রভাষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের নিয়োগ নিয়ে। এবার আসা যাক, বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক নিয়োগের দুর্নীতি কিভাবে কমানো যায়? প্রভাষক পদ দিয়ে একজন প্রার্থীর বিশ্ববিদ্যালয়জীবনে শিক্ষকতা শুরু হয়। আজকের একজন প্রভাষক সেহেতু ভবিষ্যতের অধ্যাপক, সুতরাং প্রভাষক নিয়োগপ্রক্রিয়ার মূল্যায়ন প্রক্রিয়ায় একজন যোগ্য প্রার্থী নির্বাচন করতে হলে বর্তমান প্রভাষক নিয়োগ বোর্ড সংস্কার করা জরুরি। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নিয়োগে এসএসসি বা এইচএসসির রেজাল্ট চাওয়ার মতো হাস্যকর, অপ্রয়োজনীয় এবং অবাস্তব শর্তও আমাদের দেশে জারি আছে। আবার বাংলাদেশ বাদে বিশ্বের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক নিয়োগ বোর্ডে উপাচার্য, উপ-উপাচার্য ও ট্রেজারার থাকেন না; এমনকি আমাদের প্রতিবেশী দেশগুলোতে এ চর্চা নেই। উপাচার্য, উপ-উপাচার্য, ট্রেজারার ও ডিন তো সিন্ডিকেট সদস্য, তাই তাঁদের নিয়োগ বোর্ডে থাকা সংগত কারণে যৌক্তিক নয়। প্রশ্ন করতে পারেন, তাহলে নিয়োগ বোর্ডে কারা থাকবেন? আমরা উন্নত বিশ্বের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিশ্লেষণ করে দেখতে পাই, পাঁচ বা ছয় সদস্যবিশিষ্ট প্রভাষক নিয়োগ বোর্ড উপাচার্য কর্তৃক অনুমোদিত হয়, যেখানে থাকেন বিভাগীয় প্ল্যানিং কমিটির সভাপতি ও বিভাগের সর্বনিম্ন তিনজন সিনিয়র শিক্ষক, সংশ্লিষ্ট বিষয়ের দুজন এক্সপার্ট, তাঁর মধ্যে একজন দেশবরেণ্য সংশ্লিষ্ট বিষয়ের বিশেষজ্ঞ এবং আর অন্যজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিমান সংশ্লিষ্ট বিষয়ের বিশেষজ্ঞ, যা আচার্য কর্তৃক অনুমোদনকৃত। নিয়োগ বোর্ডের প্রত্যেক সদস্য শুধু মৌখিক পরীক্ষা গ্রহণ করে নিয়োগপ্রার্থী সম্পর্কে মূল্যায়ন ও মতামত প্রকাশ করে বিভাগীয় প্ল্যানিং কমিটির সভাপতির কাছে জমা দেবেন। নিয়োগ বোর্ডের সভাপতি চাকরিপ্রার্থীদের মূল্যায়ন একীভূত করে সব সদস্যের স্বাক্ষর করিয়ে অত্যন্ত গোপনীয়ভাবে সিন্ডিকেট বা বোর্ড অব ট্রাস্টিজ সভাপতির কাছে প্রেরণ করবেন, যা সভার মাধ্যমে চূড়ান্তভাবে প্রার্থীরা নিয়োগপ্রাপ্ত হবেন। এভাবে প্রভাষক নিয়োগে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ করলে বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থিতিশীলতা আসবে এবং শিক্ষক নিয়োগে ক্ষমতার অপব্যবহার, স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতি ও নিয়োগ বাণিজ্য কমে আসবে। আমরা আশা করছি, প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা, শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি এবং শিক্ষা উপমন্ত্রী ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী বিশ্ববিদ্যালয়ের বিষয়ে খুব আন্তরিক হয়ে উপাচার্যের নিয়োগ প্রক্রিয়ার সংস্কার ও প্রভাষক নিয়োগ বোর্ড সংস্কারের নির্দেশনা দিয়ে উচ্চশিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করবেন।
লেখকবৃন্দ : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়, মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক
সম্পর্কিত খবর