ঢাকা, শনিবার ২৯ মার্চ ২০২৫
১৫ চৈত্র ১৪৩১, ২৮ রমজান ১৪৪৬

ঢাকা, শনিবার ২৯ মার্চ ২০২৫
১৫ চৈত্র ১৪৩১, ২৮ রমজান ১৪৪৬
বিদ্রোহী সিপাহির জবানবন্দি

বিদ্রোহের শুরু ও ডিজির স্ত্রীকে হত্যার বাস্তব কাহিনী

ওমর ফারুক
ওমর ফারুক
শেয়ার
বিদ্রোহের শুরু ও ডিজির স্ত্রীকে হত্যার বাস্তব কাহিনী

সিপাহি ইব্রাহিম পিলখানা হত্যা মামলার ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি। বিডিআর বিদ্রোহের পর গ্রেপ্তার হন তিনি। এরপর তিনি বিডিআরের তৎকালীন মহাপরিচালক মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদের স্ত্রীকে হত্যার দায় স্বীকার করেন। আদালতেও স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন।

তাঁর জবানবন্দিতে ওই দিনের নির্মমতা ও বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনার বাস্তব দৃশ্য ফুটে ওঠে। জবানবন্দির অংশবিশেষ হুবহু তুলে ধরছেন আমাদের প্রতিবেদক ওমর ফারুক

সিপাহি মো. ইব্রাহিম ২০০৯ সালের ১২ মে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন।

ইব্রাহিম জবানবন্দিতে বলেন, 'আমি ২০০৪ সালের আগস্টে বিডিআরে ভর্তি হই। প্রশিক্ষণের পর আমি ২০০৫ সালের জানুয়ারি মাসে পিলখানার ৪৪ ব্যাটালিয়নে যোগ দিই।

আমি ব্যাটালিয়নের ব্যারাকে থাকতাম। ২০০৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি তারিখে প্রধানমন্ত্রীর প্যারেডে আমি দর্শক হিসেবে উপস্থিত ছিলাম। তারপর সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত দরবার হলের স্টেজ সাজানোর কাজ করি। কাজ শেষে আমি রাতে সৈনিক লাইনে থাকি।
পরের দিন ২৫ ফেব্রুয়ারি দরবার হলে ছবি তোলার দায়িত্ব আমার ছিল। তাই ওই দিন সকাল ৮টার সময় আমি ৪৪ ব্যাটালিয়নের অফিসে যাই এবং সেখান থেকে সরকারি ক্যামেরা নিয়ে দরবার হলে যাই।'

জবানবন্দিতে আরো বলা হয়, "ডিজি স্যার ৯টায় দরবারে আসেন। ডিজি স্যার ১৫-১৬ মিনিট বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বক্তৃতা করার পর যখন ডালভাত অপারেশন নিয়ে কথা বলতে শুরু করেন তখন স্টেজের বাম পাশ্র্বে রান্নাঘরের পাশ দিয়া ১৩ রাইফেল ব্যাটালিয়নের সিপাহি মঈন এসএমজি নিয়ে দৌড়ে স্টেজে উঠে ডিজি স্যারের দিকে অস্ত্র তাক করে। সাথে সাথে ৪৪ রাইফেল ব্যাটালিয়নের সিপাহি কাজল রাইফেল নিয়ে একই দিক দিয়া স্টেজে ওঠে।

সিপাহি কাজল ডান হাত উঁচু করে 'বিডিআর সবাই এক হও' বলে স্লোগান দেয়। সিপাহি মঈন তখন কাঁপতে কাঁপতে অস্ত্র নিয়ে মাটিতে পড়ে যায়। এর কিছুক্ষণ পর দুই-তিনজন বিডিআর রাইফেল হাতে একই দিক দিয়া স্টেজে উঠে আসে। তখন আমি স্টেজের এক কোনায় পিলারের সাথে দাঁড়ানো। কর্নেল মজিবুল হক ও কর্নেল আনিসুর রহমান ডিজি স্যারকে রক্ষা করার জন্য স্টেজে উঠে আসেন। তখন একজন বিডিআর জওয়ান রাইফেলের বাট দিয়া কর্নেল আনিসুরকে মারলে তিনি স্টেজে পড়ে যান। এ রকম অবস্থায় দরবার হলে থাকা সকল আর্মি অফিসার, ফোর্স জেসিও দাঁড়িয়ে যান। হঠাৎ স্টেজের ওপর তিন-চার রাউন্ড গুলি হয়- ফাকা গুলি। দরবারের সব বিডিআর- যারা নিচে বসা ছিল, যারা পেছনে চেয়ারে ছিল- সবাই দৌড়ে পালাতে থাকে। ডিজি স্যার তখন সকল সিএসএমকে নিজ নিজ ফোর্সকে সামলানোর নির্দেশ দেন এবং পৃথক পৃথক দরবার নিয়া দাবি-দাওয়া শোনার নির্দেশ দেন। গুলির শব্দে অনেক অফিসার দরবারের স্টেজের পেছনের পর্দার আড়ালে লুকান আবার অনেক অফিসার দরবার হল থেকে পালিয়ে যান। তারপর ৪৪ রাইফেল ব্যাটালিয়নের সিপাহি সেলিম স্টেজের বাম পাশ দিয়া স্টেজে উঠে আসে। সে হ্যান্ডমাইক দিয়া পর্দার আড়ালে থাকা, লুকিয়ে থাকা অফিসারদের বের হতে বলে। সে ইংরেজিতে বলে, 'অল অফিসার্স ওয়ান লাইনে ফালন।' সে ইংরেজিতে আরো কিছু বলে। আমি সব বুঝি নাই। জানালা দিয়া দরবার হলের বাহিরে কেনো গেঞ্জি এবং অস্ত্র হাতে অনেক বিডিআর জওয়ানকে দেখি। সিপাহি সেলিমের এনাউন্সে প্রথমে তিনজন মহিলা অফিসার ও চার-পাঁচজন পুরুষ অফিসার বের হন। তারপর আস্তে আস্তে ডিজি, ডিডিজি, সেক্টর কমান্ডারগণসহ আনুমানিক ১৫-১৬ জন অফিসার বের হন। সিপাহি সেলিম সব অফিসারকে বলে 'গো ওয়ান বাই ওয়ান'। দরবারের ভেতরে তখন ২০-২২ জন অস্ত্রধারী বিডিআর এবং অস্ত্র ছাড়া আরো কয়েকজন বিডিআর সব অফিসারকে লাইন ধরে পশ্চিম দিকের গেটের দিকে নিয়া যায়। বাহিরে তখন প্রচুর গোলাগুলি হচ্ছিল। আমি তখন স্টেজের সামনে ছিলাম। অস্ত্রের মুখে অফিসারদের লাইনের প্রথমে ডিজি, তারপর সেন্ট্রাল এসএমসহ অন্য অফিসাররা ছিলেন। অফিসারদের লাইন যখন বের হচ্ছিল, দরজার কাছে আসতেই ব্রাশ ফায়ার হয়। সাথে সাথে ডিজি স্যার, সেন্ট্রাল এসএম পড়ে যান। এরপর আবার অনেক গুলি হয়- ব্রাশ ফায়ার হয়। তখন পাঁচ-ছয়জন অফিসার পড়ে যান। তারপর সিপাহি সেলিম আমাকে একটা রাইফেল দিয়ে গুলি করতে বলে। আমি তখন দক্ষিণ গেটের কাছে। দরবারের ভেতরের দক্ষিণ দিকের গেট। তারপর আমি রাইফেল দিয়া একজন অফিসারকে গুলি করি। তিনি পড়ে যান। আমি এই অফিসারের নাম জানি না। তারপর অস্ত্র সেখানে ফেলে ৪৪ রাইফেল ব্যাটালিয়নের অফিসে চলে যাই। সেখানে প্রায় ১১টা পর্যন্ত থাকি। বাহিরে গাড়ি দিয়া মাইকিং করে সবাই অস্ত্র নিতে বলে। কোনো বিডিআর অস্ত্র ছাড়া থাকলে তাকে গুলি করে মারা হবে। আমি তখন অফিস হতে বের হয়ে সেন্ট্রাল কোয়ার্টার গার্ডে যাই অস্ত্র আনার জন্য। আমি একটা রাইফেল এবং ২০ রাউন্ড গুলি নিই। অস্ত্র নিয়ে আমি হাঁটতে হাঁটতে সদর ব্যাটালিয়নের অফিসের সামনে আসলে ১৫-২০ জন সশস্ত্র বিডিআরকে দেখি। এর মাঝে আমি ৪৪ ব্যাটালিয়নের সিপাহি সেলিম, সিপাহি আলতাফ, সিপাহি হাবিব, সিপাহি ওবায়দুরকে চিনতে পারি। প্রায় সাড়ে ১১টার দিকে আমি, সিপাহি সেলিম, সিপাহি হাবিব, সিপাহি আলতাফ, সিপাহি ওবায়দুর, সিপাহি শাহীনসহ ১৫-২০ জন বিডিআর ডিজি স্যারের বাংলোতে যাই। বাংলোর গেটের সামনে ভবন গার্ড হাবিলদার বাবুল বাধা দিলে সিপাহি সেলিম পায়ে গুলি করে বাবুলকে ফেলে দেয়। বাংলোতে গুলি। ফাঁকা ফায়ার করতে থাকি। আমি দুই রাউন্ড ফাঁকা গুলি করি। ডিজি ম্যাডাম (নাজনীন শাকিল শিপু) দোতলা হতে নেমে আসেন। পরনে ম্যাক্সি ছিল। ম্যাডামকে সিঁড়িতে হাবিব, আলতাফ, সেলিম আর দুই-তিনজন ধরে ফেলে এবং মুখ বেঁধে ফেলে। আমি আর ওবায়দুর পাশে দাঁড়াইয়া ছিলাম। তারপর ম্যাডামকে কুক হাউসে নিয়ে সিপাহি হাবিব, সিপাহি সেলিম, সিপাহি ওবায়দুর, আমিসহ তিন-চারজন মিলে লাঞ্ছিত করি। এরপর দুজন সিপাহি দোতলায় উঠে গিয়ে ফাঁকা ফায়ার করে এবং জিনিসপত্র তছনছ করে। এরপর আরো দুই-তিনজনসহ আমি দোতলায় যাই। গিয়ে দেখি তিনজন বিডিআর ১৫-২০ বছরের একটি মেয়েকে শারীরিকভাবে নির্যাতন করছে। মেয়েটির কান্নাকাটির জন্য আমি দুই রাউন্ড গুলি করি। মেয়েটি মারা যায়। হঠাৎ নিচে গুলির শব্দ পাই। নিচে নেমে দেখি ম্যাডামকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। সিপাহি সেলিমসহ আরো দুই-তিনজন গুলি করে।"

 

 

মন্তব্য

সম্পর্কিত খবর

সর্বশেষ সংবাদ