<p>প্রেম ও শান্তির রাজা যিশুখ্রিস্ট যেখানে জন্মেছিলেন, সে দেশের মাটি আজও নিরীহ নর-নারী, মাসুম শিশুর রক্তে রঞ্জিত। ওই জনপদের অপর নাম বলা যায় ‘নরক’। অস্ত্রের ঝনঝনানির ত্রাস, গোলাবারুদের গন্ধে গাজার আকাশ-বাতাস দূষিত, নিঃস্ব অসহায় ও দুর্গত মানবাত্মার সীমাহীন আর্তনাদ বিশ্বের সাধারণ মানুষের হৃদয় ক্ষতবিক্ষত করলেও ক্ষমতামদমত্ত অনেক মানুষের যেন তাতে কিছু আসে যায় না। মানুষের জীবনের চেয়ে তাদের কাছে অস্ত্রের মূল্য অনেক বেশি। এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপ—এই তিন মহাদেশের সঙ্গমস্থল কনান দেশ বা পরবর্তী সময়ে রোমানদের দেওয়া প্যালেস্টাইন নামের দেশটিতে শান্তিপূর্ণ অবস্থা খুব কমই ছিল। একদিকে আরবের মরুভূমি এবং অপরদিকে ভূমধ্যসাগরের মাঝপথে অবস্থিত অঞ্চলটি ভূ-রাজনৈতিক ইতিহাসে মহাদেশগুলোর সব পরাশক্তির কাছে সব সময়ই ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যিশুর জন্মের পর শিশু যিশুর মৃত্যু নিশ্চিত করার জন্য রাজা হেরোদ কয়েক শ শিশুকে হত্যা করিয়েছিলেন, যাদের মধ্যে সাতজনই ছিল তাঁর আপন আত্মীয়-পরিজনের সন্তান। একদিকে হিংসার রক্ত আর অপরদিকে দুর্গত মানুষের অশ্রুভেজা মাটিতেই অনেক মানুষ পালন করছে পরিত্রাতার জন্মদিন!<br /> <img alt="শান্তি ও সম্প্রীতির অন্বেষা" height="300" src="https://cdn.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/1.Print/2023/12.December/25-12-2023/1_kaler-kantho-12-2023.jpg" style="float:left" width="500" />মানুষের আত্মিক দীনতার কুফল জীবনের সব কিছুতেই পরিব্যাপ্ত। এর সর্বোত্তম সমাধান আধ্যাত্মিক ও নৈতিক। আত্মিক শক্তির ওপরে নির্ভর করে মানুষ তার সব যুক্তি, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সৃজনশীলতাকে ব্যবহার করে তার সমস্যার সমাধান করতে পারে। বাস্তব জীবনে নৈতিকতা, ন্যায্যতা ও মানুষসহ সব সৃষ্টিকে সম্মান করার মধ্যেই আত্মিকতা। তার ফল হবে মনুষ্যত্বের বিকাশে সহায়ক মানবকল্যাণমুখী জীবন ও সাধনা। সব ধর্মকর্মের সারমর্মরূপে খ্রিস্ট দেখেছেন মানুষের সব শক্তি ও অন্তর দিয়ে ঈশ্বরকে সম্মান করাকে এবং অন্য মানুষকে আত্মতুল্য প্রেম করাকে। এই কঠিন চ্যালেঞ্জ জীবনে কাউকে গ্রহণ করতে হলে তাকে আত্মিক শক্তির প্রভাবে চলতে হবে। সবাই যদি সব সংকীর্ণতা ও গোঁড়ামি পরিহার করে একই ভাবনায় চলতে পারে, তাহলে এই পৃথিবীতে বড় একটা ইতিবাচক পরিবর্তন হবে। মানুষের বড় পরিচয় তার কোনো ধর্মবিশ্বাসের পরিচয়ে নয়, মনুষ্যত্বে।<br /> পাপের পঙ্কিলতার অন্ধকারে নিপতিত মানুষের জন্য আশা ও আলোর জীবনের পথরূপে স্রষ্টা সৃষ্টিতে এলেন। খ্রিস্ট বলেছেন, ‘যাহারা আমাকে হে প্রভু, হে প্রভু বলে, তাহারা সবাই যে স্বর্গ-রাজ্যে প্রবেশ করিতে পাইবে, এমন নয়, কিন্তু যে ব্যক্তি আমার স্বর্গস্থ পিতার ইচ্ছা পালন করে, সেই পাইবে’ (মথি ৭:২১)। ঈশ্বরের ইচ্ছা কী? বাইবেলের পুরনো ও নতুন নিয়ম উভয় অংশেই এ প্রশ্নের উত্তরে যা বলা হয়েছে তার মর্মার্থ এই—আমরা যেন আমাদের জীবনের সব কিছুতেই ঈশ্বরকে সম্মান করি এবং অন্য মানুষকে আত্মতুল্য প্রেম করি। এর অর্থ এই যে সম্পূর্ণ নম্রতায়, ভক্তিতে অন্তর্যামী যিনি, সেই ঈশ্বরকে দেহ, আত্মা, মন ও প্রাণ দিয়ে এবং অন্য সব মানুষের মর্যাদা ও ন্যায্য অধিকারকে সম্মান করি। কিন্তু লোভ, হিংসা ও অশুভ প্রতিযোগিতার যূপকাষ্ঠে আমাদের সব মূল্যবোধ আজ ভূলুণ্ঠিত। অশান্তি ও অস্থিরতার মধ্যে আমাদের দিন আসে, দিন যায়। লোভ, হিংসা ও অন্যায়-অবিচার  নতুন কিছু নয়। কিন্তু আজ গোটা বিশ্বে তার মাত্রা যে বেড়েই চলেছে! সবচেয়ে বড় শঙ্কা ও উৎকণ্ঠার বিষয়ের একটি হচ্ছে ধর্মীয় শিক্ষার অপব্যাখ্যা।<br /> খ্রিস্ট ধর্ম দর্শনে মানুষের জীবনের জন্য পরিপূর্ণ জীবনব্যবস্থা দেওয়া হয়েছে। মানুষ দেহে, মনে ও আত্মায় পরিপূর্ণ ও এক সুষম জীবন নিয়ে বেঁচে থাকবে, তা-ই প্রেমময় ও ন্যায়বান ঈশ্বরের অভিপ্রায়। প্রকৃত কৃচ্ছ্র সাধনা ও উপবাস কেবল পানাহার থেকে বিরত থাকাই নয়, বরং তার সঙ্গে থাকা চাই ন্যায্যতার কাজ, দুর্বল-দরিদ্রের আর্থ-সামাজিক মুক্তিদান, যারা সবলের দ্বারা অত্যাচারিত ও শোষিত, তাদের আর্থিক কষ্ট দূর করা। ধর্মকর্মের প্রকাশ হতে হবে সমাজের সব কিছুতে ন্যায়বিচারের মধ্যে। যিশু  বলেছেন, ‘তোমরা অন্যের কাছ থেকে যে রকম ব্যবহার পেতে চাও, প্রথমে তোমরা তা অন্যকে দাও।’<br /> আমাদের বিশ্বাসে যদি উত্তম কিছু থাকে, তাহলে আমাদের কাজ হবে তা বাস্তব জীবন ও আচরণে দেখানো। কিন্তু আজ সব কিছুই যেন হচ্ছে উল্টো। আজ সমাজে দুষ্টতা, ছলনা ও ভণ্ডামি সীমাহীন। এ মানব অধিকারের চরম লঙ্ঘন। আজকে পৃথিবীর যে অবস্থা, তাতে একটি বড় প্রয়োজন সব সংকীর্ণতা ও সাম্প্রদায়িকতার ঊর্ধ্বে উঠে কিভাবে মানুষের বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করা যায়, সবাই মিলে একসঙ্গে তার পথ খুঁজে বের করা। আবহাওয়ার পরিবর্তনজনিত সমস্যা, পরিবেশ-প্রকৃতি দূষণ, উগ্র বস্তুবাদ ও ভোগবাদ, বিশ্বব্যাপী ধনী-দরিদ্রের ভয়াবহ বৈষম্য, অশান্তি, শরণার্থী সমস্যা, অপুষ্টি, নারী ও শিশু পাচার, যৌনব্যবসা, শিশুশ্রম, নারীর অমর্যাদা, মাদক ও অস্ত্রের ব্যবসা ইত্যাকার শত রকমের কঠিন সমস্যায় জর্জরিত মানবসমাজ। প্রাকৃতিক দুর্যোগ ছাড়া বাকি সব সমস্যার কারণ মানুষের লোভ ও অহংকার, আর এসবের সমাধানও মানুষের হাতে আছে। তবে এর জন্য চাই মনের পরিবর্তন।<br /> মানবপ্রেমে অবগাহিত আমাদের ধর্মকর্ম বিশ্বভ্রাতৃত্ববোধে উদ্বুদ্ধ করুক।<br /> সবাইকে জানাই ‘শুভ বড়দিন’!  <br /> লেখক : যাজক ও খ্রিস্টীয় ঈশতত্ত্বের শিক্ষক</p>