জসীমউদ্দীনের (১৯০৩-৭৬) পরিচয় পল্লীকবি হিসেবেই প্রকটিত হলেও তিনি কবি, আধুনিক কবি, লোকায়ত জীবনের আধুনিক কবি। ‘জালি লাউয়ের ডগার মত বাহু দুখান সরু, গা-খানি তার শাওন মাসের যেমন তমাল তরু’—এ রকম দুটি মৌলিক উপমার মাধ্যমেই তাঁর আধুনিক কাব্যচিন্তার ধরন বুঝতে পারা যায়। কিংবা তাঁর চরণ—
‘মন সেতো নয় কুমড়ার ফালি, যাহারে তাহারে
কাটিয়া বিলানো যায়।
তোমারে যা দিছি, অপরে তা যবে জোর করে চাবে
কী হবে উপায় হায়!’
এ রকম আধুনিক কাব্যালংকার জসীম-পরবর্তী কজন আধুনিক কবি সৃষ্টি করতে পেরেছেন।
সরকারি সম্প্রচার মাধ্যমে গান পরিবেশনের মাধ্যমে তিনি কণ্ঠশিল্পের পরিচয় তুলে ধরলেন।
জসীমউদ্দীনের সংগৃহীত গান গেয়ে আব্বাসউদ্দীনের খ্যাতি বিস্তৃত হলো। বৃহত্তর ফরিদপুর থেকে গান সংগ্রহ করে নিয়ে যেতেন জসীম। কিন্তু শুধুই গান নয়, সঙ্গে থাকত সুর। সেই সুর তো কেবল জানেন সংগ্রাহক। কণ্ঠের জোর না থাকলে এই কাজ সম্ভবপর হয়, তা বুঝতে বেশি চিন্তা করতে হয় না।
আব্বাসউদ্দীনের বিখ্যাত হওয়ার জন্য ভূমিকা রেখেছিল ভাওয়াইয়া গান। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ পাস করার পর জসীমউদ্দীন গিয়ে উঠলেন কাড়েয়া রোডের ছোট্ট একটা বাড়ির কোঠাঘরে, যেখানে থাকতেন গোলাম মোস্তফা ও আব্বাসউদ্দীন। একজন কবি আর একজন শিল্প। সেখানে যুক্ত হলেন কবি ও শিল্পী জসীমউদ্দীন। তিনজনেই থাকতেন একটি ঘরে। তিনজনের সংসারে কোনো কাজের লোক ছিল না। তিনজনেই বাজার করতেন, তিনজনেই রান্নাবান্না করতেন। রান্নাবান্নার মধ্যেই চলত গান। গোলাম মোস্তফার গানের গলা মোটামুটি। আব্বাসের গানের গলা তো সেই সময়ের সেরা। কিন্তু জসীমের কণ্ঠ সুমধুর নয়। জসীমের ভাষায়—‘কত রকমের গান যে হইতো রান্নার সময়। আব্বাস আর মোস্তফার সুরেলা কণ্ঠের সঙ্গে আমার বেতালা কণ্ঠস্বর মিলিয়া একটা তাল-বেতালের কাণ্ড হইতো।’
সেই সময়ে যেসব গানের সঙ্গে জসীম কণ্ঠ মেলাতেন তা হলো—
‘কীসের বা রান্ধন, কীসের বা বাড়ন
কীসের বা হলুদের কোটা
আমার নয়নের জলে এবুক ভিজিল
ভাসিল হলুদের পাটা।’
কিংবা
‘যখন কালা বাজায় বাঁশি
তখন আমি রানতে বসি,
আমি রানতে বসে কানতে বসি গো
হলুদ দিতে দেই লবণ;
পরের জন্য কান্দেরে আমার মন।’
বোঝাই যাচ্ছে, তিন বন্ধু মিলে লোকসংগীতের চর্চা করতেন। এবং এইসব গানের কলি ও সুর জসীমউদ্দীনের পক্ষেই সংগ্রহ করা সম্ভব ছিল। আর সেই গীতিময় পরিবেশের সরস বর্ণনা ফুটে উঠছে জসীমের জবানিতে—‘আমাদের মুখে ছিল অদম্য হাসি, কণ্ঠে ছিল সেই বংশপরম্পরায় পাওয়া পল্লীকবিদের ভাবধারা। গান গাহিতে গাহিতে চোখে অশ্রুধারা বহিতে চাহিত। তখন আব্বাস আমার মুখের নকল করিয়া এমনি ভঙ্গি করিত যে, হাসিয়া গড়াইয়া পড়িতাম। আমাদের রান্না দেখিতে পাশের বাড়ির লোকেরা আসিয়া জড়ো হইত।’
জসীমউদ্দীন যে গানের ভেতরের কৌশলগুলো জানতেন, তা পরস্ফুিট হয় গানের পরিভাষা উচ্চারণের মধ্য দিয়ে। জসীম বলেন, “আমি যখন ‘রানতে বসে কানতে বসি রে’ গাহিয়া কণ্ঠের স্বর উদারা মুদারা ছাড়াইয়া দিতাম, তখন আব্বাস মুখভঙ্গি করিয়া ধরিত : ‘হলুদ দিতে দেই লবণ’, অমনি মোস্তফা সাহেব এক খাবলা লবণ লইয়া তরকারিতে ছাড়িয়া দিতেন। সেদিন তরকারিতে এত লবণ হইত যে কী বলিব।”
তর্কের খাতিরে বলা যেতে পারে, এই গান সেই গান নয়, যার জন্য জসীমউদ্দীনকে কণ্ঠশিল্পী বলা যেতে পারে। তাহলে আরেকটু এগিয়ে গিয়ে কিছু কথা বলতে হয়! ভাওয়াইয়া আর ইসলামী গানের শিল্পী আব্বাসউদ্দীনকে পল্লীগান গাওয়ার সুযোগ করে দিতে জসীম অবতীর্ণ হলেন গানের শিক্ষক হিসেবে। আব্বাসের গানের শিক্ষক জসীম? কপালে চোখ তোলার মতো খবর বটে! কিন্তু এটিই সত্য। গোলাম মোস্তফা যখন বিয়ে করে ভিন্ন বাড়িতে ওঠেন, তখন এক ঘরে পড়ে রইলেন জসীম ও আব্বাস। জসীম তখন আব্বাসকে পল্লীগান শেখাতে বসেন। গান শিখতে আব্বাসের একটু বেশি সময় লাগত। কোনো কোনো গান শিখতে এক মাসেরও বেশি সময় নিতেন বলে জসীম জানিয়েছেন। জসীমের ভাষায়—‘একবার আমি আব্বাসকে গ্রাম্য-গান শিখাইতে আরম্ভ করিলাম। আব্বাস উত্তরবঙ্গের লোক। পূর্ববাংলার সুর তার গলায় আসে না। সে গান শিখিতে হারমোনিয়াম লইয়া বসে। ভাটিয়ালির সুর এত সূক্ষ্ম যে হারমোনিয়ামের পরদায় তাহা বাজানো যায় না। সেখানে সুর পোয়া মাত্রা বা তারও কম, সেখানে হারমোনিয়াম অচল। কিন্তু আব্বাস হারমোনিয়ামের সঙ্গেই গানের সুর মিলাইতে চায়। ইহা লইয়া তাহার সঙ্গে আমার বচসা হইত। দুই বন্ধুতে তর্ক-বিতর্ক করিয়া বহু সময় অপব্যয় হইত। তাহা ছাড়া তাকে গান শিখানো যে কত কঠিন, তাহা যাহারা তাকে গান শিখাইয়াছেন, তাঁহারাই জানেন। এক-একটি গান শিখিতে আব্বাস এক মাসেরও বেশি সময় লইত। আমি নিরস্ত হইতাম না। ভাবিতাম, তার মতো সুরেলা কণ্ঠে যদি গ্রাম্য-গান ঢুকাইয়া দিতে পারি, তবে শহরের সমাজে লোকগীতির একটি উচ্চস্থান তৈরি হইবে।’ এইখানে স্পষ্টতই প্রতিভাত যে জসীমউদ্দীন গান গাইতেন এবং গান শেখানোর মতো শিল্পীসত্তা অর্জন করেছিলেন। আব্বাসকে জসীম যেসব গান শিখিয়েছিলেন তার মধ্যে ‘আমার গহীন গাঙের নাইয়া’, ‘তোরা কে কে যাবি লো জল আনতে’, ‘আগে জানলে তোর ভাঙা নৌকায় চড়তাম না’, ‘তুই যারে হানলি রে আঘাত, সে কি তোর পর’, ‘বাজান চল যাই চল, মাঠে লাঙল বাইতে’ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।
আব্বাসউদ্দীন যে জসীমউদ্দীনের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছিলেন, সেই খবর প্রচারিত হলে আব্বাসকে ছোট করা হয়—এমন বিবেচনা থেকেই হয়তো তাঁর সন্তানরা এই সত্য স্বীকার করতেন না। জসীমউদ্দীনের আক্ষেপবাক্য থেকেই সে কথা জানা যায়। তিনি বলেন, ‘আব্বাস তার আত্মজীবনীতে আমার প্রশংসা করিয়াছে কিন্তু আমি যে কীভাবে তাহাকে লোকগীতি শিখাইয়াছি, তাহার উল্লেখ করে নাই। আব্বাসের ছেলে ‘আব্বাসউদ্দীনের গান’ পুস্তকের ভূমিকায়ও গানের এই শিক্ষাদানের কথা উল্লেখ করেন নাই। কিন্তু তখনকার দিনের আব্বাসের বন্ধুরা সকলেই জানিতেন কীভাবে আমি আব্বাসকে পল্লীগানে শিক্ষাদান করিয়াছিলাম। মা যেমন সন্তানকে স্তন্য দুগ্ধ দিয়া লালন করে, সেইভাবে আমি আব্বাসকে লোকসংগীতের সুরসুধা পান করাইয়াছিলাম।’ কেবল আব্বাসউদ্দীন আব্দুল আলীমকেই নয়, তিনি আরো অনেককে গান শিখিয়েছেন। ‘আমার গহীন গাঙের নাইয়া’ গানটি ছাত্রাবস্থায় শিখেছিলেন জসীমের সহপাঠী আবদুস সালাম খান। তিনি অনেক অনুষ্ঠানে গানটি গাইতেন। সাবেক মন্ত্রী কর্নেল ফারুক খানের চাচা এই আবদুস সালাম খানও মন্ত্রী হয়েছিলেন। এই গানটি জসীমউদ্দীন তৎকালীন প্রখ্যাত শিল্পী হিমাংশু দত্তকেও শিখিয়েছিলেন। অনেক অখ্যাত শিল্পী এসে জসীমউদ্দীনের কাছে গান শিখে বিখ্যাত হয়েছেন। কণ্ঠ সুরেলা না হলেও জসীম গাইতেন এবং গেয়ে গেয়েই শেখাতেন গান।
একবার চাচার বিয়ের বরযাত্রী গিয়ে ঢোলের বাদ্য শুনে ছুটে যান। গিয়ে দেখেন কবিগান হচ্ছে। তিনি স্বপ্নাবিষ্ট হয়ে সেই গান শুনতে লাগলেন। এবং বিয়েবাড়িতে ফিরে বরযাত্রার পেছনে পেছনে চলতে গিয়ে কবিগানের আসরে চেনা সুর নেচে নেচে গাইতে লাগলেন। তাঁর ভাষায়, ‘এইরূপ গাহিতে গাহিতে সুরের ভিতরে যেখানে নারে নারে করিতেছিলাম সেখানে যা-তা ইচ্ছামতো কথা জুড়িয়া দিয়া ছন্দের পরিমাপ বিষয়ে আমার মনে একটা ধারণা আসিল। তারপর হঠাৎ কথার সঙ্গে কথা আসিয়া কেমন করিয়া যেন একের সঙ্গে অপরের মিল হইয়া গেল। তখন আর আমাকে পায় কে; সারা পথ ইচ্ছামতো উপস্থিত বোল রচনা করিয়া গান গাহিতে লাগিলাম। সে কি আনন্দ! কথার সঙ্গে কথা আসিয়া যখন মিলের বন্ধন পরিতেছে, তাহার তালে তালে আমার বুক নাচিয়া উঠিতেছে।’ এই গাওয়াও তো একজন শিল্পী হিসেবে গড়ে ওঠার পর্যায় মাত্র। পরিণত বয়সে তিনি নরসিংদীর কবিয়াল হরিচরণ আচার্যের সঙ্গে দেখা করেছিলেন। প্রখ্যাত গণসংগীতশিল্পী হেমাঙ্গ বিশ্বাস জসীমের কণ্ঠের প্রশংসা করলে তাঁর শিল্পীসত্তার প্রশংসা করেছেন। এক স্মৃতিচারণায় তিনি বলেছেন, ‘নানা অঞ্চলের বৈশিষ্ট্যপূর্ণ গান গেয়ে চলেছিলাম আমরা। কাজেই কবি জসিমউদ্দীনও [?] গান ধরলেন। পূর্ব বঙ্গের রাখালীয়া গানের বিলম্বিত সুরের সূক্ষ্ম খোঁচাগুলি এমন চমৎকার তাঁর গলায় উঠছিল যে সরল সবুজ গ্রাম্যতার স্পর্শ আমরা সবাই তাতে পাচ্ছিলাম। অথচ গায়ক বলে কিন্তু তাঁর নাম নেই। এ-গানই হয়তো রেকর্ড বা রেডিওতে অচল। অন্য যে কোনো শহুরে পল্লীগায়ককে দিয়ে গাওয়াতে গেলে তাঁর গলার এই গান জল ছাড়া মাছের মতো ছটফটিয়ে মরবে।’ আকাশবাণীতে গান পরিবেশন, আব্বাস-আলীম-হিমাংশুকে গান শেখানো, বিভিন্ন আসরে স্বকণ্ঠে সংগীত পরিবেশনের তথ্য জানার পর জসীমউদ্দীনকে কণ্ঠশিল্পী হিসেবে মেনে নিতে আপত্তি থাকার কথা নয়।