তপন বাগচী

কণ্ঠশিল্পী জসীমউদ্দীন

  • জন্ম : ১ জানুয়ারি ১৯০৩, মৃত্যু : ১৪ মার্চ ১৯৭৬
শেয়ার
কণ্ঠশিল্পী জসীমউদ্দীন
প্রতিকৃতি : তানভীর মালেক

জসীমউদ্দীনের (১৯০৩-৭৬) পরিচয় পল্লীকবি হিসেবেই প্রকটিত হলেও তিনি কবি, আধুনিক কবি, লোকায়ত জীবনের আধুনিক কবি। ‘জালি লাউয়ের ডগার মত বাহু দুখান সরু, গা-খানি তার শাওন মাসের যেমন তমাল তরু’—এ রকম দুটি মৌলিক উপমার মাধ্যমেই তাঁর আধুনিক কাব্যচিন্তার ধরন বুঝতে পারা যায়। কিংবা তাঁর চরণ—

 

‘মন সেতো নয় কুমড়ার ফালি, যাহারে তাহারে

কাটিয়া বিলানো যায়।

তোমারে যা দিছি, অপরে তা যবে জোর করে চাবে

কী হবে উপায় হায়!’

এ রকম আধুনিক কাব্যালংকার জসীম-পরবর্তী কজন আধুনিক কবি সৃষ্টি করতে পেরেছেন।

তবু তাঁকে আধুনিক কবি বলতেই নারাজ একালের সমালোচককুল।

আমরা জানি যে জসীম কেবল কবিই নন, গান-উপন্যাস-নাটক-প্রবন্ধ, স্মৃতিকথা-ভ্রমণকাহিনি লিখেছেন এবং লোকসংগীত সংগ্রহ ও মূল্যায়ন করে ফোকলোরবিদ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে অধ্যাপনা করেছেন, সরকারি সংস পাবলিসিটি বিভাগের (অধুনা গণযোগাযোগ অধিদপ্তর) প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এত সব পরিচয়ের আড়ালে চাপা পড়ে গেছে তাঁর কণ্ঠশিল্পী পরিচয়টি।

জসীমউদ্দীন গান লিখেছেন, লোকমুখে প্রচলিত গান সংগ্রহ করেছেন, সুরসহ গান তুলে দিয়েছেন আব্বাসউদ্দীন আহমদ ও আব্দুল আলীমের মতো শিল্পীদের কণ্ঠে। এঁদের তিনি গান শিখিয়েছেন—এমন স্বীকারোক্তিও রয়েছে জসীমের স্মৃতিকথায়।

জসীমউদ্দীন তাঁর ফরিদপুর অঞ্চলের কানাইলাল শীলকে দোতারাবাদক ও সংগীত সংগ্রাহক হিসেবে প্রতিষ্ঠা দিয়েছেন। এইচএমভি রেকর্ড কম্পানি এবং আকাশবাণীতে বাজানোর সুযোগ করে দিয়েছেন জসীমউদ্দীনই।

জসীমউদ্দীন আকাশবাণীতে সংগীতও পরিবেশন করেছেন। বিশেষত কবির লড়াইতে তিনি অংশ নিয়েছেন, সে কথাও অনেকের জানা। জসীমের কণ্ঠ তেমন সুরেলা ছিল না হয়তো, কিন্তু সুরের খেলাটা তিনি রপ্ত করেছিলেন। তাই মাঠের কবিয়ালদের গান নিজ কণ্ঠে ধারণ করেছেন, নিজে তাৎক্ষণিক রচনায় কবিগান গেয়েছেন, আবার কবির দলের পক্ষ হয়ে বেতারেও গান পরিবেশন করেছেন। একজন আধুনিক কবির পক্ষে কবিগান পরিবেশন করা অনেক বড় সাহসের বিষয়।
সরকারি সম্প্রচার মাধ্যমে গান পরিবেশনের মাধ্যমে তিনি কণ্ঠশিল্পের পরিচয় তুলে ধরলেন।

জসীমউদ্দীনের সংগৃহীত গান গেয়ে আব্বাসউদ্দীনের খ্যাতি বিস্তৃত হলো। বৃহত্তর ফরিদপুর থেকে গান সংগ্রহ করে নিয়ে যেতেন জসীম। কিন্তু শুধুই গান নয়, সঙ্গে থাকত সুর। সেই সুর তো কেবল জানেন সংগ্রাহক। কণ্ঠের জোর না থাকলে এই কাজ সম্ভবপর হয়, তা বুঝতে বেশি চিন্তা করতে হয় না।

আব্বাসউদ্দীনের বিখ্যাত হওয়ার জন্য ভূমিকা রেখেছিল ভাওয়াইয়া গান। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ পাস করার পর জসীমউদ্দীন গিয়ে উঠলেন কাড়েয়া রোডের ছোট্ট একটা বাড়ির কোঠাঘরে, যেখানে থাকতেন গোলাম মোস্তফা ও আব্বাসউদ্দীন। একজন কবি আর একজন শিল্প। সেখানে যুক্ত হলেন কবি ও শিল্পী জসীমউদ্দীন। তিনজনেই থাকতেন একটি ঘরে। তিনজনের সংসারে কোনো কাজের লোক ছিল না। তিনজনেই বাজার করতেন, তিনজনেই রান্নাবান্না করতেন। রান্নাবান্নার মধ্যেই চলত গান। গোলাম মোস্তফার গানের গলা মোটামুটি। আব্বাসের গানের গলা তো সেই সময়ের সেরা। কিন্তু জসীমের কণ্ঠ সুমধুর নয়। জসীমের ভাষায়—‘কত রকমের গান যে হইতো রান্নার সময়। আব্বাস আর মোস্তফার সুরেলা কণ্ঠের সঙ্গে আমার বেতালা কণ্ঠস্বর মিলিয়া একটা তাল-বেতালের কাণ্ড হইতো।’

সেই সময়ে যেসব গানের সঙ্গে জসীম কণ্ঠ মেলাতেন তা হলো—

‘কীসের বা রান্ধন, কীসের বা বাড়ন

কীসের বা হলুদের কোটা

আমার নয়নের জলে এবুক ভিজিল

ভাসিল হলুদের পাটা।’

কিংবা

‘যখন কালা বাজায় বাঁশি

তখন আমি রানতে বসি,

আমি রানতে বসে কানতে বসি গো

হলুদ দিতে দেই লবণ;

পরের জন্য কান্দেরে আমার মন।’

 

বোঝাই যাচ্ছে, তিন বন্ধু মিলে লোকসংগীতের চর্চা করতেন। এবং এইসব গানের কলি ও সুর জসীমউদ্দীনের পক্ষেই সংগ্রহ করা সম্ভব ছিল। আর সেই গীতিময় পরিবেশের সরস বর্ণনা ফুটে উঠছে জসীমের জবানিতে—‘আমাদের মুখে ছিল অদম্য হাসি, কণ্ঠে ছিল সেই বংশপরম্পরায় পাওয়া পল্লীকবিদের ভাবধারা। গান গাহিতে গাহিতে চোখে অশ্রুধারা বহিতে চাহিত। তখন আব্বাস আমার মুখের নকল করিয়া এমনি ভঙ্গি করিত যে, হাসিয়া গড়াইয়া পড়িতাম। আমাদের রান্না দেখিতে পাশের বাড়ির লোকেরা আসিয়া জড়ো হইত।’

জসীমউদ্দীন যে গানের ভেতরের কৌশলগুলো জানতেন, তা পরস্ফুিট হয় গানের পরিভাষা উচ্চারণের মধ্য দিয়ে। জসীম বলেন, “আমি যখন ‘রানতে বসে কানতে বসি রে’ গাহিয়া কণ্ঠের স্বর উদারা মুদারা ছাড়াইয়া দিতাম, তখন আব্বাস মুখভঙ্গি করিয়া ধরিত : ‘হলুদ দিতে দেই লবণ’, অমনি মোস্তফা সাহেব এক খাবলা লবণ লইয়া তরকারিতে ছাড়িয়া দিতেন। সেদিন তরকারিতে এত লবণ হইত যে কী বলিব।”

তর্কের খাতিরে বলা যেতে পারে, এই গান সেই গান নয়, যার জন্য জসীমউদ্দীনকে কণ্ঠশিল্পী বলা যেতে পারে। তাহলে আরেকটু এগিয়ে গিয়ে কিছু কথা বলতে হয়! ভাওয়াইয়া আর ইসলামী গানের শিল্পী আব্বাসউদ্দীনকে পল্লীগান গাওয়ার সুযোগ করে দিতে জসীম অবতীর্ণ হলেন গানের শিক্ষক হিসেবে। আব্বাসের গানের শিক্ষক জসীম? কপালে চোখ তোলার মতো খবর বটে! কিন্তু এটিই সত্য। গোলাম মোস্তফা যখন বিয়ে করে ভিন্ন বাড়িতে ওঠেন, তখন এক ঘরে পড়ে রইলেন জসীম ও আব্বাস। জসীম তখন আব্বাসকে পল্লীগান শেখাতে বসেন। গান শিখতে আব্বাসের একটু বেশি সময় লাগত। কোনো কোনো গান শিখতে এক মাসেরও বেশি সময় নিতেন বলে জসীম জানিয়েছেন। জসীমের ভাষায়—‘একবার আমি আব্বাসকে গ্রাম্য-গান শিখাইতে আরম্ভ করিলাম। আব্বাস উত্তরবঙ্গের লোক। পূর্ববাংলার সুর তার গলায় আসে না। সে গান শিখিতে হারমোনিয়াম লইয়া বসে। ভাটিয়ালির সুর এত সূক্ষ্ম যে হারমোনিয়ামের পরদায় তাহা বাজানো যায় না। সেখানে সুর পোয়া মাত্রা বা তারও কম, সেখানে হারমোনিয়াম অচল। কিন্তু আব্বাস হারমোনিয়ামের সঙ্গেই গানের সুর মিলাইতে চায়। ইহা লইয়া তাহার সঙ্গে আমার বচসা হইত। দুই বন্ধুতে তর্ক-বিতর্ক করিয়া বহু সময় অপব্যয় হইত। তাহা ছাড়া তাকে গান শিখানো যে কত কঠিন, তাহা যাহারা তাকে গান শিখাইয়াছেন, তাঁহারাই জানেন। এক-একটি গান শিখিতে আব্বাস এক মাসেরও বেশি সময় লইত। আমি নিরস্ত হইতাম না। ভাবিতাম, তার মতো সুরেলা কণ্ঠে যদি গ্রাম্য-গান ঢুকাইয়া দিতে পারি, তবে শহরের সমাজে লোকগীতির একটি উচ্চস্থান তৈরি হইবে।’ এইখানে স্পষ্টতই প্রতিভাত যে জসীমউদ্দীন গান গাইতেন এবং গান শেখানোর মতো শিল্পীসত্তা অর্জন করেছিলেন। আব্বাসকে জসীম যেসব গান শিখিয়েছিলেন তার মধ্যে ‘আমার গহীন গাঙের নাইয়া’, ‘তোরা কে কে যাবি লো জল আনতে’, ‘আগে জানলে তোর ভাঙা নৌকায় চড়তাম না’, ‘তুই যারে হানলি রে আঘাত, সে কি তোর পর’, ‘বাজান চল যাই চল, মাঠে লাঙল বাইতে’ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।

আব্বাসউদ্দীন যে জসীমউদ্দীনের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছিলেন, সেই খবর প্রচারিত হলে আব্বাসকে ছোট করা হয়—এমন বিবেচনা থেকেই হয়তো তাঁর সন্তানরা এই সত্য স্বীকার করতেন না। জসীমউদ্দীনের আক্ষেপবাক্য থেকেই সে কথা জানা যায়। তিনি বলেন, ‘আব্বাস তার আত্মজীবনীতে আমার প্রশংসা করিয়াছে কিন্তু আমি যে কীভাবে তাহাকে লোকগীতি শিখাইয়াছি, তাহার উল্লেখ করে নাই। আব্বাসের ছেলে ‘আব্বাসউদ্দীনের গান’ পুস্তকের ভূমিকায়ও গানের এই শিক্ষাদানের কথা উল্লেখ করেন নাই। কিন্তু তখনকার দিনের আব্বাসের বন্ধুরা সকলেই জানিতেন কীভাবে আমি আব্বাসকে পল্লীগানে শিক্ষাদান করিয়াছিলাম। মা যেমন সন্তানকে স্তন্য দুগ্ধ দিয়া লালন করে, সেইভাবে আমি আব্বাসকে লোকসংগীতের সুরসুধা পান করাইয়াছিলাম।’ কেবল আব্বাসউদ্দীন আব্দুল আলীমকেই নয়, তিনি আরো অনেককে গান শিখিয়েছেন। ‘আমার গহীন গাঙের নাইয়া’ গানটি ছাত্রাবস্থায় শিখেছিলেন জসীমের সহপাঠী আবদুস সালাম খান। তিনি অনেক অনুষ্ঠানে গানটি গাইতেন। সাবেক মন্ত্রী কর্নেল ফারুক খানের চাচা এই আবদুস সালাম খানও মন্ত্রী হয়েছিলেন। এই গানটি জসীমউদ্দীন তৎকালীন প্রখ্যাত শিল্পী হিমাংশু দত্তকেও শিখিয়েছিলেন। অনেক অখ্যাত শিল্পী এসে জসীমউদ্দীনের কাছে গান শিখে বিখ্যাত হয়েছেন। কণ্ঠ সুরেলা না হলেও জসীম গাইতেন এবং গেয়ে গেয়েই শেখাতেন গান।

একবার চাচার বিয়ের বরযাত্রী গিয়ে ঢোলের বাদ্য শুনে ছুটে যান। গিয়ে দেখেন কবিগান হচ্ছে। তিনি স্বপ্নাবিষ্ট হয়ে সেই গান শুনতে লাগলেন। এবং বিয়েবাড়িতে ফিরে বরযাত্রার পেছনে পেছনে চলতে গিয়ে কবিগানের আসরে চেনা সুর নেচে নেচে গাইতে লাগলেন। তাঁর ভাষায়, ‘এইরূপ গাহিতে গাহিতে সুরের ভিতরে যেখানে নারে নারে করিতেছিলাম সেখানে যা-তা ইচ্ছামতো কথা জুড়িয়া দিয়া ছন্দের পরিমাপ বিষয়ে আমার মনে একটা ধারণা আসিল। তারপর হঠাৎ কথার সঙ্গে কথা আসিয়া কেমন করিয়া যেন একের সঙ্গে অপরের মিল হইয়া গেল। তখন আর আমাকে পায় কে; সারা পথ ইচ্ছামতো উপস্থিত বোল রচনা করিয়া গান গাহিতে লাগিলাম। সে কি আনন্দ! কথার সঙ্গে কথা আসিয়া যখন মিলের বন্ধন পরিতেছে, তাহার তালে তালে আমার বুক নাচিয়া উঠিতেছে।’ এই গাওয়াও তো একজন শিল্পী হিসেবে গড়ে ওঠার পর্যায় মাত্র। পরিণত বয়সে তিনি নরসিংদীর কবিয়াল হরিচরণ আচার্যের সঙ্গে দেখা করেছিলেন। প্রখ্যাত গণসংগীতশিল্পী হেমাঙ্গ বিশ্বাস জসীমের কণ্ঠের প্রশংসা করলে তাঁর শিল্পীসত্তার প্রশংসা করেছেন। এক স্মৃতিচারণায় তিনি বলেছেন, ‘নানা অঞ্চলের বৈশিষ্ট্যপূর্ণ গান গেয়ে চলেছিলাম আমরা। কাজেই কবি জসিমউদ্দীনও [?] গান ধরলেন। পূর্ব বঙ্গের রাখালীয়া গানের বিলম্বিত সুরের সূক্ষ্ম খোঁচাগুলি এমন চমৎকার তাঁর গলায় উঠছিল যে সরল সবুজ গ্রাম্যতার স্পর্শ আমরা সবাই তাতে পাচ্ছিলাম। অথচ গায়ক বলে কিন্তু তাঁর নাম নেই। এ-গানই হয়তো রেকর্ড বা রেডিওতে অচল। অন্য যে কোনো শহুরে পল্লীগায়ককে দিয়ে গাওয়াতে গেলে তাঁর গলার এই গান জল ছাড়া মাছের মতো ছটফটিয়ে মরবে।’ আকাশবাণীতে গান পরিবেশন, আব্বাস-আলীম-হিমাংশুকে গান শেখানো, বিভিন্ন আসরে স্বকণ্ঠে সংগীত পরিবেশনের তথ্য জানার পর জসীমউদ্দীনকে কণ্ঠশিল্পী হিসেবে মেনে নিতে আপত্তি থাকার কথা নয়।

 

 

মন্তব্য

সম্পর্কিত খবর

বিশ্বসাহিত্য

অথার পুরস্কারের দীর্ঘ তালিকা প্রকাশ

শেয়ার
অথার পুরস্কারের দীর্ঘ তালিকা প্রকাশ

২০২৫ সালের অথার পুরস্কারের দীর্ঘ তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে এ মাসের ৮ তারিখে। ভারতের নারী লেখকদের ইংরেজিতে লেখা বইয়ের স্বীকৃতি হিসেবে দেওয়া হয় অথার পুরস্কার। এ পুরস্কারের প্রবর্তক জেকে পেপার এবং টাইমস অব ইন্ডিয়া। কথাসাহিত্য, প্রবন্ধ সাহিত্য, শিশুসাহিত্য এবং প্রথম প্রকাশিত বইয়ের জন্য দেওয়া হয় এ পুরস্কার।

ভারতে নারী লেখকদের জন্য দেওয়া জাতীয় পর্যায়ের সর্বোচ্চ মানের এ পুরস্কার প্রবর্তন করা হয় ২০১৮ সালে। ২০২৩ সালের নভেম্বর থেকে ২০২৪ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে ভারতে প্রকাশ করা নারী লেখকদের বই ২০২৫ সালের পুরস্কারের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে।

এ বছরের পুরস্কারের জন্য প্রতিযোগিতা করতে জমা পড়ে দুই হাজারের বেশি বই। দীর্ঘ তালিকায় রয়েছে মোট ৩৪টি বই।

সাহিত্যজগতে মূল্যবোধ ও সৃজনশীলতা তৈরিতে ভূমিকা রাখা নারীদের মূল্যায়ন করার একটা প্রয়াস হিসেবে দেখা হয় এ পুরস্কারকে। বিচারকদের হাতে এসে পৌঁছতে বইগুলো আরো অনেক পর্যায়ের পর্যবেক্ষণের মধ্য দিয়ে এসেছে। এবারের পুরস্কারের সাহিত্য পরিচালক জয়া ভট্টাচার্য রোজ বলেন, ‘আমরা আজ দ্বিতীয় শিল্প বিপ্লবের মধ্যে আছি।’ তথ্য-প্রযুক্তির বিস্তার এত বৃহৎ পরিসরে ঘটছে যে শুধু মানুষের ক্ষমতা নিয়ে তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলা প্রায় অসম্ভব।
বেশির ভাগ নারীর জন্য সময় হলো একটা নমনীয় সত্তা; সময়কে নিজেদের মতো করে ব্যবহার করতে হয়। এভাবেই লেখার সময় বের করা সম্ভব। ২০২৫ সালের তালিকায় থাকা লেখকরা বৈচিত্র্যময় বিষয় নিয়ে চিন্তা উসকে দেওয়ার মতো বই লিখেছেন।’ উল্লেখ্য, ২০২৫ সালের অথার পুরস্কার চূড়ান্ত বিজয়ীর হাতে তুলে দেওয়া হবে দিল্লিতে মার্চের ২১ তারিখে।

 

অথার পুরস্কারের দীর্ঘ তালিকা প্রকাশ

নিরো পুরস্কার পেলেন যাঁরা 

ব্রিটেন ও আয়ারল্যান্ডের সেরা সাহিত্যের স্বীকৃতি হিসেবে নির্বাচিত বইয়ের জন্য ২০২৪ সালের নিরো পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছে গত ৫ মার্চ।

কথাসাহিত্য, গদ্যসাহিত্য, শিশুতোষ কথাসাহিত্য এবং প্রথম প্রকাশিত কথাসাহিত্যের জন্য দেওয়া হয় নিরো সাহিত্য পুরস্কার। সব রকমের রুচির পাঠকদের জন্য উঁচু মানের বই বাছাই করা হয় এ পুরস্কারের মাধ্যমে। কয়েক শ বইয়ের মধ্য থেকে  লেখক, সাংবাদিক এবং বই বিক্রেতারা বছরের সেরা বই বাছাই করেছেন এবারের পুরস্কারের জন্য। এবারের পুরস্কারপ্রাপ্ত বইগুলোর মধ্যে রয়েছে লক্ষণীয় বৈচিত্র্য। কথাসাহিত্যের পুরস্কার পাওয়া উপন্যাসটা লেখা হয়েছে ধাঁধালো আবহের মধ্যে লোমহর্ষক লোককাহিনির মিশ্রণ ঘটিয়ে। অন্যদিকে লোককাহিনির সঙ্গে বিজ্ঞানের উপাদান মিশিয়ে লেখা উপন্যাস পেয়েছে শিশুতোষ কথাসাহিত্যের পুরস্কার। লেখকের প্রথম প্রকাশিত কথাসাহিত্যের বইটিতে আছে ডার্ক কমেডি। আর নৌকাডুবির পর ১১৮ দিন সমুদ্রে টিকে থাকা দম্পতির সত্যি ঘটনার ওপর লেখা বই পেয়েছে গদ্যসাহিত্যের পুরস্কার। কথাসাহিত্যে এবারের পুরস্কার পেয়েছেন অ্যাডাম এস লেসলি। তাঁর উপন্যাসের নাম ‘লস্ট ইন দ্য গার্ডেন’। সোফি এমহার্স্ট পেয়েছেন গদ্যসাহিত্যের পুরস্কার। তাঁর বইয়ের নাম ‘মরিস অ্যান্ড মেরালিন : অ্যান এক্সট্রা-অর্ডিনারি স্ট্রু স্টোরি অব শিপরেক সারভাইভাল অ্যান্ড লাভ’। শিশুতোষ কথাসাহিত্যের পুরস্কার পেয়েছেন লিজ হায়দার। তাঁর বইয়ের নাম ‘দ্য টুয়েলভ’। প্রথম প্রকাশিত বই ‘ওয়াইল্ড হর্সেস’ উপন্যাসের জন্য নিরো পুরস্কার পেয়েছেন কথাসাহিত্যিক কলিন ব্যারেট। উল্লেখ্য, ২০২৩ সালের ১ ডিসেম্বর থেকে ২০২৪ সালের ৩০ নভেম্বরের মধ্যে প্রকাশ করা বই বিবেচনায় রাখা হয়েছে। 

♦ ফাহমিদা দ্যুতি

 

 

মন্তব্য
বই আলোচনা

‘ঘষা কাঁচে’ ক্রীড়াঙ্গনের বিস্মৃত তারকারা

    সৈকত কবির সায়ক
শেয়ার
‘ঘষা কাঁচে’ ক্রীড়াঙ্গনের বিস্মৃত তারকারা

প্রচ্ছদে কালোর আবহ, শিরোনামে একটি প্রতীকী ভাবনা ‘ঘষা কাঁচে’—সময়ের ধুলোমলিন ঘষা কাঁচের ভেতর দিয়ে সদ্য-অতীত জীবন। বইটির পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে স্পষ্ট হয়ে ওঠে, এটি নিছক ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণা নয়। সাবলীল গদ্যে লেখা বইটি সম্পর্কে লেখক নিজেই বলেছেন—এটি ‘ঝকঝকে সকালের ক্লান্তিহীন গতিময়তার প্রতিশ্রুতি’, কিন্তু একই সঙ্গে ‘বিষাদের আবছায়া’ও রয়েছে এর পরতে পরতে। এই দ্বৈত অনুভূতিই পাঠককে আকৃষ্ট করে।

kk বাংলাদেশের ক্রীড়াজগতে কত শত কিংবদন্তি রয়েছেন, যাঁদের নাম ইতিহাসের পাতায় খুব বেশি উচ্চারিত হয় না। মূলধারার আলোচনায় তাঁদের সাফল্য কিংবা সংগ্রামের কথা উঠে আসে না, অথচ তাঁদের অবদান কম নয়। ঠিক এমনই কিছু বিস্মৃতপ্রায় ক্রীড়াবিদের গল্প তুলে এনেছেন তরুণ লেখক বইটির শুরুতে।

ইভান ইকরামের সাংবাদিকতা জীবনের ছাপ পড়েছে বইয়ের প্রতিটি অধ্যায়ে।

বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনের আড়ালে থাকা অনেক গল্প তিনি অনুসন্ধানী নয়, বরং ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণা হিসেবেই তুলে ধরেছেন। ক্রিকেট ও ফুটবলের বাইরে গিয়ে তিনি ভলিবল, দাবা, অ্যাথলেটিকস এবং প্যারা-স্পোর্টসের বিস্মৃতপ্রায় ক্রীড়াবিদদের কথা বলেছেন।

ক্রীড়াবিদদের জীবন শুধু মাঠের পারফরম্যান্সে সীমাবদ্ধ নয়, তাঁদের লড়াই শুরু হয় মাঠের বাইরেও। সেই লড়াই কখনো প্রতিষ্ঠার, কখনো স্বীকৃতির, কখনোবা নিছক জীবনধারণের।

পাঠকের সামনে ফুটে ওঠে এক ভিন্ন জগৎ, যেখানে ওয়াহিদুল গণির স্পিন, রকিবুল হাসানের সাহস কিংবা নিয়াজ মোরশেদের দাবার চাল এক নতুন ব্যাখ্যা পায়। ফুটবল কোচ ওয়াজেদ গাজী, ভলিবল তারকা ইয়াদ আলি কিংবা কমনওয়েলথ পদকজয়ী আব্দুস সাত্তার নিনির গল্পগুলো যেন শুধুই তাঁদের ব্যক্তিগত সাফল্যের নয়, বরং সময়ের কাছে হারিয়ে যাওয়া অধ্যায়ের পুনরুদ্ধার।

লেখকের স্মৃতির ঝাঁপি থেকে উঠে আসে ময়মনসিংহের এক অজপাড়া গাঁয়ের গল্প, যেখানে ফুটবল খেলে বদলে গেছে পুরো একটি গ্রামের চেহারা। কলসিন্দুরের সেই মেয়েরা, যারা সমাজের গত্বাঁধা দৃষ্টিভঙ্গিকে ভেঙে নতুন এক দিগন্ত উন্মোচিত করেছে। কে জানত, ছোট্ট একটি বল বদলে দিতে পারে একদল কিশোরীর জীবন, বদলে দিতে পারে একটি অঞ্চলের ভবিষ্যৎ! অথচ এমন ঘটনা কতবার ঘটে, কজনই বা সে কথা জানে!

সাংবাদিকতার জীবনও যে কতখানি ঘটনাবহুল, তা লেখকের নিজস্ব অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে ফুটে উঠেছে।

কখনো মাঠের সীমানায় দাঁড়িয়ে দেখা খেলা, কখনো খেলোয়াড়দের সঙ্গে কাটানো মুহূর্ত, কখনোবা দূর-দূরান্তে সফর—এসবের বর্ণনায় জীবনধর্মী এক আখ্যানের স্বাদ পাওয়া যায়। মাঠের উন্মাদনা, গ্যালারির শ্বাসরুদ্ধকর মুহূর্ত, ক্রীড়াবিদের ক্লান্ত-অবসন্ন মুখ কিংবা বিজয়ের হাসি—সব কিছুই অনুভব করা যায় লেখকের ভাষার গভীরতায়।

বাক্যের কারুকাজে সহজ-সাবলীল অথচ গভীর এক প্রকাশভঙ্গি। অল্প কথায় অনেক কিছু বলার মুনশিয়ানা লেখকের কলমে স্পষ্ট। কোথাও কোনো অতিরিক্ত ব্যাখ্যা নেই, কোথাও আবার ছোট্ট একটি বাক্যে গভীর জীবনবোধ। ক্রীড়ার প্রতি ভালোবাসা, খেলোয়াড়দের প্রতি মমতা আর জীবনের প্রতি তাঁর গভীর দৃষ্টিভঙ্গি একসঙ্গে মিলে এক মায়াবী গদ্য সৃষ্টি করেছে। ইভান ইকরাম একজন ক্রীড়া সাংবাদিক হিসেবে যে দায়বদ্ধতা দেখিয়েছেন, তা প্রশংসনীয়। তাঁর অন্তর্মুখী দৃষ্টি ও ঝরঝরে গদ্য বইটিকে করেছে স্বতন্ত্র।

 

মন্তব্য

শেকসপিয়ারের প্রেমের কবিতার

    আদি কপি আবিষ্কার
শেয়ার
শেকসপিয়ারের প্রেমের কবিতার

কয়েক শ বছর পরে শেকসপিয়ারের হাতে লেখা প্রেমের কবিতার কপি পাওয়া গেছে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সপ্তদশ শতকের কবিতা সংকলনে। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক ড. লিয়াহ ভেরোনিজ উইলিয়াম শেকসপিয়ারের ১১৬ নম্বর সনেটের এই কপিটা পেয়েছেন। অক্সফোর্ডের অ্যাশমোলিয়ান জাদুঘরের প্রতিষ্ঠাতা এলিয়াস অ্যাশমোলের কাজকর্ম এবং স্মৃতিবিজড়িত ফাইলপত্রের মধ্যে পাওয়া গেছে কবিতাটা। অক্সফোর্ডের শেকসপিয়ার বিশেষজ্ঞ প্রফেসর এমা স্মিথ বলেন, ‘এই চাঞ্চল্যকর আবিষ্কার শেকসপিয়ারের মৃত্যু-পরবর্তী দশকগুলোতে তাঁর জনপ্রিয়তা সম্পর্কে জানতে গবেষকদের জন্য 

শেকসপিয়ারের প্রেমের কবিতার

সহায়ক হবে।

’ বিভিন্ন লেখকদের বিবিধ বিষয়ে লেখা পাণ্ডুলিপির মধ্যে এই কবিতটা পেয়েছেন ড. ভেরোনিজ। তিনি বলেন, ‘পাণ্ডুলিপির পাতা ওল্টানোর সময় হঠাৎ আমার নজরে আসে, এটা ১১৬ নম্বর সনেটের একটা ব্যতিক্রমী চেহারার কপি। উনিশ শতকে সাজানো একটা ক্যাটালগে কবিতাটা পাই। কবিতাটার গায়ে শেকসপিয়ারের নাম ছিল না।
তবে স্পষ্টভাবেই লেখা ছিল, ‘অন কন্সট্যান্সি ইন লাভ’। কবিতাটার অ্যাশমোলের ভার্সনে একটা পঙক্তিতে কয়েকটা কথার পরিবর্তন বা হেরফের করা হয়েছে। আদি কবিতার সঙ্গে পার্থক্য এইটুকুই। ড. ভেরোনিজ মনে করেন, প্রথম পঙক্তিতে  এই সামান্য পরির্তন এবং শেকসপিয়ারের নাম উল্লেখ না থাকার কারণে এ কবিতাটা এত দিন ১১৬ নম্বর সনেটের আদি কপি হিসেবে পরিচয় পায়নি ।
১৬৪০-এর দশক অর্থাৎ রয়েলিস্ট এবং পার্লামেন্টারিয়ানদের মধ্যে সংঘটিত গৃহযুদ্ধের দশকের ‘রাজনৈতিক তাড়না’ তকমা পাওয়া লেখা হিসেবে বিবিধ লেখার মধ্যে পড়েছিল এটা। অ্যাশমোল ছিলেন রাজতন্ত্রের সমর্থক। গবেষকদের মতে, তিনি যে পরিবর্তনটুকু এনেছেন তার কারণে কবিতাটা পুরোপুরি প্রেমের কবিতা না থেকে কিছুটা ধর্মীয় ভাব এবং রাজনৈতিক আনুগত্যের বৈশিষ্ট্য পেয়েছে।

♦ আল মনসুর

মন্তব্য

বুদ্ধিবৃত্তিক সমাজ নির্মাণের হাতিয়ার বিতর্ক

    বহুমুখী চিন্তার বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে নব্বইয়ের দশকে হাসান আহমেদ চৌধুরী কিরণ বেছে নিয়েছিলেন বিতর্ক। কেটে গেছে তিন দশক। জনমানসে কতটুকু ভূমিকা রেখেছে বিতর্ক? এসব প্রশ্ন সামনে রেখেই শিলালিপির জন্য তাঁর সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন অলকানন্দা রায়
শেয়ার
বুদ্ধিবৃত্তিক সমাজ নির্মাণের হাতিয়ার বিতর্ক

আপনি কিভাবে বিতর্কের জগতে প্রবেশ করলেন? এখনো কিভাবে বিতর্কের মাঝেই নিজেকে উজ্জীবিত রেখেছেন?

স্কুল-কলেজ জীবন থেকেই আমার বিতর্কচর্চার লড়াই শুরু। তবে সেই লড়াইটা সমৃদ্ধি লাভ করে নব্বইয়ের দশকে। আশির দশকে ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন ভর্তি হই রাষ্ট্রক্ষমতায় তখন সামরিক সরকার হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। সারা দেশে সামরিক সরকারবিরোধী আন্দোলনের ঢেউ।

বিতর্ক নিয়ে এরশাদবিরোধী আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ি আমি নিজেও। গড়ে তুলি ঢাকা ইউনিভার্সিটি ডিবেটিং সোসাইটি। সাধারণ সম্পাদক হিসেবে নেতৃত্বে থাকি। একঝাঁক তরুণকে সঙ্গে নিয়ে বিতর্কের লড়াইটা ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হই।

 

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিতর্কের ধারা এবং শৈলী কিভাবে পরিবর্তিত হয়েছে? কিভাবে এই পরিবর্তনগুলোর সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিয়েছেন?

বিতর্ক একটা চলমান বিষয়। বিতর্ককে আকর্ষণীয় করতে নতুন নতুন ফর্ম ব্যবহার করা হয়। এখানে ব্যক্তির প্রাপ্তির চেয়ে সামাজিক দায়বদ্ধতার বিষয়টিকে বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয়। এখানে মূল লক্ষ হলো—তরুণদের একমুখী চিন্তার বিপরীতে বহুমুখী চিন্তার বহিঃপ্রকাশ ঘটানো।

এ কারণেই নব্বইয়ের দশকের শেষে বেসরকারি টেলিভিশনে বিতর্কের সূচনা ঘটে আমার হাত ধরেই। নব্বইয়ের দশকের শেষলগ্নে প্রথম বেসরকারি টেলিভিশন এটিএন বাংলায় আমার পরিকল্পনা, উপস্থাপনা ও নির্দেশনায় শুরু করি বিতর্ক প্রতিযোগিতা। প্রথম প্রথম বিষয়ভিত্তিক বিতর্ক নিয়ে কাজ করি। এরপর রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তনের কথা ভেবে সংসদীয় ধারায় শুরু করি ছায়া সংসদের আদলে বিতর্ক প্রতিযোগিতা, যা এখনো চলমান আছে।

বিতর্ককে আপনি কিভাবে একটি শৈল্পিক অভিব্যক্তি হিসেবে দেখেন? বিতর্কের মাধ্যমে কিভাবে সাহিত্যিক মূল্যবোধ প্রকাশ করা যায়?

বিতর্ক চর্চা, অনুশীলন হলো সমাজের আয়না।

সমাজে যেকোনো বিষয় নিয়ে যত বেশি বিতর্ক হয় তাতে সমাজ, রাষ্ট্রই বেশি লাভবান হয়। সমাজের সব ক্ষেত্রে এক ধরনের জবাবদিহি উত্তরোত্তর বাড়ে। প্রথাগত চিন্তা-ভাবনা থেকে তরুণ প্রজন্মের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হয়। তরুণ প্রজন্মের মাঝে মূল্যবোধ, দেশপ্রেম, সদিচ্ছা তৈরি হয়। আসলে সমাজে-রাষ্ট্রে কী হচ্ছে, কেন হচ্ছে তা জানা ও বিশ্লেষণের অন্যতম মাধ্যম হলো বিতর্ক। যেখানে নানা মতের সম্মিলন ঘটে। যেখানে শুধুই যুক্তি দিয়ে বিষয়গুলো তুলে ধরা হয়। যেখানে আবেগের চেয়ে বাস্তবতার আলোকে বিষয়গুলো প্রাধান্য পায়। বিষয়গুলোকে শুধুই তথ্য-উপাত্ত দিয়ে গভীরভাবে তুলে ধরতে হয়। এ সব মিলিয়েই বিতর্কের শৈল্পিক রূপটি ফুটে ওঠে। এখানে যুক্তি, পাল্টা যুক্তি, তথ্য, উপস্থাপন সব একসঙ্গে তুলে ধরতে হয়। সাহিত্যের মাধ্যমে মানুষের মূল্যবোধ গড়ে ওঠে এবং তা বিকশিত হয়। সাহিত্যের মাধ্যমে মানুষের ভালো চরিত্রের গুণাবলি বিকশিত হয় এবং  মানবিক মূল্যবোধের উন্নয়ন ঘটে।

 

বিতর্কচর্চার সঙ্গে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সম্পর্কটা কিভাবে দেখেন?

বিতর্কচর্চার প্রসার বৃদ্ধিতে, বিতার্কিক তৈরিতে আমরা অনেক দিন ধরে নিরলসভাবে কাজ করছি। আমরা চাই বিতর্কচর্চাটা শিক্ষার মূল শ্রোতধারায় অন্তর্ভুক্ত হোক। এখন পর্যন্ত সেটা কিন্তু হয়নি। আগেও বলেছি কো-কারিকুলার হিসেবে বিতর্কটাকে পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করা হোক। আমরা লক্ষ করছি, এ বছর পরিমার্জিত বা সংশোধিত পাঠ্যপুস্তকে ব্যাবহারিক ও উন্নয়নমূলক অনেক ধরনের শিক্ষা যুক্ত করা হয়েছে। অথচ ব্যাবহারিক শিক্ষার চেয়ে জরুরি বিষয় শিক্ষার্থীর ভেতরের বিকাশ। এখানে বিতর্ক শিক্ষা একজন শিক্ষার্থীর মেধা-মনন বিকাশে বড় ভূমিকা রাখতে পারে।

 

বিতর্ক প্রতিযোগিতায় নতুন প্রজন্ম সম্পৃক্ততাকে কতটা গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন?

বিতর্ক প্রতিযোগিতা বরাবরই তথ্য-তত্ত্ব, চিন্তার এবং দৃষ্টিভঙ্গির এক অপূর্ব উপস্থাপন, যা জ্ঞান ও চিন্তাকে বিকশিত করে। ভাবনার জগেক বড় বেশি প্রসারিত করে। বিতর্কচর্চার প্রাণ হলো নতুন প্রজন্ম। এটিই সত্য, বিতর্কচর্চার মধ্য দিয়ে নতুন প্রজন্ম যেমন প্রতিনিয়ত যুক্তিশীল হয়ে ওঠে, তেমনি তাদের মাঝে একটি চমৎকার ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে ওঠে। এটি সত্য যে এ দেশটাকে সুন্দরভাবে গড়তে হলে দায়িত্ববান যুক্তিশীল নতুন প্রজন্ম দরকার। দেশপ্রেমিক নতুন প্রজন্ম দরকার। যে নতুন প্রজন্ম বদলে দেবে আগামীদিন, আনবে নতুন সুপ্রভাত।

 

একটি দুর্দান্ত বিতর্ক আয়োজন উপহার দিতে গিয়ে সংগঠক হিসেবে আপনাকে কী ধরনের দায়িত্ব পালন করতে হয়।

সংগঠক হিসেবে আসলে অনেক দায়িত্ব রয়েছে। প্রোগ্রাম কনসেপ্ট তৈরি থেকে উপস্থাপন, অতিথি নির্বাচন—সব কিছুই করতে হয়। তবে সংগঠক হিসেবে অনেক দায়িত্ব পালন করলেও আমি বিতর্কের থিমেটিক বিষয়গুলোকে বেশি প্রায়োরিটি দিই। বিশেষ করে টপিক সিলেকশনে আমি সমসাময়িক প্রেক্ষাপটের ভিত্তিতে করে থাকি। বিতর্কচর্চাকে আমি সব সময় সমাজ-রাষ্ট্র-রাজনীতির আয়না হিসেবে দেখতে চাই। সমসাময়িক বিষয়ের ওপর প্রতিযোগিতা আয়োজন করতে গিয়ে বিগত শাসনামলে ফ্যাসিস্ট সরকারের রোষানলে পড়ারও ঘটনা ঘটেছে। তবে এখন সেই ঝুঁকি নেই। তাই প্রেক্ষাপট বিবেচনায় যেকোনো বিষয়ের ওপর ছায়া সংসদটি আয়োজন করতে পারছি।

গণতান্ত্রিক সমাজ বিনির্মাণে বিতর্ক কতটা প্রভাব রাখতে পারে বলে আপনি মনে করেন?

বিতর্কের প্রভাব বিশাল। বিতর্ক হলো যুক্তি উপস্থাপন ও শোনার একটি বিকল্প জায়গা। যেখানে মতপ্রকাশের পূর্ণ স্বাধীনতা রয়েছে। যে কেউ স্বাধীনভাবে এখানে মতামত এবং নিজের কথাগুলো বলতে পারে। এই মতামতের মধ্য দিয়েই সমাজের ভালো-মন্দ চুলচেরা বিশ্লেষণ করা যায়। দেখুন, দেশের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আমরা প্রতিনিয়ত রাজনীতিবিদ এবং নীতিনির্ধারক এবং পর্যবেক্ষকদের কথা শুনছি। গণমাধ্যমগুলোও বিভিন্ন বিষয়ে মত প্রকাশ করছে, সংবাদ বিশ্লেষণ করছে। কিন্তু ‘বিতর্কের চর্চামূলক অনুষ্ঠানে আমরা রাজনৈতিক পরিচয়ের বাইরের নতুন প্রজন্মোর প্রতিনিধিদের চিন্তা-ভাবনার কথা বিশেষভাবে শুনতে পাচ্ছি। গণতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণে এটির প্রভাব বিশাল।

 

আপনি অনেক দিন ধরে ডিবেট ফর ডেমোক্রেসি নামের একটি সংগঠনের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। এ সংগঠন নিয়ে আপনার ভবিষ্যৎ ভাবনার কথা জানতে চাই।

আমি আসলে স্বপ্নবাদী মানুষ। আমি স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসি। বিতর্ক নিয়ে আমার স্বপ্ন অনেক বড়। আমি বিশ্বাস করি বিতর্কচর্চা একটি গণতান্ত্রিক, বুদ্ধিবৃত্তিক সমাজ নির্মাণের প্রধানতম হাতিয়ার। বিতর্কের ব্যাপ্তি বাড়লে রাষ্ট্রসমাজ উপকৃত হয়। কিন্তু আমাদের দেশে এই শিল্পের এখন পর্যন্ত কোনো প্রাতিষ্ঠানিক রূপ গড়ে ওঠেনি। প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার জন্য আমরা অনেক আগেই একটি জাতীয় বিতর্কশালা বা একাডেমি নির্মাণের আহ্বান জানিয়েছে। এটি আমাদের প্রাণের দাবি। আমরা মনে করি, বিতর্কচর্চার প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে সরকার যদি এগিয়ে না আসে. তাহলে ডিবেট ফর ডেমোক্রেসি জনগণের সহায়তায় নিজেই উদ্যোগ গ্রহণ করবে। কেননা দেশে অনেক প্রতিষ্ঠান এভাবেই মানুষের সহায়তায় গড়ে উঠার নজির রয়েছে।

 

 

মন্তব্য

সর্বশেষ সংবাদ