জীবাশ্ম জ্বালানির (গ্যাস, তেল, কয়লা) পরিবর্তে নবায়নযোগ্য জ্বালানিই বাসযোগ্য শহরের নিশ্চয়তা দিতে পারে। তাই দ্রুত জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমিয়ে নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহারের দিকে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা।
বৃহস্পতিবার (২০ মার্চ) রাজধানীর বাংলামোটরে 'রোল অফ রিনিউয়েবল এনার্জি ফর এ লিভঅ্যাবল সিটি' শীর্ষক একটি পলিসি ডায়ালগ অনুষ্ঠিত হয়। অনুষ্ঠানটি যৌথ আয়োজক ছিলেন বায়ুমন্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস), বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স (বিআইপি), বাংলাদেশ রিসোর্স সেন্টার ফর ইন্ডিজেনাস নলেজ (বারসিক), সেন্টার ফর পার্টিসিপেটরি রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (সিপিআরডি) এবং জেট নেট বিডি।
পলিসি ডায়ালগে ঢাকার প্রধান সমস্যা উল্লেখ করে বাসযোগ্য নগরী গড়তে নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বাড়ানোর ওপর জোর দিয়েছেন বক্তারা।
বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব প্ল্যানার্সের প্রেসিডেন্ট পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খানের সভাপতিত্ব এবং সঞ্চালনায় পলিসি ডায়ালগে গেস্ট অব অনার হিসেবে উপস্থিত ছিলেন স্টেট ইউনিভার্সিটির স্থাপত্য বিভাগের প্রধান ও বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি অনুষদের ডিন অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী নকী। ডায়ালগটিতে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনা করেন বায়ুমন্ডলীয় দূষণ অধ্যায়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার।
আরো পড়ুন
তিন ঘণ্টায় ঢাকা মেডিক্যালে ভর্তি ‘ধর্ষণের শিকার’ ৪ শিশু-কিশোরী
অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার তার বক্তব্যে বলেন, বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে, যেখানে শিল্পায়ন ও নগরায়ণ দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি পাচ্ছে, সেখানে জীবাশ্ম জ্বালানির উপর নির্ভরশীলতা উল্লেখযোগ্য।
এই নির্ভরশীলতাই দেশের বর্তমান বায়ুমান পরিস্থিতির অবনতি ঘটাচ্ছে যা ক্রমশই আরও তীব্র আকার ধারণ করছে। আইকিউ এয়ার ২০২৪ এর রিপোর্ট অনুযায়ী, বাংলাদেশের প্রধান শহর রাজধানী ঢাকা বায়ু দূষণের তালিকায় তৃতীয় স্থানে রয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানদণ্ড অনুযায়ী, ঢাকার বায়ুমান সবসময়ই নিম্নমানের থাকে।
তিনি বলেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বায়ু দূষণ প্রতি বছর প্রায় ৭০ লাখ মানুষের অকাল মৃত্যু ঘটায় এবং সেইসাথে স্ট্রোক, হৃদরোগ, ফুসফুস ক্যান্সার এবং শ্বাসতন্ত্রের রোগসহ বিভিন্ন গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যার ঝুঁকি বৃদ্ধি করে।
জীবাশ্ম জ্বালানির উপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বৃদ্ধি করে বসবাস যোগ্য শহর নিশ্চিত করতে হবে।
অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী নকী বলেন, প্রথম কথা হল অবশ্যই সাধ্যমত জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমাতে হবে। এটি শুধু সরকার বা সরকারি সংস্থা বা কেবলমাত্র নীতিমালার বিষয় নয়। এটি সচেতন সংস্কৃতির বিষয়- তা প্রত্যেকটি নাগরিকের দায়িত্ব-যা' স্বভাবে পরিণত হবে।
পরিবেশ অধিদপ্তরের বায়ুমান ব্যবস্থাপনা বিভাগের পরিচালক মো. জিয়াউল হক বলেন, জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে সৃষ্ট বায়ু দূষণ বাংলাদেশের জন্য একটি গুরুতর সমস্যা, যা জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
তবে, সঠিক নীতি গ্রহণ ও কার্যকর পদক্ষেপের মাধ্যমে এই সমস্যার সমাধান সম্ভব। পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে ইতিমধ্যে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো মনিটরিংয়ের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। পরিবেশ অধিদপ্তর ২০৩০ সালের মধ্যে নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে ৪০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। দূষণ নিয়ন্ত্রণে সকল মন্ত্রণালয়কে একযোগে কাজ করতে হবে। পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে চাপ প্রয়োগ করেও সবাইকে একত্রিত করে কাজ করানো সম্ভব হচ্ছে না। বায়ু দূষণ নিয়ন্ত্রণে আমাদের তাৎক্ষণিক কিছু সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আমাদের যে সকল নীতিমালা রয়েছে সেগুলোকে বাস্তবায়ন করতে হবে। পাশাপাশি আইনের কঠোর প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।
আরো পড়ুন
মাঝরাতে রুমে গিয়ে প্রস্তাব, অক্ষয়কে ফিরিয়ে দেন আয়েশা
পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, বাংলাদেশে নবায়নযোগ্য শক্তির প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে। নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বৃদ্ধি, পরিবহন ও শিল্পখাতে পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তির প্রয়োগ এবং জনগণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করে আমরা একটি সুস্থ ও সবুজ বাংলাদেশ গড়ে তুলতে পারি। এটি শুধুমাত্র বর্তমান প্রজন্মের জন্য নয়, বরং ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্যও একটি নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করবে।
ওয়ার্ক ফর এ বেটার বাংলাদেশ ট্রাস্টের (ডব্লিউবিবিটি) পরিচালক গাউস পিয়ারী বলেন, বর্তমানে নবায়নযোগ্য জ্বালানির বিকল্প নাই। বাংলাদেশ বায়ু দূষণ, শব্দদূষণ, নদী দূষণ কমাতে জীবাশ্ম জালানির ব্যবহার কমিয়ে আনা এখন সময়ের দাবি।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী রাশেদুজ্জামান মজুমদার বলেন, জ্বালানি নিয়ে এই পর্যন্ত অনেকগুলো পরিকল্পনা করা হয়েছে। কিন্তু কোনটাই নবায়নযোগ্য জ্বালানির উৎপাদন টার্গেট পূরণ করতে পারেনি। আমাদের সবগুলো জ্বালানি নীতির মধ্যে সমন্বয় করতে হবে বিশেষ করে নবায়নযোগ্য জ্বালানি নীতি ২০২৫ এর আলোকে জ্বালানি মহাপরিকল্পনা ২০২৩ কে সংশোধন করতে হবে।
অ্যাকশন এইড বাংলাদেশের মো. আবুল কালাম আজাদ বলেন, আমাদের বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা বেড়েছে কিন্তু বিদ্যুতের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায়নি। ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে তেল গ্যাস এলএনজি আমদানি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ভয়াবহ লোডশেডিং এ পতিত হয়েছিল দেশ। নবায়নযোগ্য জ্বালানিই তাই জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে।
পলিসি ডায়ালগে আলোচক হিসেবে আরো বক্তব্য রাখেন ব্যারিস্টার নেওয়াজ মোরশেদ, সেন্টার ফর ল এন্ড পলিসি অ্যাফেয়ার্সের সেক্রেটারি সৈয়দ মাহবুবুল আলম তাহিন, বারসিক'র সমন্বয়কারী মো. জাহাঙ্গীর আলম, ৭১ টিভির সিনিয়র রিপোর্টার মো হাবিবুর রহমান, বারসিক'র সমন্বয়কারী কামরুজ্জামান সাগর, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনেরর (বাপা) যুগ্ম সম্পাদক ফরিদুল ইসলাম ফরিদ, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সহ-সভাপতি মুহাম্মদ আনোয়ারুল হক, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের ক্যাপাসিটি ডেভেলপমেন্টের কো-অর্ডিনেটর ওয়াসিউর রহমান তন্ময়, মিশন গ্রিন বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক আহসান রনি এবং সেন্টার ফর পার্টিসিপেটরি রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (সিপিআরডি) রিসার্চ অফিসার ইলমি তাবাচ্ছুম।